২০১৪ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে কেরিয়ারের শুরু। এরপর ২০১৬ তে বাঁকুড়া মিমসের মাধ্যমে অন্তরালে থেকেও প্রথম জনপ্রিয়তার আস্বাদ। তারপর ইউটিউব চ্যানেলে আরও নানা শোয়ের মাধ্যমে ক্রমশ নিজের নামে পরিচিত হয়ে ওঠা। এবং এসবেরই পরিণতিতে ২০২০ তে লকডাউন পর্বে ঘোতনের ভিডিওর ভাইরাল হওয়া। বাঁকুড়া মিমসের অচেনা এডমিন থেকে আজকের অন্যতম জনপ্রিয় কমিক চরিত্র ঘোতনের জার্নি, সঙ্গে অভিনয় এবং পরিচালনার কাজে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প, সবটাই শোনা গেল খোদ উন্মেষের মুখে।
প্রশ্ন: গত দু-তিন বছর হল সাধারণ মানুষ একডাকে উন্মেষকে চেনে। এই জার্নিটার শুরু কবে থেকে আর কীভাবে?
উন্মেষ: আমি আগে মুম্বইতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতাম। তারপর দাদুর অসুস্থতার কারণে আমাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। সেটা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস। তার আগের থেকেই আমি আর দাদা লেখালেখি করতাম। আমাদের একটা ফেসবুক পেজ ছিল ‘বাঁকুড়া মিমস’ বলে যেখানে আমরা আড়ালে থেকে পোস্ট করতাম। এই পেজটা আমরা শুরু করি ২০১৬ সালে। পেজটা খুব হিট করেছিল। এই সময় দাদা একদিন বলল ইউটিউব চ্যানেল খুলতে। তখন বং গাই, ওয়ান্ডার মুন্না, ডিজে বাপন এরা সব নতুন চ্যানেল করে বেশ নাম করেছে। বাংলা ইউটিউবার ব্যাপারটা তখন সবে শুরু হয়েছে। আমাদের ফেসবুক পেজের নামেই চ্যানেলটা শুরু করা হল। তখন আমরা একটা সিরিজ করেছিলাম যেটার নাম ছিল ‘মিনিটখানেক সঙ্গে চুমন’। এটা একটা ইন্টারভিউ শো ছিল। এখানে আমরা সেলিব্রিটি গেস্টদের ইন্টারভিউ নিতাম। যেমন ক্ষমতা ব্যানার্জি, মরেন্দ্র নদী, দার্জিলিং দত্ত, ফিলিপ ঘোষ এদের। তখন দাদা লিখত আর আমি ভিডিয়োতে থাকতাম। এরপর শুরু করি ‘সিনেমাংসের ঝোল’ বলে একটা অনুষ্ঠান। সেখানে আমি ছিলাম চম্পার বর, পাড়ার দাদা টাইপের। সে একটা ছবি দেখছে, সেটা দেখে তার কেমন লাগছে সেটাই হত রিভিউ। এরপর করলাম ‘মানুষ কী ভাবছে’। সত্যি এখন ভাবলে মনে হয় আমি ছাড়া কেউ বোধহয় এতরকম কন্টেন্ট ট্রাই করেনি। ‘মানুষ কী ভাবছে’ হোস্ট করত আমার বন্ধু সৌমিত্র। সমসাময়িক নানা জিনিস যেমন গরুর দুধে সত্যিই সোনা আছে কি না বা কোনো রাজনৈতিক নেত্রীর লেখা বাচ্চাদের কবিতা, সেটা শুনে বাচ্চারা কী বলছে, সেটাই ছিল আমাদের কন্টেন্ট। এটা কিছুটা ‘আনফিল্টারড বাই সামদিশ’ দেখে মাথায় এসেছিল। ওটা বেশ ভালো চলছিল, এইসময় এল লকডাউন। হঠাৎ করে সব বন্ধ হয়ে যাওয়াতে রাস্তাঘাটে ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার উপায় ছিল না। এইসময় আমি ঘোতন সিরিজের প্রথম ভিডিয়ো বানাই। ২০২০ সালে এই সিরিজের প্রথম ভিডিয়োটাই মানুষের পছন্দ হয়। ভাইরাল হয়েছিল ওটা। সেই ‘ঘোতন সিরিজ’ এখনও চলছে। এরপর লকডাউন একটু শিথিল হলে আবার যখন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া শুরু হল তখন ‘যদুবাবুর টিউশনি’ সিরিজ শুরু করলাম।
প্রশ্ন: তার মানে এটাই এখন তোমার পেশা। এর বাইরে গিয়ে চাকরির চেষ্টা করেছ কি কখনো?
উন্মেষ: চাকরি ঠিক নয়, তবে আমি প্রচুর ইন্টার্নশিপ করেছি। কলেজে পড়ার সময় ২০১৪ সালে পরিচালক জুটি রাজদীপ পাল-শর্মিষ্ঠা মাইতির সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। সেটাই আমার কেরিয়ারের শুরু বলা যায়। এর পরেও মুম্বইতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। চাকরি করার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। আর মুম্বইতে কাজ করে এসে কলকাতায় ফিরে আবার শূন্য থেকে শুরু করার ইচ্ছে হয়নি আর।
প্রশ্ন: পেশা হিসেবে এই কাজটাকে কেমন বলবে? নিশ্চিন্ত হওয়া যায়?
উন্মেষ: আমি বলব সিরিয়াসলি করতে পারলে অন্য যেকোনো পেশার মতোই এটাকেও দেখা যায়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে অফিস যাওয়ার মতো এখানেও প্রতিদিন নতুন কন্টেন্ট নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। অফিসে যেমন বসের বকুনি খেতে হয় তেমন এখানে আমার বস আমার দর্শক। তারা আমার কাছে কী চাইছে সেটা মাথায় রাখতে হয়। তাদের আমি কোনো অবস্থাতেই নিরাশ করতে চাইব না। শুরু থেকেই দর্শকদের প্রচণ্ড সাপোর্ট পেয়েছি। তাই তারাই আমার বস।
প্রশ্ন: যদি ইনফ্লুয়েন্সার না হতে তাহলে পেশা হিসেবে কোনটাকে বেছে নিতে?
উন্মেষ: পরিচালনার কাজে থাকতাম অবশ্যই। সেই কাজটা করতে চাই বলেই আগে নিজের একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছি ইউটিউবের মাধ্যমে। গত বছর একটা শর্ট ফিল্ম করেছি। পরবর্তীকালে বড়ো আকারে কাজ করতে চাই। শুরুতে হয়তো মজাদার কিছুই ভাবব সেক্ষেত্রে কারণ আমার দর্শক আমার থেকে সেটাই আশা করেন।
প্রশ্ন: এক একটা কন্টেন্ট কীভাবে তৈরি হয়? যেমন ঘোতনের পারিবারিক নানান ঘটনাগুলো, চারপাশের জগৎ থেকে উদাহরণ নিয়ে, না কি একেবারে আলাদা কিছু ভাবার চেষ্টা থাকে?
উন্মেষ: যখন যে ঘটনাগুলো চারপাশে ঘটতে দেখি সেখান থেকেই আইডিয়া আসে। যেমন অনন্ত আম্বানীর বিয়েতে জাস্টিন বিবার কয়েক কোটি টাকা নিয়ে গান গাইতে এসেছে। সেটা শুনে ঘোতনের বাবার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এইভাবে ভাবি আমি।
প্রশ্ন: সচেতনতা, স্যাটায়ার, না কি সারকাজম কোনটা উদ্দেশ্য থাকে একটা ভিডিয়ো বানানোর পিছনে?
উন্মেষ: আমার কন্টেন্ট মূলত স্যাটায়ারধর্মী। সেটা যে সবসময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয় তা নয়। ওটা কিছু ক্ষেত্রে আপনিই হয়ে যায়। একটা বড়ো কোনো ঘটনায় আমাদের বাড়ির লোকজন কীভাবে উত্তর দেবে বা তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা লিখতে গিয়ে ওটা এসে যায়।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
প্রশ্ন: এই স্যাটায়ার মানেই তো বিশেষ কোনো ঘটনা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক একটা বক্তব্যকে কৌশলে পেশ করা। সেটা করতে গিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়? কারোর গায়ে লাগে কি, বা কেউ কি বিরোধিতা করেন?
উন্মেষ: বেশিরভাগ মানুষই ভালো বলেন, প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ। যেমন আমি অনেক বিখ্যাত মানুষকে নকল করেছি, তাঁরা কিন্তু খুব প্রশংসা করেছেন দেখা হলে। এবার যেকোনো বিষয় নিয়ে বললেই কারোর-না-কারোর গায়ে লাগবেই। আর এখন কিছু মানুষ ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে আসে নিজের ফ্রাস্ট্রেশন মেটাবার জন্য। তারা আক্রমণাত্মক কথা বলতেই ভালোবাসে। ওগুলো নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।
প্রশ্ন: তোমার তৈরি বিখ্যাত চরিত্র ঘোতনের মা যিনি বিজাতীয় খাবার বা অচেনা কিছু দেখলে অদ্ভুত সব মন্তব্য করেন তিনি কি আসলে উন্মেষেরই মা? চরিত্রটা কি নিজের মাকে দেখেই বানানো?
উন্মেষ: অবশ্যই, আমার মা আর আমার জ্যেঠিমা এই দু-জনকে দেখেই মায়ের চরিত্রটা তৈরি করেছি। ওরা দু-জনেই খুব সরল মানুষ। ঘোতনের মাও তাই। ওদেরকে যেমন দেখেছি বা দেখছি সেটাই আমার কন্টেন্টে আসে।
প্রশ্ন: এই যে প্রতিদিন ভিডিয়ো বানানো এবং পোস্ট করা, কতটা টেনশন বা স্ট্রেস হয়? দর্শক আদৌ দেখবে কি না, রিচ পাবে কি না, এসব মনে হয়?
উন্মেষ: অবশ্যই। দৈনন্দিন জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার এলগোরিদম যেভাবে পালটে পালটে যাচ্ছে তার সঙ্গে তাল রাখা মুশকিল হয়ে যায়। গতবছর ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে এক মিনিটের ভিডিয়ো বেশি লোকে দেখছিল। আমরা ইউটিউবকে সরিয়ে রেখে ফেসবুক ইন্সটাতে বেশি সময় দিতে থাকলাম তখনই আবার এলগোরিদম পালটে দিয়ে বলা হল তুমি এবার ইউটিউবে তিন মিনিটের ভিডিয়ো বানিয়ে মানুষকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারো। এবার আমরা কিছুটা কনফিউশনে আছি যে তিন মিনিটে আমরা কী দেব দর্শকদের।
প্রশ্ন: ইউটিউবার হিসেবে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি কতটা বলে মনে হয়?
উন্মেষ: অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। রাস্তাঘাটে মানুষ চিনতে পারেন। ছবি তোলেন, কথা বলেন। এগুলো অবশ্যই প্রাপ্তি। অপ্রাপ্তি সেভাবে কিছু নেই। সবটাই তো পাওয়া, যা কিছু পেয়েছি এই কাজ থেকেই পেয়েছি।
প্রশ্ন: একজন ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কোনটা, নতুন নতুন আইডিয়ার, না কি বাজেটের?
উন্মেষ: প্রতিদিন কন্টেন্ট তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। আগে আমি একমাস ধরে স্ক্রিপ্ট লিখে একটা বড়ো ভিডিয়ো বানাতাম। এখন ইন্সটাতে এলগোরিদম ভীষণ ফাস্ট। প্রতিদিন রিল দিতে পারলে তবেই রিচ ঠিক থাকবে। তাই প্রতিদিন আমাকে নতুন কিছু ভাবতে হচ্ছে। সেটা অবশ্যই বেশ কঠিন কাজ।
প্রশ্ন: এই পেশায় থাকার কারণে কখনো সামাজিক বা পারিবারিক বাধা এসেছে কি?
উন্মেষ: সে তো এসেছেই। পারিবারিক দিক দিয়ে কিছুটা তো থাকেই। যতদিন না একটা স্থায়ী উপার্জন শুরু হচ্ছিল বাবার খুব চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে, যেটা স্বাভাবিক। আর পাড়া প্রতিবেশীদের দিক থেকে তো বরাবরই ছিল। আমি যে-জায়গার ছেলে সেই বাঁকুড়া হচ্ছে পড়াশোনার জায়গা। প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাঁকুড়া থেকে কয়েকজন র্যাঙ্ক করেই। সেই জায়গার ছেলে হয়ে যখন আমি স্কুল পাশ করার আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম চিরাচরিত সায়েন্স কমার্স নিয়ে পড়ব না তখন থেকেই আমি সকলের তাচ্ছিল্য দেখে আসছি। তাই ওটা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: একজন ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে কতটা সামাজিক দায়িত্ব থাকা উচিত বলে মনে হয়? কমেডির ছলে কি যা খুশি বলা যায়, না কি কোথাও একটা সীমারেখা টানা দরকার?
উন্মেষ: না, যা খুশি কখনোই বলা যায় না, আর সেটা শুধু ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে নয়। সাধারণ মানুষ হিসেবেই মনে করি। কোথায় কী বলছি সেই সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার প্রত্যেকের। কিন্তু গণ্ডি টানা প্রসঙ্গে আমি বলব সমাজের অনেক উঁচুতলার মানুষ অনেক সময় এমন মন্তব্য করেন যেটা তাদের করা উচিত নয়। সামাজিক দায়িত্ব কথাটা যদি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয় তাহলে একজন ইনফ্লুয়েন্সারকে কেন শুধু শুধু দায়ী করা হবে? দায়িত্ব থাকলে সকলেরই সেটা সমান থাকা উচিত।
প্রশ্ন: নতুন ইউটিউবার যারা এই একই পেশায় যুক্ত হচ্ছে তাদের কী পরামর্শ দেবে?
উন্মেষ: একটাই কথা বলব যে এই প্ল্যাটফর্মটাকে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জায়গা না ভেবে যদি নিজের বক্তব্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরা যায় তাহলে অনেক বেশিদিন ধরে মানুষের মনে টিকে থাকা যায়। প্রথমেই টাকা আসবে এটা ভাবলে ভুল হবে। লেগে থাকতে হবে, হাল ছাড়লে চলবে না।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
Saswati Lahiri
4 দিন আগেবাঙালি ছেলেরা সাধারণত যুগ - স্রোতের বাইরে বেরিয়ে নতুন কিছুর উদ্যোগ নিতে বেশ কুণ্ঠিত থাকে। তার চেয়ে চাকরির নিশ্চিন্ত মাস মাইনে ও বসের দাসত্ব নিরাপদ বলে মনে করে। সেক্ষেত্রে উন্মেষের এমন ক্রিয়েটিভ উদ্যোগ এর সিদ্ধান্ত ও সব বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে নিজের কাজে সিরিয়াস থাকার মধ্যে ওর আত্মশক্তির অভিপ্রকাশ ঘটেছে , যা অভিনন্দন যোগ্য।