প্রত্নতত্ত্ব ও লিপিতত্ত্বের জীবন্ত কিংবদন্তী ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ এপ্রিল, ১৮৮৫- ৩০ মে, ১৯৩০) প্রকৃতই ছিলেন ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো। রাখালদাস তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবিচারে ৫০০০ বছরের পুরনো সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের সুখ্যাতি সুনামের আলো থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক এবং ১৯১০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন রাখালদাস। ১৯১০ সালে তিনি কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা এবং ১৯১১ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগে সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২৬ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এর পর ১৯২৮ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির ‘মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী অধ্যাপক’ পদে যোগ দেন। রাখালদাস ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পুরনো লিপি পাঠ ও তার ব্যাখ্যা, প্রাচীন এবং মধ্যযুগের মুদ্রার গুরুত্ব নির্ণয়, স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পকলা নিদর্শনের মূল্য বিচার ইত্যাদি মিলিয়ে প্রাচীন ভারতের প্রামান্য ইতিহাস রচনা করা ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসাবে খননকার্য চালানোর পাশাপাশি তিনি ইতিহাস বিষয়ের উপর লিখেছেন অজস্র বই। প্রথম বাংলা ভাষার আদি রূপ ‘প্রোটো বাংলা লিপি’ নিয়ে গবেষণা করেন। সমগ্র জীবনে তিনি ১৪টি মনোগ্রাফ, ৯টি উপন্যাস এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিনশোর বেশি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় ‘বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটি’, ‘বিহার রিসার্চ সোসাইটি’, লন্ডনের ‘রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি’, ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘Modern Review’, ‘Epigraphia Indica’, ‘Indian Antiquary’, ‘Annals of Bhandarkar Oriental Research Institute’ ইত্যাদি নানান পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি— দুই খণ্ডে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৯১৪ এবং ১৯১৭), দুই খণ্ডে ‘উড়িষ্যার ইতিহাস’ (১৯৩০ এবং ১৯৩১), ‘ভূমারার শৈবমন্দির’ (১৯২৪), ‘ত্রিপুরী হৈহায়াস জাতির ইতিহাস’ (১৯৩১) ইত্যাদি। রাখালদাস ৯টি উপন্যাস লিখেছিলেন। তার মধ্যে অধিকাংশই ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই বিশেষ গোত্রের সাহিত্যে রাখালদাসের কলম ছিল বেশ বলিষ্ঠ। কুষাণ বংশের ইতিহাস বিষয়ে লেখা ‘পাষাণের কথা’ (১৯১৪), গুপ্ত বংশের বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস ‘শশাঙ্ক’ (১৯১৪), পাল বংশের ইতিহাস সম্পর্কিত ‘ধর্মপাল’ (১৯১৫), সম্রাট শাহ্জাহানের সময়কাল নিয়ে লিখিত ‘ময়ূখ’ (১৯১৬), গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরাক্রমশালী সম্রাট স্কন্দগুপ্তকে নিয়ে ‘করুণা’ (১৯১৭) ও বাংলার নবাবী আমলের প্রেক্ষাপটে লিখিত ‘অসীম’ (১৯২৪) এছাড়াও ‘ধ্রুব’ (১৯১৭) রাখালদাসের এই উপন্যাসগুলি ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।
© 2022 All Rights Reserved by ketab-e | This website is owned by Bestread Publications and Digital Services Private Limited. Design By Mindmine and Developed By Technophilix.