preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
হুতাশী রাতের আত্রাই নদী
গল্প

হুতাশী রাতের আত্রাই নদী

05 Oct, 2024.

জিতেশ ওর অবহেলায় ফেলে যাওয়া প্রেমকে কুড়িয়ে নিতে এসেছিল আবার এই গ্রামে, এত বছর পরে। কিন্তু রিক্ত-নিঃস্ব হয়েই রইল ওর বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া হৃদয়টা। আর সেই আত্রাই নদী তার উদ্দাম জলোচ্ছ্বাস আর নদীর ঘাটে আছড়ে পড়ার শব্দ দিয়ে ওর রোদনের আর্তনাদ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। সবটুকু আগুন নিভে গিয়ে পোড়া কাঠগুলো ধোঁয়া ছাড়ছিল তখন। গুম হয়ে যাওয়া সেই রাতে একঝাঁক রাতচরা পাখি হঠাৎ ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল উন্মত্ত আত্রাইয়ের দিকে।

মোঙ্গাহুদুরের মাতাল করা মনমোহক সুরের রেশ কখন হারিয়ে গেছে। ধামসা-মাদলের একটানা ঘুমপাড়ানি বাজনার তান শুনতে শুনতে কখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল জিতেশ। আত্রাই নদীর ধারে বুড়ো বটগাছটার নিচে এই হিমেল নিশুতি রাতে একা-একা টুপভুজঙ্গ হয়ে পড়ে আছে ও। কেবল নদীটার কুলকুল করে বয়ে যাওয়ার শব্দ কানে আসছে, নদীর পাড়ের জমাট অন্ধকার দিকটার থেকে। পূর্ণিমা রাতের সেই উজ্জ্বল আলোভরা চাঁদটা এর মধ্যেই পাঁশুটে বর্ণ ধারন করেছে। তার ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।

মহুয়ার নেশাটা মারাত্মক ধরেছে কাল রাতে। চাঁদনী রাতের মায়াবী জ্যোৎস্নায় জ্বলন্ত কাঠের আগুনের আঁচ ছড়িয়ে পড়ছিল বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে। সেই আগুনের চারিদিক ঘিরে গভীর রাতে ঝুমুর নাচের আসর বসেছিল এখানটায়। তার সঙ্গে জুড়েছিল জোড়ায় জোড়ায় আদিবাসি যুবক-যুবতীদের ভেজ্জা নাচ। মেয়েদের কোমর ধরে ভুয়োং আর ঝুমঝুমির তালে তালে নেশার বশে জিতেশ নেচে যাচ্ছিল একনাগাড়ে। মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছিল মহুয়া আর হাঁড়িয়ার নেশায়। কখন যে সেই নেশা ধরানো নাচ শেষ হয়ে গেছে, জিতেশ জানেই না। আদিবাসি ছেলেদের আর সুন্দরী মেয়েদের দল ক্লান্ত পায়ে কখন বাড়ি ফিরে গেছে সবার সঙ্গে, খেয়ালই করেনি জিতেশ। এতগুলো আদিবাসি ছেলেমেয়ের দলের মাঝে ও একজনকেই ভীষণ চাইছিল শুধু তখন। লাজ্জু, দময়ন্তি, লাজলি, কিসকুদের মধ্যে সারা রাত ধরে ওর হারানো লাজবন্তীকেই আকুল হয়ে খুঁজে বেরাচ্ছিল জিতেশের চোখ। ওর কথা ভেবে ভেবেই হা-হুতাশ করে উঠছিল জিতেশের বুকটা। আর সেই ব্যথা ভোলাতে বার বার হাঁড়িয়া টেনে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ছিল ও।

দময়ন্তি নামের চটুল আদিবাসি মেয়েটাই জিতেশকে জোর করে বার বার টেনে আনছিল আগুনের কাছে, নাচের জায়গাটায়। জিতেশের হাত ধরে টানতে-টানতে খিল-খিল করে হাসতে হাসছিল মেয়েটা। মেয়েটাই বার বার আগুন ঘিরে নাচিয়েছে ওকে সারাক্ষন। হাঁড়িয়ার নেশাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল দময়ন্তির ছিপছিপে সুন্দর কষ্টিপাথর-রঙের শরীর থেকে বেরনো সরগুজা-কারোঁয়ার তেলের সুবাস আর মাথার গুঞ্জা ফুলের থেকে বেরোনো একটা মিশ্রিত মাতাল করা গা-শিরশিরানি গন্ধ। লাজবন্তীর শরীর থেকেও এরকমই একটা আঘ্রান বেরত। বহুবছর আগে ঠিক এই গন্ধটাই জিতেশকে নেশা ধরাত একদিন। কিন্তু সেই তৃষ্ণা মেটানোর মতন সেই তামাটে রঙের চাবুক-গড়ন, সেই কালো-হরিণ চোখ আর ওর মতন নাচানো ভুরুর ধনু, চকিত-চটুল চোখের সেই গভীর মাদকতা, সেই শরীরী আকর্ষণ কোথায়। সেসব এদের মধ্যে খুঁজে পায়না জিতেশ। রাত শেষ হতেই থাকে। তৃষ্ণার্তই থেকে যায় সে সারারাত। মন শুধু খুঁজে ফেরে তাকে। ওর সেই একান্ত নিজের লাজবন্তীকে।

এখন সোহরায় উৎসবের পুষনা পার্বণ চলছে কদিন ধরেই। মাঘী পূর্ণিমার কনকনে ঠাণ্ডাটা এবার যেন হাড়ে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। শেষ রাতের ঘোলাটে রঙের জ্যোৎস্না ভেজানো জায়গাটায়, শিশির ভেজা দুধলি-ঘাসের ওপর একা শুয়ে আছে জিতেশ। নেশার আবেশ সারা গায়ে মাখামাখি। গাত্রত্থান করতে ইচ্ছা করছে না ওর। হিমেল হাওয়া এসে শরীর ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঠেকছে। নেশার মধ্যেই সেটা টের পাচ্ছে ও। চাঁদের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। সেই নিস্তেজ আলোর নিচে বুড়ো বটগাছটা একটা প্রেতের মতো অন্ধকার অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধিকি-ধিকি জ্বলতে থাকা পোড়া কাঠে দমকা হাওয়া এসে উস্কে দিচ্ছে আঁচ। স্ফুলিঙ্গগুলো শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে ভাঙ্গা উৎসব-প্রান্তরটাতে আর বাইরের হিমেল-রাতটাকে তখনও অনেকক্ষন জাগিয়ে রাখার। চাঁদের আলো ফিকে হয়ে গেলেও লাজবন্তীর স্মৃতি, লাজবন্তীর আসঙ্গলিপ্সা, ওকে কাছে পাওয়ার বাঁধ-ভাঙ্গা ইচ্ছা, আর একবারটি চোখের-দেখা দেখার অদম্য অভিলাষ যে কিছুতেই ফিকে হয় না জিতেশের মন থেকে। নেশায় বুঁদ হয়ে থেকেও কিছুতেই যে ভুলতে পারে না ওকে। সব নেশাকে ছাপিয়ে এতদিন পরেও লাজবন্তীর সান্নিধ্যের নেশা জিতেশকে ক্রমশ পেয়ে বসছে। লাজবন্তীকে হারানোর হাহাকার বিন্দুমাত্র কমেনি মন থেকে। কোথায় এখন ওকে খুঁজে পাবে? এই গ্রামেই ওর ফেলে যাওয়া সেই লাজবন্তীকে কোথায় পাবে ও এত বছর বাদে? বহুবছর আগের সেই গুম হয়ে যাওয়া হৃদয়ের নিভৃত প্রেমটাকে কী আর ফিরে পাবে ও?

শুয়ে-শুয়ে আকাশটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে জিতেশ। পুরোনো বটগাছটা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে একা এই ধূ-ধূ মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। ওদের সেই প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাওয়া প্রেমকথার এক ভুতুড়ে সাক্ষীর মতো লাগছে ওটাকে। উঠে বসার ইচ্ছে বা শক্তি দুটোই হারিয়ে ফেলেছে জিতেশ। এতবছর বাদে এখানে এসে গ্রামের পর গ্রাম খুঁজে-খুঁজেও এখনও হদিশ পায়নি লাজবন্তীর। কেউ ওকে বলেইনা ও কোথায় আছে এখন। এতকাল বাদে এই গ্রামে ফিরে এসেও ওকে এভাবে হারিয়ে ফেলে ওর শরীর, মন, প্রাণশক্তি সব নিঃশেষ। ও পাগলের মত খুঁজেছে সারা গ্রাম। ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বুকে করে, সঙ্গে করে হরিয়ানায়। সেজন্যই ও হন্যে হয়ে খুঁজছে ওকে। কিন্তু পায়নি।

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

এত খোঁজাখুঁজি করেও লাজবন্তীকে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে পড়ে আছে এখানে নেশায় বুঁদ হয়ে। এ জীবন রাখার আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। এভাবে নিঃসাড় হয়ে একলা জীবনটাকে তীব্র নেশায় আচ্ছন্ন করে দিয়ে জীবনের মত একেবারে ঘুমিয়ে পড়লে কী ভালই যে হত। চেতনা না ফিরে এখানেই চিরনিদ্রায় ঢলে পড়তে পারলে, ও কী শান্তিই না পেত। মা-বাবা দুজনেই আজ নেই এই পৃথিবীতে। একমাত্র রয়ে গেছে লাজবন্তীর স্মৃতি, বহুদিন আগে বধ করে ফেলা ভালবাসার সুতীব্র বিরহ-জ্বালা। আর একদম সহ্য করতে পারছেনা জিতেশ। প্রতিদিন এভাবে হারানো স্মৃতি হাতড়ে বেঁচে থাকা আর সম্ভব নয়। নিথর দেহে শুয়ে-শুয়ে জিতেশের এসবই মনে আসছে এখন ঘুরে ফিরে। কানে তালা-ধরানো ঝিঁঝিঁ পোকার ক্লান্তিকর একটানা আওয়াজটাও এখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এই নেশার মধ্যেও সব হারানোর বেদনা সারা শরীর মনকে আবিষ্ট করে রেখেছে।

নিঝুম রাতের ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নার আলোয় ভাসা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে শুয়ে শুয়ে আগের সব কথা খুব স্পষ্ট করে মনে পড়ছে এখন। মনে পড়ছে এই ঘোর নেশার মাঝেও। জিতেশের বাবা যখন পার্বতীপুরে চাকরির ট্র্যান্সফার নিয়ে এলেন, তখন জিতেশ ওর মায়ের পেটে। পাশের দিনাজপুরেই কাছের সরকারি এক মহকুমা হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল জিতেশের। মায়ের মুখেই শুনেছে, ওর জন্মানোর খবর পেয়ে পাশের চিরাকুঠা আর বুকচি গ্রামের আদিবাসিরা ভিড় করে দলে দলে দেখতে আসত রোজ ওকে। গ্রাম থেকে একের পর এক সাঁওতাল মেয়ে-বউরা সিং-সাহেবের ছেলেকে দেখার জন্য জমায়েত হতো দূর-দূরান্ত থেকে। জিতেশের বাবা যে কোম্পানির বড়বাবু ছিলেন, এসব গ্রামের সাঁওতাল রমণীদের মরদরা সেই কোম্পানিতেই কাজ করত। কোম্পানি-সাহেবের এইবাচ্চার মুখ দেখার সময় নানা রকম ভেট আর উপহার সামগ্রী নিয়ে আসত ওরা। জিতেশের মায়ের হাতে দিত এনে সব। রাজবংশী, কৈবর্তরাও আসত। পায়ে হেঁটে নাজিবপুর, বালুরঘাট থেকে, সাঁওতালরা আসত সবাই দল বেঁধে। সাহেবের ছেলে হয়েছে, এই আনন্দে সারা গ্রামে উৎসবের ঢল নেমেছিল ক’দিন। গরিব-গুর্বো আদিবাসির দল তাদের বাগানের লাউ-কুমড়ো, পুকুরের জ্যান্ত মাছ, কচিপাঁঠার মাংস, শাক-সবজি, ক্ষেতের ভুট্টা, নানা রকম ডাল, দুধ সব নিয়ে এসে স্তূপীকৃত করত ওদের বাড়ির উঠোনে। সে এক এলাহি ব্যাপার। জিতেশের জন্মানোর খবরে মহানন্দে ওরা বেশ কয়েকদিন ধরে উৎসব পালন করতে শুরু করেছিল। এই গরিব লোকগুলোর জীবন থেকে দারিদ্র যেন বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছিল খুশিতে। মায়ের মুখেই এসব শোনা। বাবা এই গরিব সাঁওতালদের উপহার আনতে বারন করেছিলেন। কিন্তু কে শোনে তাঁর কথা। অঢেল উপহার-সামগ্রী সব আসছে তো আসছেই। নিজেরাই রান্নাবান্না করে ওরা খাওয়াদাওয়াও করত এখানেই। শুধু তাই নয়। এই আনন্দে ওরাপেছনের দিকের চাতালটায় রোজ রাতেই সাঁওতাল নাচ-গানের আসর জমাতো। ওরা কয়েকদিনের জন্য সব দারিদ্রকে ভুলে আনন্দ আর নাচগান হৈ-হুল্লোড়ে মজে ছিল। ঝুমুর নাচের আসর বসত রোজ। আগুন জ্বালিয়েমায়ের কোলের ছোট্ট শিশু-জিতেশকে ঘিরে ঘিরে নাচ চলত অনেক রাত অবধি। ধামসা-মাদল, বাঁশি আর ঝুমঝুমি বাজাত গানের তালে তালে। কাঁসর-ঘণ্টা তো ছিলই। পাশের বুকছি গ্রাম থেকে কোন কোনোদিন ভুয়োং-বাদক তার দলবল সমেত চলে আসত। কিংবা নাজিবপুর থেকে চলে আসত মোঙ্গাহুদুরের সঙ্গে নাচ-গানের খাস দলটাও। তাদের সঙ্গে আরও থাকতো তুমদা, টামাক, বানতা, রাহাড়, তিরোয়ো-বাঁশি, আরও কত কি নাম না জানা আদিবাসিদের বাজনা।

রাতের ঝুমুর আর ভেজ্জা নাচের আসরে আদিবাসি রমনীরা ছোট্ট জিতেশকে কোলে নিয়ে নাচত গানের সঙ্গে সঙ্গে। সাঁওতাল মেয়েদের নাচ হত। মরদদের বাজানো ঢোল-টামাকের দুলুনি দেওয়া একটানা ঘুমপাড়ানি তালের সঙ্গে সঙ্গে কোমর শরীর ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে নাচ। সাঁওতালি মেয়েরা মাঝে মাঝে জিতেশের মা’কেও টেনে আনত ওদের সঙ্গে হাত ধরে কোমর দুলিয়ে কিছুক্ষন নাচার জন্য। মা মাঝে মাঝে আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন ওই ছোট্ট জিতেশের জন্য। রাতের পড়া শিশিরে পাছে ছেলের ঠাণ্ডা লেগে যায় সেই ভয়ে। হাঁড়িয়ার নেশাটা মাথা অবধি চড়ে গেলে ছোট্ট জিতেশকেও মেয়েরা কোলে নিয়ে নাচতে শুরু করত। মা ভয় পেতেন পাছে হাঁড়িয়া খেয়ে নাচতে থাকা বেহুঁশ বেহেড আদিবাসি রমনীদের কোল থেকে ছেলে ছিটকে পড়ে যায়। ওদিকে জিতেশের বাবা বসে বসে আদিবাসি মাতব্বর বুড়োদের দলের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই নাচ দেখতেন। আর উনিও দু-পাত্তর খাঁটি হাঁড়িয়া কিংবা মহুয়ার ভাগও পেতেন। তারপর নেশাগ্রস্ত চোখে জগত ভুলে গুম হয়ে বসে থাকতেন মহানন্দে। মাদলের সঙ্গে সঙ্গে তাল দিতে দিতে ওদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। আর কোনোদিকে হুঁশ থাকতো না তখন ওনার। ভালই কেটে যেতে লাগলো দিনগুলো।

সাঁওতাল মেয়েদের কোলে চড়ে ঝুমুর নাচতে নাচতে, তাদের শরীরের জংলি-ফুলের তেল আর ঘাম- মিশ্রিত আদিম গন্ধে মোহিত হয়ে, মাথায় গোঁজা শাল-শিমুল ফুল আর মহুয়া-পচানির নেশায় বুঁদ রমনীদের নাচুনি-দুলুনিতে কোলে শুয়ে শুয়ে এভাবেই একদিন কিভাবে কৈশোরে পৌঁছে গেল জিতেশ। একদম ছোটবেলা থেকেই আদিবাসি সাঁওতালদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠেছিল ও। মুণ্ডা, ওঁরাও, খেওয়ার, দোসাদদের সঙ্গে মেলামেশা করে ওদের জীবনধারাতেই বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল ক্রমশ। রাজবংশী, সাঁওতাল আর কৈবর্তদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই ওর সর্বক্ষণের সাথী ছিল ছেলেবেলায়।

পার্বতীপুরের আদিবাসি স্কুলেই জিতেশকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল ওর বাবা। সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই পড়াশুনা করছিল জিতেশ। সেই একই ক্লাসে লাজবন্তীও পড়ত। রূপে লক্ষ্মী আর গুনে সরস্বতী যেন একই সঙ্গে বিরাজ করছিল মিষ্টি সুন্দরী বন্য-কিশোরী লাজবন্তীর মধ্যে। আদিবাসিদের গর্ব ছিল ও। পড়াশুনায় ওকে টেক্কা দেওয়া ছিল ভার। আর লাজবন্তীর চকিত-চঞ্চল বন-হরিণীর মতো নেশাধরানো রূপ জিতেশের কৈশোরকে পাগল করে তুলত সবসময়।

এরপর কৈশোরের আর যৌবনের সন্ধিক্ষনে এল ওদের জীবনে দুর্বার প্রেম। একে অপরের প্রতি ভাল লাগা, পেছনে পেছনে এল ভালবাসা। বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনের মতন ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওদের দুজনকেই। এ গ্রামে ও গ্রামে সারা বছর ধরে নানান পুজা পার্বণ লেগেই থাকে। বাহা, কারাম, সহরাই, পুষনা পার্বণ তো আছেই। তাছাড়া গ্রামে অনাবৃষ্টি আর খরা কাটাতে পালিত হয় দাঁশায় উৎসব। এছাড়া হুদুরদুর্গা পুজা করে মেঘকে আহ্বান জানায় ওরা সকলে।

এমনি এক দাঁশায় উৎসবের রাতে ঝুমুর নাচের আসরে প্রথম কাছে পেয়েছিল ও এই আদিবাসি সুন্দরী মেয়ে লাজবন্তীকে। পাশের নকশাগ্রামের দোসাদদের ঘরের রূপবতী আদিবাসি মেয়ে লাজবন্তী। ওর মধুর সান্নিধ্য আর শরীরী জাদুর আকর্ষণে বিমোহিত হয়ে ওর সঙ্গে সেদিন রাতভর ভেজ্জা নাচল জিতেশ। পুনর্ভবা নদীর পাশে সন্ধ্যেবেলা এভাবেই আগুন জ্বালিয়ে নাচের আসর বসেছিল সেদিনও। আগুন ঘিরে নাচতে নাচতে জিতেশ আর লাজবন্তী প্রথম ঘনিষ্ট হয়। পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে। পরস্পরকে ভাললাগার এমন উপলব্ধিতে সারা রাত ধরে ওরা ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে নেচেই যেত এক টানা। বানাম, তুমদা আর টামাকের সুর-তাল-লয়ে আর ভুয়োং-এর মন মাতানো সুরে নেশা ধরায় ওদের মনে। এ নেশা উপস্থিত গ্রামের সকলের হাঁড়িয়ার নেশাকেও ছাপিয়ে যায়। ওদের সারারাত ধরে অবিরাম নাচের সাক্ষী হয়ে থাকে আদিবাসি গ্রামের মেয়ে বুড়ো সকলেই।

এর পর দুজনেই ভেসে গেল দুর্বার এক প্রেমের জোয়ারের প্রবল উচ্ছাসে। বৃষ্টি আনার উৎসব পুষনা-পার্বণের রাতে একদিন ওদের জীবনে আসে পরম মিলন। ভালবাসার এক অবিশ্রান্ত বর্ষণমুখর রাতে মন দেয়া-নেয়া হয়ে গেল ওদের। উদ্দাম ভালবাসার আর ভাললাগার এক উত্তাল ঢেউয়ে দুজনেই বাধাহীনভাবে গা ভাসিয়ে দিল ওরা। এরপর থেকে রোজ ওরা মিলিত হত। নেশার ঘোরের মতো একে অপরের সান্নিধ্য চাইত সব সময়। চোখের আড়াল হতে চাইতনা একে অপরের। সে এক ভীষণ নেশা ওদের টেনে আনত রোজ। কখনও আত্রেয়ী নদীর ধারে ভাঙ্গা শিব মন্দিরটার আড়ালে, কখনও অন্য কোনও পার্বণের রাতে লোকচক্ষুর আড়ালে শুধু ওরা দুজনে মিলিত হত। দুটো হৃদয়, দুটো মন, দুটো শরীর মিলেমিশে এক হয়ে যেত এক দুর্নিবার আকর্ষণে।

কিন্তু পাশের পার্বতী গ্রামের দোসাদদের কিছু মাতব্বর ওদের এই মেলামেশাকে ভালো চোখে দেখল না। লাজবন্তীর বাবাকে মেয়ের এই মেলামেশা নিয়ে কুৎসা ছড়াতে শুরু করল। শেষকালে এই খবর সঙ্গে করে মাতব্বরকে সঙ্গে নিয়ে একদিন জিতেশের বাবা-মায়ের কাছে গেল ওরা। জিতেশের মায়ের চোখে ব্যাপারটা খারাপ কিছু মনে হয়নি। আদিবাসিদের গর্ব লাজবন্তী দেখতে খুবই সুন্দর। মেধাবি তো বটেই। খুব ভাল মেয়ে ও। জিতেশের মায়ের ভাল লাগে ওকে। হলই বা ও আদিবাসি মেয়ে। ওর রুচিবোধ, ওর সুন্দর মন আর লোকের সঙ্গে কোমল ব্যবহার আর পাঁচটা ভালো মেয়েদের থেকে কোন অংশে কম না। বেশ বুদ্ধিমতিও। স্থানীয় স্কুলেও পরীক্ষায় বেশ ভালো ফল করে প্রতিবারই। জিতেশের সঙ্গে মানাবেও বেশ ভালো। ওদের মধ্যে বেশ ভাবও আছে। জিতেশের মা এসব লক্ষ্য করেছিল। দোসাদদের মেয়ে হলেও মনে-মনে লাজবন্তীকে মেনে নিতে একদমই দ্বিধা হয়নি ওর মায়ের। কিন্তু বেঁকে বসল জিতেশের বাবা। এক গ্রাম্য আদিবাসি মেয়েকে জিতেশ বিয়ে করবে এটা উনি ভাবতেই পারতেন না। জিতেশের মা ওর বাবাকে বোঝাবার শত চেষ্টা করেও কিছুতেই রাজি করাতে পারেনা। এদিকে জিতেশ আর লাজবন্তী পরস্পরকে ছাড়া কিছুতেই বাঁচতে পারবে না জানে। আগত যৌবনের দোরগোড়ায় আসা ওদের দুটো প্রাণই তখন দারুন আবেগ আর উচ্ছ্বাসে সব বাধাকে তুচ্ছ করার জন্য প্রস্তুত।

প্রেমের অবাধ স্রোতে ভাসতে থাকা দুটো ছেলে-মেয়েকে আলাদা করার জন্য এবার মোক্ষম চালটা চাললেন জিতেশের বাবা। উপরওলা সাহেবদের ধরে হঠাৎ করেই নিজের ট্র্যান্সফার চেয়ে নিলেন আপন জায়গা হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথে। একটা আদিবাসি সাঁওতাল মেয়ের সঙ্গে ওনার একমাত্র ছেলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বীজটাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেবার কাজটা সফল হয়ে গেল ওনার। ব্যাস, জিতেশকে বালুরঘাট ছাড়তে হল ভেঙ্গে পরা হৃদয় নিয়ে। লাজবন্তীর পৃথিবী সেদিন থেকে ঝাপসা হয়ে এল চোখের জলে। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দিন শেষ বারের মতো দেখা হয়েছিল ওদের।

সেদিন অসহায় বুকফাটা বেদনা আর অশ্রুভরা হাহাকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দুটো নিস্পাপ হৃদয়ের গভীর প্রেম। দুজনেই ভীষণ কেঁদেছিল সেদিন। রক্তাক্ত দুটো হৃদয় চোখের জলে চির বিদায় নিল চিরদিনের জন্য।

* * *

এবার নেশাটা ক্রমশ লঘু হয়ে আসছে জিতেশের। সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ অদম্য হয়ে উঠছে ওর হারানো লাজবন্তীকে ফিরে পাবার বাসনাটা। আত্রাই নদীর জলের কূলে আছড়ে পড়ার ছলাৎ-ছলাৎ জলোচ্ছ্বাসের শব্দটা যেন কান্নার শব্দ হয়ে কানে ঢুকছে জিতেশের। ফিকে হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে ওর।

আচমকা ঘোর লাগা চোখে পরিত্যক্ত ভেজ্জা নাচের আসরের চত্বরটায় নিভু-নিভু কাঠের আগুনের ধিকি-ধিকি করে জ্বলতে থাকা স্ফুলিঙ্গের আলো যেন উস্কানি পেয়ে দপ্ করে জ্বলে উঠল একবার, জিতেশকে চমকে দিয়ে। জিতেশ অকস্মাৎ দেখল সেই নিভন্ত আগুনের পাশে লাজবন্তী বসে আছে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জিতেশের। চোখ কচলে আবার চোখ মেলে দেখল ও। ঠিকই তো দেখছে ও। মুখে মধুর হাসি নিয়ে ওর লাজবন্তী বসে আছে আগুনের ধারে। সুরেলা হাসির একটা মধুর রোল তুলে বলল—“বড্ড দেরি করে তোমার কাছে এলাম জিতেশ, আমায় ক্ষমা কোরো।” জিতেশ বিস্মিত, আবেগের বশে হাত বাড়িয়ে ওকে বুকে টানার জন্য উঠে দৌড় লাগাল লাজবন্তীর দিকে। উত্তেজনা আর বিহ্বলতায় থরথর করে শরীর আর পা দুটো কাঁপছে জিতেশের। দৌড়োতে গিয়ে কী যেন একটা পায়ে জড়িয়ে নেশার ঝোঁকে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল আধ বোজা ধুঁকতে থাকা আগুনটার কাছে। আর পড়ে গিয়েই জ্ঞান হারাল লাজবন্তীর পায়ের কাছে।

কিসকু ওস্তাদ অনেক সাধ্য সাধনার পর জ্ঞান ফেরায় জিতেশের। জ্ঞান ফিরতেই জিতেশ উতলা হয়ে খুঁজতে থাকে ওর লাজবন্তীকে। কিসকুর হাত দুটো ঝাঁকিয়ে উত্তেজিত হয়ে জানতে চায়—“লাজবন্তী কোথায়, লাজবন্তী!” কিসকুবুড়ো জিতেশের মাথাটা ওর নিজের কোলের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে—“লাজবন্তী তো বহুদিন আগেই এই দুনিয়া ছেইড়ে চইলে গেছে রে! ও আত্রাই-এর জলে নিজেকে শেষ কইরে দিছে। চিতার আগুনটার ভিত্রে সেদিন ছাই হইয়ে গেইলো ওর দেহডা। তোমরা বালুরঘাট ছাইড়বার দুই মাসের মাথায়। তোমরা চইলে যাইবার পর উর বাবা-মা উকে বিহা দিইছিল জবরদোস্তি। কিন্তুক সে বিহা ভেইঙ্গে গেছে। লোকটা একদমই ভাল ছিল না রে। উকে রোজ মাইরধোর কইরত। বাপের বাড়ি চলি এইসছিল লাজবন্তী। কিন্তু উর বাপ-মাও বিহা হওয়া মেইয়েডাড়ে ঠাঁই দিলোনি শেষকালে উদের বাড়িতে। মেইয়েডা শেষ-মেশ জলে ঝাঁপ মাইরল একদিন, আর উইঠল না, উইঠল শুধু উর দ্যাহ।” বলেই হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল কিসকু। সেই কান্নার রোল নিভু নিভু আঁচের আগুনের স্ফুলিঙ্গের সঙ্গে মিশে সেই নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতাকে দলিত করে ঊর্ধ্বে উঠে ভোরের ছোঁওয়া পাওয়া আকাশের দিকে ধাবমান হল। আর জিতেশের বুকফাটা কান্না আর আর্তনাদ সেদিন ভোর রাতে শুধু কিসকুই শুনেছিল। জিতেশ ওর অবহেলায় ফেলে যাওয়া প্রেমকে কুড়িয়ে নিতে এসেছিল আবার এই গ্রামে, এত বছর পরে। কিন্তু রিক্ত-নিঃস্ব হয়েই রইল ওর বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া হৃদয়টা। আর সেই আত্রাই নদী তার উদ্দাম জলোচ্ছ্বাস আর নদীর ঘাটে আছড়ে পড়ার শব্দ দিয়ে ওর রোদনের আর্তনাদ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। সবটুকু আগুন নিভে গিয়ে পোড়া কাঠগুলো ধোঁয়া ছাড়ছিল তখন। গুম হয়ে যাওয়া সেই রাতে একঝাঁক রাতচরা পাখি হঠাৎ ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল উন্মত্ত আত্রাইয়ের দিকে।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দীপক রায় কর্মসূত্রে সাড়ে তিন দশক ধরে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পৃথিবীর নানা দেশের অসীম-সাগরের নীল জলরাশির নোনা জলে অভিজ্ঞতার ঝিনুক-খোলের ভেতর থেকে কুড়িয়ে এনেছেন বহু অজানা তথ্য, বিভীষিকাময় ঘটনা, চাঞ্চল্যকর তথ্যের মুক্তোরাজি। সেসব প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন