স্বপন পাণ্ডা প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন। তবে আখ্যানকে পাঠক রাজনীতিমূলকভাবে একপেশে দেগে দিতে পারবেন না। স্বপন পাণ্ডার দক্ষতা এখানেই। আখ্যানে যা কথাবার্তা হচ্ছে, যে পরিসর গড়ে উঠছে তার তলদেশ দিয়ে বৃহত্তর-ক্ষুদ্র রাজনীতি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। বৃহত্তর রাজনীতি যেমন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি ক্লাব আবার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্লাব নামক ইউনিটের সংঘবদ্ধ প্রয়াস রাজনীতির পাশা খেলাকে ক্রমেই ভিন্ন চালে কিস্তিমাত করে। এইভাবে ক্লাবগুলি একদিন বামফ্রন্টকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। জনগণই যেহেতু গণতন্ত্রের নায়ায়ণ সেহেতু গণদেবতার সন্তুষ্টের নিমিত্তে নানা পূজাচার চলছে—দুয়ারে বিবিধ প্রকল্প এসেছে। ক্লাব তার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। স্বপন পাণ্ডা সময়ের পরাক্রমকে বিবিধ মাত্রায় স্পর্শ করতে চান। সেই সম্পৃক্তকরণ এতই গভীর এবং প্রকাশসজ্জা এমন মৃদু যা আখ্যানকে ভিন্ন সমীকরণে নিয়ে যায়।
একবিংশ শতাব্দীর সমাজটা বড়রকম বদলে যেতে থাকল। বিশ্বায়ন, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের রমরমা, তথ্য প্রযুক্তির দৌলতে যোগাযোগ যেমন সহজ হয়ে গেল তেমনি জীবনে একটা গতি এল। এই গতি বাঙালির চিরকাল সঞ্চিত সংস্কৃতিকে টেনে হিঁচড়ে উপড়ে ফেলল। ধুতির বদলে শার্ট প্যান্ট বাঙালি কোন যুগে ধরেছে, সেই বাঙালি এবার ছেঁড়া প্যান্ট পরে মুখে হিন্দি বুলি বলে ভোজপুরি সংস্কৃতি আয়ত্ত করল। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা, মান্না-সলিলের বদলে মোচ্ছবে, উৎসবে চটুল হিন্দিগানে, ডিজে সংস্কৃতিতে ভেসে গেল। কলেজ সোশ্যাল, বিগ বাজেটের পূজা সমস্ত ক্ষেত্রে হিন্দি গানে, ডিজে পার্টিতে, লঘু সংগীতে ডিসকো ড্যান্সে বিড়ি ফুকে, মাতলামি করে অধিক চাঁদা আদায়ে, হপ্তা তুলে, চোখ রাঙিয়ে একটা কদর্য সমাজের জন্ম দিল। সমাজ মানসের চোখে হয়ে গেল ত্রাস। রাজনীতিকে মূলধন করে ক্লাব কালচারে মেতে মুনাফা তুলে, ভদ্রতার বারোটা বাজিয়ে সমাজে বিশুদ্ধতার শ্মশানযাত্রা করে নিজেদের রকবাজ প্রমাণই নয় বাঙালিকেই কলঙ্কের সিংহমূলে পৌঁছে দিল। সেই দূষিত পরিবেশকেই নির্মাণ করেছেন স্বপন পাণ্ডা ‘সিটি বুলেটিন’ (২০২৩) আখ্যানে।
স্বপন পাণ্ডা উপন্যাসের পরিসরকে বারবারই আলগা করে রাখেন। বলার ধরনের মধ্যে একটা হালকা আমেজ থাকে। সংলাপে বাংলা-ইংরেজি-তৎসম-বিকৃত শব্দ দ্বারা বাক্যের গঠনে একটা সরসতা বজায় রাখেন। বিষয় গম্ভীর হলেও, সমস্যার সংকট গভীর হলেও বলার ধরনের কায়দাবাজিতে তিনি জিতে যান। পাঠকের মস্তিষ্কে আঘাত না করেও বাক্যের মধ্যে শ্লেষ-ব্যঙ্গ-মিষ্টতা বজায় রেখে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেন যার প্রসাদগুণ বড় সরস। হপ্তা, চাঁদার জুলুমবাজি, মানুষকে প্রহার, খিস্তি, পার্টির ভয় দেখানো, শেষে বিপদে পরে পার্টির দূরে যাওয়ায় গল্পকথক, বাপ্পাই, মন্টাই, পাপাই, শ্যামলেন্দু বুঝে যায় পার্টি কী জিনিস। আজকের মিনি মস্তান, এলাকার দাদারা সময় বুঝে যেমন পার্টি বদল করে তেমনি পার্টিও সুযোগ বুঝে পাশে দাঁড়ায়, সময় অন্তর প্রত্যাহার করে। সর্বত্রই লাভ লোকসানের হিসেব। কোন পার্টির পাশে থাকলে মুনাফা বেশি, তেমনি পার্টিও সমর্থন-অসমর্থনে দেখে নেয় ভোটের অঙ্ক কত। মাঝ থেকে প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের। পুলিশ দ্বারা মানুষ দিনের পর দিন নিপীড়িত হতেই থাকে। দিন বদলায়, পার্টি বদলায় কিন্তু অত্যাচার অব্যাহত থাকে।
স্বপন পাণ্ডা প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন। তবে আখ্যানকে পাঠক রাজনীতিমূলকভাবে একপেশে দেগে দিতে পারবেন না। স্বপন পাণ্ডার দক্ষতা এখানেই। আখ্যানে যা কথাবার্তা হচ্ছে, যে পরিসর গড়ে উঠছে তার তলদেশ দিয়ে বৃহত্তর-ক্ষুদ্র রাজনীতি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। বৃহত্তর রাজনীতি যেমন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি ক্লাব আবার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্লাব নামক ইউনিটের সংঘবদ্ধ প্রয়াস রাজনীতির পাশা খেলাকে ক্রমেই ভিন্ন চালে কিস্তিমাত করে। এইভাবে ক্লাবগুলি একদিন বামফ্রন্টকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। জনগণই যেহেতু গণতন্ত্রের নায়ায়ণ সেহেতু গণদেবতার সন্তুষ্টের নিমিত্তে নানা পূজাচার চলছে—দুয়ারে বিবিধ প্রকল্প এসেছে। ক্লাব তার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। স্বপন পাণ্ডা সময়ের পরাক্রমকে বিবিধ মাত্রায় স্পর্শ করতে চান। সেই সম্পৃক্তকরণ এতই গভীর এবং প্রকাশসজ্জা এমন মৃদু যা আখ্যানকে ভিন্ন সমীকরণে নিয়ে যায়।
‘সিটি বুলেটিন’ আসলে শহর সংস্করণের ইস্তেহার। শহর কীভাবে বদলে যাচ্ছে, শহরের সংস্কৃতি কোন খাতে যাচ্ছে, রাজনীতি কীভাবে মানুষকে ব্যবহার করছে এবং মানুষ নিজের প্রয়োজনে রাজনীতিকে কীভাবে ছুঁড়ে ফেলছে তার কাহননামা। ভোটের আগে রাজনৈতিক নেতাদের বিশুদ্ধিকরণ, ক্লাবের পরিশুদ্ধিকরণ, রকবাজদের হালকা টাইট দেওয়া আবার প্রয়োজনে ভোটে ব্যবহার করা ইত্যাদি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শহরের রোজনামচা উঠে আসে। ভোটের আগে পার্টির একচিত্র, ভোটের দিন ক্ষমতাতান্ত্রিক পার্টির আরেক চিত্র এবং দুই চিত্রে ক্লাবের যুবসমাজকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তার ফরমান জারি করে অভিজ্ঞ সিনিয়ার থেকে হাফ নেতা। ভোটের আগে এক ভাষা, মিডিয়ার সামনে এক ভাষা, ক্লাবে গিয়ে আরেক ভাষা যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সমস্ত দখল করে নেবার আধিপত্যবাদ, সেই রহস্যকে চিহ্নিত করে চলে ‘সিটি বুলেটিন’।
শুধু শহরেই নয় শহরের ভিতর অন্ধকার লেখকের নিরীক্ষণ বিন্দু। শহরের রংচঙা আলোকসজ্জার ভিতরে কতপ্রকার যে অন্ধকার আছে তার স্পষ্ট-অস্পষ্ট সজ্জা চিহ্নিত হয়ে চলে। আছে রাজনীতি, আধিপত্যবাদ, মিডিয়ার দালালি। বেহাল পরিষেবা, জনগণকে নানামাত্রায় শোষণ, ভোগবাদের ইশারা ও কায়দা মাফিক মানুষকে ঠকানোর ধান্দাবাজি। লেখকের ভাষায় মিডিয়া পলিটিক্স। মিডিয়ার কোনো দায় দায়িত্ব নেই। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ লেবেল সেঁটে যেখানে মুনাফা সেখানে সে ছোটে। রিকশাচালক ব্রজমোহনের মৃত্যুর খবর হয় বটে, পাবলিকের আগ্রহ কমলে খবরও হারিয়ে যায় কিন্তু নিম্নবিত্তের সমস্যার সমাধান হয় না। সিনেমা হলের বারবার মালিক বদল, হাত বদল হয় বটে লাইটম্যানের রোজগারের কোনো সুরাহা হয় না। গরম যত বৃদ্ধি পায় বৃক্ষ নিধন তত দ্রুত বৃদ্ধি পায় শহর সংস্করণে। গ্রীষ্মে জল সংকট দেখা দিলে নতুন কায়দা মাফিক সরকার দায়িত্ব এড়িয়ে মিনারেল ওয়াটার চালু করে দেয়। বাঁশ খায় পাবলিক। পক্ষে বিপক্ষে ঘণ্টা খানেক সঙ্গে চিল্লামিল্লি চলে। রাজনীতির চক্রান্ত, মিডিয়ার দালালিতে পাবলিকের জীবন থেকে সুখ শান্তি হারিয়ে যায়। ইউটিউব, ফেসবুকে এসব নিয়ে চর্চা হয় বটে, লাইকের বন্যা হয় বটে কিন্তু সমস্যার সমাধানের বদলে আরও বেশি সমস্যা ঘনীভূত হয়। টোটাল সিস্টেমটা একটা দুর্নীতি, অনিময়তান্ত্রিক পরিসরে ভেসে গেছে। সমস্তক্ষেত্রে সাফার করতে হচ্ছে জনগণকে। অথচ এরাই গণতন্ত্রের গণেশ। ভোটের আগে আবার সমীকরণ বদলে যাবে। সময়ান্তরে বিবিধ বয়ান, বিবিধ ঘটনায় পক্ষ-বিপক্ষ, সরকারি-বেসরকারি বয়ান, সরকার পক্ষ-বিরোধী পক্ষের ভাষ্য নিয়ে এই আখ্যান শহর পরিক্রমা করে।
শহরের এপিঠ-ওপিঠে নানা যন্ত্রণা ঝুলে আছে। হোডিং পোস্টার বিজ্ঞাপনে ভোগবাদে এক শ্রেণি চমক দিচ্ছে কিন্তু আরেক শ্রেণি বস্তিতে পড়ে আছে। নগরায়নে, শপিংমলে, ফ্লাই ওভারে, মেট্রো রেল স্থাপনে বস্তির পর বস্তির উচ্ছেদ অভিযান চলছে। প্রতিরোধ হলে পুলিশ, স্থানীয় পার্টি ভয়ভূষণে মানুষকে ঘরছাড়া করছে। এই যে দ্বিমুখী উন্নয়ন অথবা উন্নয়নের নামে এক শ্রেণিকে সর্বস্বান্ত করা বা উন্নয়নের ঘোমটা খুললেই যে কদর্য রুচি, শোষণচিত্র, তাই আখ্যানের পরিসর। এই আখ্যান আসলে কতগুলি ইস্তেহারের মালা। শহরের ভিতরে শহর বা শহর গড়ে ওঠার যে নানা গল্প আছে, শহর কাদের, শহর কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, শহর কাদের আশ্রয় দেয়, কাদের বাস্তুচ্যুত করে, রাজনীতির ব্যবহার ও রাজনীতি দ্বারা কীভাবে মানুষ ব্যবহৃত হয় সেই সংকেতমালা।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
সিনিয়ার ক্লাব মেম্বাররা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেই জুনিয়াররা ক্লাব পরিচালক হয়ে ওঠে। তবে এলোমেলো হলেই সিনিয়াররা বুলি ঝাড়ে। কালীপূজাকে কেন্দ্র করে চাঁদা আদায়, ফাংশন, বোম বাজি, পুলিশ নিয়ন্ত্রণ, ইভটিজিং, পাড়ার মেয়ে বউদের গালি গালাজের মধ্য দিয়ে শহর সংস্কৃতির পুরো চিত্রটাই উঠে আসে। কিছু উঠতি যুবকের বেয়াদপ চিত্রনাট্য, বাপে খেদানো, মায়ে পেদানো শান্ত ছেলেরা বাইলেনের পীর পয়গম্বর হয়ে যে অপসংস্কৃতির জন্ম দেয়, যার মধ্যে সময়ের নথিনক্ষত্র অন্তর্ভুক্ত থাকে তার অন্তর্বয়ন এই আখ্যানের গোত্র নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। ক্লাব নিয়ন্ত্রিত বাইলেনের উঠতি যুবকদের নানা কেচ্ছা কলাপ যা নাগরিক জীবনকে ক্রমেই অসহিষ্ণু তিতিবিরিক্ত করে তোলে অথচ রাজনীতির পৃষ্ঠদেশ মজবুত থাকায় থানা-পুলিশ কিছুই করতে পারে না, বড় নেতারা বাচ্চা ছেলেদের খাম খেয়ালি রঙ্গরসিকতা বলে অপরাধ গোপন করে। পূজাকে কেন্দ্র করে মদ মাংসের উৎসব, মায়ের চরণে ভক্তের আরতির আড়াল দিয়ে কিছু পকেট খরচ তুলে নেওয়া, বিকট শব্দে বোম-ডিজে বাজিয়ে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলার জঘন্য পৈশাচিকতা যা শহরের অন্যতম চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে তার রসদ বেরিয়ে আসে।
স্বপন পাণ্ডা প্রবল পরাক্রান্ত সময়কে নানা বীক্ষণে ব্যক্ত করে চলেন। ঘটমান বর্তমান সময় যা নাগরিক মানুষকে ক্রমেই পিষ্ট করছে সেই রহস্য বেরিয়ে আসে। তরুণ প্রজন্মের বখাটে সাধনায় পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে কেমনভাবে তোলা আদায়ে এগিয়ে গেল। ভাঁড়ুদত্ত, জগাই-মাধাইয়ের উত্তরসূরী হয়ে সিন্ডিকেট, প্রমোটার, তোলাবাজের অংশ নিয়ে কিছু করে কম্মে খাবার মধ্যে যে নষ্ট আত্মার দংশনক্ষত চিহ্নমালা ঝুলে থাকে তাই লেখকের অন্বিষ্ট। বৃহত্তর মুনাফাবাজের ছিন্নাংশ হয়ে কিছুটা ছিটেফোঁটা তুলে পান বিড়ি খেয়ে আড্ডায় মশগুল হয়ে, বাইলেনের ঘরের খোঁজ খবর রেখে কখনও ঝগড়ার ইন্ধন জুগিয়ে নিজেদের কিছুটা আখের গুছিয়ে নেবার রহস্য স্পষ্ট হয়ে চলে। স্বপন পাণ্ডা দূষিত দগ্ধবেলাকে ট্রিটমেন্ট করেন। কোনো আবেগ, রোমান্টিকতা, ফ্যান্টাসি নয় সিটি কালচারে যা চলছে, সিটি প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ড কাউন্সিলারের পাতানো ভাইপোরা যেভাবে করে কম্মে খাচ্ছে বিনা পরিশ্রমে তার নথিনক্ষত্র চিহ্নিত হয়ে চলে।
বামপন্থীদের বিদায়ে নগরে নীল পার্টির ছক্কাবাজি, কিছুদিন বাদে গেরুয়া শিবিরের উত্থান ও প্রচার-প্রসারে গোমাতার ইন্ধন জাগানো এবং তার সুবিধা খুঁজে পাবলিকের ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সময়ের রাজনীতি উঁকি দেয়। রাজনীতির আধিপত্যবাদ, ক্ষমতাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, পাবলিকের সুবিধাবাদ এবং সুযোগ বুঝে সব হাতিয়ে নেবার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে দূষিত সময়কেই লেখক পর্যবেক্ষণ করে চলেন। সময়টা ক্রমেই পচনশীল নোংরা ভাগাড়ে পরিণত হয়ে চলেছে। এর জন্য দায়ী কে? রাজনীতি। আছে বেকার বখাটে তরুণ প্রজন্মের সমস্ত কুড়িয়ে খাওয়ার লালসা। তুমি দিচ্ছ আমি খাচ্ছি। সুযোগ বুঝে নেমে পড়ছি আবার কেটেও পড়ছি। এই দেওয়া-নেওয়ার ছলচাতুরির মধ্য দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন থমকে আছে। একটা প্রজন্ম শিক্ষাদীক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে কর্মহীন হয়ে বখাটে সেজে কিছু করে-কম্মে খাওয়ার নামে গোটা পরিসরটাকেই দূষিত ক্লেদময় করে তুলেছে। সেই নষ্ট আত্মার কঙ্কাল এই আখ্যানের কাঠামো। স্বাধীনতার অমৃত উৎসব, মন্ত্রীজির বাতেলাবাজি, অথচ জনগণের শূন্য ভাঁড়ার, ফাঁকতালে পার্টির মুনাফা লাভের মধ্য দিয়ে সময়ই যেন কথা বলে। দাপুটে প্রমোটার যুধিষ্ঠির সাহার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় কিছুই তো সঙ্গে যাবে না মা। প্রতাপের রক্তচক্ষু, মুনাফার মুতসুদ্দিগিরি সবই তো শূন্য হয়ে যাবে। মৃত যুধিষ্ঠির সাহার মুখে মাছির ভনভনের মধ্য দিয়ে শুধু ব্যঙ্গই নয় ক্ষমতাতান্ত্রিক বয়ানের নিষ্ঠুর পরিণতি চিহ্নিত হয়ে চলে। চারিদিকে ধান্দাবাজি, পার্টি পলিটিক্স, মানুষকে ঠকানো ও আখের গুছিয়ে নেবার সিয়ানাগিরি এবং ভেকধারীদের কাছা খুলে দেখান আমাদের যাপিত সময় এমন। যে সময় ক্রমেই দূষিত হচ্ছে, যে সময়ের বাতাসে বারুদের গন্ধ, যে সময়ে মূল্যবোধ ক্রমেই রসাতলে, যে সময় পার্টি পলিটিক্সে জর্জারিত সেই সময় এই আখ্যানের বহমান বাতাস।
এই রকবাজ প্রজন্ম এই নতুন ভাষা আয়ত্ত করেছে। বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মেশানো এক মিশ্র ভাষা। খিস্তির বন্যায়, বিকৃত হিন্দি-ইংরেজিতে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিয়েছে। সংস্কৃতির এলোপাথারি ইনিংসে যেন এক নতুন বাঙালির জন্ম হয়েছে। একুশ শতকের বাঙালি নিজের সংস্কৃতির পায়ে নিজেই কুড়োল মেরে এমন ভাষা সংস্কৃতি ও জীবনচেতনা আয়ত্ত করেছে যা ভিত্তিহীন। এই নতুন বাঙালি খিস্তি খেউড়ে, রঙ্গতামাশায় আলাল বা নবকুমারকেও ফেল মারে। যথেচ্ছাচার এদের জাতধর্ম। দ্রুত বলদে যাচ্ছে বাঙালিয়ানা। এই বদলনামাই লেখককে লিখতে বাধ্য করে এমন আখ্যান। ‘সিটি বুলেটিন’ একদিকে যেমন নগরিক দৌরাত্ম্য তেমনি নগরের ওপিঠে থাকা বস্তি মানুষের দুঃখ যন্ত্রণার ভাষ্য। বছরের পর বছর যায়, নগরের রংচঙ বদলায় কিন্তু বস্তি মানুষের অর্থনৈতিক চিত্র বদলায় না। বয়ানে ভেসে আসে—
“এই বুলেটিন পুরনো; এই বুলেটিন সেই বিগত শীতকালের এক দুঃখিত রাত্রির। সে রাত্রে কী হয়েছিল শহর এখন তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কত শীতকাল আসে কত বস্তিতে আগুন লাগে কত কত বুলটির মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি ছাই হয়ে যায়। কত কত বুল্টির কাঁধ খামচায় কত কত হাত কব্জি চেটো…” (সিটি বুলেটিন, কেতাব e, প্রথম সংস্করণ, নভেম্বর ২০২৩, পৃ. ৮২-৮৩)
আছে মিডিয়া। সুযোগ বুঝে, লাভ বুঝে সরকার-জনগণের পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়ায়। পাবলিক যা খায় তেমন করে খবর সাজায়। প্রকৃত সত্য হারিয়ে যায়। যুধিষ্ঠির মণ্ডলরা আক্ষেপের মালা গলায় পরে হতাশ নয়নে বসে থাকে। দিন যায়, রাত যায় সুখ আসেনা। আসে চোখ রাঙানি, ধমক-ধামক। ‘সিটি বুলেটিন’ আসলে নগরের মানচিত্র। নগরের বুকে ঘটে যাওয়া নানা রকমফের ঘটনার বৃত্তান্ত। চাকরি চেয়ে পথে পড়ে আছে কিছু যুবক যুবতী। পুলিশ দিয়ে ছত্রভঙ্গ, গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়া, বেকায়দায় ফেলে মিছিল ভেঙে দেওয়া, চাকরির দুর্নীতি, দুইনম্বরী সব মিলিয়ে সময়ের বুকে আঁচড় কেটে এই আখ্যান হেঁটে চলে। লেখক তীব্রভাবে নগরের বুকে ঘটে চলা আর্তনাদকে পর্যবেক্ষণ করে চলেন। বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, অনিয়ম, মাত্রাহীনতা, অত্যাচার, অবৈধ পাচার, জুলুমবাজি সব মিলিয়ে অতিষ্ঠপ্রায় নাগরিকের জীবন। সেই জীবনের প্রাত্যহিক রোজনামচা এই আখ্যান।
স্বপন পাণ্ডা আমার সময়ের সেই লেখক যাঁর চোখ কোনোকিছুই এড়িয়ে যায় না। প্রত্যক্ষ সময় জ্ঞান, অন্তর্ভেদী জীবনচেতনা, বাস্তবের হরেকরকম সমস্যা ও স্বচ্ছ ভাষা বীক্ষণ দ্বারা সময়ের প্রতিমূর্তিকে স্থাপন করে চলেন। করোনাকে সামনে রেখে আঁতলেমি, কুসংস্কার, ধান্দাবাজি, মানুষ পেষণ, অন্যদিকে নগরের রাস্তায় চাকরি প্রার্থী যুবকদের আর্তনাদ, চাঁদার জুলুম, বখাটেদের অত্যাচার, হাফ নেতা-ফুল নেতার কথার ফুলঝুরি, দরিদ্র নিষ্পেষণ—সব দ্বারা আখ্যান নানাভাবে সময়কে ধরতে চায়। করোনাকে কেন্দ্র করে গোমূত্র সেবন, কর্মহীন দরিদ্র, প্রধানমন্ত্রীর বাতেলাবাজি, ক্ষুধা ও বস্তি মানুষের আর্ত চিৎকার সব মিলিয়ে আখ্যান বাস্তবের ধারাপাতকে ছিন্নভিন্ন করে চলে। আখ্যানের একাদশ পরিচ্ছেদে বড় পরিসরে রয়েছে করোনাকে কেন্দ্র করে ভণ্ডামি, ব্যক্তির আর্তনাদ, রাষ্ট্রের ফরমান ও অসহায় মানুষের হাহাকার। একুশ শতকের বিশ্ববাসীর জীবনে ভয়াবহ মহামারি রূপে এসেছিল করোনা। কিন্তু করোনাকে কেন্দ্র করে গভমেন্ট, পুঁজিবাদি বেনিয়াতন্ত্রের যে চিত্রনাট্য মানুষের চোখে ধরা দিয়েছিল তা বিভীষিকাপ্রায়। একদিকে মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি, অন্যদিকে কুসংস্কার, লোকাচারের ভণ্ডামি ও নেতাদের রক্তচক্ষু শোষণ নাগরিক জীবনে দুঃস্বপ্ন স্বরূপ হয়ে উঠেছিল। প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হতেই পারে কিন্তু তাকে রাষ্ট্র, মিডিয়া, পুঁজিপতি বেনিয়ারা যে পর্যায়ে নিয়ে গেল তা সভ্যদেশে অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা। সময়ের বুকে ঘটে চলা সেই বিধ্বংসী তাণ্ডবের আদি-অন্ত রহস্য লেখক চিহ্নিত করে চলেন।
করোনা থেকে মেছোভেড়ি, বখাটেদের সঙ্গী করে অত্যাচার, ক্ষমতাতান্ত্রিকতার বিভিন্নমাত্রা ও সমস্ত ছিনিয়ে নেবার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে সময়ের অন্ধকার ব্যক্ত হয়ে চলে। বয়ানে ভেসে ওঠে—
“এখানেও কাজ বলতে ওই মারদাঙ্গা, সিন্ডিকেট বানানো, দরকার পড়লে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, অফিস-ফফিস গুঁড়িয়ে দিয়ে ওখানে গাছ লাগিয়ে ছবি তোলা। কাগজে গবমেন্ট বলল, টিভিতে সেসব ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ছেলেরা আছে পটু ভোডা গদাই পাবনা হেথায় সিন্ডিকেট নাই। আমরা অ্যান্টি সিন্ডিকেট। এই দেখুন বিরোধীদের তৈরি করা সব ছাতার মাথা সিন্ডিকেট তুলে দিয়ে আমাদের ছেলেরা কেমন গ্রিন রেভুল্যাশান ছড়িয়ে দিয়েছে দেখুন। ততদিনে ভেতর দিকে লুকিয়ে ফের নতুন সিন্ডিকেট আমরা তৈরি করে ফেলি।” (তদেব, পৃ. ১২৩-১২৪)
সিন্ডিকেট, সিন্ডিকেট ভেঙে নয়া সিন্ডিকেট, দুষ্কৃতিরাজ, হপ্তা, আগ্রাসন, বখাটেদের হাতে রেখে সমস্ত ছিন্নভিন্ন করে যে দৌরাত্ম্য চলে প্রতিনিয়ত তা লেখক অব্যর্থ নিশানায় চিহ্নিত করে চলেন। সংস্কার, বিশ্বাসে ভরপুর জীবনে একদিন করোনামাতার পূজা প্রচলিত হয়ে গেল। বখাটে ছেলের দল যারা এতদিন কালী-দুর্গা নিয়ে মেতে থাকত তারা আজ করোনা মাতার পূজায় মেতে উঠল। দিনকে দিন নগরের সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। হাফ নেতা, ফুল নেতা লাভের গন্ধ পেতেই অনৈতিকতা, ভিত্তিহীনতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। পাবলিক ডিমান্ড মেটাতে কুসংস্কার বড় হয়ে উঠেছে। একুশ শতকের হুজুগে বাঙালি বড় উৎকট ব্যাভিচারে ভেসে যাচ্ছে। সময়ের রাজনীতি, সমস্যা ও মানুষের প্রবণতা নিয়ে যে চলমান নাগরিক জীবন তাই আতশ কাচে মেলে ধরেন লেখক।
আখ্যানের এগারোটি পরিচ্ছেদে হরেকরকম সমস্যা, প্রবাহিত সময়ের প্রবণতা, রাজনীতি, শ্রেণিচক্রে পিষ্ট মানুষের নামাবলি যে সুরে ভেসে গেছে তা প্রশংসনীয়। স্বপন পাণ্ডার ন্যারেটিভের একটি বিশেষ প্রসাদগুণ আছে। তা অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কিন্তু পরিবেশন দক্ষতা এমন নমনীয় যে তা রুক্ষ নয়। একটা আলগা পরিসর নির্মাণ করে কিছুটা আয়েস ভঙ্গিতে, কিছুটা শিথিল অথচ দ্রুত গদ্যে তা আলো দান করে। ন্যারেটিভ কোথাও ছড়া, শ্লেষ, ব্যঙ্গ, স্কেচ দ্বারা হালকা সুরে গম্ভীর জীবনচেতনার কথা উঠে আসে। আখ্যানকে তিনি কখনোই জটিল করেন না, সমস্যা কিন্তু জটিল। ন্যারেটিভে নানারকম ঠাট্টা, তামাশা, শ্লেষ, ব্যঙ্গ-হাসি, শব্দসাঁচ, চরিত্রের নানামাত্রিক গড়ন, কিছুটা উদ্ভট, কিছুটা চলতি সংস্করণ রেখে জীবনের গভীর পাদদেশে নিয়ে যান। এখানে সুনির্দিষ্ট কাহিনি নেই। আবার কাহিনির সবটাই নগরের অংশ। নাগরিক জীবনের বহমান সত্য। আর তা শেষ হয়েছে একুশ শতকের শেষ প্রহরে। করোনা, গোমূত্রপান, সংঘ শক্তির উত্থান, করোনা পূজা—সমস্ত মিলিয়ে আখ্যান হয়ে ওঠে একুশ শতকের চলমান ধারাপাত। এগারোটি বুলেটিনে নগরের নানামাত্রিক সমস্যা, চক্রান্ত, রাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন, মানুষের নাজেহাল অবস্থা দ্বারা আখ্যান ঘটমান সময়কে যে ভাষায়, যে বয়ানে চিহ্নিত করে চলে তা একুশ শতকের বাংলা আখ্যানের জরুরি দিক বলেই বিবেচিত হবে। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অপরাশেন রাজারহাট’, ‘শহর সংস্করণ’ আখ্যানে আরেক শহর গড়ে ওঠার বৃত্তান্ত ছিল। স্বপন পাণ্ডা আরেকটু এগিয়ে এসেছেন, আসতে বাধ্য হয়েছেন সময়ের দাবি মেনে। জীবনের চলমানতাই তো আখ্যানের স্বধর্ম। সেই স্বধর্ম স্বপন পাণ্ডা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন।
মূল সুর
“স্বপন পাণ্ডা আমার সময়ের সেই লেখক যাঁর চোখ কোনোকিছুই এড়িয়ে যায় না। প্রত্যক্ষ সময় জ্ঞান, অন্তর্ভেদী জীবনচেতনা, বাস্তবের হরেকরকম সমস্যা ও স্বচ্ছ ভাষা বীক্ষণ দ্বারা সময়ের প্রতিমূর্তিকে স্থাপন করে চলেন। করোনাকে সামনে রেখে আঁতলেমি, কুসংস্কার, ধান্দাবাজি, মানুষ পেষণ, অন্যদিকে নগরের রাস্তায় চাকরি প্রার্থী যুবকদের আর্তনাদ, চাঁদার জুলুম, বখাটেদের অত্যাচার, হাফ নেতা-ফুল নেতার কথার ফুলঝুরি, দরিদ্র নিষ্পেষণ—সব দ্বারা আখ্যান নানাভাবে সময়কে ধরতে চায়। করোনাকে কেন্দ্র করে গোমূত্র সেবন, কর্মহীন দরিদ্র, প্রধানমন্ত্রীর বাতেলাবাজি, ক্ষুধা ও বস্তি মানুষের আর্ত চিৎকার সব মিলিয়ে আখ্যান বাস্তবের ধারাপাতকে ছিন্নভিন্ন করে চলে।”—কেতাব e প্রকাশিত সিটি বুলেটিন-এর আলোচনা করলেন অধ্যাপক পুরুষোত্তম সিংহ।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন