রমাপ্রসাদ চন্দ
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রমাপ্রসাদ চন্দ (১৫-৮-১৮৭৩ – ২৮-৫-১৯৪২) একটি স্মরণীয় নাম। সাধারণ স্কুলশিক্ষক থেকে অসাধারণ প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের বলে তিনি প্রথম শ্রেণীর ঐতিহাসিক গবেষকের সম্মান লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। রমাপ্রসাদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এস্ট্রান্স, ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ. ও কলিকাতা ডাফ কলেজ থেকে বি-এ পাশ করার পর গৃহ-শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হন। এরই পাশাপাশি নৃতত্ত্ব ও ইতিহাস অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। ছাত্রজীবনে সাধক ভোলা গিরির শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেছিলেন। পরে তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন হয়। তিনি ধর্মের জগৎ ছেড়ে যুক্তিবাদ ও কর্মকে জীবনের মন্ত্ররূপে গ্ৰহণ করেন। গৃহ-শিক্ষকতার কাজে কিছুদিন উত্তরপ্রদেশে কাটিয়েছেন। পরে কলিকাতা হিন্দু স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯০৫ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে স্থানান্তরিত হন। এখানকার কর্মজীবনে তিনি ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, পুরাতত্ত্ববিদ ও বঙ্গসাহিত্যসেবী হিসাবে বিদ্বৎসমাজে খ্যাতি ও প্ৰতিপত্তি অর্জন করেন। অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয়, শরৎচন্দ্র রায় ও তাঁর চেষ্টায় রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’র (১৯১০) তিনি প্ৰথম সাধারণ সম্পাদক। এই সমিতিই ভারতবর্ষে বেসরকারী উদ্যোগে গঠিত ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা এবং গবেষণার প্রথম প্ৰতিষ্ঠান। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত তাঁর ‘বাঙ্গালীতত্ত্ব’, ‘জাতিতত্ত্ব’ ও অন্যান্য প্ৰবন্ধাবলী বিশেষ প্রশংসিত হয়। ‘অনুসন্ধান সমিতি’র সম্পাদক ও কিউরেটররূপে তিনি তার অশেষ কল্যাণ সাধন করেন। এই সমিতি থেকে ১৯১২ সালে তাঁর লেখা ‘গৌড়রাজমালা’ (গৌড় বিবরণের ১ম খণ্ড) প্রকাশিত হয়। তাঁর যুগান্তকারী গ্ৰন্থ ‘Indo-Aryan Races’ (১৯১৬) এই সমিতি প্রকাশ করে। ১৯১৭ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি বিভাগে চাকরি নেন। এখানে দুবছর গবেষক শিক্ষানবীশ হিসাবে কাজ করার সময় তিনি তক্ষশীলা, সাঁচী, সারনাথ, মথুরা প্রভৃতি ইতিহাসসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষগুলিতে অনুসন্ধান ও খননের কাজ চালিয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেন তার বিবরণ পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করে প্রাচীন ও অজ্ঞাত ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করে গেছেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিভাগ খোলা হলে (১৯১৯) তিনি তার লেকচারার নিযুক্ত হন। তাঁর আগ্রহাতিশয্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রবর্তন হয় এবং তিনি তার প্রথম প্রধান অধ্যাপক হন। ১৯২১ সালে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুপারন্টিন্ডেন্টের পদে যোগদান করেন এবং ১৯৩২ সালে সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯৩৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ফাস্ট ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ সায়েন্সেস, অ্যানথ্রোপলজি অ্যান্ড এথনোলজি অধিবেশনে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ‘রেসেস অ্যান্ড কাল্ট ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক নিবন্ধ পাঠ করেন। এই সময় ব্রিটিশ মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ ভারতীয় প্রত্নসামগ্ৰীসমূহ যথাযথ সংস্থাপনের জন্য তাঁর সাহায্য নিয়েছিলেন।