সপ্তর্ষি আর শিঞ্জিনির তিরিশ বছরের দাম্পত্য জীবন আপাতদৃষ্টিতে মসৃণ, কিন্তু ঠিক যেন আর পাঁচটা তিরিশ বছর বয়সী সম্পর্কের মতো নয়। বরং প্রথম থেকেই সেই দাম্পত্যে শিঞ্জিনীর নরম স্নেহ মায়ের তেল-হলুদমাখা আটপৌরে আঁচলের মতো সপ্তর্ষির জীবনযাপনকে মুড়ে রাখে। মনস্তত্ত্ববিদ শিঞ্জিনী সারাদিন ব্যস্ত থাকেন তাঁর মহানাগরিক কলেজ আর চেম্বার নিয়ে, স্বামী সপ্তর্ষি তাঁর অবসর একক সকাল দুপুরগুলো ফেসবুক-তরজায় মেতে থাকেন। গিন্নীটি বাড়ি ফিরলেও কর্তা ফোন থেকে বিশেষ চোখ সরান না, উল্টে বৌকেও অলীক দুনিয়ার সমাচার দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁদের দাম্পত্যে ফেসবুকের অবিরাম টুংটাং নোটিফিকেশনের একটা ভূমিকা আছে।
এই দম্পতির দুটি ছেলে। দুটিই ওয়েল সেটলড, বিবাহিত। অবসরপ্রাপ্ত সপ্তর্ষি যখন ফেসবুকের গরমাগরম তর্কবিতর্কে মগ্ন থাকেন, বাবা হিসেবে প্রায় নির্লিপ্তই, তখন প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলে আর ছেলের বউদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন শিঞ্জিনী। শিঞ্জিনী এই পরিবারের ছাতা।
কিন্তু সেই ছাতাই দুমড়ে গেল একদিন। সপ্তর্ষির মতো বিশাল কিছু ফেসবুকসর্বস্ব জীবন নয় তাঁর, ফেসবুকে তাঁর চলাচল খুবই সঙ্গোপন। সপ্তর্ষির স্ত্রী হিসেবে এই পরিসরে তাঁর আইডেন্টিটি নেই। কিন্তু শিঞ্জিনী সপ্তর্ষির ফেসবুক-ফ্রেন্ড, সেই সুবাদে তাঁদের মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড প্রচুর। হয়তো সাইকোলজিস্ট বলেই সেইসব ভার্চুয়াল বন্ধুদের প্রোফাইল ঘেঁটে-ছেনে মানুষ চেনার চেষ্টা করতে শিঞ্জিনীর দিব্যি লাগে। রাজকন্যে, সপ্তর্ষির ফেসবুকীয় জগতের নতুন বন্ধুর প্রোফাইলও সেই দিব্যি লাগার আলতো মজা থেকে দেখেছিলেন শিঞ্জিনী। প্রথমে অবশ্য সপ্তর্ষিই মেয়েটিকে চিনিয়েছিলেন। ফেসবুকমুখো বর তাঁর পরম মুগ্ধতা ভাগ করে নিতে চেয়েছিলেন বৌয়ের সঙ্গে। মহা চৌখস সে মেয়ে। যেকোনো ঝামেলায় দিব্যি কোমর বেঁধে মুখে ঝামা ঘষতে তৈরি হয়ে যায়, কোনো অশ্রাব্য গালি গালাজ এর তোয়াক্কাই করে না, ভয়ঙ্কর ওপিনিয়ানেটেড! পেশায় আবার সাংবাদিক। তীক্ষ্ণ, ক্ষুরধার মুখশ্রীর এই মেয়েকে তাঁর চেনা লাগে, খুব চেনা। আরো একটু চিনতে গিয়েই শিঞ্জিনীর মনোজগত বেদম টাল খায়। শিঞ্জিনী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুস্থতার অনুঘটক হয় দিঠির দাম্পত্য। দিঠি, ছোটছেলে বিম্বর স্ত্রী ফোনে জানায় তার আসন্ন মাতৃত্বের খবর। সুসংবাদটি আদৌ সুসংবাদ হয়ে আসে না। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় শিঞ্জিনীর চূড়ান্ত নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়। দিঠি বিম্বর দাম্পত্য বিড়ম্বনা আসলেই পাকচক্র। এ এক ভিশিয়াস সার্কল। অতীতের প্রেতছায়া বর্তমানের ঝকঝকে জীবনের আয়নাকে ধূসর মলিন করে দিচ্ছে, আর উপন্যাসের কিছু চরিত্র তাদের আন্তরিক রুমাল দিয়ে সেই আয়নাটি মুছেই যাচ্ছে। এই মোছাও যেন অনিঃশেষ প্রকল্প। অলাতচক্র। এই উপন্যাস সেই পাকে পাকে জড়িয়ে থাকা ব্যথা উত্তরণের আখ্যান।
দারুণ
© 2022 All Rights Reserved by ketab-e | This website is owned by Bestread Publications and Digital Services Private Limited. Design By Mindmine and Developed By Technophilix.
বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া