“পালামৌ” ভ্রমণকাহিনি
সঞ্জীবচন্দ্র তাঁর সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় “প্রমথনাথ বসু” ছদ্মনামে
সর্ব্বপ্রথম মোট ছয় কিস্তিতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করেছিলেন। সঞ্জীবচন্দ্রের জীবৎ-কালে এই ভ্রমণকাহিনী
পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর অনুজ বঙ্কিমচন্দ্র ‘সঞ্জীবনী সুধা’ নাম দিয়ে সঞ্জীবচন্দ্রের রচনার যে সঙ্কলন
প্রকাশ করেন, তাতে এই ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ
তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে সঞ্জীবচন্দ্রের “পালামৌ”
সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
পালামৌ ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্য্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের
যে একটি অকৃত্রিম সজাগ অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে
দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের জাতির মধ্যে একটি বিজ্ঞবার্দ্ধক্যের লক্ষণ
আছে—আমাদের চক্ষে সমস্ত জগৎ যেন জরাজীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সৌন্দর্য্যের মায়া-আবরণ
যেন বিস্রস্ত হইয়াছে—এবং বিশ্বসংসারের অনাদি প্রাচীনতা পৃথিবীর মধ্যে কেবল আমাদের
নিকটই ধরা পড়িয়াছে। সেই জন্য অশন বসন ছন্দ ভাষা আচার ব্যবহার বাসস্থান
সর্ব্বত্রই সৌন্দর্য্যের প্রতি আমাদের এমন সুগভীর অবহেলা। কিন্তু সঞ্জীবের অন্তরে
সেই জরার রাজত্ব ছিল না। তিনি যেন একটি নূতনসৃষ্ট জগতের মধ্যে একজোড়া নূতন চক্ষু
লইয়া ভ্রমণ করিতেছেন। “পালামৌ”তে সঞ্জীবচন্দ্র যে, বিশেষ
কোনো কৌতূহলজনক নূতন কিছু দেখিয়াছেন, অথবা
পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু
সর্ব্বত্রই ভালবাসিবার ও ভালো লাগিবার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। “পালামৌ” দেশটা
সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্বল্যমান চিত্রের মতো প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবোধ থাকিলে জগতের সর্ব্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্য্যের
সুধাভাণ্ডার উদ্ঘাটিত হইয়া যায় সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন,
এবং তাঁহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ
যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছে—কৃষ্ণবর্ণ কোলরমণীই হৌক্, বনসমাকীর্ণ
পর্ব্বতভূমিই হৌক্, জড় হৌক্, চেতন
হৌক্, ছোট হৌক্, বড় হৌক্ সকলকেই
একটি সুকোমল সৌন্দর্য্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে।
বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া