নারীবাদী লিখনপ্রক্রিয়া বইটি কেতাব-ই থেকে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। সে বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখলেন অধ্যাপক বীথিকা সাহানা।
আধুনিক কবিতার ইতিহাসে মেয়েদের কবিতা লেখার ইতিহাস খুব পুরনো নয়। তাদের লেখা সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, পুরুষের দাক্ষিণ্যে একথাও সত্য। অন্যান্য কাজের মতই মেয়েরা তাদের দক্ষতায় কবিতার ইতিহাসে পুরুষের প্রায় সমান জায়গা জুড়ে রয়েছেন, সময়ের গ্যাপ খুব দ্রুত পূরণ করেছেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখা এবং নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির লড়াই কতটা কঠিন ছিল, তা আমরা সকলেই জানি। পান থেকে চুন খসলেই, পরিবার থেকে সমাজ সকলের ‘সম্মানহানি’ হয়ে যেত, যায়। আর তার প্রতিকার হিসেবে মেয়েটিকে অপমানে তুলোধোনা করে এমন মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়া হত, হয়, যে সে আর মাথা তুলতে পারে না। মেয়েদের সৃষ্টির ক্ষেত্রও নানা সীমায়, বাধায়, ট্যাবুতে পরিবৃত। আশাপূর্ণা দেবী তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তিনি বহুদিন শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন, কারণ বড়দের বিষয় মানেই ‘রোমান্টিক সিন ফিন’ এসে যাওয়া আর সে বড় লজ্জা র কথা! প্রকৃতি, শিশু, দাম্পত্যপ্রেম, সুখী গৃহকোণ এসবই ছিল বিষয়। ফলে এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জনও দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ পেরিয়ে আসা।
‘নারীবাদী লিখন প্রক্রিয়া’ তে পাঁচজন কবির লেখার বিভিন্ন প্রক্রিয়া, উপাদান নিয়ে আলোচনা রয়েছে। পাঁচজনই মেয়ে। গিরীন্দ্রমোহন দাসী (১৮৫৮-১৯২৪), গীতা চট্টোপাধ্যায় (১৯৪৩-২০১০), কবিতা সিংহ (১৯৩১-১৯৯৮), অনুরাধা মহাপাত্র (১৯৫৭ জন্ম) এবং বল্লরী সেন। আলোচক বল্লরী সেন নিজেই। আরও চারজন কবির কাব্য-প্রক্রিয়া শৈলী উপাদান পদ্ধতি আলোচনার পাশাপাশি তাঁর নিজের লেখাও রয়েছে। সমগ্র বইটির লেখক হিসেবে তাঁর অবস্থান একটু দূরে, আর কবি হিসেবে, আরও চারজন কবির পাশে তিনি নিজেই বিষয়। আর দৃষ্টিভঙ্গি, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাকে সরিয়ে রেখে সাহিত্য পাঠ এবং সমালোচনা।
গিরীন্দ্রমোহনীকে নিয়ে এর আগে আলোচনা করেছেন, দীপ্তি ত্রিপাঠী। তিনি বলেছেন― গিরীন্দ্রমোহিনী লিরিক্যাল কবি। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার মিশ্রণ ঘটেছিল তার মধ্যে, যা তাঁর শৈলী এবং বিষয়কে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়াও দীপ্তি ত্রিপাঠী আলোচনা করেছেন, তাঁর কবি সত্তার উন্মেষ প্রসঙ্গে, স্বামীর সহযোগিতার কথা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা। বল্লরী সেন সেসব সংক্ষেপে বলে সরাসরি তাঁর কবিতার আলোচনা করেছেন। গিরিন্দ্রমোহিনীর কবিতায় যৌনতার উন্মেষের কথা বলেছেন, ‘ইন্টেলেকচুয়াল এক্সট্যাসির’ কথা আলোচনা করেছেন। গিরিন্দ্রমোহিনীর কবিতায় আত্মনির্মাণের ধারাবাহিক আলোচনায়, তাঁকে ‘এক্টিভিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
অনুরাধা পাত্রের কবিতা এবং চমস্কির রাজনীতি, সমাজ ভাষা ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনা নিয়ে অধ্যায়― ‘অনুরাধা মহাপাত্র এবং চমস্কিঃ একটি কাল্পনিক কথোপকথন’। কাল্পনিক আসলে নয়, কারণ অনুরাধা মহাপাত্রের কবিতায় সরাসরি চমস্কির সঙ্গে কথোপথন আছে। শুধু চমস্কি নয় আলোচনা প্রসঙ্গে এসেছেন অন্যান্য তাত্ত্বিক এবং তাদের তত্ত্বের কথা― হেরাল্ড ব্লুম, লেকফ প্রমুখ। মেয়েদের কবিতার ভাষা নিয়ে স্বতন্ত্র গবেষণার বীজ এই অধ্যায়টি।
‘গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা: কাব্য শরীর পাঠ’ অধ্যায়ে ‘কাব্য শরীর’ আলোচনায় বল্লরী লক্ষ্য করেছেন,― পুরুষের লিখন প্রবাহকে গীতা অস্বীকার করেছেন, তাঁর কবিতা বুঝতে উল্লেখ করেছেন নির্দিষ্ট তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কথা। গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্যের বিস্তৃত আলোচনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তপোব্রত ঘোষও তাঁর ফেসবুক পোস্টে গীতার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বল্লরীর আলোচনা সেই ধারার সংযোজন সঙ্গে অভিনব।
‘কবিতা সিংহের ক্রূরগামিতা’ অধ্যায়ের শব্দটি কবিতার কবিতা থেকেই নেওয়া। পৃথিবীতে নিজেদের নারী-পরিসরের দাবি তাঁর অনেক কবিতার বিষয়।
উপরোক্ত মেয়েকবিদের কবিতা আলোচনার পাশাপাশি এবং শেষে রয়েছে বল্লরী সেনের নিজস্ব গদ্য/কবিতা। বিষয়― বাইরের এবং ঘরের একান্ত পরিসরকে মেয়ের দৃষ্টিতে দেখা, আত্মানুসন্ধান এবং নারীবাদের অনুশীলন। নারীবাদী হিসেবে পরিচিত হওয়া নয়, অন্তরে নারীবাদকে গড়ে তোলার দিকে নজর দিয়েছেন বল্লরী সেন। সাহিত্যিক আন্দোলন, বিভিন্ন সমালচনা পদ্ধতি, তত্ত্ব সেগুলিকে আরেকবার কাব্যশরীরের সঙ্গে মিলিয়ে পড়েছেন, সংযুক্ত করেছেন, প্রয়োজনে বাতিল করেছেন। এর সঙ্গে আছে বল্লরী সেনের নিজস্ব ভাষা শৈলী― যেভাবে তিনি বাংলা বাক্যের মধ্যে ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করে, তাকে বাংলা বাক্যের সঙ্গে সাবলীলভাবেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। দু একটা উদাহরণ দিই― ‘সে ধারায় গিরীন্দ্রমোহিনীও নাম রেজিস্টার করিয়েছিলেন’, ‘পাহাড় কান্নার লবণ আর প্যারাসিটামল’ ইত্যাদি। শিরোনাম নামগুলিও আধুনিক তথা অভিনব― ‘কোভিডসম্ভব ১৯’, ‘২য় মাস কোয়ারেনটাইন বর্ষ ২০১৯’, ‘চিনচর্চিতনীলকলেবর’ ইত্যাদি। বইটি পাঠকের কাছে নারীবাদের পরিসরে পাঁচজন মেয়ে কবির কাল্পনিক কথোপকথন হয়ে উঠেছে। পাঁচ নয় আসলে ছয়জন, পাঠকও এই আলোচনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী।
কেতাব-ই একটি অভিনব প্রকাশনী সংস্থা, তাদের উদ্যোগ আধুনিক এবং অভিনব। অ্যাপের মাধ্যমে প্রযুক্তির সাহায্যে আধুনিক পাঠকের মোবাইলে বই পৌঁছে যাচ্ছে; পাঠক বই পড়ছেন সুবিধেজনক এবং সহজলভ্য পদ্ধতিতে। কেতাব-ই যে ‘নারীবাদী লিখন প্রক্রিয়া’- এর মত একটি অভিনব ভাবনাসমৃদ্ধ বই পরিকল্পনা করেছে তার জন্য ধন্যবাদ।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন