preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
একটি ডায়েরি, প্রদোষ আর সে
গল্প

একটি ডায়েরি, প্রদোষ আর সে

প্রিয় ডায়েরি, …আমার জীবনের যেকটা ছবিই তোর গায়ে আঁকি না কেন, তাকে কোনো তারিখ দিয়ে দাগিয়ে দেব না। কারণ, আমাদের কাহিনি আজ-কাল-পরশু সেই একইরকম থাকে। সেদিন লিখব তারিখ, যেদিন গল্পগুলো একটু অন্যরকম হবে...

প্রিয় ডায়েরি,

জানিস তো ডায়েরি লেখার অভ্যেস আমার কস্মিনকালেও ছিল না। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন প্রাচীন জিনিসের দোকানে ঘুরতে ঘুরতে তোর দিকে আমার চোখ আটকে গেল। মলিন চামড়ার কাভার দেওয়া হলদে হয়ে যাওয়া একটা সাধারণ ডায়েরি। পাতাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। তাক থেকে নামিয়ে দেখলাম, কিছুই লেখা নেই। হাতে নিয়ে মনে হল, সেখানে অনেকে অনেক কিছু লিখতে চেয়েছে, হয়ত লিখেওছে। কিন্তু কোন জাদুবলে সেই সমস্ত লেখা তুই যেন শুষে নিয়েছিস ব্লটিং পেপারের মত। রিক্ত করে দিয়েছিস নিজেকে, আমার কাছে আত্মসমর্পণের জন্য। শুঁকে দেখলাম, তোর গায়ে সদ্য বৃষ্টির পর ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে। কেমন যেন অনুভব করলাম, কোনো একদিন বৃষ্টিস্নাত বিকেলে, যেদিন সাথে কোনো ছাতা থাকবে না, সেদিন তোকে মাথায় দিয়ে রাস্তা পেরোব আমি। তোর গায়ে লেগে যে জল ছোঁবে আমায়, সেখানে না থাকবে কোনো আত্মগ্লানির চিহ্ন, না কোনো বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-পরিজনের বিদ্রূপ।

আসলে কী জানিস, জন্মেছি পুরুষ দেহ নিয়ে, ভেতরে আটকা পড়ে আছে অবলা এক নারী। খুব চেষ্টা করি, তাকে দমিয়ে রাখতে। মনে পড়ে, আগে মোবাইলে একটা খেলা খেলতাম। অনেকগুলো গর্ত থাকত আর সেগুলো দিয়ে একটা মুখ ওপরে ওঠার চেষ্টা করত। একটা হাতুড়ির মত জিনিস রাখা ছিল। খেলাটা হল, মুখটা ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেই হাতুড়ি দিয়ে মেরে তাকে আবার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। নিজের ভেতরের নারীটাও যখনই মাথা তুলতে চেষ্টা করে, হাতুড়ি দিয়ে চুপ করিয়ে দিই।

তবুও মাঝে মাঝে পারি না তাকে আটকে রাখতে। একটু অন্যমনস্ক হলেই সে বাইরে বেরিয়ে আসে। আর আশেপাশের লোকজন লাল কাপড় দেখা ষাঁড়ের মত ছুটে আসে গুঁতোবে বলে। একবার শিঙে তুলে ফেলতে পারলে ছুঁড়ে ফেলবে মাটিতে। সে আঘাত সইতে পারার মত শক্তি আমার আছে কিনা জানা নেই। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করি অথবা সেখান থেকে পালিয়ে যাই। মুখ বুজে সহ্য করি সমস্ত অপমান।

সতীর্থদের কেউ কেউ যারা দুঃসাহসী, তারা বাথরুমে একা পেয়ে চেষ্টা করেছে জোর খাটানোর। কখনো হয়ত কোনোমতে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছি। কখনো বা সহানুভূতিশীল কেউ আবির্ভূত হয়েছে রক্ষাকর্তার ভূমিকায়। কাউকে কোনোদিন বলতে পারিনি কথাগুলো। এমনিতেই তো ‘হিজড়া’, ‘ছক্কা’, ‘মিঠা’ এইসব কথাগুলো শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। তার উপর বাড়িতেও যেখানে মা-বাবা-দাদা কেউই আমাকে বোঝে না, সেখানে এইসব ঘটনাগুলো বাজারি করে নিজেকে খাদের আরও কিনারায় ঠেলে দিতে ইচ্ছে করেনি। নিজেকে সবকিছু মেনে নেওয়ার মত করে তৈরি করেছি। আমার চারপাশে গন্ডারের চামড়া দিয়ে বানানো বর্ম। উপহাস, অবজ্ঞা, অপমান কিছুই সেই বর্ম ভেদ করে ঢুকতে পারে না। 

কত করে খুঁজি একটা আস্তানা, একটা মানুষ, একটা জায়গা যেখানে নিজেকে লুকোতে হবে না। যার কাছে আমি উলঙ্গ হলেও সে শুধু আমার গোপনাঙ্গ দেখে আমায় বিচার করবে না। আমার ভেতরে উঁকি দেবে। পড়ে ফেলবে সিন্দুকে রাখা আমার গোপন বই। খোলা বই তো নই আমি, কিছুটা কষ্ট করার মনোভাব নিয়েই আসতে হবে তাকে। কিন্তু কই? তেমন কাউকে তো দেখিনা কোথাও! 

আমাদের মত মানুষের জীবন এখনও এই সংকীর্ণ সমাজে কুণ্ঠাহীনভাবে গৃহীত নয়। তাই আমার জীবনের যেকটা ছবিই তোর গায়ে আঁকি না কেন, তাকে কোনো তারিখ দিয়ে দাগিয়ে দেব না। কারণ, আমাদের কাহিনি আজ-কাল-পরশু সেই একইরকম থাকে। সেদিন লিখব তারিখ, যেদিন গল্পগুলো একটু অন্যরকম হবে।

***

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

গতকাল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। বয়সন্ধির পর থেকেই আমি নিজেকে মেলাতে পারিনি আর পাঁচজনের সঙ্গে। একটা ছেলে হয়ে মেয়েদের প্রতি কোনোরকম আকর্ষণ বোধ করিনি। কোনোদিন বিশ্বাস করিনি ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ বলে কিছু হতে পারে। কিন্তু কাল আমার সমস্ত চিন্তা ভাবনা ধ্যান ধারণা গুলিয়ে গেল।

ম্যান্ডোলার জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে আমি আগেও থেকেছি । একেকদিন জঙ্গলের এক এক জায়গায়। তার নতুন নতুন রূপ দেখার লোভে। বাড়ি থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার। ইচ্ছে হলেই নিজের বাইকে চেপে বেরিয়ে পড়ি। একা জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় রাত কাটাতে আমার দারুণ লাগে। হিংস্র জানোয়ার আছে বলে শুনিনি কখনো। তাই বাড়ির লোক বারণ করলেও আটকাতে পারে না। প্রাপ্তবয়স্ক একজন কলেজ পড়ুয়াকে বেঁধে রাখবে কীভাবে? ঠিক কোনো না কোনোভাবে ফাঁক গলে বেরিয়ে যাই। তাতে তারা রেগে যায় বটে। ভর্ৎসনার সাথে সাথে কখনো ভাগ্যে প্রহারও থাকে। কিন্তু আমি সবকিছু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাই। 

গতকাল ছিল তেমনই একটা দিন। তাঁবু, ওডোমস আর সাথে রাত কাটানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম জঙ্গলের উদ্দেশে। দোকান থেকে আনা স্যান্ডউইচটা খেয়ে তাঁবুর ভেতর শুয়ে শুয়ে জঙ্গলটাকে চাঁদের আলোয় ভাসতে দেখছিলাম। অপার্থিব সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ঠিক তখনই আকাশ থেকে নেমে এল সে। মনে হল যেন চাঁদ থেকে নেমে এল।

কোমর পর্যন্ত সুগঠিত একজন পুরুষ। ঢেউ খেলানো চুল, বড় বড় চোখ, ভরাট ঠোঁট, গোঁফহীন মুখে গালভর্তি সুসজ্জিত দাড়ি, পেটের কাছে অ্যাবগুলো যেন অদ্ভুত ভাস্কর্য। কোমরের নীচ থেকে আবার এক অন্য অবয়ব। একঝলকে দেখলে মনে হবে ঘোড়া— চারটে পা, ল্যাজ, দেহাকৃতি সেরকমটাই মনে করায়। কিন্তু সাথে পিঠে রয়েছে দুটি ডানা, বেশ বড়ো আর শক্তপোক্ত। কিছুটা মানুষ, কিছুটা ঘোড়া, কিছুটা পাখি। এ যেন গ্রিক মাইথোলজির সেনটোরের পিঠে কেউ পাখির ডানা লাগিয়ে দিয়েছে। ঘাড় তুলে দেখতে হয় তাকে। আমার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ লম্বা।

যে প্রাণীকে দেখে আর পাঁচজন ভয় পাবে, তাকে দেখে আমার অক্সিটোসিন ক্ষরণ হতে লাগল। তাঁবুর দুপাশে বসে কারা যেন ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’ এর সুর তুলেছে মাউথ অরগ্যানে। আমার চোখের তারায় জ্বলজ্বল করছে হাজার হাজার নক্ষত্র। সেই সমস্ত নক্ষত্রে ওই ডানাওয়ালা নরাশ্বের ছবি আঁকা। তার খয়েরি চোখদুটো কাকে যেন নিরন্তর খুঁজে চলেছে। নির্লজ্জের মত বেপরোয়া কল্পনায় মনে হল সে যেন আমাকেই খুঁজছে। হিপনোটাইজড অবস্থায় আমি এগিয়ে গেলাম। মুখোমুখি দাঁড়ালাম তার। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি আমাকেই খুঁজছ?”

আমার দিকে সে হাঁ করে তাকাল। লজ্জা পেলাম আমি ওর চোখের ভাষা দেখে। আর তার ঠিক পাচঁ-ছয় সেকেন্ড পরেই চোখের সামনে থেকে কর্পূরের মত উবে গেল। এই ছিল, এই নেই। আমি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম এদিক ওদিক। আশেপাশের প্রতিটা গাছের পেছনে, ঝোপের আড়ালে। কিন্তু না, সে নেই। যাওয়ার আগে ওর মুখের দিকে চেয়ে মনে হয়েছিল, যেন সামান্য হাসি দেখতে পেয়েছিলাম। যে হাসিতে আমার বুকের ভেতরের নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে সুনামি এসেছিল। সত্যিই হেসেছিল তো? নাকি সেটাও আমার কল্পনা? মানুষ তো নিজের ভালো লাগার জন্য কত কিছু কল্পনা করে নেয়! আমিও কি তাহলে সেরকমই কিছু…

***

ডায়েরি, তুই আবার আমার ওপরে অভিমান করে নেই তো? তোর সাথে ক’দিন একেবারেই গল্প করতে পারিনি। কী করব বল! আসলে আমার মন মেজাজ কিছুই ভালো নেই। সেদিন যে সেই তোকে বললাম একেবারে অন্যরকম একজনের কথা। জঙ্গল থেকে আসার আগে, তাঁবুর চারপাশে দাগ করে এসেছিলাম। যাতে করে আবার যখন যাব, তখন যেন ঠিক ওইখানটাতেই তাঁবু খাটাতে পারি। আমার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন আমায় বলেছিল, না জানি কোন সংযোগ আছে ওই জায়গায়, না জানি কোন অদৃশ্য সুইচ আমি ছুঁয়ে দিয়েছিলাম, যার জন্য সে দেখা দিয়েছিল।

কিন্তু তারপর থেকে সাতদিন কেটে গিয়েছে। আমি এর মধ্যে তিনদিন ওই জঙ্গলে রাত কাটিয়েছি। বাড়ির লোকের সাথে তীব্র আশান্তি। তবু তার দেখা মেলেনি। কেন আসেনি? কেন? কেন? আকাশের দিকে ঢিল ছুঁড়তে ইচ্ছে করছে আমার। ঈশ্বরকে বলতে ইচ্ছে করছে, আজ পর্যন্ত একটা মানুষকেও তো পেলাম না, যাকে ভালোবাসতে মন চায়। তারপর যদিও বা তাকে আনলে তুমি আমার সামনে, আবার ফিরিয়ে নিলে কেন?

এখন তো আমার মনে অন্য একটা চিন্তাও ঘোরাফেরা করছে। যদিও সেদিন আমি কোনো নেশা করে ছিলাম না, তবুও প্রশ্ন জাগছে, সত্যিই দেখেছিলাম তো আমি তাকে? সে কি আদৌ এক্সিস্ট করে? নাকি পুরোটাই আমার মনের ভ্রম? এখনো চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে তার ছবি। যেন কোনও শিল্পীর তৈরি করা মূর্তি। মিউজিয়ামে রাখার মত দর্শনীয় একটি বস্তু। তার কপালের প্রতিটি বলিরেখা, মুখের প্রতিটি ভাঁজ, বড় কমলালেবুর কোয়ার মত পেটের প্রতিটি অ্যাব— সবকিছু বড় স্পষ্ট। ভ্রম হওয়া কোনো ছবি এত স্পেসিফিক হয় কীকরে? নাহ্, মন বলছে, সে আছে, নিশ্চয়ই আছে। এত সহজে হাল ছাড়ব না আমি। আজ পূর্ণিমা, আবার যাব ওই জঙ্গলে। হয়ত কোনো কারণ আছে, তাই আসতে পারছে না।

***

উফফ, কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার! তোকে বলেছিলাম না সে আছে? এতটা ভুল আমি কিছুতেই হতে পারি না। আবার দেখা পেয়েছি তার। কাল রাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি। চাঁদের আলোয় জঙ্গলের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তোলপাড় করে ফেলেছিলাম এদিকওদিক। তাঁবু যেখানে ছিল, সেখান থেকে তিন কিলোমিটার মত হাঁটার পর একটা প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু ঝাঁকড়া ঝোপ দেখতে পাই। আশেপাশের দৃশ্যের সাথে ঝোপটাকে মেলাতে পারি না। যেন সে স্বতন্ত্র, বাকি গাছেদের থেকে আলাদা।

ঝোপটার মাঝের দিকে ঝুরির মত নেমে আসা পাতাগুলো সরাতেই আমার অবাক হওয়ার পালা।  দেখতে পেলাম একটা গলির মুখ। সেখানে প্রথমেই একটা সিঁড়ি, যেটা নীচের দিকে নেমে গেছে। ঝোপটা যেন একটা সুসজ্জিত প্রবেশদ্বার। ঠাকুর ঠাকুর করে ঢুকে পড়লাম তার মধ্যে। প্রায় গোটা চল্লিশেক সিঁড়ির ধাপ নামার পর রাস্তাটা সমতল হয়ে গেল। চারিদিকে ঘেরা, বাইরের কিছুই দেখা যায় না। তবুও গলির ভেতর যেন সর্বদাই একটা মৃদু আলো বিচরণ করছে। তাই দেখতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। এরকম প্রায় আধ কিলোমিটার চলার পর একটা মোড় ঘুরতেই দূরে ফাঁকা জায়গা দেখতে পেলাম, সেখানে বাদামী রঙের আভা। গলির শেষে বেরিয়ে যা দেখলাম, সে দৃশ্য আমি জন্মেও ভুলব না।

এখানে আকাশ সবুজ, গাছের পাতা নীল। বাদামী রঙের সূর্য। হ্যাঁ, সূর্য। বাইরে যখন রাত, এখানে তখন দিন। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু বাড়ি। তাদের প্রত্যেকের ঘরের দরজাগুলো সাধারণ বাড়ির দরজার দ্বিগুণের বেশি লম্বা। পুরোটাই একটা চারণভূমি। বেশ কিছুটা দূরে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রায় পঞ্চাশজন নরাশ্ব, যাদের পিঠে ডানা আছে। এদের মধ্যে মেয়েও আছে কিছু, মানে যাদের উপরিভাগ মেয়েদের। শুধু লম্বা চুল দেখে অতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। কারওরই গায়ে কোনো আবরণ নেই। তাই স্তন দেখে বুঝতে পারলাম, তারা নারী। আর আছে কিছু ছোট বাচ্চা। সবাই যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত।

গাছগুলো বেশ মোটা মোটা। চট করে একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম, যাতে ওরা কেউ দেখে না ফেলে। কিন্তু এই এত জনের ভিড়ে আমি আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে পাব কীভাবে? গাছের পেছন থেকে আমার চোখ দুটো নিরন্তর খুঁজে চলেছে সেই মনের মানুষ। অনেকক্ষণ ধরে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার পরেও তাকে খুঁজে না পেয়ে যখন আমি আরেকটু এগিয়ে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, তখনই কেউ আমার মাথায় হাত রাখল। চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখি, আরে এই তো! আমি যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি বিশ্ব-সংসার, সে নিজেই আমাকে খুঁজে নিয়েছে। চোখে তার প্রবল আকুতি। সে আকুতি যেন চিৎকার করে বলছে— 

স্বর্গ থেকে আরো স্বর্গে উড়ে যাও আর্ত রিনিঝিনি

প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ’রে ধ’রে

ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি

একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?

কী উত্তর দিতাম আমি সে প্রশ্নের? ওকে দেখলেই আমার যেন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়। আচ্ছা, ও কি বশীকরণের মন্ত্র জানে? দুহাত উঁচু করে বাড়িয়ে ধরলাম। সে নিজের দুহাত দিয়ে উপরে তুলে নিল আমায়। আমি প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। এক মুহূর্ত দ্বিধার পর সেও জড়িয়ে ধরল আমায়। তার বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধনে চওড়া রোমশ বুকের মাঝে খুঁজে পেলাম এক অপার নীরবতা। আনন্দে আমার চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার কাঁধে। শিউরে উঠল সে। আরও জোরে জড়িয়ে ধরল আমায়। মনে হল, এভভাবেই কেটে যাক সহস্র বছর। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এভাবেই এক হয়ে থাকি দুজনায়।

এক সময় হাতের বাঁধন আলগা দিলাম আমি। সে আমায় মাটিতে নামিয়ে রাখল। তাকিয়ে দেখলাম তারও চোখ দু’খানি সিক্ত হয়ে উঠেছে। আমি অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “সেদিনের পর তুমি আর এলে না কেন?”

ভেজা চোখে সে বলে উঠল, “শুধুমাত্র এই মুহূর্তগুলোর ভয়ে।” যে মুহূর্তদের আমরা হৃদমাঝারে সোনার সিংহাসনে বসিয়ে রাখতে চাই, তারাও তাহলে কখনো কখনো ভয় দেখায় আমাদের?

কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর শঙ্কিত গলায় বলল সে, “এবার তুমি চলে যাও এখান থেকে। ওরা দেখে ফেললে অনর্থ হবে।”

ইচ্ছে করছিল না, তবুও বুঝতে পারছিলাম ওর আশঙ্কার কথা। বললাম, “আবার কবে দেখা হবে?”

“তুমি এরপর যেদিন আসবে, আমি সেখানে চলে যাব ঠিক।”

“কীভাবে জানবে আমি কখন আসব?”

মুচকি হেসে সে বলল, “যেভাবে এখন জানতে পারলাম তুমি এখানে এসেছ।”

সেই কথা শুনে আমিও হেসে হাত নেড়ে তার কাছ থেকে বিদায় চাইলাম। কিছুটা যাওয়ার পর হঠাৎ কিছু মনে পড়ল। চকিতে পেছনে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নামটাই তো জানা হল না।”

সে আমার যাওয়ার পথের দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, “আমাদের নাম তোমরা উচ্চারণ করতে পারবে না। তার চেয়ে তোমার খুশিমতো একটা নাম দিয়ে দিও।”

নাম দেব? আমি? বেশ। প্রথমেই যে নামটা মাথায় এল, সেটা হল ‘আদিত্য’, সূর্যের মত উজ্জ্বল। হেসে বললাম, “বেশ, আদিত্য।”

“আর তুমি?”

“তুমি আদিত্য হলে আমায় যে প্রদোষ হতেই হবে।”

***

আজ কয়েকদিন হল যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। যে পৃথিবীটাকে এতদিন অর্থহীন মনে হয়েছিল, এখন সেটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছি আমি। আর কেবল আদিত্য আছে আমার সে স্বপ্ন জুড়ে। এর মধ্যে তিনবার দেখা হয়েছে ওর সাথে। প্রতিবারই মনে হয়েছে, বাড়ি ফিরে না এসে ওর কাছেই থেকে যাই। কে আছে আমার বাড়িতে? তিনজন মানুষ, যারা সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মে এতটাই অন্ধ যে আমার সত্যিটাকে তারা দেখতে পায় না অথবা দেখতে চায় না। আর অন্যদিকে আছে এমন একজন, যাকে মুখ ফুটে আমার মনের কথা বলতে হয় না। সে এমনিতেই বুঝে যায়।

তার পিঠের উপর শুয়ে সেদিন আমি জঙ্গলের বৃষ্টিতে ভিজেছি। জঙ্গলের বৃষ্টি বাইরের থেকে অনেক আলাদা। যে জলের বিন্দু যখন মাটিতে পড়ার কথা, তখন সেটা পড়ে না। জমা হয়ে থাকে কোনো গাছের পাতায়। একটা সময় পাতা হয়ত আর জলের ভার সইতে পারে না। তখন টুপ করে ঝরে পড়ে। তাই জঙ্গলের বৃষ্টির গায়ে সবুজ গন্ধ মাখা, যে সবুজে ধরিত্রীর বুকে প্রাণ সঞ্চার হয়।

বৃষ্টির তালে তালে একটা নাম-না-জানা হলুদ রঙের পাখি একটানা শিস দিয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে আমি শুনছিলাম সেই কলতান। কখন যে তার গান শুনতে আমাদের চারপাশে জঙ্গলের আরও আবাসিকরা এসে ভিড় বাড়িয়েছিল জানি না। বৃষ্টির পরেও সে সুরের রেশ কানের সঙ্গে লেগেছিল। চোখ খুলে দেখি, আশেপাশের সমস্ত প্রাণীদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি লেগে রয়েছে। যে হাসি লেগে থাকে খুব ভালোভাবে আদর করার পর।

আমি আদিত্যকে শুধোলাম, “একটা কথা সত্যি করে বলবে, প্রথম দিন আমার সাথে দেখা হওয়ার পর তুমি কি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে? নাহলে ওভাবে পালালে কেন? চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলে?”

আদিত্য ধীর গলায় বলল, “হ্যাঁ, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল তুমিই সেই যাকে আমি খুঁজেছি পাহাড়ের প্রতিধ্বনিতে, সমুদ্রের আস্ফালনে, জঙ্গলের নীরবতায়। সাথে এও বুঝেছিলাম, আমার মনের কথা বাকিরা জানতে পারলে রাজ্য থেকে বের করে দেবে। একা একা দলছুট হিসেবে বেঁচে থাকার সাহস আমি এখনও জড়ো করে উঠতে পারিনি প্রদোষ।”

মনে হল, আমার বুকটা যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। নেমে পড়লাম ওর পিঠ থেকে। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “তাকাও আমার দিকে।”

থরথর চোখে তাকাল আদিত্য। বললাম, “একা বলছ কেন? আমি তো আছি। এমনিতেই প্রতিদিন আমাকে অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুনতে হয়। তার উপর তোমায় ভালোবাসি জানলে আমার বাড়ির লোকও কি আমাকে আর আস্ত রাখবে? আচ্ছা আদিত্য, অনেক দূরে সমুদ্রের মাঝে নির্জন কোনো দ্বীপে, আমরা নতুন করে নিজেদের মত বাসা বানাতে পারি না? যেখানে সবাই নিজের পরিচিতি নিয়ে গর্ববোধ করবে, যেখানে কাউকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে হবে না।”

“হয়ত… হয়ত একদিন সব শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার দুঃসাহসিকতা দেখাতে পারব। সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি।”

“বেশ, আমিও তোমার সেই অপেক্ষার সঙ্গী হলাম।”

***

এখন রাত বারোটা। প্রায় দুসপ্তাহ পর আবার তোর গায়ে পেনের আঁচড় কাটছি। কদিন ধরেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আদিত্যের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে নিজের মধ্যে পোঁতা হয়ে গেছে বেপরোয়া সাহসের একটা বীজ। আমি আর কাউকে তোয়াক্কা করছি না। আজ পর্যন্ত অনেক কিছু মেনে নিয়েছি চক্ষুলজ্জার ভয়ে, সমাজে আমার পরিবারের মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে পিছিয়ে এসেছি। এবার এতদিন পরে যেটুকু সাহস পেয়েছি, সেখানে আর নিজেকে অর্থহীন গন্ডিতে বেঁধে রাখার কোনো মানে হয় না।

তাই আমি গতকাল নিজের মত করে সেজেছিলাম। শাড়ি পরার আমার অনেকদিনের শখ। মায়ের আলমারি থেকে চুপিচুপি একটা শাড়ি বের করে তুলে নিয়েছিলাম গায়ে। কিনে এনেছিলাম ইমিটেশানের কিছু ঝুটো অলঙ্কার এবং প্রসাধন সামগ্রী। গলায় হার, কানে দুল, হাতে চুড়ি পরে, লিপস্টিক, নেলপালিশ আর ফেস পাউডার লাগিয়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম, অবাক হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজেকে। এত সুন্দর আমি? একটা ফটো তুলে রেখেছি, আদিত্যকে দেখাব পরের দিন।

বুঝতে পারছি আমার সহজাত চলন, বলন অধিকার করে নিচ্ছে আমার এতদিনের আরোপিত ধরন-ধারণ। ভেতরের নারীসত্তা ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলছে বাইরের খোলস। বাড়ির লোকের চোখে আমি দেখতে পাচ্ছি পুঞ্জীভূত ঘৃণা। ওরা আমাকে সহ্য করতে পারছে না। তাদের খরদৃষ্টি যেন বলছে, “জন্মের সময়ই কেন মরে গেলি না তুই?” শুধুমাত্র ওদের মত নই বলে, আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই? কিন্তু এটা তো আমি ঠিক করিনি। এভাবেই জন্মেছি আমি।

যে আত্মা আগে এইসব দেখে চুপচাপ মেনে নিতে, সে এখন সাথে সাথে বিদ্রোহ করে বলছে, কেন মরব আমি? কী আমার অপরাধ? এই পৃথিবীতে তোমাদের বাঁচার যতটা অধিকার, আমারও ঠিক ততটাই। এক ইঞ্চিও জমি ছাড়ব না আমি। মাটি কামড়ে পড়ে থাকব। দেখি আমায় কে আটকায়। তবে সময়ে সময়ে ওদের পারিবারিক সম্মানে আঘাত লাগলে যে ওরা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, সেটা আগেও দেখেছি। মানুষের সম্মান কি এতই ঠুনকো?

ওই কেউ আসছে মনে হয়। ডায়েরি, এবার তুই ঘুমো, আজ রাতের মত ছুটি দিলাম তোকে।

***

শেষ ডায়েরি লেখার পর হপ্তাখানেক কেটে গিয়েছে। ভাবিনি আর কোনোদিন ডায়েরি লিখতে পারব। ভাবিনি কোনোদিন জীবনের স্বাভাবিক স্রোতে ফিরতে পারব। কিন্তু শেষমেশ যে লিখতে পারছি, সেটা একজনের জন্যই সম্ভব হয়েছে, সে হল আদিত্য। শেষবার ডায়েরি লেখার সময় লিখেছিলাম, কেউ আসছে। এসেছিল ওরা তিনজন, যারা আমার জীবনের সবচেয়ে আপন হতে পারত। পায়ের অস্থির শব্দে বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ঘরে ঢুকেই আমার হাত, পা, মুখ চেপে ধরল তারা। মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল একটা কাপড় যাতে আওয়াজ না বেরোয়। আমি ছটফট করছিলাম। কিন্তু তিনজনের সাথে একজন পারে কখনো?

আমার শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি করে হাত, পাগুলো দড়ি দিয়ে খাটের স্ট্যান্ডে বেঁধে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় যখন আমি পর্যুদস্ত, তখনই আমায় আরও চমকে দিয়ে ঘরে ঢুকল একজন তান্ত্রিক। রক্তচক্ষু, মুখে দাড়ির জঙ্গল, মাথায় জটা, কপালে তিলক, গায়ে লাল বসন, দেখলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অবাক হচ্ছিলাম ওদের কান্ড দেখে। সবাই মিলে ইঁট নিয়ে এসে বেদী বানিয়ে ফেলল হোমের জন্য। অত কষ্টের মধ্যেও হাসি পেল আমার। এরা কি যজ্ঞ করে ভূত তাড়াবে নাকি? আমি ভাবতে পারছি না, কীভাবে এরা সমাজে নিজেদের শিক্ষিত বলে পরিচয় দেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল যজ্ঞ। সেই তান্ত্রিকের নাচের সাথে মন্ত্রোচ্চারণে কেঁপে কেঁপে উঠছিল ঘরটা। মাঝে মাঝে ঝাঁটা দিয়ে মারছিল আমায়। ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছিল, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল খুব। এরকম চলতে চলতে একসময় সংজ্ঞা হারালাম।

পরেরদিন সকালে ঘুম যখন ভাঙল, দেখি আমার হাত পায়ের বাঁধন খোলা। সর্বাঙ্গে অসম্ভব ব্যথা। ঘরের মধ্যে ধোঁয়া তখনও কুন্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। কোনোমতে উঠে দেওয়াল ধরে ধরে গেলাম অ্যাটাচড বাথরুমে। কমোডে বসতেই দারুণ কষ্ট হচ্ছিল। প্রাতঃকৃত্য সারতেই খরচ হয়ে গেল দেহের অর্ধেক শক্তি।

এরপর ঘরের বাইরে বেরোনোর জন্য দরজা টানতেই দেখলাম সেটা বাইরে থেকে আটকানো। মনের মধ্যে এরকম একটা ভয় যে একেবারেই ছিল না তা নয়। অর্থাৎ বক্তব্য পরিষ্কার –তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ মানুষের মত কাটাতে হবে জীবন। আর যদ্দিন না সেটা হচ্ছে আটকে থাকো ঘরে। শুরু হল আমার বন্দী জীবন। আমিও ভেবে নিয়েছিলাম, হার আমি মানবো না। তাতে যদি মরেও যেতে হয়, তাতেও অসুবিধে নেই।

সবাই পালা করে দিনে চারবার খাবার, জল এগুলো দিয়ে যেত ঘরে। ওদের মুখচোখ দেখে মনে হত, ওরা খুব করে চাইছিল, আমি যেন ছুটে গিয়ে ওদের পা জড়িয়ে ধরি। বলি যে যা হওয়ার হয়ে গেছে, আর কোনোদিন হবে না। এবার তোমরা আমাকে মুক্তি দাও।

কিন্তু ভালোবাসার শক্তিকে বোধহয় সর্বদা আমরা আন্ডারএস্টিমেট করে থাকি। আদিত্য আমায় শক্তি দিয়েছে প্রতিবাদ করার। প্রাণ থাকতে মাথা নোয়াব না আমি। হয় আমাকে আমার শর্তে জীবন কাটাতে দিতে হবে। নাহলে থুতু ফেলি অমন ভিক্ষার জীবনে।

এরকম চলল বেশ কয়েকদিন। খেয়াল করে দেখিনি ঠিক কতদিন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম দেখি কতদিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারি। ততদিনে আমি শুধু শারীরিক গঠনটুকু ছাড়া আর সবদিক থেকে সম্পূর্ণ নারী হয়েছি। কতদিন দেখিনি আদিত্যকে! ওকে চোখের সামনে দেখার, একবার জড়িয়ে ধরার খুব ইচ্ছে করছিল। আমার সমগ্র সত্তা দিয়ে চাইছিলাম ওকে। ভাবছিলাম, এটুকু পাওয়ার জন্য আমি আমার জীবন বাজি রাখতেও রাজি। কিন্তু এখান থেকে বেরোব কীভাবে? সেও কি তার দুনিয়ার কাঁটাতার পেরিয়ে আসতে পারবে এখানে? সবকিছু ছেড়ে আসার সাহস কি হয়েছে তার? 

রাত প্রায় একটা তখন। এরকম যখন ভাবছি, ঠিক তখনই বিকট শব্দে আমার ঘরের দেওয়াল ভেঙে পড়ল। অবাক হয়ে দেখি, ভাঙা ইঁট, সিমেন্টের ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসছে আমার রাজা, আমার আদিত্য। এ পৃথিবীতে তাহলে এমনও কেউ আছে, যে আমার জন্য সাত সমুদ্র, তেরো নদী পার করে ফেলে! ওদের দুনিয়া থেকে আমাদের দুনিয়ায় আসাটা নদী, সমুদ্র পেরিয়ে আসার থেকে কোনো অংশে কম তো নয়। মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে ছুটে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। সে আমায় তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রবল আশ্লেষে। আমিও তাকে জড়িয়ে তার কাঁধে মুখ লুকোলাম।

ইতিমধ্যে আমার ‘ঘরের’ লোক ছুটে এসেছ। আদিত্যকে দেখে তাদের এতবড় হাঁ হয়েছিল, সেখান দিয়ে শুধু বেড়াল নয়, আস্ত একটা মুরগী ঢুকে যেতে পারে। ওদের অবস্থা দেখে আমি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। জানি আমাকে নিয়ে যাবে আদিত্য। টেবিলের ওপর থেকে শুধু ডায়েরি আর পেনটা তুলে নিলাম। আমার অনেক গোপন কথার সঙ্গী। ওই দুটো জিনিস ছাড়া আর কিছু নেওয়ার ইচ্ছে করল না।

এবার আমি চড়ে বসলাম তার পিঠে। বাইরে বেরিয়ে এসে কিছুটা দৌড়ে সে মেলে দিল ডানা। আমার পায়ের নীচ দিয়ে ক্রমশ সরে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট। আমি পেছন থেকে তার গলার কাছটায় জড়িয়ে ধরে আছি। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর আমিই নীরবতা ভাঙলাম, “তুমি যে আসতে পারবে, সেটা আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি।”

সে মুখটা অর্ধেক ঘুরিয়ে বলল, “আমিও এখানে আসার আগে পর্যন্ত বিশ্বাস করিনি যে আসতে পারব। কিন্তু কতদিন হয়ে গেল, তুমি গেলে না জঙ্গলে! কু গাইছিল আমার মন, কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে। কিন্তু কী করব সেটা বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে আজ যখন তুমি আমায় মনে মনে এত করে ডাকলে, আমি আর না এসে থাকতে পারলাম না। ফেলে এসেছি সব বন্ধন, শুধু তোমাকে পাব বলে।”

এত আনন্দ বোধহয় কোনোদিনও হয়নি আমার। হাওয়ায় উড়ছিলাম আমি, আক্ষরিক অর্থে এবং ভাবনায়। জিজ্ঞেস করলাম তাকে, “আর আমার বাড়িটা কীভাবে খুঁজে পেলে?”

সে হেসে বলল, “বাড়ি খুঁজিনি তো! তোমাকে খুঁজেছি। যেভাবে তোমাকে খুঁজে পাই সবসময়, সেভাবেই…”

কথায় কথায় খেয়াল ছিল না। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি লোকালয় সরে গিয়ে এবার শুরু হয়েছে সমুদ্র। অনেকখানি সমুদ্র পেরিয়ে আদিত্য নিয়ে এসেছে আমায় এই দ্বীপে। ভালোই আছি দুজনে, গাছের ফলমূল, সমুদ্রের মাছ খেয়ে। আদিত্য জঙ্গলের ভেতর থেকে কাঠ নিয়ে এসে ছোটখাটো একটা ঘরের মত বানিয়েছে। রোদ, বৃষ্টি এসবের হাত থেকে বাঁচার জন্য। জানিনা সে চকমকি পাথর পেয়েছে কোথায়। আমায় উনুন ধরিয়ে দেয়, আমি রান্না করি। রান্না করার দায়িত্বটাও আদিত্য নিজেই নেবে বলেছিল। কিন্তু রান্না করতে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগে। বাড়িতেও যখন তখন রান্না করতাম। তাই ওই দায়িত্বটা আমি নিজের কাছেই নিয়েছি।

আগে আগে মনেপ্রাণে এরকমই একটা ঘর বাঁধতে চাইতাম। ওদের বাঁধাধরা নিয়ম থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এখন মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন এসে খোঁচা দেয়, এটাই কি আমাদের গল্পের পরিণতি? এত সাদামাঠা? এত স্বার্থপর? শুধু নিজেদেরটুকু? ব্যাস?

‘নষ্ট’ দ্বীপের থেকে অনেক দূরে ‘সভ্য’ মানুষদের ডাঙায়

রাতের আকাশে ম্লান তারাগুলো কেমন যেন টিমটিম করে জ্বলছে। অপর্ণার চোখে ঘুম নেই ওই তারাগুলোর মতই। কল্লোল কখন ক্লাব থেকে ফিরবে সেই জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। ক্লাবে কল্লোলের অনেক গার্লফ্রেন্ড। মাঝে মাঝেই শোয় তাদের সাথে। পুরুষমানুষ তো! অত দোষ ধরলে কি চলে?

আজ অবশ্য ফিরবে বলে গেছে। অপর্ণা জেগে আছে কল্লোলের পেট আর শরীর, দুটোরই খিদে মেটাবে বলে। মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে কল্লোলের বাড়া ভাত চাই। তারপর বিছানায় চাই একটা নারীশরীর। সেটা অপর্ণাই হোক আর যেই হোক।

আজকাল অপর্ণা ঘৃণা করে কল্লোলের বারোয়ারি শরীরটাকে। অবশ্য স্ত্রী নামক কেনা বাঁদির সাথে যা কিছু করা যায়। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাম আর কেই বা রাখে? তাই প্রতি রাতে অপর্ণা ধর্ষিতা হয়। তার শরীর জাগে না, মন তো কবেই উঠে গেছে। তবু প্রতি রাতে নিপীড়ন সহ্য করতে হয় তাকে। আজ অবশ্য রাতটা একটু অন্যরকম কাটল।

খাওয়াদাওয়ার পর কল্লোল যখন নারীমাংস ভোগ করতে আসছে, তখনই দরজায় ঠক ঠক। কল্লোল বিরক্তি সহকারে মুখ বাঁকিয়ে স্বগতোক্তি করল, “ধুর শালা! এত রাতে আবার কে?”

অনিচ্ছা সহকারে পা দুটোকে টেনে টেনে নিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলে কাউকেই দেখতে পেল না। বাড়ির বাইরে বেরোল। চাঁদের হালকা আলো রয়েছে। কিন্তু কেউই তো নেই। অস্ফুটে পাঁচ অক্ষরের একটা গালি দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাবে প্রায়, ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ যেন ওর জামার কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে ওপরে উঠিয়ে নিল। চিৎকার করে উঠল কল্লোল। সেই চিৎকার শুনে অপর্ণা ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে। দেখল, একজন আধা মানুষ-আধা ঘোড়া যার আবার ডানাও রয়েছে, ক্রমশ উড়ে যাচ্ছে ওপরের দিকে। সেই নরাশ্বের পিঠে চেপে আছে একটা ছেলে, যে ধরে আছে কল্লোলের জামার কলার। কল্লোল হাত পা ছুঁড়ছে আর চিৎকার করছে। একসময় অনেক উপর থেকে কল্লোলকে ছেড়ে দিল ছেলেটা। অনেকদিন পর হাসিতে ফেটে পড়ল অপর্ণা, যেন দারুণ কোনো মজার ঘটনা ঘটছে। নীচে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অপর্ণার হাসির দিকে চেয়ে থাকা কল্লোলের অবিশ্বাসী মুখটা ছিল দেখার মত।

কবিতা ঋণ– স্পর্শ (জয় গোস্বামী)


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

Agniswar Chakraborty

6 মাস আগে

চমৎকার লেখা


Image Description

Claudine Garrison

17 ঘন্টা আগে

Hi, Your brand deserves to stand out, and we’re here to help. At Global Wide PR, we specialize in connecting businesses with top media platforms to increase visibility and credibility. As a gesture to get started, we’re offering a free article on Digital Journal—a great way to showcase your business to a wider audience. For those looking to maximize exposure, we can also feature your brand on affiliates of FOX, NBC, CBS, ABC, and 300+ other sites for just $297. These placements can help you build trust and attract new customers. To take advantage of this opportunity, click the link below to sign up on our site, and we’ll get back to you ASAP: https://benzingaarticlefree.com/ Looking forward to helping your brand shine! Best regards, Claudine Global Wide PR We understand that our emails may not always be relevant. To unsubscribe from our list, please submit the form here with your website address: bit. ly/unsubscribemeurl


Image Description

শাশ্বতী লাহিড়ী

6 মাস আগে

একটি নিরুপায় মানুষী মনের কল্পলোক, রূপকথা, বাস্তব, ব্যাকুলতা ও অব্যাখ্যাত বেদনায় দগ্ধ অঙ্গার - যাপনের সুন্দর উপস্থাপনা। সমব্যথী মনে তার ডাইরিটিকে স্পর্শে রাখলাম। মনে মনে উচ্চারণ করলাম, ' প্রদোষে'র অমোঘ অন্বেষণে রোজ রোজ আদিত্য বুঝি আসেন আকাশে ! তাহাদের সহগামী পথে রাঙা হয় পৃথিবীর মন ! '


মন্তব্য করুন

লেখক

পরিচয় করাতে গিয়ে জন্ম, পেশা ইত্যাদি সম্বন্ধে শুধু কয়েকটা নীরস তথ্য নাই বা দিলাম। তার চেয়ে বরং এই উপন্যাসের জন্ম হল কীভাবে, সেকথা বলি। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বিনি পয়সার বায়োস্কোপ’ স্বপ্ন দেখিয়েছিল আমায়। কিন্তু সেই স্বপ্নে গল্পের চরিত্ররা অভিযোগ জানাতে শুরু করল এই বলে যে তাদের জীবনকাল অত্যন্ত স্বল্প। কতকিছু দেখা, জানা বাকি রয়ে গেল তাদের। দু-চার পাতায় জীবনকে আর কতটুকুই বা ছোঁয়া যায়? ... বেশ... ঠিক করলাম এবার চরিত্রদের অনেকখানি সময় দেব। দেখাই যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। একেবারে বাস্তব কিছু চরিত্র তুলে ধরতে চাইলাম। এতটাই বাস্তব যে নিজেরই ভয় করতে লাগল, আশেপাশে যাদের দেখছি তারাই না কপিরাইট স্ট্রাইক দেয়! তবুও সাহস করে গড়ে তুললাম... একটু একটু করে। হোঁচট খেলাম, রক্তাক্ত হলাম, গভীর ক্ষত তৈরি হল মনে। কিন্তু থামতে পারিনি। এ যেন এক অভিশাপের মতো। যে অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে একরাশ বিষণ্ণতা। এই কাহিনি লিখতে গিয়ে আমার যা অবস্থা হয়েছে, পড়তে গিয়ে আপনারও হয়তো তেমনই... তবু যা লিখেছি শুরুর পাতা থেকে শেষ পর্যন্ত, ওইটুকুই আমার পরিচয়। তার বাইরে আমি আর কিচ্ছুটি নই।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন