কার কাটা মাথা? ভূতই বা কার? কে দেখল আর কাকেই বা ধরলো গো? ভূত দেখা থেকে ভূত ধরা এক দীর্ঘ বকমবক। নজর থাক আনাচে কানাচে। চাই কি ভয় পেলেও পেতে পারে!
রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেরা এই ঘটনায় একটু নড়েচড়ে বসে। এ জাতীয় ঘটনা গত একশ বছরে এ গাঁয়ে ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারে না। এমন ঘটনা উচিত কিনা তা নিয়ে বিচারে গাঁয়ের লোক অঁটাজলে। তার মধ্যে অঁকবকাইলে তাদের লাইকুটু গায়েব হয়, দুদু গায়েব হয়, গলার ডিম যাই যাই করে। কিন্তু নড়াচড়া থামে না। এমন একটা ঘটনায় গাঁয়ের ঘোষপাড়া, মাজিপাড়া মিলে নাক উপরের দিকে তোলে, আর জোরে জোরে শ্বাস নেয়। সেই শ্বাসের মধ্যে দিয়েই ঘটনাটির গা থেকে আসা বিস্কুটের গন্ধ তাদের নাক ও চোখের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঘটনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তাদের জলের অভাব আর গতরে ফোটে না। বরং ঘটনার মোড় খতিয়ে তারা ডুবে থাকার আরাম মেহসুস করে। আর সে বিস্কুটও তো যে সে না। আজকাল অবশ্য এমন সুগন্ধি বিস্কুট আকছার মেলে। অ্যামাজন আছে, মোর সুপারকমপ্লেক্স, তবে কথাটা কী, রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোক এখনও নিরাপদর দোকান থেকে ধারে জিনিস তুলতেই বেশি স্বস্তি বোধ করে। সেই স্বস্তির অনেকখানি উবে যখন এমন একটি অভাবীত ঘটনার আভাসে লিমটেক্স বিস্কুটের পরিচিত গন্ধ তাদের ঘরে অথবা স্মৃতিতে ফিরে আসে। বাইরে থেকে উড়ে আসা সুগন্ধি বিস্কুটের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অনেক আগেই বিস্কুটের সুগন্ধের সঙ্গে তারা পরিচিত হয়। সে কি আজকের কথা! দেন্দুয়া হয়ে কালীতলার দিকে যেতে রাস্তা থৈ থৈ বিস্কুট আর বিস্কুট, এবং, ঠিক তার পরেই, স্পঞ্জ আয়রন কারখানার গন্ধের সাম্রাজ্য। ভগবানের বিচারে কুটুম বাড়ি যাওয়ার সময়, বিস্কুটের গন্ধের কোনও স্মৃতি থাকে না যাতে গাঁয়ের লোকে দুটি ভালো কথা সে সম্বন্ধে তাদের বলতে পারে। কিন্তু নিজের গাঁয়ে ফেরে তারা ভরপুর বিস্কুটের গন্ধ নিয়ে। ঘোষেরা বলে স্পঞ্জ আয়রন গন্ধের চোটে একবার নাকি প্রকাশের একটা গাভীন মোষ পর্যন্ত ছোটা হাতিতেই বিইয়ে দেয়। তারপর সেই পেটে মোষ বিয়ানো হাতি পরিষ্কার করতে আরও সাড়ে সাতশোটি টাকা গচ্ছা! তবে এই অচিন্তনীয় ঘটনার হালে বিস্কুটের গন্ধ নিয়েই খঁচাখুঁচি হয় বেশি। এমনকি স্পঞ্জ আয়রনের হাতির পেটে মোষ বিয়ানো বাঁজখাই দুর্গন্ধের প্রসঙ্গও রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেদের লিমটেক্স বিস্কুটের স্মৃতিকেই বেশি দড় করে। সেই নরম গলা গন্ধের কথা বলতে বলতে তাদের জিভ ভিজে আসে। নাকের নিচে জমে ঘাম। চোখে কুয়ার অতল ঘাই। বিস্কুটের কথাকুটো উঠলে অসীম মাজির কথাটাও উঠে। গাঁয়ের ঘরজামাই অসীমের কেবেল ব্যবসা। কী যে কেবেল সে তার ইয়াই জানে, হেই সকালে লাইন নাই, তো ওই সাঁঝে সিরিয়াল চলে না। নেট চলে না। ফোনে হঁ অসীম, বাবা, অল্প চালাইন্দে বাবা, গোয়েন্দা গিন্নি শেষ হইথে চইল্ল তো, সে চইল্ল তো চইল্লই। অসীমের পাত্তা নাই। ‘হঁ করছি’ বলে ফোন রেখে সে চণ্ডীমণ্ডপে খাটিয়ায় বসে ইয়ার-দোস্তোদের লিমটেক্সের বিস্কুট খাওয়ায়, নিজেও খায়। খেতে খেতে নাকি একবার সে জানায়, স্বাদ এমন কিছু আহামরি না, তবে যা নরম গন্ধ, মনে হয় মাগির দিনে একবার পিছন মারি, রাতে একবার পিছন মারি। যদিও এই জাতীয় ঘটনার সঙ্গে পিছন মারার যোগ সরাসরি আছে কিনা রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেরা তা ঠিক ভেবে পায় না। বরং কথাখানি ঘুরিয়ে তারা অসীমের কেবলের উপর ব্যবহার করে। এই অসীম মাজির বৌ পরমা, কাঁকন মাজির বড় মেয়ে, একদিন জিতেন তিওয়ারি বাড়ির সামনে পঞ্চায়েত থেকে বসানো টিপকলে যায়। সে যাক। গোটা পাড়াই যায়। বর্ষার দিনে কুয়া খটখটা। জলই হয় নাই। সে আর এমন কি! কিন্তু জল নিয়ে ফেরার পথে গেটের ওপারে তার চোখে পড়ে। তাথে চোখ পালোটে ‘অ মা গ’ বইলে কলোসি ফেলায় সে বেটি দেএদ্দৌড় ঘরকে। গড়াতে গড়াতে সে কলোসি গিয়ে ঠেকে জিতেন তিওয়ারির বাড়ির গেটে। মাটি ছেনে ঘাম বুনে তুলে আনা জল ঢুকঢুক করে উচ্ছুগ্গু হয়ে যায় গাঁয়ের শেষ বাউন বাড়ির টালি বাঁধানো দোরগোড়া পিছলা করতে। সে বেটিকে সবাই শুধায়, কী হৈঞ্ছে রে? কী? কী হৈল রে? অ পরমা! পালালি ক্যানে? জবাব দেয় না। কিছুতেই কলোসি আনতে যায় না। বিকাশ ঘোষের বড় বেটা এনে দিলেও ঘরে তুলতে চায় না। শেষে অনেক কষ্টে অসীম মাজির শালি কথা খানিক উদ্ধার করে। তখন গাঁয়ের লোকেরা জানতে পারে, জল নিয়ে ফিরে আসার পথে পরমার চোখ যখন গেট টপকে কয় মুহূর্ত ওইপারে ঘোরাঘুরি করছিল, তখন এক ভয়ানক দৃশ্য তার চোখে পড়ে। যদিও অসীম মাজি তা শুনে মন্তব্য করে, এবং সেই মন্তব্যের গা ধরে গাঁয়ের লোকেদেরও মনে হয়, যে সে ঘটনা এমন কিছু নতুন না। এমন জিনিস গাঁয়ে আকছার হয়। ফলে সে কলোসির কানা ধরে পরমার বুনের ঘরে তুলে নিতে কোন কষ্টই হয় না। পরমা জানায়, কানাই মন্ডলের বেটা রতন, বাড়ির পুবদিকে ঘরগুলার পিছনে যে জঙ্গল, সেখান থেকে বেরায় আসে এবং বেরায়ে এলে পরে পরমা দেখে ধড়টা রতন মণ্ডলের হলেও মুণ্ডুটা তার নিজের না। এক বুড়ার ভয়ানক মুণ্ডু কেউ জোয়ান দেহে জুড়ে দিয়েছে। রতন মণ্ডলের নাভির পাশে একটা জড়ুল, তাই দেখেই পরমা রতন বলে চিনতে পারে। আসলে জল বইতে বইতে অল্প ঝুঁকে থাকার কারণে জড়ুলটাই তার আগে চোখে পড়ে। পরে উপর দিকে নজর ঠেললে মুখের জায়গায় যে মুখটি দেখে তা পরমার চেনার কথা না। তবে সেই মুণ্ডু দেখে তার গায়ের মাটি গুলায়ে আসে। বুক থেমে যায়। সেই চোখ যেন বরাকরের পাথর। ধারে ভারে গাঁইথে আঁতে। তার বর্ণনায় গাঁয়ের লোকেরা নিশ্চিন্ত হয় যে এ অমল তিওয়ারি ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। তখন অসীম মাজি আরও জানায়, যে এই রকম একটা কিছু যে ঘটবে তা সে আগে থেকেই টের পেয়েছিল। এমন কি সে নাকি রতনকে সাবধানও করেছিল। কিন্তু যার কপালে যেই ট লিখা! বুঝলে নাই! আমরা তো লিমিত্ত বৈ লই। খণ্ডাবে কী কইরে! বলতে বলতে কলোসিতে কাঁচা গোবর ডলে অসীম মাজি।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে যখন রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকে এক আনকোরা ঘটনায় নড়েচড়ে বসে, সেই নড়নচড়নের রাতে রতন তার কাজচলা নতুন বাড়িতে ইয়ুথ ক্লাবের বন্ধুবান্ধব ডাকে। রান্নাঘরের দরজা লাগে নাই তখনও। ওয়েরিং-এর কাজ হয়েছে আধখানা। বাইরের যাবতীয় তার ঢুকিয়ে দেওয়া গিয়েছে ভিতরে কিন্তু তখনও ঠিকঠাক সেট হয় নাই। একটা পুরান পাখা ছাড়া যাবতীয় পাখা কেনা বাকি। কাজ চালানো দু একটা আলো। বাকি একেবারে ওয়েরিং-এর পর রঙ পড়লে কিনবে। অন্ধকারে ফ্যাঁসফেঁসে রান্নাঘরের চৌকাঠে ঠেস দিয়ে বসে তারা আইকনিক হোয়াইট খায়, পার্টির কথা বলে। সেই সময়, সেই খোলা ঘরের সামনে বারান্দার গ্রিলের দিকে পিছন ঘুরে বসে বিশু ভাণ্ডারি জড়ানো ভেজা গলায় তার পুষে রাখা বিরক্তি উগরেই ফেলে। “এবারেও হল না! এতদিন ধরে খেটেখুটে…সব বাঞ্চোত কাকে নিয়ে গেল!” অন্ধকার এবং খোলা রান্নাঘরের দিকে মুখ করে অথবা রান্নাঘরকে উদ্দেশ্য করে বিশু ভাণ্ডারি যখন এই কথা বলছিল, তখন তার মাথার একপাশে বড় চাঁদ পুড়ে যেতে থাকে। রতন সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভাসতে ভাসতে হাতের তালু এবং পিছন দিয়ে নাকমুখ মোছে কয়েকবার। একটু ফুটে ওঠার চেষ্টা করে। ডানপাশে বাবু জোছনায় নখকুনি খুঁটতে খুঁটতে বলে, “ব্লাড ক্যাম্পটা সেই কয়েক বছর থেকেই ঝোলাচ্ছে! সবাই খাচ্ছে, আমরা হাঁ করে বসে আছি বাঁড়া। ও মুকুল ভটচাজের আমি গাঁড় ভেঙ্গে দেব!” রতনের এতে হাসি পায়। চাঁদের আলো বেয়ে সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ে আইকনিক হোয়াইট বোতলের গায়। কে কার গাঁড় ভাঙে তা টের পাওয়াও এক মহাজগতিক ব্যাপার। এতগুলো টাকা! একটি বার করে ফেলতে পারলে দু-তিন বছর আরাম। মাগামাগি থেকে রাহত। কিন্তু রাজ্য সরকারের ব্লাড ক্যাম্প কিছুতেই নাগালে আসে না। এই নিয়ে আলোচনা করতে ও মাল খেতে তাদের খারাপ লাগে না। বরং খারাপ লাগারা সেখানে বিষয় হয়ে ওঠে। ফেসবুকের আলোয় সমরের মুখটা একটু উজ্জ্বল। ছ নম্বর পেগটা শেষ করে সমর রায় ছন্দার খোঁজ করে। বৌদির খবর কিছু পেলি? হয়তো তার মনে হয় এই রকম এক বাদলার রাতে এ বাড়িতে ছন্দার থাকাটা দরকার ছিল। অথচ বিশু ভাণ্ডারির মাথার তফাতে একটানা পুড়ে যায় চাঁদ। এক্ষুনি দপ করে জ্বলে উঠবে কি? না, জ্বলে না। নির্ভার নিঃশব্দ পুড়ে যায়। এই অবস্থায় রতন নিজের না-ফোটা মুখের নিচে খানিকটা বিরক্তি টের পায়। হয়তো বা ওজনও। সেই প্রশ্নের মুখে পড়ে রতন মণ্ডল অনুভব করে যে ছন্দার চলে যাওয়াটা সে এখনও পুরোপুরি অনুভব করে উঠতে পারে নাই। অথবা চায় নাই, এও সম্ভব। কিন্তু ছেলেটাকেও নিয়ে গেল কেন? অমন ফুটফুটে ছেলে, গর্ব হয় রতনের। শ্বশুর দুপুরে ফোন দিয়ে মিনমিন করল খানিক। স্থানীয় তৃণমূলে রতন মণ্ডল পুরনো লোক বলে মুখের উপর খুব একটা কিছু বলতে পারে না। কানেকশনের কিছু সুবিধা পারিবারিক ব্যাপারও কখনও কখনও মসৃণ করে। তবে একটাই মেয়ে তো। বাপ একটু বেশি কাতর। এ কথাটা অবধি এসে ফের তার মনে পড়ে ছেলেটার জন্য বুক খাঁ খাঁ। এতক্ষণ বেশ ছিল। সমরের ওপর রতন বেশ বিরক্ত হতে চায়। পারে না। সে এখন ফুটে উঠতে পারছে না। পচে যাওয়া চোখ দিয়ে চাঁদ পোড়া চাখতে চাখতে রতন হঠাৎ এক ঝলক তৃপ্তিও অনুভব করে। বাড়িটা! হল তবে? হল কি? এতদিন ধরে কি সেই চেষ্টাই করছে না? ক্রমে তৃপ্তিবোধের অপরাধ তাকে আরও অতৃপ্তির দিকে ঠেলে। ছন্দা, সম্রাট-ওরাও তো থাকতে পারত! জিতেন তিওয়ারির একা হাতে অত বড় যৌথ সংসার! ফুটফুটে। তেজালো। রতনের বাপটাও পট করে মরে গেল! চাঁদ পোড়া ছাই আকাশে ঘন হয়ে এলে বাদলার দমছাড়া ফেনিল হাওয়া উঠান পেরিয়ে বারান্দা পেরিয়ে রতন মণ্ডলের প্রায় খালি গ্লাসের উপর পাক খেতে থাকে। এই বাড়ি কেনায় ছন্দার মত ছিল না এতটুকু। তার উপর বাড়ির কাজ শেষ হওয়া অবধি যখন রতনের তর সইল না, তার আগেই শিফট করার জন্য ব্যস্ত, তখন সে বেঁকে বসল আরও। অসম্ভব, ঐ বাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে উঠবে না ছন্দা। একদিন চূড়ান্ত ঝামেলার পর ছেলের হাত ধরে সোজা বাপের বাড়ি। আর শালা বাপের বাড়িটাও বাঁকুড়া কি পুরুলিয়া নয়, এই লালগঞ্জ। দু পা ডাবরমোড়ে গিয়ে উঠলে সোজা বাস। বিয়ের পর থেকেই এই ঝক্কি পোহাতে হয়েছে রতনকে। কিন্তু এবার একটু আলাদা। নিজের এমন একটা অ্যাচিভমেন্টে ছন্দা নাই, ছেলেটা নাই, এটা অসম্পূর্ণতা। আর অসম্পূর্ণতাকে সে ব্যর্থতার উর্বর জমি বলেই ভাবে।
কানাই মণ্ডলের ব্যাটা রতন মণ্ডল যখন দুগগামন্দিরের ওপার থেকে এসে রুপনারায়ণপুর গাঁয়ে জিতেন তিওয়ারির বাড়ি কিনে বসে, তখন গাঁয়ের লোকেরা সেই ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছিল। কানাই মণ্ডল জাতে শুঁড়ি, চাকরি করত হিন্দুস্তান কেবলস্-এ। ফিটারের চাকরি। এ গাঁয়ের সঙ্গে তার দূরদূর পর্যন্ত কোনও যোগ নাই। তবে রতন-যতন দুই ভাইকেই ন্যাংটাপঁদে দেখেছে এই গাঁ। যতন বড় রাস্তার উপর বাথরুম পায়খানার দুকান করে। দুকান দুই ভাইয়েরই কিন্তু রতন বসে না। কী করে? না সারাটা দিন শুধু টো টো করে ঘুরছে, এই ডাবরমোড় তো এই আহ্লাডি, এই আহ্লাডি তো এই আমলাদৈ, এই আমলাদৈ তো এই জিমারি, হাঁ রতন! কী কইরছিস রে? হারুদা বইল্ল তুই নর্থ-মার্কেট গেইছিলি? কী, না পাটি কইচ্ছি! সেই বাড়ির অবস্থা তেমন না। কেবলস্-এর পুরানো লোকের মাইনে ভালোই ছিল, তা সে এখনকার হিসাবে আর কত! পেনশন কিছুই নাই। কানাই মণ্ডল মরেছে। তার বৌ পায় সেই নামমাত্র পেনশন। সেই মা আর ভাইকে ছেড়ে রতন এখানে বাড়ি হাঁকালেক? তাও কোন ট? না তিওয়ারি বাড়ি! গাঁয়ের লোক এতেই নড়েচড়ে বসে। এবং নড়েচড়ে বসলে তাদের দীর্ঘদিন কালিতলা থেকে দেন্দুয়ার দিকে আসা রাস্তা-কুড়ানো গন্ধের স্মৃতিও গা মাজে। এমনকি অনুচিত ঘটনাটি থেকেও তারা বিস্কুটের গন্ধ পায়। তখন সেই লিমটেক্স বিস্কুট খাওয়া ও খাওয়ানো গাঁয়ের ঘরজামাই অসীম মাজি বলে, “এই ট এক ট ব্যাপার! রাখো তুমাদের প্যাকেট। আমি যাছি দেন্দুয়া আজ। কাজ আছে। ঠিক খবর লিঞে ফিরব!” ফিরে খবর লিঞেই, তখন রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে গন্ধটা তারা ঠিকোই পাইছিল। কেননা অসীম মাজি জানায়, লিমটেক্স বিস্কুট ফ্যাক্টরির জল ছাড়া নে পিছন গাঁয়ের কজনের সঙ্গে নাকি হেভি ঝামেলা। দু তিন বছর ধরে চলছে। কেউ গা করে নাই। এবার কী না কী জলে ছেইড়ে দিইঞ্ছে, দশজনার চাষের জমি পুরা খড়। একে বাদলা ফি বছর পিছাছেই। চাষের অবস্থা ভালো না। তার উপর আছে তলে তলে কোলিয়ারির উৎপাত। আদ্ধেকের বেশি জমি খুঁড়ে ফাঁক করে রাইখিছে ইখানে সিখানে। সে সব জমিতে চাষ চলে না। তল ফাঁপা। বালি দে ভরাট তো নাইয়োই, যে কয়লার পিলার ছেড়ে যায় কোম্পানি, মাফিয়া তাও খুঁটে খাঁটে তুলায়। তা ভাগ্যিস তুলে, নাইলে রূপনারায়ণপুরের গাঁয়ের লোকেদের কারওর বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত! বিস্কুটের মাঝে জ্বলজ্বলে কোলিয়ারির কথা তুলে ফেলে অসীম বোঝে কেসটা ঠিক হয় নাই। সে তখন সযত্নে ঐটুক ডিঙ্গায় পা ফেলে খড়ের পারা ফসলে। এবার সেই জনা দশেক তিন গাঁ লোক লিঞে যায়ে বিরাট ক্যাসেট। কুথা থেকে রতনের কাছে খবর যায় কে জানে! লোকে দেখে রতন তার তিন বন্ধুকে নিয়ে হাজির সেইখানে। দশ জনাকে ডেকে শলা, বলে, এভাবে তো হবে না, তোমাদের ওপরে বলতে হবে। তো তাদের মধ্যে জন তিনেককে নিয়ে সোজা নবান্ন। সেখানে লিমটেক্সের ম্যানেজমেন্টের লোকও যায়। বাদ-বিবাদ কিছু হয়। ফ্যাক্টরিতে তালাফালা মারার কথা ওঠে। মেরেও দেয় বোধায় কিছুদিনের জন্য। পরে রফা হয়, দশজনকে ক্ষতিপূরণ সমেত রতনকে কুড়ি লাখের একটা অফার দেয় কোম্পানি। তাতে নাকি দর কষাকষি হয় আরও কিছু। ফলে ঝামেলাটা থিতিয়ে যায়। কারখানাও আবার ঘটরং পটরং সমান তালে চইলথে থাকে। চাষবাসও চলতে থাকে। কেউ কেউ বলে রতনই লোক দিয়ে ঝামেলা লাগাইঞ্ছিল। নইলে ফ্যাক্টরির পিছনের জমিতে চাষ কত আর ফসল কত! কয়লার প্রসঙ্গে মনে জমা আলগা বিরক্তি ঝেড়ে এই কথা শুনতে শুনতে রুপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোক সন্ধ্যার উনুন ধরায়। এবং ধোঁওয়া জড়ানো জলহীন বাদলার জ্বলজ্বলে অন্ধকারে তারা এই বাড়ি কেনার রহস্যের খানিকটা যেন কিনারা করতে পারে। কিন্তু পিপাসা তাদের সম্পূর্ণ মেটে না। কারণ হাতে টাকা আসা উপায় মাত্র। অসীম মাজির এই গল্প তাদের রূপনারায়ণপুর গাঁয়ে ঘটে যাওয়া এমন অভূতপূর্ব ঘটনাটির কারণ সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলে না। বরং গাঁয়ের লোকে বলে বিস্কুটের সঙ্গে যে এই বাড়ি কেনার যোগ আছে তা তারা আগেই টের পেয়েছিল। জামাই আর এমন কী নতুন কথা বলল! এই আলোচনা ঘুরেফিরে ফের অসীম মাজির কানে যায়, এবং খাটিয়া থেকে বিস্কুট বিতরণ করতে করতেই সে আরেকবার কারণ উদ্ধারের জন্য উঠে পড়ে লাগে, আর মনে মনে বলে, শালার শ্বশুরবাড়ি!
অসীম মাজি এই কথাটি মনে মনে বলার কিছুদিন পরে যখন একদিন দেরিতে আগত বাদলার এক সন্ধ্যায় অন্ধকারে কাজ শেষ না হওয়া নতুন ঘরের বারান্দায় বসে বসে রতন তার বন্ধুদের সঙ্গে মদ খাচ্ছিল, তখন ছন্দার না থাকাটা এক মুহূর্তের জন্যেও মুছে না ফেলতে পারার গ্লানি না-ফোটা রতনের মুখের নিচে পাক মারে। এবং এতে তার মনে পড়ে এই কদিন ক্রমাগত তার মন চাবাচ্ছে। সমরের বৌদিকে এনে ফেলার প্রসঙ্গে সে বিরক্ত হতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু সমরকে তার কোনওটাই বুঝতে দেয় না। অথবা সমরের পক্ষে ছ পেগের চোখ নিয়ে রতনের আট পেগের মুখের অভিব্যক্তি বোঝাটা সম্ভবই ছিল না। রসিকতার সুরে রতন বলে, “আমার বাড়িতে বসে বানচোদ আমার বৌ নিয়েই ফুককুড়ি?” নেশার ঝোঁকে সমর ঠিক ঠাওর করতে পারে না যে এতদুর যাওয়ার মতো কোনও কথা সে আদৌ বলেছে কিনা! বাবু নখকুনি ছেড়ে তাখে মুখ তুলে বলে, “হ্যাঁ বাবা! যাবে তো সেই আসমা তলে! বাড়িতে আর কতক্কুন!” বিশু আর বাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠে। এই হাসিটা রতনের ভালো লাগে না। সে উঠে গিয়ে গ্রিলের কাছে দাঁড়ায়। তাদের মদের আড্ডায় এটা একটা ইঙ্গিত। এবারে ওঠো। আড্ডা শেষ। বাবুও ওঠে। রতন সমরকে বলে, “এই আসমা পিসটি আবার কে? কোত্থেকে জোটালে?” বিশু ভুরু নাচিয়ে বলে, “কেন! বৌদি কদিন নেই, তোমার লাগবে নাকি?” “ভ্যাট্ বাঁড়া! ফালতু বকিস না। কে? আসমাটা কে?” “ও আছে, চিত্তরঞ্জন পার্টি! ভদ্রঘরের মেয়ে বাওয়া! রেট একটু বেশি। হাউজ-ওয়াইফ!” “এই নিয়ে ক নম্বর হল? বাড়িতে অমন একটা বউ থাকতে…” সমর ওঠে, “এবার কে কার বৌ চোদাচ্ছে বাঁড়া! তুই আর বলিস না! একটা সামলাতে পারিস না…” বলতে বলতে একটু থমকে যায় সমর। কথাটা শেষ করে না। সে সময় বিশু সমরকে বলে, “চল চল, পুরো কালো করে মেঘ আসছে বাল! ঢালার আগে বাড়ি ঢুকতে হবে”। রতনের শক্ত চোয়াল নরম হয় না। মুখটা গতি হারিয়ে ফেলছে। ওরা তিনজন বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়। নাক আর মুখ হাত দিয়ে মুছতে মুছতে গেটটা লাগায় রতন। তালা দেয়। গেটটা পাল্টানো হয়েছে। লোহার কবাটের জায়গায় এখন ঝাঁ চকচকে গোল্ডেন ও ব্ল্যাকের গ্রিল-গেট। দেখে একটা পরিতৃপ্তি আসে। কিন্তু ছন্দা না থাকায় সেটা ঠিক জমি পায় না। এখান থেকে একটা সরু প্যাসেজ, এগিয়ে গিয়ে মেশে প্রায় পঞ্চাশ বাই সত্তর ফিটের একটা উঠানে। সেই উঠানের উপর তিনদিক ঘিরে দোতলা বাড়ি করেছিল জিতেন তিওয়ারি। রতন দোতলায় তিনমুখো বিরাট একটা ব্যালকনি ঝুলিয়েছে। দক্ষিণ মুখী দরজাটা সদর, টানা বারান্দাও ইউ শেপের। বাকি দু দিকের বারান্দায় ওঠার দুটো সরু সরু দরজা। পশ্চিমদিকে রান্নাঘর, তার লাগোয়া একটা শোয়ার ঘর, সদর দরজায় বারান্দা হয়ে বৈঠকখানা। পুবদিকে দুটো ঢাউস শোয়ার ঘর। বাথরুম পায়খানা উঠান পেরিয়ে ঐপাশে। রান্নাঘরের পিছনের দিকটায়। ঐদিকেই পরপর কয়েকটা গাছ আর পাঁচিলের পিছনে পাতলা জঙ্গল। বাথরুম-পায়খানা নিচের তলায় দুখানা বার করিয়েছে সে, উপরের তলাতেও দু খানা থাকবে। সুরকির পনেরো ইঞ্চির গাঁথনি। প্যারপিটে শুয়ে থাকা যায়। এখন তো তিনটি মাত্র লোক। ধীরে সুস্থে বাকিটা গোছালেই চলবে। ছেলেটার সংসার টংসার হলে…এই অব্ধি এসে ফের ছাইঢাকা চাঁদের দিকে চোখ চলে যায় রতনের। ফাঁপা বুকে হাওয়া ধরে খুব। ছন্দা নাই, ছেলেটাকেও নিয়ে গেছে। নিজের টাকায় করা বাড়ি, এ বাড়িতে ভাই, ভাই-বৌকে সে তোলে কেমন করে! আজ বাদে কাল বাচ্চাকাচ্চা হলে তারা ভাগ বসাবে না? তার থেকে পুরনো বাড়িটা ওদের ছেড়ে দেবে। ও বাড়ির যা পজিশন, বিক্রি করলে দুখানা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে যতন। পৈতৃক বাড়ি ভোগ কর! দোকানে বস। ভালোই তো চলছে। যতনও ভালো করেই জানে রতনের জোগাড় করা পুঁজি না হলে ও দোকান চালানো তার পক্ষে সম্ভব না। ফলে রতনের মুখের উপর কথা বলার সাহস তার তেমন নাই। তারপর রতনের স্থানীয় তৃণমূলে প্রভাব রয়েছে। তার কিছু না কিছু সুবিধা তারাও ভোগ করে সারাক্ষণ। ভাই ভাই-বৌকে কোনমতেই এ বাড়িতে জায়গা দেওয়ার যায় না বটে, তবে মাকে এনে রাখা যেত। সেকালের সেই যৌথ পরিবার। বাপ বেঁচে থাকলে সবার আগে বাপকে এই বাড়িতে এনে তুলত সে। কিন্তু পুরনো বাড়িতে বাপ মরে গেল, ও বাড়ি ছেড়ে আর মাও এ বাড়িতে আসতে রাজি হবে না বোধায়। বাকি তাদের এই তিনজনের সংসার। ছন্দা থেকে গেলেই পারত। ছেলেটাকেও নিয়ে গেল। এ সমস্ত হিসেবের পরেও এই এতবড় একটা গোটা বাড়ির সামনে নিজেকে কেমন ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ঠেকে রতনের। উঠান পেরিয়ে সে সদর দরজা দিয়ে ওঠে বারান্দায়। সেখানে খাটিয়া পাতা। উপরে একটি মাত্র ফ্যান। এইখানেই থাকবে সে আজ থেকে। বউহীন, বাচ্চাহীন। ছন্দাকে দেখিয়ে দেওয়ার একটা প্রয়োজন,একটা তাগিদ বোধ করে সে মনের ভিতরে। ছন্দার ভয় অকারণ, আপত্তি অতিরঞ্জিত। শিল্প-নগরীর এত কাছে থেকেও উদ্ভট শুভ-অশুভের ধারণা সে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে বাল। বন্ধু-বান্ধব থাকাকালীন মাথাটা যতটা খালি খালি লাগছিল এখন আর লাগে না রতনের। কিন্তু চাঁদ পুড়ে যায়। কালো ও বিস্তৃত ছাইয়ে মাঝেমাঝে তাকে ঢেকে স্পর্শ দেয় কিছু। ফের দহন ফোটে, পরিস্কার হয়। বৃষ্টি হবে হয়তো। তাতে জ্বলন কমবে কি? বারান্দায় মশারি টাঙিয়ে শুয়ে একটা ঘোর এসে গিয়েছিল। হঠাৎ টোকায় ঘোর পাতলা রতনের। অন্ধকারে বাড়ির গ্রিল মানে না। না ফোটা মুখের উপর থেকে উঠানের ঐপাশ অবধি তার বিস্তার। সেই অন্ধকারের এক প্রান্তে যেন নাড়া লাগে। কম্পন তার ডানা রাখে চেতনায়। একটা শব্দ। পাতলা ঘোরের মধ্যে টানা টানা। হচ্ছে, থামছে। ছন্দ গড়ছে। কীসের শব্দ? উঠতে গিয়েও উঠতে পারে না সে। শব্দটা কোত্থেকে আসছে এভাবে নির্জীবের মতো পড়ে পড়ে ঠাওর করতে একটু সময় লাগে। হ্যাঁ, রান্নাঘরের পিছন দিকের উঠান। পুরনো বাথরুমের দিকটা। ঝসসসসস্ ঝসসসসস্। নারকেল ঝাঁটার শব্দ। কেউ উঠান ঝাড় দিচ্ছে? এত রাতে? ঘোরে বিছানায় জমে যেতে থাকে রতনের হাত এবং পা এবং বুক এবং মাথা। বিলকুল জড় পদার্থ। এখন এই এত রাতে জিতেন তিওয়ারির উঠান ঝাড় দেয় কে?
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
রুপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেরা সেই আজব ঘটনায় যখন নড়েচড়ে বসে, তার কিছুদিন পর ঘটনার কারণ তাদের জন্য খুঁজে নিয়ে এসে অসীম মাজি জানতে পারে সে যা খুঁজে এনেছে তা কারণ নয়, তা আসলে উপায় মাত্র, তখন অসীম মাজি শ্বশুরবাড়ির লোকেদের গাল দেয়, এবং সেই গালাগালি থেকেই একরকম জন্ম হয় তার কারণের আরেকটি খোঁজের। সেই ঘটনার কদিন পর থেকে সে তার বন্ধু মৃন্ময় ঘোষকে তেল দিতে থাকে। মৃন্ময়ের কৃতিত্ব এই যে সে রতন মণ্ডলের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের দেশবন্ধু বিদ্যালয় (বালক)-এ পড়েছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। সেই সুবাদে রতনের সঙ্গে ঠেকে-বেঠেকে আড্ডা তার প্রায় নিয়মিত। এই খবরটি অসীম মাজি জানে, এবং তার সাম্প্রতিকতম যোজনায় মৃন্ময় হয়ে ওঠে মোবিল। সে মৃন্ময়কে নিয়মিত তেল দেয়, এবং বলে গাঁয়ে এক ট নতুন লোক আইল, তুমার বন্ধুলোক বটে, আমাদের কুটুম, ই বাবা! ডাক উয়াকে একদিন। খাওয়াই। অল্প আড্ডা টাড্ডা হোক। অসীমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নিজের জায়গাটা খেলো করার ইচ্ছে মৃন্ময়ের না থাকলেও উলটা পথে গাঁয়ে একরকম নিজের ক্ষমতা দেখানোর লোভ সামলানো তার পক্ষে ক্রমে মুশকিল হয়ে ওঠে। অসীমের সঙ্গে দেখা করায় বলতে গেলে রতনেরও তেমন সায় ছিল না। অসীম মাজি পলাশ গুপ্তের, যে পলাশ গুপ্ত বাউরি পাড়ায় তৃণমূলের সংগঠন ভেঙে বিজেপি বের করছে, তার ডান হাত, এখবর তার কাছে থাকা সত্ত্বেও মৃন্ময়ের ডাক সে ফেলতে পারে না। মৃন্ময়ের সঙ্গে তার সমীকরণ আলাদা। ফলে মৃন্ময়ের বৈঠক খানায় স্বপন খাঁড়ার দোকান থেকে আনা শিঙাড়া ও চা খেতে খেতে অসীম অনিবার্য ভাবে জানে, রতনের বাপের কথা। রতনের বাপ ছিল এআইইউটিইউসি ঘেঁষা। সে সময় তাদের জনা দশেক মেম্বার কিন্তু কেবলস্ ম্যানেজমেন্টকে ধুয়ে দিচ্ছিল ঐ কজন। চার ইউনিয়ন মিলে তাদের বাগে আনতে পারে না। বাপ যদিও অ্যাকটিভ ছিল না, কিন্তু প্রচ্ছন্ন সমর্থন। সেই সুবাদে সদ্য মোচ ওঠা বয়সে ডিএসও করে কিছুদিন রতন। একবার অরুনাংশুদা এসেছে, অসীমের বাপকে যমের মতো ভয় করত, ডিএসও-র সংগঠক, কানাই মণ্ডলকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সাইকেল নিয়ে দৌড়। “রতন, ওটা কে রে?” “ও! ও আমার বন্ধু!” “ঐ ঝাঁটার কাঠির মতো মোটা মোটা গোঁফ, ওটা তোর বন্ধু?” কানাই মণ্ডলের সামনে রতনের বোল বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় সেই লড়াকুদের মধ্যে জিতেন তিওয়ারিকে নিয়ে চর্চা চলত খুব। মতাদর্শ আলাদা, অথচ তখনও সংগঠকদের উপর মানুষের একটা শ্রদ্ধা ছিল। এদেরও তাই। একাহাতে তখন গোটা অঞ্চলের এইচ এম এস সামলাচ্ছে জিতেন তিওয়ারি, এখান থেকে পুরুলিয়া, বীরভূম! জিতেন তিওয়ারির সেই লড়াকু বিশাল একখানা ইমেজ গড়ে তোলা ও নিরন্তর তার চর্চা মাথার খাঁজে খাঁজে জমে গিয়েছিল রতনের। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সেই গল্প, উঠতে, বসতে, শুতে, হাগতে, খেতে শুধু তখন হিরো জিতেন তিওয়ারি। এই পর্যন্ত বলে রতন চলে যায় অন্য প্রসঙ্গে, স্কুলজীবন হয়ে বাউরি পাড়ায় এককালীন সিপিএমের সংগঠন, অসীম তখন কিঞ্চিৎ বিপদগ্রস্ত। অসীমের কাঁচা হাতের ডজে অনেক খবরই টেনে বের করে আনে রতন, তখন অসীম মাজি, রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের ঘরজামাই, মৃন্ময়কে বলে, তার একটা লাইন সারাতে যাওয়ার কথা আছে, গল্প করতে করতে একেবারেই খেয়াল ছিল না, আজ উঠতে হচ্ছে। অসীম বেরিয়ে যাওয়ার পরেও রতন অনেকক্ষণ মৃন্ময়ের বাড়িতে বসে থাকে, আড্ডা দেয়। মৃন্ময় রতনকে শুধায়, তোদের নতুন ইউনিয়নটার কী হল? তৃণমূলের নেতারা ব্যাপারটা সাপোর্ট করছে? মাথা নাড়ে রতন, “দেউচা-পাচামিতে যাই নি? দিন রাত পড়ে থেকেছি ঐ আন্দোলনের মধ্যে! তখন থেকেই একঘরে। আর দিচ্ছেই বা কী! পুরনো লোকেদের তো জানিসই এখন সাইড করে দিয়েছে। বলে আর কী করবে, শালা, ছাড়া গরু তাই।” মৃন্ময় আরেকবার চা দিতে বলে। “রামপুরের কেসটা কী রে?” “আরে বলিস না! ওটা তো সাঁওতাল গ্রাম। চিত্তরঞ্জনের জমি অধিগ্রহণের সময় ঐ সব এলাকা দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফ থেকেই। এবার জমির মিউটেশন করায় নি প্রপারলি কোনটাই! এরাও লেখাপড়া তেমন জানত না। জমি রয়ে গেছে রায়দের নামে। এখন এরা জমি বিক্রি করলে টাকা পায় রায়রা। তাদের পারমিশন ছাড়া জমি বিক্রি করতে পারে না। চষতে পারে না। এইসব নিয়ে ঝামেলা আর কি! এদের নিয়েই চিত্তরঞ্জনের সেই নতুন ইউনিয়ন। আর এই মজদুর ইউনিয়নের লোকেরা শালা এত হারামি, এত হারামি, কী আর বলব! এস ইউ সি-র এক নেতাকে আনানোর চেষ্টা করছিলাম, সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য, কিছুতেই আনতে দিল না! এরা কী পার্টি করবে! ছ্যাঃ! পলিটিক্সের কিছু বোঝে? বাপের সম্পত্তি যেন পার্টিটা!” “তোর এস ইউ সি নিয়ে দুর্বলতাটা আর গেল না! হে হে হে।” “ না বস্! দুর্বলতা টুর্বলতা কিছু না, আমি তো পরিষ্কারই বলি এস ইউ সি-র কাজকর্ম আন্দোলন আমি সমর্থন করি। কিন্তু এখন আর লড়ার আছেটা কে! কেবলস্-এর মেনস্ ইউনিয়নের যা দম ছিল চিত্তরঞ্জন পার্টির সুখী গৃহকোণের ও লড়াই লড়তে প্যান্ট হলুদ হয়ে যাবে। ওরা চাকরিতে ঢোকার দু বছরের মধ্যে চুরি আটকে দিয়ে তিন তিনবার সাসপেন্ড হয়েছে। তোরা করলিটা কী? নিজেরা কোনওদিন লড়েছিস? আরে তোরা তো ইউনিয়নটা করলিই ভগতের ল্যাজ ধরে। সে মাল এইচ এম এস ভেঙে বেরিয়ে আবার তাদেরই সংগঠনের নাম ব্যবহার করত। আর এখন খালি ফুটানি! আমিও শালা দেখে নিয়েছি! মেধা পাটেকরকে আনিয়ে সম্মেলন করিয়েছি। এবার কর কী করবি! সে কি রাগ শালা আমার উপর! মেয়েছেলের মতো ফুঁসছে!” কথায় কথা বাড়ে। রতন ফেরে না। আসলে ছন্দাকে ছাড়া বাড়িতে ফিরতে তার ইচ্ছে করে না। তার এই ক্রমাগত টাল সামলানো মৃন্ময় টের পেলে খানিকটা খুলে বলতেই হয়। ছন্দার আপত্তি, ভয়, বাপের বাড়ি যাওয়া। মৃন্ময় আর তার সমীকরণ একটু আলাদাই। তখন সেই উড়িয়ে দিতে চাওয়া শুভ-অশুভ বোধের সামনে দাঁড়িয়ে মৃন্ময় তার নিজস্ব মতামতটি জানায়, যা আদতে রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোক অনেকদিন থেকেই বলাবলি করে আসছে। সেই সিদ্ধান্তটি রতনের টাল খাওয়া বিন্দুমাত্র কমাতে পারে না। বরং সেইসব না-জানা অতীত তাকে দাঁড় করায় আরও সরু এক অবস্থানের উপর। কনৌজি বামুন বৌ না হোক, ছন্দা সুন্দর, ছন্দা ফর্সা। ছেলেটাও হয়েছে মায়ের মতো। অথচ তিওয়ারিদের এই ঘটনা সে জানত না? অবশ্য এআইইউটিইউসি-কে সমর্থন করা কানাই মণ্ডল যে পরের দিকে কোলিয়ারির ডিও বেচে বেশ মালকড়ি করেছিল, তাই বা কজন জানে! এইসব না জানা এবং না জানানো-রা আজ এই নেশার অতর্কিতে অপরাধবোধ তোলে, গলা সরু করে। অত্যন্ত কম শ্বাসবায়ু বুকে নিয়ে সে ঘুরেফিরে খালি নিজের সংসার দেখে। এই টুকু কথার পরে নেশা তার আরও বেড়ে যায়। সরকারি চাকরি না হোক, সরকার। এক মাথা ক্ষয়ে যাওয়ার বোধ সামলাতে সামলাতে পা তার এতোল বেতোল পড়ে। কোনও রকমে বাড়ি ফিরে খাটিয়ায় শরীর ছেড়ে দেয় রতন। আজও বেশি খাওয়া হয়ে গেল মিন্টুর বারে। খানিক আগে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ পরিস্কার না। ছাই এবং ছাই এবং ছাইয়ে চরাচর এমন ঢেকে গিয়েছে যে জ্বালা দেখার উপায় নাই। অথচ জ্বলছে। নুনছাল উঠে যায় পাঁজরার নিচে। আরও কয়েক পোঁচ তীব্র। ছন্দা তোমার দিকে কখনও ঐভাবে তাকায় যেভাবে শলা দিয়ে জিতেন তিওয়ারির দিকে তাকাত তার বৌ? ছেলেটাকে কনভেন্টে দিয়েছে। সে তিওয়ারি বংশের মতন হবে কি? না নিশ্চয়! নিশ্চয়? নিশ্চিত কি জানে সে? না না, হাজার হোক মণ্ডলের ছেলে! তবে বেশ ফুটফুটে, ফরসা। ছেলের মুখটা মনে করলে শরীরে কোমল একটা উষ্ণতা। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। শব্দটা আজ আরও স্পষ্ট। আইকনিক হোয়াইট একটু বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছে? আজ মাথাটা হেঁচড়ে তুলে গ্রিলের কাছে এগিয়ে যায় সে। একবার শুলে ফের ওঠার দিশা নেশা বাঁচিয়ে রাখে না। গ্রিল ধরলে খানিক তাল পাওয়া যায়। হাতড়ে হাতড়ে সে বোঝে আজ শব্দটা আরও এগিয়ে এসেছে সদরের দিকে। ঝসসসস্ ঝসসসস্। নারকেল ঝাঁটায় মুছে যাচ্ছে পৃথিবী। এঁটো, খানিক অগোছালো, আধজাগা, আধো অন্ধকার। কিন্তু পাতা, পাতার ছায়ারা সরে না একচুল। ঝসসসসস্ ঝসসসসস্। এইবার প্রায় তার সামনে। উঠানের মাঝ বরাবর। আরও অদ্ভুত, উঠানের মাঝখানে, অর্থাৎ সেই নির্দিষ্ট স্থানে, কেউ কোত্থাও নাই।
অসীম মাজি যখন লিমটেক্সের বিস্কুট খাওয়াতে খাওয়াতে রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেদের জানায় রতনের জিতেন তিওয়ারির বাড়ি কিনতে চাওয়ার কারণ খোদ জিতেন তিওয়ারিই, তখন অসীম মাজির একটু খরচা বেশি হয় বটে, কিন্তু গাঁয়ের কজন বুড়া লোকে তথা গাঁয়ের লোকেই বলে যে, এই সব কথা তাদের বহুদিন আগেই জানা। জিতেন তিওয়ারিকে তাদের মতন আর দেখেছে কয়জনা? এই কথা উঠলে মৃন্ময়ের বাবা ঘোষ খুড়া তার গল্প শুরু করে। রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেরা জানায় এই গল্প তাদেরই গল্প। তবে ঘোষ খুড়ার বাবার একখান হারানো গরুর তদারক করেছিল জিতেন তিওয়ারি, কাজেই সেই ভালো বলতে পারবে। এই গল্প শোনার কিছুদিন পরে, অসীম মাজির বৌ, কাঁকন মাজির বড় মেয়ে পরমা, জিতেন তিওয়ারির বাড়ির সামনে পঞ্চায়েতের বসানো টিপকল থেকে জল আনতে গিয়ে তার জীবনের ভয়ানকতম দৃশ্যটি দেখে এবং তখন অসীম মাজি গাঁয়ের লোকেদের বলে এমন যে হবে সে আগেই জানত, এমনকি রতনকে সে নাকি সাবধানও করে দিঞ্ছিল। মৃন্ময়ের রতনকে বলা কথার সূত্র ধরেই ঘোষ খুড়া যখন জিতেন তিওয়ারির কথাগুলো বলে তখন তার চোখে একটা আলগা স্মৃতিমেদুর অসাবধানতা কাজ করে। কাজ করে কারণ যে সময় সে এই কাহিনি বলতে আরম্ভ করে, তার কিছুদিন আগেই রতনকে বাড়ি বিক্রির মধ্যে দিয়ে রূপনারায়নপুর গাঁয়ে তিওয়ারিদের বাস উঠে গিয়েছে। পল তিওয়ারি, যার কাছ থেকে বাড়ি কেনে রতন, সে চাকরি নিয়ে ব্যঙ্গালোরে চলে গেলে একা একা নিতীশ তিওয়ারির বৌ ঝুমার দিন কাটে না। ঐ কলপাড়ে দাঁড়িয়ে সে সারাদিন লোক ধরে ও সুইজারল্যান্ডের গল্প করে। মেয়ে বিয়ানোর সময় গিয়ে পাক্কা ছ মাস সেখানে কাটিয়ে আসে। জামাই নাকি চাকরি করে। তা, হ্যাঁ গা! আর কারোর আত্মীয় কি বিদেশে থাকে না, নাকি? এই পল্টুর বেটি, গাল টিপলে দুধ বেরায়, সেও তো জানি কোথায় একটা করছে, আর তোর তো জামাই! গাঁয়ের জলের ভিতর সুইজারল্যান্ড চুঁয়ায়, ধু ধু রোদে বিরক্তির ঘামের ভিতর সুইজারল্যান্ড বগবগ করে, পাড়ার নতুন বৌ-এর বুক ধড়ফড়, কান হেজে চোখে পোকা, জিভ গিলে মরিস না কেন মাগি! মর মর! বলতে নাই, মরেও গেল! ছেলের কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট নিয়েছিল। মেয়ে তো দেখে না। গাঁ তার নাকি আর পোষাচ্ছিল না। নে, গেলি তো গেলি, ভোগ করতে পারলি কি! এখন ছেলে দিলেক বাড়ি টও বিখে! কী রইল! এই পল তিওয়ারির বাপ হইল যেয়ে নীতিশ, নীতিশের বাপ হল জিতেন তিওয়ারি। সে তুমরা দেখা নাই। আমি দেইখেছি। দুধে আলোতা রঙ, ইয়া খাড়া নাক, আর হাইট কী, হাইট মানে ধর তিওয়ারিদের চৌকাঠেও অল্প ঝুঁকে হাঁইটথে হইথ। কবজির বেড়ও সেই, আর তেমন গলা। একবার হাঁক পাইড়লেক তো ডাবরমোড় থেইকে চাকর বাকর ছুইটে আইসথ। এ হেন জিতেন তিওয়ারি যে খনি অঞ্চলে এইচ এম এসের ডাকাবুকো লিডার হবে, তা রূপনারায়ণপুরের সেকেলে লোকেরা একরকম জানতই। তাছাড়া তিওয়ারি বংশে এই এক ব্যক্তি যে কিনা মাগিবাজ ছিল না। এ কথাটা বলার সময় ঘোষ একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে। তার তিন ভাই সতীশ, গনেশ, সদাশিব—তিনটেই পাঁচ ম-এ একেবারে ম ম। তবে সবথেকে কুখ্যাত মাগিবাজ ছিল তাদের বাপ অমল তিওয়ারি। জিতেন যখন এইচ এম এসের মাথায়, তখন অমল তিওয়ারির বেশ বয়েস হয়েছে, দাপট একটু কম। কিন্তু নিজের কালে দাপটে বাউরি থেকে ঘোষ কি মাজি, মেয়েদের বেলা কোনও বাছবিচার নাই। ধান ঝাড়তে গিয়ে টাকার সঙ্গে ছেলেপিলে নিয়ে ফিরেছে বহু কামিন। কথা কারও বলার উপায় ছিল না। জিভ ছিঁড়ে নিত। সরাকদের জমিজমা ছিল, মণ্ডলদের ভাঁটি, ঘোষেদের গরু, তাদের বাড়ির মেয়েছেলেরা যতটা পারত ওদিকে কম যেত, কিন্তু বাউড়িদের উপায়? এ অঞ্চলে চাষের কাজ সারা বছর থাকে না। চ্যাটার্জীরা ফুলচাষ করত, সেই ফুল বড়লাটের কাছে পাঠানো হয়েছিল পাঞ্জাব মেলকে এই স্টেশনে এক মিনিট দাঁড় করিয়ে রেখে। সেখানে কাজ করত কিছু মাস মাহিনায়। কিন্তু তাতে পোষাত না। এছাড়া পাথর মেশিনের কিছু কাজ, আর সময়ে এই ধানঝাড়ার উপরি। বাকি তিওয়ারিদের জমিজমার কাজ। জমি নিয়ে এমন রেসারেসি যে গাঁয়ে ঢোকার মুখে যে দুর্গামন্দির, সেটা কৃষ্ণপ্রসাদ ত্রিবেদীর জমির উপর হল বলে অমল তিওয়ারি দুর্গাপুজো কমিটিতেই থাকল না। কাজেই এ গাঁয়ের বাউরিরা ওদিকে চ্যাটার্জীদের ফুলবাগানে গেলেও ডাক পেত তিওয়ারি বাড়িতে। গোয়ালে খুঁটার সঙ্গে বেঁধে চাবকাতো অমল তিওয়ারি। তারপর গোলাঘরের একটা ব্যাপার ছিল। কাজ বাউরিদের করতেই হয়। জিতেন পরিবার, গাঁ সমেত আরও দশজনের মাথা হওয়ার পরও সে জমিদারি বহাল ছিল। কিন্তু খুব লাগত বাপে-ব্যাটাতে। অমলেরই ব্যাটা। কোম্পানিকে টাইট দেয়, খনি এলাকা সামলায়। তখন আর খনি এলাকায় ভদ্দরলোক কোথায়! উড়িষ্যা বিহার থেকে গাঁ উজাইড়ে ছোটলোক তুলে আনত হাতে দড়ি পায়ে দড়ি দিয়ে ট্রাকে। কিছু পালাতে গিয়ে মরত, বাকিগুলাকে খনি খেত। তাদের মধ্যে কিছু বদ্যি মুৎসুদ্দি, অফিসার, বামুন আরও কম। তাদের সবাইকে নিয়ে চলতে হত জিতেন তিওয়ারিকে। কম কথা? দাপট তার আরও বেশি। অমল কুলাতে পারত না। বয়েস হচ্ছে। তবে ছেলের কাছে হারায় তার একটা প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল। ব্যাটার মত ব্যাটা। পুরুষ সিংহ! কী আওয়াজ ট দেখ! এদিকে বাপকে নিয়ে জিতেনের অশান্তির শেষ নাই। ফেলতেও পারে না। রাখতেও পারে না। বাপের মাগিবাজি তার পজিশন, ইউনিয়নের ফেস বা বলা ভালো তার ফেস শেষ করে দিচ্ছে। সোসালিস্ট পার্টির অস্তিত্ব নাই এই অঞ্চলে। ইউনিয়নটা একার লড়াইয়ে এত বড় করা একরকম। আরও কাজ সামনে। এমনি মাণ্যি গন্যি করে না লোকে। তার জন্য একটা সাইকেল নিয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত খাটতে হয়েছে। পড়তে হয়েছে। লড়তে হয়েছে এলাকার শ্রমিকদের নিয়ে। এইসব ছোটলোক খনি শ্রমিকদের মধ্যে একটা স্টেডি ইউনিয়ন দাঁড় করানো চাট্টিখানি কথা না। সেই পরিশ্রম বাপের লাম্পট্যে ধুয়ে যায় যায় অবস্থা। মাঝেমধ্যে খাবার বন্ধ করে দেয় জিতেন বাপের। অমলের রোয়াব একটু কমে। এরই মধ্যে একদিন কাজ করতে আসা দু দুটো মেয়ে গায়েব। গায়েব মানে পুরাই গায়েব। তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। থানা পুলিশ করার লোক এরা না। সে সাহসও নাই। তাই রক্ষে। কিন্তু কাঁহাতক আর নেওয়া যায়! জিতেন তিওয়ারি ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে অমল তিওয়ারিকে বাড়ির বাইরে বের করে দিলে। তাতে কি সমস্যা যায়! ইউনিয়নের কাজে মন বসে না, বুক জোড়া কারখানার ভোঁ। তবু মাস-দুমাস যায়, জিতেন বাপকে আর ঘরে ঢুকতে দেয় না। অমল তিওয়ারির অবশ্য খুব একটা অসুবিধা হবে না, তা জিতেন জানত। হয় নাইও। এ মাস এ জ্ঞাতি, দিন পনেরো ও জ্ঞাতির কাছে ঘুরে সে দিব্যি থাকে, খায়। আর দিকবিদিকজ্ঞান শূন্য হয়ে ছেলের নিন্দা করে। বোকাচোদা ঢ্যামনা ছিলা, আদসসো হইছে, আদসসো! আর তোর ঘমণ্ডের আমি গাঁড় না মারি! মুখে রক্ত উইঠে মইরবেক নাই! বাপকে দেখে না! হারামজাদা জন্ম দিল কে রে? নিজের ঘরে ঢুইকতে নাই দিল বাইনচোদ! গোহত্যার পাপ লাইগবেক তুকে, এই বইলে রাইখলম! বলো, ধম্ম তো এক ট আছে, লাকি! কোন জ্ঞাতি তাতে সাথ দিতে গেছিল, জিতেন মণ্ডলের উপরে তারও খার, সে আবার উলটা গাল খায়। তুমি লিজের ট দেখ কেনে? আমার বেটা আমি বুইঝে লিব! উয়ার নখের যুগ্যি হও আগে! হুঁহ্! নিজের মাগ সামহোইলথে পারে না, কয়লা ঝাইড়তে গিয়ে খাইলে তো ধরা ট! চোরচোট্টা কাঁড়া, উ আবার জিতেনের নিন্দা কইরথে আসে! অমল তিওয়ারির বেটা হে! এ ধরনের বিপরীত আচরণে সেই জ্ঞাতি প্রথমে ব্যোমকে যায়, কী হয় তার মাথায় ঢোকে না, কিন্তু যখন ঢোকে, তখন সে যারপরনাই চটে, কিন্তু গায়ে গতরে তথা জমিজিরেতেও অমল তিওয়ারির ক্ষমতা যথেষ্ট বেশি হওয়ায়, তাকে ঘাঁটানোর সাহস তার হয় না। নিরূপায় হয়ে আরও দিন দশেক তার বাড়িতে ভাতের শ্রাদ্ধ করে, বেটাকে ও তাকে একসঙ্গে গাল দিয়ে তারই চামড়া আলগা করে অমল তিওয়ারি অন্য জ্ঞাতির কাছে যায়। এইসব কথা সোজাসুজি জিতেনের কানে ওঠে না। তবে জিতেনের স্ত্রী অলকা এই খবর পায়। তাতে করে একদিন, জিতেনের খাওয়াদাওয়ার পর খবরের কাগজ নিয়ে বসার সময়ে সে জিতেনের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে। দিন দুপুরে এ বাড়িতে এমন নিয়ম নাই। তাই অলকার ব্যবহারে জিতেন অবাক হওয়ার আগেই অলকা জিতেনের চোখে চোখ রাখে, এবং জানায়, “আর কদ্দিন? বাবা পাটি লিঞে যা যা কথা বইলি বেড়াচ্ছেন গাঁয়ে, এইভাবে লাভের লাভ ট কী হইছে বলো তো? উনাকে লিঞে আইসো, যা করবার ঘরে কর, বাইরের লোক হাঁসাঞে লাভ ট কী!” রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকে বলে এই চোখে চোখ রাখার ব্যাপারটাতেই জিতেন তিওয়ারি মজে গেইছিল, নাইলে এত সোজায় মিটে যাওয়ার জিনিস যে এ না, তা না বুঝা জিতেন তিওয়ারি পক্ষে অসম্ভব। বাপকে ঘরে এনে তুললেও জিতেন বাপের উপর নজরদার বসায়। এর বছর দশেক পরের ঘটনা। জিতেন তিওয়ারির মেয়ের বিয়া হয় নিতুরিয়ার পাণ্ডে-পাড়ায়। তা জিতেন বেয়াইবাড়ি হয়ে গেইছে বেয়াইয়ের দাদা অশোক পাণ্ডের বাড়ি। অশোক পাণ্ডে তখন পারবেলিয়া কোলিয়ারিতে কাজ করে, ইউনিয়ন দেখে। তার চেষ্টাতেই ভাইপোর সঙ্গে জিতেনের মেয়ের বিয়া। মেয়েকেও দেখা হল, ইউনিয়নের কটি কাজও হল। মিটিং টিটিং সেরে সেদিন ওখানেই থেকে যাওয়ার কথা জিতেন তিওয়ারির। কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন মনে হল মেয়ের কাছে যাওয়াটা খুব দরকার। মেয়েটা যেন কাঁদছে। সেই রাতে অশোকের বাড়ির খিড়কির উঠানে দাঁড়িয়ে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পায় জিতেন তিওয়ারি। ফলে সে সেই রাত জঙ্গল খনি এলাকা মাথায় করে একাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ভিতু বলে দুর্নাম তার কোনওদিন ছিল না। হ্যাণ্ডেল ধাওড়া গ্রামের পিছন দিকটা তখন পুরাই জঙ্গল। খোঁচা খোঁচা অন্ধকার আকাশের চাহিদায় ঘন। তারই বুক টিপে রাস্তা ছুটেছে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল জিতেন। জঙ্গল একপাশে খানিকটা দূরে সরে যায়। ব্যাপার কী? বিরাট এক দিঘি তার কাজল ওপচানো বুকে রাস্তায় ভর দেয়, অনেকখানি আকাশ থুয়ে রাখে। সেই খানে, সেই কাজল-নিবিড় জলের কাছে এসে জিতেন তিওয়ারি প্রথম টের পায় উল্টাপাশে জঙ্গল থেকে খুব মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ। আওয়াজটা এগিয়ে আসে। জিতেন তিওয়ারিও এগাতে থাকে। দিঘি পার হয়ে আরও খানিক। আওয়াজ আরও স্পষ্ট। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। মেয়েদের পায়ের মল। আর খানিকটা এগোতে পারলেই জাহের থান। জিতেন তিওয়ারি এতক্ষণে খেয়াল করে জঙ্গলে একটা ঝিঁঝিঁও ডাকে না। চারপাশ বেয়াড়া রকমের ঠাণ্ডা। সেই ঠাণ্ডা নৈঃশব্দ কেটে এগোতে এগোতে জিতেন তিওয়ারি একটি পরম ক্ষণে পৌঁছায় যখন রাস্তার খুব কাছাকাছি এসে মলের আওয়াজ ঝপ করে নৈঃশ্বব্দে লীন। কিছুটা সময় অপেক্ষা। হাঁটা ধীর হয়। তাতে অপেক্ষার ভার চাপে। কিচ্ছু নাই। সেই টান বাড়তে বাড়তে বাড়তে বাড়তে একসময় ভার ছিঁড়ে বাতাস ঢোকে খানিক। মনটা বুঝি বা হালকা প্রায়। ঠিক এমন সময় “অ্যাহহহ্”। করাল দাঁতের ফাঁকে টকটকে লাল জিভ বার করে এক কালো কুচকুচে মেয়ে দাঁড়ায় রাস্তার ওপরে। সে যেন রাস্তা ফুঁড়ে ওঠে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলে জিতেনের চোখে পড়ত। কিন্তু না। সামনের অন্ধকারে তালগোল পাকিয়ে তার এই আচম্বিত উপস্থিতি। পোষাক আশাক দেখে বাউরি ঘরেরই ঠেকে। উপরের কাপড় খসে গিয়েছে। কেবল নিম্নাঙ্গে ট্যানা জড়ানো। অন্ধকার লেপটে মাই তার নজরে আসে না। কেবল পোচ পোচ কালোর উপরে ও শনের মতো জটি চুলের নিচে জিতেন তিওয়ারি দেখে সে চোখ দুটি। একফোঁটা অন্ধকারের আভাস নাই। ডাগর দুটি চোখ একেবারে সাদা। জ্বলছে। কয়েক মুহূর্ত। তারপর তার আর অস্তিত্ব থাকে না। অথচ জিতেন তিওয়ারির পা আর নড়তে চায় না। তা রাস্তার মধ্যে যেন গেঁথে গিয়েছে। সামনে বহুদূর অবধি কোথাও কিছু নাই। কিন্তু সেই জঙ্গলের সিঁথি মুহূর্তেকের এক কয়লা মাখা অস্তিত্ব লাল করে দিয়ে গেছে। সে পথে যেতে কনৌজি বামুনের দুটি পা একান্তই অনিচ্ছুক। কোনও মতে টেনে হিঁচড়ে জাহের থান। সেখান থেকে ডাকাডাকি করে দু জন সাঁওতাল জোগাড় করা যায়। তারপর তাদের কাঁধে ভর দিয়ে বেয়াইবাড়ি। বেয়াই বাড়িতে লোকজন ছুটে আসে। ধরে ঘরে তোলে, বিছানায় শুইয়ে জল-বাতাস। জিতেন তিওয়ারি খালি মেয়ে মেয়ে করে। মেয়ে আসে। “কাঁইদছিলি মা?” “কৈ! না তো! কাঁইদব ক্যানে? ষাইট ষাইট! তুমি আর একটু জল খাবে বাবা? দিব?” মেয়ে দিব্য আছে। কেউ কোথাও কাঁদে নাই। কে কাঁদল তবে? ও বাড়ি থেকে বেরনোর আগে স্পষ্ট যে শুনতে পেল কান্না সে! মনের ভিতর যে ছাপ কয়লাকালো অন্ধকার এঁকে দিয়ে গেল, তা ক্রমশ কালো রোমশ নখ-দাঁতআলা ভয় হয়ে ওঠে। ভয়ে ইউনিয়নের অত বড় নেতা চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে। দিন চারেক বেয়াই বাড়ির বাইরে পা দেয় নাই জিতেন তিওয়ারি। পারলে পেচ্ছাপটা পায়খানাটাও ঘরেই করত, কিন্তু বেয়াই বাড়ি বলে কথা। একটা মান সম্মান আছে! চারদিনের দিন ভয়টা একটু ফিকে। বাড়িতে হাজারটা কাজ, ইউনিয়নের কাজ, বেরিয়ে পড়ে প্রৌঢ়। এই দুই দশক আগেও দামোদরের উপরে ব্রিজ হয় নাই। আর তখন তো কথাই নাই। নৌকায় দামোদর পেরিয়ে চিনাকুড়ি পর্যন্ত এসে তার মনে হয় সকাল সকাল বেরোন হয়েছে, একটু চা খেলে মন্দ হয় না। অনেকটা রাস্তা। একটা মিষ্টির দোকানে বসে সে চা-শিঙ্গাড়া খায়। ঠিক সেই মুহূর্তে ভরা দিনের বেলায় সেই ঘটনাটি ঘটে, যা তিওয়ারি বংশের ভবিষ্যত একরকম বেঁধে থুয়ে দেয়। চায়ে চুমুক দেওয়া মাত্রই ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম! আবার! এ কী রে? গরম চা মুখের ভিতরে গিয়ে বিস্বাদ হয়, ঠোঁট পুড়ে যায়। সাদা পাঞ্জাবিতে দাগ লাগে। কেউ কোত্থাও নাই। কানে আসে কাটা কাটা হাওয়ার শব্দ, গেল বটে, দেনা ট রাইখেই, শুইধবি আর শুইধবি, মুখে রক্ত থুইকবি! কে রে? ফ্যাটফেটে দিনের বেলা জিতেন তিওয়ারি দেখে সেই কাপড়েই এক বাউড়ি মেয়ে মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে নেমে গেল পিছনের কাঁকালে। তখন আর চা, আর শিঙ্গাড়া! দৌড়ে দোকানের পিছে গিয়ে কারওরই খোঁজ মিলল নাই। স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে জিতেন তিওয়ারি সোজা এল ঘর। রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকে বলে, সেইদিন, যেদিন রাতে জিতেন তিওয়ারি প্রথমবার লাল টকটকে জিভ দেখে, সেইদিন রাত থেকেই শরীর ভাঙে অমল তিওয়ারির। আর সেইদিন, যেদিন স্কুটার নিয়ে চিনাকুড়িতে চা খেতে দাঁড়িয়ে জিতেন তিওয়ারি দ্বিতীয়বার কথাগ্যালা শুনে, সেদিন ভোর থেকে মুখে রক্ত তুলে সকালের মধ্যে বুড়া শেষ। ঘরে এসে জিতেন তিওয়ারি বাপকে আর জিন্দা দেখে নাই। তাতে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে বটে। তবে সে শ্বাস কতখানি রাহতের আর কতখানি দুঃখের তা বোঝা গাঁয়ের লোকের পক্ষে শক্ত হয়। কারণ তারা বলে যে সেদিন জিতেনের চোখে কেউ এক ফোঁটাও জল দেখে নাই। রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকে বলে জিতেন তিওয়ারির পুণ্যফল ছিল। তাই সে বয়েসকালেই স্বাভাবিক মউত মরে। শাপ তার গায়ে লাগে নাই। আবার কেউ কেউ এও বলে ঐ সব ভূতফুত মিছা কথা, নিজের বাপকে জিতেন তিওয়ারিই বিষ খাওয়ায় মাইরিছে। বাপের ও পরিণতি চোখে দেখতে লাইরবে, তাই দুদিন মেয়ের কাছে ঘুরে আসা। কিন্তু সে সব নিন্দুকের কথা। কারণ শাপকে সইত্য প্রমাণ করে তিওয়ারি বংশ হু হু করে পুড়তে থাকে। যেন দাবানল। জিতেন বেঁচে থাকতেই সতীশ, গনেশ, সদাশিব—সব সাফ। অথচ জিতেনই ছিল সবথেকে বড়। নিন্দুকেরা এও বলে ভাইদের সাফা করবার পিছনেও জিতেন তিওয়ারির হাত ছিল। জিতেন মরলে দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে বড় ছেলে নীতিশের ঘাড়ে। নীতিশের মেজভাই আর ছোটভাইও মরেছে তার আগেই। দুজনেরই মদে সর্বনাশ করলে। একমাত্র সেজ, সেও গনেশ, সে কেবলস্-এ চাকরি পেয়ে বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যায়। এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে নাই কোনও। পরে জমিজমা বেচে কলকাতায়। সে বোধায় এখনও বেঁচে। মেজ মারা যাওয়ার ঠিক দু বছরের মাথায় তার ছেলে বিয়ে করল। একটা মেয়েও হয়েছিল ফুটফুটে। মেয়ের যখন মাস চারেক বয়েস সে ছেলের কোনও রোগ নাই, জ্বালা নাই, হঠাৎ করে পেটে ব্যাথা, ধরা পড়ল ক্যান্সার, ফোর্থ স্টেজ। বছর খানেকের মধ্যে সব শেষ। মেজ-র মেয়ে বিয়ে করেছিল এক প্র্যাক্টিসহীন বাঁজা উকিলকে। তাকে নিয়ে মা-মেয়ে ছেলের বিধবা বৌকে মেয়ে সমেত বাড়ি থেকে বের করে দিল। বৌয়ের নাকি স্বভাব চরিত্র ভালো না। রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের অনেকেই তাকে জিনস্ টপ পরে ঘুরতে দেখেছে, ফলে কথাটা তারা ফেলেও দিতে পারে না। তবে সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ যে একটা ছিলই-এও কারোর অস্বীকার করার জায়গা নাই। সে মেয়ে প্রেম করে, কিন্তু বিয়ে করে নাই। সম্পত্তির হক অত সহজ না। কেস করে সেই জিনস্ আর টপ পরা বিধবা অথচ প্রেমিকা বউ। তারপরে পুলিশের তাড়ায় ভিটে ছাড়া মা-মেয়ে-বাঁজা জামাই বহুদিন নিখোঁজ। সে ভিটেতে আগাছা ছায়। মাঝে দরজা জানলা ভেঙে মাল-পত্তর সব চুরি। বাসন্তী পুজোর দায়িত্ব ছিল ওদের ভাগেই। সেটাও হাতছাড়া। অবশ্য এ জন্য রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকেদের খুব একটা দুঃখ নাই। তার বলে, এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে তা তারা আগে থেকেই জানত। শাপ বলে একটা ব্যাপার আছে তো! নীতিশের ছোট ভাই মেয়েটাকে গছিয়েছে এক কায়েতের ঘরে। ছেলে মিলিটারিতে আছে। ভালো টাকা। বোতলের সেটিং ছিল। বৌ মরার পরপর সেও বোতল সমেত উপরে চলে যায়। এক নীতিশ আর ঝুমা এক মেয়ে এক ছেলে নিয়ে টিকে ছিল। সেও আর রইল না। অদ্দেষ্ট! খণ্ডাবে কে? গাঁয়ের কয়েক বিঘা ডিস্পুটেড জমি দেখিয়ে দশ লাখ টাকা অ্যাডভানস নিয়েছিল কার কাছ থেকে নীতিশ। তারপর আর সে টাকা ফেরত যায় না তার মালিকের কাছে। পরিবর্তে মালে চুর নীতিশের বডি মেলে বনজেমারির এক পঁচিশ ফিট ঘেরের কুয়ার ভিতর থেকে। পুলিশ বলে সুইসাইড। কিন্তু রূপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোকে বলে, তাদের হিসাব মতো এমনটাই আসলে হওয়ার কথা। সুইসাইড টাইড নয়। মাল খেয়ে পুলিশ পার্টিকে আড়াল করছে। এ আসলে খুন। টাকাটা নীতিশ কাঁচা পার্টির কাছ থেকে ঝাড়তে পারে নাই। আর এখন ঝুমার সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ের শেষ কনৌজি বামুন বাড়িটাও ধুয়েমুছে গেল।
অসীম মাজি যখন খুঁজে পেতে কারণটিকে আনে, এবং রুপনারায়ণপুর গাঁয়ের লোক বলে এ তাদের অনেক আগে থেকেই জানা ছিল, জিতেন তিওয়ারি হতে চাওয়াটা দোষের কিছু না, বরং তাদের গল্প অসীমের জোগাড় করে আনা কারণকে পাত্তা না দিয়ে ছাপিয়ে যায়, এবং গল্প শেষ করে তারা যখন বলে কারণ তো বোঝা গেল, কিন্তু খচখচানি থেকেই যাচ্ছে, কানাই মণ্ডলের ব্যাটা কীভাবে জিতেন তিওয়ারির বাড়ি কিনে ফেলে, এমন আশ্চর্য ঘটনা গত একশো বছরে হয় নাই, তখন অসীম মাজির মুখ ফস্কে একটু জোরেই বেরিয়ে যায়, শালার শ্বশুরবাড়ি। এই গালাগাল দেওয়ার বেশ কিছুদিন পরে পরমা যখন জল আনতে যায়, তারও দিন কতক আগে রতন তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়। সকালে কাজের মেয়ে আদুরি যখন বাড়ির কাজ করছিল, তখনও সে বাড়িতেই। মোবাইল ঘাঁটার ফাঁকে একবার বারান্দা ঝাড় দেওয়া আদুরির দিকে নজর যায় রতনের। নাহহ্! ছেলেবেলা থেকে যেমনটি দেখে আসছে, তেমনই। দুধ নাই, পাছা নাই, চার ফিটা শরীর। অপুষ্টি হতে পারে, গঠনও খানিক। এ অঞ্চলের সাঁওতালরা চিত্তরঞ্জনে চাকরি পায় নাই কবজি আর সিনার মাপ শ্রমিকের প্রমাণ মাপের থেকে কম হওয়ায়। এদের কেন অমল তিওয়ারিরা ফ্যান্টাসাইজ করে, বোঝে না সে। বরং তিওয়ারিদের মেয়েদের স্বাস্থ্য এদের থেকে অনেক ভালো। সিনেমাতেও দেখ! একটা বাংলা সিনেমায় বাউরি কি সাঁওতাল রোল এদের দিয়ে করিয়েছে? উঁচুজাতের মেয়েদের গায়ে ভুসোকালি লেপে সে কি সুড়সুড়ি! আদুরি তার শুকনা কাঠি দেহ নিয়ে ঘর ঝাড় দেয়, মোছে। কোথাও একফোঁটা লাস্য নাই। চেষ্টা করেও যৌন ক্ষিদে আনতে পারে না রতন। বিতৃষ্ণা আসে বরং। পাশাপাশি ছন্দাকে রাখো! কোনও তুলনা হয়! আদুরির বাড়ির কাজ শেষের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দার এই চিন্তা রতনকে যেন আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় বাড়ির কাজও তার প্রায় শেষ। সে বোধ করে এবার ছন্দার আসাটা প্রয়োজন। ছেলেটা আসবে না? ওদের জন্যেই তো সবকিছু। যৌথ পরিবার না হোক, পরিবার। শুধু বাড়িতে কুলাবে? এত আয়ের চেষ্টা, সম্পত্তির চেষ্টা, কাদের জন্য? জিতেন তিওয়ারি কি একা জিতেন তিওয়ারি হয়ে ওঠে কোনওদিন এ অঞ্চলে? তার না হয় লিনিয়েজ নাই, কিন্তু পারিপার্শ্বিক সে নিজে গড়ে নিয়েছে! অন্তত নিতে চেষ্টা করেছে! কিন্তু এইসব ভেবে ছন্দাকে আনার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েও ডাবরমোড়ে গিয়ে সে বাইক স্ট্যাণ্ড করে রাখে। একটা কথা তাকে থামতে বাধ্য করে। একটা আবছা স্মৃতি। আগের দিন রাত্রে নেশার ঝোঁকে সে ফের ঐ শব্দ শুনেছে। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। ঝসসসসস্ ঝসসসসস্। এবার শুধু শব্দ না। শোবার ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মনে হল যেন একফালি কমলা আঁচল ফট করে গ্রিলের ওপাশে সরে গেল। শব্দটা কিন্তু থামে নাই। তবু সেই শব্দের আড়ালে কেউ যেন আসে, সরে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার নেশা না করলে সেই শব্দ মেলে না। কিন্তু ব্যাপারটাকে শুধু নেশার চেতনা বলে কাটিয়ে দিতেও সে পারে কই! এত স্পষ্ট অনুভূতি! মৃন্ময়ের মুখ থেকে যা শুনল তাকেও কি উড়িয়ে দেবে? তাহলে তো কানাই মণ্ডলকেও উড়িয়ে দিতে হয়। তার লিনিয়েজের ক্ষীণ একটা চেষ্টা, যা সে তার পূর্বসূরীকে দিতে পারে। তা কি সম্ভব? অথচ বাপকে রাখলে তার এই ভুতুড়ে শব্দও থেকে যায়। কী মুশকিল! এই সমস্ত চিন্তা নিয়ে ছন্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে সে? ছন্দা এক মুহূর্তেই তো ধরে ফেলবে। তবে কী করণীয়? গিয়ে সব খুলে বলবে? তাই বা কীভাবে সম্ভব! ছন্দার এ বাড়িতে আসার সমস্ত সম্ভাবনা নিজের হাতে গলা টিপে শেষ করে দেওয়া! ছন্দার কাছে হেরে যাওয়া! ছেলেটার চোখে চোখ রাখতে পারবে কোনওদিন? রতনের গোটা জীবনটার উপরে কেউ লাল কালি দিয়ে রিজেক্টেড লিখে দেবে না? নিজের হাতে তৈরি করা মহত্বের অধিকার চোখের সামনে বিষ্ঠা! শেষ! স্পঞ্জ আয়রনের গন্ধ? ছন্দা বা ছেলেটাকে ছাড়াই বা তার জীবনের কী মানে? তার পরিবার জিতেন তিওয়ারির মতো ভরাট হবে না? ব্লাড ক্যাম্পটাও ফসকে গেল! টাকার জোগানটা দরকার ছিল। একটা ধারাবাহিকতা না থাকলে ক্ষমতা হয় না, জোটে না। সে টাকা হোক, বা নেতৃত্ব। বাইক রেখে ধীরে ধীরে অনুপ্রেরণায় খাড়া রূপনারায়নপুর বাসস্ট্যান্ডের স্টিলের বেঞ্চের উপর রতন শুয়ে পড়ে। গোটা দুপুর। কেউ খেয়াল করে না। ওষূধের দোকান, মিষ্টির দোকান, ডাক্তারের চেম্বার, এটিএম, জেরক্স, বইখাতার দোকান। লোক আসে। লোক যায়। এটা বড় বেশি বাজার এলাকা। এখানে কেউ না কেউ রোজ বাসস্ট্যান্ডে শুয়ে থাকে। এখানে মিনিট পনেরো পর পর বাস। দুপুরে আধ ঘণ্টা অন্তর। এখানে কেউ বাসস্ট্যাণ্ডে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে না। অথচ সে, রতন, শুয়েই থাকে। দুপুর কেটে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে গাঢ় সন্ধ্যা। বন্ধ কেবলস্ কারখানার কয়েকজন এককালীন ইউনিয়ন-সদস্য বৃদ্ধ। এটা তাদের আড্ডার জায়গা। কীরে রতন? তুই এখানে? খেয়েছিস বাবা? চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে সারাদিন পেটে কিছু পড়ে নি! কত করে বলি, মদটা একটু কম খা। অতটুকুন একটা ছেলে তোর! ভাবতে হবে তো! রতন কিছু বলে না। মাথা তার ঝিম ঝিম করে। মদ আর আজ খেল কখন। মদ না খেয়েই সে জীবনের মাতালতম কাজটা করল। তাই হয়তো হয়! মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি, তেলেভাজা খাওয়ায় বৃদ্ধেরা। খিদেটা বেশ চাগাড় দেয় তখন। পেট ভরে খেয়ে টকটক মুখ রতন ফেরে তার একা অথচ বিরাট বাড়িতে। ছন্দা যদি নাও আসে সে একা কাটিয়ে দিতে পারবে না? আজ আর যাওয়া হল না লালগঞ্জ। দেখা যাক। কাল দেখবে। পরশু দেখবে। এই সব ভাবতে ভাবতে শোয়ার ঘরের পাখাটা ছাড়ে সে। জামাটা খুলে দরজায় টাঙায়। প্যান্টটাও। তারপর ঘামে ভেজা জাঙিয়া পরেই খালি গায়ে বিছানায় বডি ফেলে দেয়। খালি গায়ে বাতাস লাগে। বুকের চুলে নিজেই হাত বুলায়। আজ সারাটা দিন নষ্ট, লালগঞ্জও যাওয়া হল না, একবার রামপুর যেতে হত, আবার ঝামেলা হয়েছে বলছিল অমিত, কী অবস্থা না অবস্থা দেখতে হত, ইয়ুথ ক্লাবে বইমেলা, তার কিছু দায়িত্ব যদি হাতানো যায়, বেশ কিছু টাকার জোগাড়, ভুতোকে বলে শম্পাদির মায়ের জন্য একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডারের ব্যবস্থা---এই সব মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে। নিজেকে আজ মদ ছাড়াই বেশ ভাসা ভাসা ঠেকে। সেই ভাসা ভাসা অসম্পূর্ণতা বোধের কয়েক হাজার লিগ তলিয়ে সে বুক চেপে নিঝুম বুদবুদ ছাড়ে। না হওয়া কাজেদের চিন্তা মাথায় বয়ে ক্লান্ত রতন এ সময় বারান্দা-সংলগ্ন জানলা দিয়ে উঠানের দিকে তাকায় এবং ঝটিতে খানিক পিছিয়ে যায় বিছানায়। দোতলার ব্যালকনির কার্নিশ থেকে দুটো পা, মিশমিশে কালো পা ঝোলে, দোলে। উপরের দিকে কমলা কাপড়। কিন্তু আজ তো মাল খায় নি রতন! চোখ পড়ার অপেক্ষা মাত্র। ওপর থেকে ঝুপ করে কিছু একটা নিচে পড়ে। রতনের মাথা থেকে কান, কান থেকে বুক, হাত, পা বিছানায় ঢুকে যেতে চায়। নড়েচড়ে উদ্দাম চিৎকারের একবুক ইচ্ছে নিয়েও সে স্থির, আরও স্থির হয়ে পড়ে। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। মল বাজে। সদর দরজা হয়ে কেউ বারান্দায় উঠল। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। শব্দটা দরজার দিকে এগিয়ে আসে ক্রমশ। তারপরে সব চুপ। এই সেই নৈঃশব্দ! উফফফ্! ভার ভার! অপেক্ষায় রতনের কান থেকে চোখ যেন ছিঁড়ে আসে। ফালাফালা হয়ে আসে শ্বাসনালি। হঠাৎ দরজায় নয়, ঘরের মাঝখানে একেবারে বিছানার সামনেটায় মেঝে ফুঁড়ে যেন আবির্ভূত হয় সেই মূর্তি। কমলা শাড়ি, মিশমিশে গা, কিন্তু উর্ধাঙ্গ খোলা নয়, ব্লাউজ নাই, এক কাপড়, আঁচলের তলা দিয়ে ডুমো ডূমো বুক চোখে আসে, বিরাট পাছা, ছমকে ছমকে ওঠে। ঐ অত বড় বুক যেন গিলে খেয়ে ফেলতে পারে। আঁট শাড়ির ভাঁজে গতরের লাবণ্য ফোটে। টানা টানা চোখ, আর ঢল ঢল হাসি। কই! এর চোখের মণি তো সাদা নয়! এমনটাই কি জিতেন তিওয়ারি দেখেছিল? কিন্তু মুখে একটা হিংস্রতা আছে। বাউড়ি মেয়ের শরীর…আদুরিকে এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে তার, হাত এবং পা এবং মুখ এবং ঘাড় বিছানায় অচল পুঁতে গেলেও রতন মণ্ডল, জাতে শুঁড়ি, অনুভব করে তার লিঙ্গের দৈর্ঘ ক্রমশ বাড়ছে। তার কোমরের জাঙিয়া কখন খুলে গিয়েছে সে জানে না। মেয়েটি অথবা সে নিজেই হয়তো খুলে ফেলেছে, কিন্তু হাত যে নিজের না, ঘামে ভেজা নিকষ যৌন সেই জাঙিয়া পড়ে রয়েছে তার নতুন শোবার ঘরের জানলার কাছে। বাউরি কি? মেয়েটির হাত এই সময় তার লিঙ্গ ছুঁলে সে খেয়াল করে হাতের ভুসোকালি উঠে এসেছে চামড়ায়। এই সময়ে তার মাথার অন্দরে গতি ও গরম বেড়ে যেতে থাকে, তার বুকের পুরুষ স্তন খড়খড়ে হয়, পায়ের পাতা বেঁকে বেঁকে আসে, তলিয়ে যাবার আগে একবার অস্ফূট ভাবে ছন্দার মুখ মাথায় আসে রতনের। এর সঙ্গে ছন্দার মুখের কি মিল আছে কনও! বাউড়ি মেয়েটির চোখ আরও হিংস্র থেকে হিংস্রতর দাঁত। এক সময় রতন মণ্ডলের দাঁড়িয়ে থাকা লিঙ্গের থেকে ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে গরম সাদা রস বেরিয়ে আসে। বাউরি মেয়ের মূর্তি, সমস্ত দুনিয়া হাতে দপ করে নিভে যায়। সেই সময়, সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে রতন মণ্ডলের গড়ে তোলা নতুন বাড়িতে রতন মণ্ডল বলে কেউ আর বাকি থাকে না। কেবল ইলেক্ট্রিক পাখা ও আলোর একটানা ঝিঁঝিঁ একটি বহুকাঙ্খিত প্রত্যাবর্তনের কথা ঘোষণা করে ফেরে। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে, অসীম মাজির বৌ, কাঁকন মাজির বড় মেয়ে পরমা জল আনতে পঞ্চায়েত থেকে গোটা গ্রাম এড়িয়ে জিতেন তিওয়ারির বাড়ির সামনে বসানো টিপকল থেকে জল আনতে যায়, এবং জল নিয়ে ফেরা পথে সে রতনের শরীরে দেখে সেই বৃদ্ধ ভয়ঙ্কর মুখ, যা শুনে গাঁয়ের লোক সেটাকে অমল তিওয়ারির বলে শনাক্ত করে, এবং সেই শনাক্তকরণের মাঝেই অসীম মাজি জানায়, এ ঘটনা তেমন আশ্চর্যের কিছু না, এ যে হবে তা সে আগেই জানতে পেরেছিল। এমনকি এ ব্যাপারে সে রতন মণ্ডলকে সাবধানও করে এসেছিল।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
Sindhu Som
1 মাস আগে@DIBYENDU DEY অনেক অনেক ধন্যবাদ
Agniswar
4 মাস আগেচমৎকার গল্প।
Sindhu Som
3 মাস আগে@Agniswar অনেক অনেক ধন্যবাদ
DIBYENDU DEY
3 মাস আগেঅসাধারণ একটি।