preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
স্লো ম্যান ও তার পারিপার্শ্বিক, নধরের ভেলা
রিভিউ

স্লো ম্যান ও তার পারিপার্শ্বিক, নধরের ভেলা

৩১তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে গতকাল প্রদর্শিত হল প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের নতুন ছবি ’নধরের ভেলা’। দেখে এসে ছবিটি নিয়ে লিখলেন নবীন চিত্র পরিচালক অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়।

টর্‌ টর্‌ টর্‌ টর্‌। বাঁশঝাড়ে হাওয়াদের দল সংকীর্তন করে। নধর তার মৃত মায়ের ফেলে যাওয়া শাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতের লন্ঠনের আলোয়, সাদা শাড়িতে ছায়া পড়ে তার। ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কী ভাবে সে? তার ভাবনারাও কি তার মতোই অতীব মাত্রায় ধীর? না কি সে ভাবনার গতি, আলোর চেয়েও দ্রুত?

প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক ছবি ‘নধরের ভেলা’তে, এই বাঁশঝাড়ের শব্দ প্রথমে আসে Diegetic Sound হিসেবে; এবং পরে, যখন নধরের ঠিকানা পালটে, কখনও হয়ে ওঠে সার্কাসের তাঁবু, কখনও রাতের মাঠ, কখনও-বা একটা খাঁচা—এই একই ধ্বনির মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োগ, তার মাকে মনে পড়ায়, আর নধরের অভিব্যক্তিহীন মুখে প্রখর করে তোলে বেঁচে থাকার গ্লানি।

‘নধরের ভেলা’ ছবিটিতে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য প্রথমেই যা সাফল্যের সঙ্গে করেন, তা হল গ্রাম ও মফস্‌সল জীবনযাত্রা নিয়ে, শহুরে মানুষের যে রোম্যান্টিসিজ্‌ম, গ্লোরিফিকেশন, অথবা নাকউঁচু সহানুভূতিশীল দৃষ্টি—তা আছড়ে সিনেমা হলের বাইরে ফেলে দেওয়া। বদলে তৈরি করেন এমন এক অতিবাস্তব জগৎ, যেখানে মায়া, স্বপ্ন, প্রেমের পাশাপাশি অনেকটা জুড়ে আছে হিংসা, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, দম্ভ, এবং লোক ঠকানোর আজব কারখানা।

এ জগতে কেউ পবিত্র নয়। কারণ পবিত্র হওয়ার দায় নেই কারও, অবস্থাও নেই। আর অধিকারও কেই-বা কবে দিয়েছে! তাই ছবিটি যে শট্‌ দিয়ে শেষ হয়, তার চেয়ে ভালো সমাপ্তি হয়তো এই ছবিটির আর হতে পারত না। আরও ভালোভাবে বললে, শটটি ঠিক যেখানে কাট হয়ে সমাপ্তি তালিকা শুরু হয়—তা অত্যন্ত আধুনিক এবং সাহসী। কী শট, কোথায় শেষ—বলা যাবে না। তাহলে মজা নষ্ট। নিজে দেখে নিতে হবে। নন্দন প্রেক্ষাগৃহে অনেক দিন পর, বেশ কয়েকটি স্বতঃস্ফূর্ত ‘বাহ্‌’ শুনতে পেলাম। যেন অনেকক্ষণ আলাপ ও বিস্তারের পর, একদম সঠিক তালে সমে ফিরলেন প্রদীপ্ত।

তবে, এ ছবি সবার সম্পূর্ণ মাত্রায় ভালো না-ও লাগতে পারে। তার গৌণ কারণ, দৈর্ঘ্য। মুখ্য কারণ, বিষয়বস্তুর রূঢ়তা। ছবিটির প্রায় আশি শতাংশ জুড়ে, নিষ্ঠুরতার যে বহিঃপ্রকাশ ঋত্বিক চক্রবর্তী অভিনীত হারাধন ম্যানেজার চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে ঘটে, তা অনেককেই নাড়িয়ে দেবে। এর সাথে গ্রামের মানুষদেরও একদমই নেকুপুসুমুনু করে রাখেননি প্রদীপ্ত। বরং দেখিয়েছেন, সেখানেও লালসা ও আর্থিক দৈন্য, কীভাবে মানুষকে বদান্যতা ও স্বার্থপরতার দোলাচলে অবিরাম দুলিয়ে চলে।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

তাই কোনো কোনো মুহূর্তে ‘নধরের ভেলা’ দমবন্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে—প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যর চিত্রনাট্যের স্বকীয় হিউমার, যা হারাধন ম্যানেজারের সংলাপ বা কার্যকলাপেই বেশি প্রকাশ পায়, তা ক্ষেত্রবিশেষে রিলিফ দিলেও। এও এক আশ্চর্য বৈপরীত্য। সবচেয়ে কর্কশ যে চরিত্র, সে-ই মধ্যে মধ্যে কৌতুকের অবসর তৈরি করে। ঋত্বিক চক্রবর্তীর এযাবৎ করা সমস্ত চরিত্রগুলির মধ্যে, এটি ভীষণভাবেই অন্যরকম। দর্শকের মনে তার জন্য ঘৃণা তৈরি করতে, হারাধন ম্যানেজার এক মুহূর্তের জন্যেও বিরাম নেয় না।

এবং শুধু ঋত্বিক চক্রবর্তী নন। নধরের চরিত্রে অমিত সাহা’র অভিনয় আন্তর্জাতিক স্তরের। ছবিটি একবার দেখে ফেললে, ওই চরিত্রে আর কাউকে ভাবা যায় না। নধরের জেদ, ক্লেদ, অসহায়তা, দীনতা—অমিত সাহা অনভিব্যক্তির যে অপরূপ রসে জারিয়ে নিয়ে প্রকাশ করেন, তা অনবদ্য।

অন্য চরিত্রগুলির মধ্যে প্রিয়াঙ্কা সরকারের শ্যামা, শতাক্ষী নন্দীর রূপা, সায়ন ঘোষের রহমান, নিলয় সমীরন নন্দীর ভালু এবং বাকি পার্শ্বচরিত্ররা যথাযথ। শুধু, শ্যামা যখন নধরকে শারীরিকভাবে উত্তেজিত করে তুলতে চায়, এবং নধর তা প্রত্যাখান করে, ওই দৃশ্যটিতে প্রিয়াঙ্কা সরকারকে যেন আড়ষ্ট লাগে কিছুটা।

তুলনামূলকভাবে কম সময়ের জন্য হলেও, অপরাজিতা ঘোষের চরিত্রটি (হারাধনের স্ত্রী), হারাধন ও তার সার্কাস-সাম্রাজ্যের একটি সামগ্রিক ইমেজ গড়ে তুলতে অনেকটা সাহায্য করেছে। হারাধনের স্ত্রী ও শ্যামার মধ্যে যে সূক্ষ্ম ঈর্ষার লড়াই, তা ছবিটিতে অসামান্য স্তর সংযোজন করে।

আর সাহায্য করেছে সাত্যকি ব্যানার্জির সংগীত। অনেক দৃশ্যেই সাত্যকি ব্যানার্জির সংগীতকে, নধরের অভিব্যক্তিহীন জীবনযাত্রার পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক।

কিন্তু ছবিটির দৈর্ঘ্য? সেটা কি আরেকটু কম হতে পারত? হয়তো পারত। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, তাঁর অন্য ছবিগুলির মতো, ‘নধরের ভেলা’তেও নিজেই সম্পাদনা করেছেন। তাই কখনও কখনও মনে হচ্ছিল, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যে ছবিটি, বা ছবিটির যে সংস্করণ আমরা দেখলাম, তা যেন ডিরেক্টর’স কাট। পরিচালক যেন একটা ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর প্রতি মন দিয়েছেন, যেরকম আমরা ভালো ওয়েব সিরিজে সচরাচর দেখে থাকি।

তাই সেখানে নধর, হারাধন, ও শ্যামা এই তিন মূল চরিত্র ছাড়াও রহমান, রূপা, ও হারাধনের স্ত্রী’ও মূল চরিত্রের সমান মনোযোগ ও সময় দাবি করে। গ্রাম ও সার্কাস—এই দুই ভিন্ন ইমেজকে যত্নের সাথে তৈরি করা, প্রতিষ্ঠা করা, ও পাশাপাশি সহাবস্থানের কোলাজ মেকিং—এখানেও সময়ের দাবিকে এড়ানো যায় না।

বরং নধরের অতীব ধীর গতি-কে প্রতিষ্ঠা করার দৃশ্যগুলির পাশাপাশি যখন অন্য চরিত্রদের স্বাভাবিক গতির দৃশ্যগুলি আসে, প্রথমে সে-সংঘাত ধাক্কা মারলেও, পরে তা ধীরে ধীরে সয়ে যায়। অর্থাৎ আমরাও নধর-কে বাকি দুনিয়ার থেকে আলাদা করতে শিখে যাই। অর্থাৎ আমরাও হারাধন ম্যানেজারের সার্কাসের একেকটি চরিত্র হয়ে উঠি।

পুনশ্চ—কোনো বিশেষ দৃশ্য নিয়েই আলাদা করে আলোচনা করা হল না, যাতে নতুন দর্শকের কাছে ছবিটি বাসি না হয়ে যায়। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি আবার ৯ ও ১১ তারিখ দেখানো হবে। আশা করা যায়, তারপর খুব শীঘ্রই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে ‘নধরের ভেলা’।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

লেখক

পেশায় তিনি একজন চিত্রপরিচালক, লেখক ও অধ্যাপক। শৈশব কেটেছে উত্তরবঙ্গের কুচবিহার শহরে। বর্তমানে কর্মসূত্রে তিনি কলকাতা, মুম্বাই ও পুনে, এই তিন শহরের সাথে যুক্ত। অভ্রদীপ পুনে ফিল্‌ম ইনস্টিটিউটের চিত্রনাট্য ও পরিচালনা বিভাগের প্রাক্তনী। ২০২২ সালে তাঁর প্রথম বই ‘জাফর পানাহি: নিষিদ্ধ সিনেমা ও মানবতার ইস্তেহার’ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাতে প্রকাশিত।

অন্যান্য লেখা