...নিজেকে সামলে নিয়ে সরস্বতী এরপর যা বলে তাতে দারোগার মাথা ভোঁ ভাঁ হয়ে যায়। “খুন হয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাকে হোয়াটজ অ্যাপে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রবাবু। সেখানে উনি যে খুন হয়ে যেতে পারেন এরকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর শুধু উনি নন, উনি ছাড়া আরও দু’জন খুন হতে পারেন, এরকম একটা আভাসও ছিল...”
বিশ্বামিত্র নিজে খুন হতে পারেন এইরকম একটা আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু উনি ছাড়া যে আরও দু’জনের উল্লেখ করা হল, তাঁরা কারা! শুধুমাত্র ইঙ্গিত নয়, এই উপাখ্যান চলতে চলতে তা সুস্পষ্ট হবে ক্রমে।
এছাড়াও আরও একটি বিষয়, বিশ্বামিত্র সেনের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বেশ বোঝা যাবে এইবার, ঠিক কী ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে।
উনপঞ্চাশ
চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।
দারোগা সাহেব যখন নিজের ঘরে বসে কথা বলছিলেন বলরাম কিস্কুর সাথে, তখনই, হাজিরা কনস্টেবল ঝিলম এসে বলেছিল, সরস্বতী বৈগা নামে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে। বৈগা পদবিটা শুনে ছন্দ কেটে যায় সুজয় মাহাতোর। ঝিলমকে বলেন, “ঠিক আছে পাঠিয়ে দিন।”
ঝিলম যায়। সরস্বতী আসে, “আসব স্যার?”
উদভ্রান্ত চেহারা মেয়েটির। দারোগা তাকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলেন। ধপাস করে শরীর ছেড়ে দেয় সরস্বতী বৈগা। সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিয়ে মাহাতো সোজা তাকান আগন্তুকের দিকে, “পরমেশ্বর বৈগা আপনার কেউ হন?”
ঢোকার সাথে সাথে এইরকম একটা প্রশ্ন আশা করেনি সরস্বতী। থতমত খেয়ে বলে, “হ্যাঁ স্যার...। উনি আমার বাবা।”
“কিন্তু আমরা এই মুহূর্তে একটা হেভিওয়েট খুনের তদন্তে খুব ব্যস্ত। রায়টের ব্যাপারে মাথা গলানো এখন মুশকিল।”
“স্যার আমি রায়টের ব্যাপার নিয়ে আপনার কাছে আসিনি।” সে আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দুগ্ধা মন্দির কমিটির হোমড়া চোমড়া বলরাম কিস্কুর দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। দারোগা, বলরামকে ইশারায় বিদায় জানান। বলরাম চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়। আবার নিজের কথা বলতে শুরু করে সরস্বতী, “আমি আসলে বিশ্বামিত্র সেনের হত্যার ব্যাপারে কয়েকটা তথ্য জানাতেই এখানে এসেছি।”
ইস্কুলে পড়াশুনা করা মেয়ে সরস্বতী। বেশ ভালো হিন্দি এবং বাংলা বলতে পারে। দারোগা সাহেব সরস্বতী বৈগার থেকে এতখানি পরিশীলিত ভাষা আশা করেননি। তাঁর গলায় বিস্ময়, “বিশ্বামিত্রের খুনের ব্যাপারে তথ্য আপনার কাছে! বেশ বলুন ঐ বিষয়ে কী জানেন আপনি?”
“আপনি নিশ্চয়ই অনাদি গোস্বামী কে চেনেন?”
“হ্যাঁ চিনি বৈকি। এই অঞ্চলে ওঁকে কে না চেনে? ওঁর মন্দিরেই তো খুন হয়েছেন বিশ্বামিত্র।”
“হ্যাঁ। ডি টাইপ ব্রিজে দাঙ্গা হয়ে যাবার পর থেকে অনাদি গোসাঁই আমাদের গাঁয়ে মাঝে মাঝেই যেতেন। নগর কীর্তনের দল নিয়ে। বেশ কিছুদিন হল সেই দলে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র সেনও। আমাদের বৈগা পাড়ার উনিও যেতেন কীর্তনের দলের সাথে। খুব ভালো খোল বাজাতে পারতেন।”
সুজয় মাহাতোর মনে পড়ে যায়, একটা খোল দেখেছিলেন বিশ্বামিত্র সেনের ঘরে। সোফার উপর পড়েছিল। ওইদিকে বলে যায় সরস্বতী, “অনাদির সাথে আমাদের বাড়িতে যেতেন মানুষটি। আমাকে আর দাদাকে...”
“কী নাম আপনার দাদার?”
“রতন বৈগা।”
“আচ্ছা। তারপর...”
“আসলে আমাদের বৈগা পাড়ার পুরোহিত সদাশিব মোহান্তিকে সবাই ভয় করলেও, দু’জন কিন্তু একদম ভয় পায় না। একজন হলেন অনাদি গোসাঁই আর একজন আমার দাদা। সদাশিব চাইত না অনাদি নামগানের দল নিয়ে আমাদের পাড়ায় যাক। কিন্তু তা স্বত্বেও তিনি যেতেন। আর উঠতেন গিয়ে আমাদের ঘরে। বিশ্রাম নিতেন আবার কখনও বা ঘরের দাওয়ায়, গাছতলায় বসে কীর্তন করতেন সবাই মিলে। আমি জল বাতাসা দিতাম।”
দারোগা আসল প্রসঙ্গে যেতে চান, “হ্যাঁ তারপর বলুন।”
“হ্যাঁ যেতেই যেতেই আমাদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। আমাকে আর দাদাকে নিজের ছেলে মেয়ের মত...”
হঠাৎ করে বাস্পরুদ্ধ হয়ে আসে সরস্বতীর গলা। চুপ করে যায় সে। সুজয় সময় দেন সরস্বতীকে। স্নেহ নিম্নগামী। অকৃতদার বিশ্বামিত্র বাবুর পক্ষে, সদ্য পিতৃহারা ভাইবোনের উপর একটু বেশি স্নেহশীল হয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে বৈগা পাড়ায় গেলে তাদের ঘরে যখন আশ্রয় পেতেন।
নিজেকে সামলে নিয়ে সরস্বতী এরপর যা বলে তাতে দারোগার মাথা ভোঁ ভাঁ হয়ে যায়। “খুন হয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রবাবু। সেখানে উনি যে খুন হয়ে যেতে পারেন এরকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর শুধু উনি নন, উনি ছাড়া আরও দু’জন খুন হতে পারেন, এরকম একটা আভাসও ছিল...”
শিল্প নগরী ছোঁয়া ফুলওড়ারিতোড়ের মানুষজনের কথাবার্তার দেহাতি টান বহুদিন ধরেই গায়েব। আর সরস্বতী বৈগার মত যারা একটু হলেও শিক্ষার আলো দেখেছে, তারা স্থান কাল পাত্র বুঝে খানিক পরিশীলিত ভাষা প্রয়োগ করতে পারে বৈকি।
এইদিকে, মহাদেবও দারোগার ঘরে উপস্থিত ছিলেন। মেয়েটার পরিশীলিত শব্দগুলোর প্রেক্ষিতে উপস্থিতির জানান দিলেন, “বলেন কী! উনি খুন হয়ে যেতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সাথে আবার অন্য দুজনের আগাম খুনের খবরও দিয়েছেন! তা আপনি সাথে সাথে পুলিশকে ইনফর্ম করেন নি কেন?”
সুজয়ও বলেন, “ইয়েস... আপনি তখনই পুলিশকে জানান নি কেন?”
সরস্বতী বলে, “প্রথমে আমি বুঝতেই পারি নি যে, ওই ম্যাসেজে এরকম একটা বিষয় বোঝানো হয়েছে। পরে যখন বুঝতে পারি, তখন আমি মিঃ সেনকে বলেছিলাম আপনাদের জানানোর জন্য। কিন্তু উনি শুনতে চান নি।”
“কী বলেছিলেন উনি?”
“হেসে উঠেছিলেন প্রথমে। তারপর…”
“তারপর…!”
সুজয় এবং মহাদেব একসাথে জিজ্ঞাসা করেন।
“তারপর এক অদ্ভুত কথা বলেছিলেন।”
“কী?”
“পুলিশ কী করবে! পুলিশের ক্ষমতা নেই কিছু করার। আমাকে যারা খুন করতে চায় তাদের ক্ষমতা পুলিশের থেকে অনেক বেশি।”
এই কথায় এস আই সাহেব ফোঁস করে উঠলেও মাহাতো সেরকম কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান না। কারণ তিনি অনেক বেশি বাস্তববাদী। উল্টে বলেন, “হ্যাঁ। কথাটা খুব ভুল বলেননি। আততায়ীর কাছে গ্লক সিরিজের আগ্নেয়াস্ত্র... অথচ আমাদের হাতে গাদা বন্দুক। এখানকার অনেক কনস্টেবল এখনও ‘গ্লক’ শুনলে মাথা চুলকোবে...”
সরস্বতী বৈগা পরের কথায়, “এছাড়াও উনি যা বলেছিলেন সেটা আরও ভয়ের...”
“কী !”
“বলেছিলেন, পুলিশের থেকে ওরা যে শুধু বেশি ক্ষমতাবান তাই নয়, ইচ্ছে করলে ওরা পুলিশকে দিয়েও কাজ হাসিল করতে পারে। আলতু ফালতু কেসে ধরে নিয়ে গিয়ে কোনও ফেক এনকাউন্টারে...”
দাঙ্গার পর যে সব এলাকায় পুলিশ ‘ছানবিন’ চালিয়েছিল তার মধ্যে বৈগাপাড়াও ছিল। ফেক এনকাউন্টার-পি সি-জেল কাস্টডি, এইসব শব্দগুলোর সাথে তখনই পরিচিত হয়ে গিয়েছিল সরস্বতী। কাজেই তার মুখ থেকে এই শব্দটা বার হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। দারোগা ভাবেন বিশ্বামিত্র নিজে এত কেন মৃত্যুর আশঙ্কা করতেন? একটা বির্তকিত বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতেন বলে এতখানি ভয়! যেখানে সেখানে ‘আগামী মৃত্যুর’ পদচিহ্ন এঁকে গেছেন! নিশ্চয়ই কেউ রক্তচক্ষু দেখিয়েছিল। সে কে!
যাই হোক, চরম অসম্মানজনক কথা বলেছে সরস্বতী, কিন্তু সুজয় মাহাতোর কিছু করার নেই, কারণ সামনে বসা সরস্বতী তার নিজের কথা বলছে না। সে বিশ্বামিত্রর বক্তব্য তুলে ধরছে মাত্র। নিজেকে সামলে নিয়ে দারোগা বলেন, “সরস্বতীদেবী বিশ্বামিত্রবাবুর পাঠানো ম্যাসেজটা আছে আপনার কাছে? দেখাতে পারবেন?”
মোবাইলটা বার করে সরস্বতী। কম দামি একটা স্মার্ট ফোন। দাদার যখন প্ল্যান্টে কাজটা ছিল তখন মাসে মাসে হাত খরচা দিত তাকে। সেই পয়সা জমিয়ে কেনা। হাতে একটা ব্যাগ ছিল সরস্বতীর। সেখান থেকে মোবাইলটা বার করে অদ্ভুত এক বার্তা দারোগাবাবুকে দেখায় সে। বিশ্বামিত্র সেন পাঠিয়েছেন,
একা নই আমি/ আরও আছে দুজন/ যারা বড় দামি
বিশ্বামিত্র–বাল্মীকি– আছে আরও একজন, যারে প্রলয়ঙ্কর মানি...
দুর্বল এবং চূড়ান্ত অপেশাদারি ছন্দে গাঁথা তিনটে লাইন। না, এইটারও মাথা মুণ্ডু যথারীতি কিছু বোঝা যায় না। বেশ খানিক ভালো করে দেখার পর সুজয় বলেন, “আচ্ছা... আপনি বুঝলেন কী করে যে, এই ম্যাসেজে আরও দুজনের মৃত্যু, আই মিন মার্ডারের কথাই বলা হয়েছে?”
এই প্রশ্নে সরস্বতী খানিকটা গুটিয়ে যায়, “আসলে বিশ্বামিত্রবাবু মারা যাবার আগে, এটাকে নিয়ে আমি সে ভাবে ভাবিইনি। কিন্তু মারা যাবার পর ...আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সেরকম কিছু হলেও হতে পারে। ঐ যে আরও আছে দু’জন বলেছেন। তবে...”
“তবে?”
“ঐ রকম ম্যাসেজ আমায় কেন পাঠিয়ে ছিলেন সেটা আমার কাছে এখনও ধোঁয়াশা। হয়ত আমাকে নিজের মেয়ের মত দেখতেন বলে বিশ্বাস করে পাঠিয়ে রেখেছিলেন। যাতে কখনও দরকার হলে পুলিশকে জানাতে পারি। তবে সবটাই আমার ধারণা...।”
দারোগা সুজয় মাহাতো নিজের মনেই বলে যান, “বিশ্বামিত্র...বাল্মীকি...বাল্মীকি...বিশ্বামিত্র... তারপর আবার কী যেন... অতীশ দীপঙ্কর...!”
মহাদেব হাউমাউ করে ওঠেন, “আজ্ঞে স্যার অতীশ দীপঙ্কর নয়, প্রলয়ঙ্কর।”
“ইয়েস। প্রলয়ঙ্কর। মানে কী কথাটার!”
মানেটা যে কী, তা এই ঘরে উপস্থিত কেউ জানে না। দু-এক মুহূর্ত বাদে সুজয় মাহাতো তাকান একই ভাবে বসে থাকা সরস্বতীর দিকে, “আপনি কি আরও কিছু বলবেন?”
সরস্বতী বৈগাকে এই কথায় ইতস্তত করতে দেখে দারোগা সাহেব ভরসা দেন, “না, সঙ্কোচের কোনও কারণ নেই। আপনার আরও কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।”
“হ্যাঁ। উনি বলতেন যে চৈতন্যের মৃত্যু নেই। চৈতন্যে বধিবে কে !”
স্বভাবতই এই কথাটিও বোধগম্য হয় না দারোগার, “বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়।”
“এই রকম একটা ম্যাসেজ পাঠানোর পর আমি তাঁকে বলেছিলাম, চাঁদপুরা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য। সেখানে কেউ কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আমার সেই কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। বলেছিলেন...”
“কী বলেছিলেন।”
“বাপের ভিটে ছেড়ে, তোদের ছেড়ে যাই কী করে সরস্বতী! আর শোন, কেউ আমাকে খুন করতেই পারে। কিন্তু স্বয়ং চৈতন্যকে কে খুন করবে! তাকে মারে এমন সাধ্য এই সংসারে কারও নেই রে। তারপর একটু থেমে আবার বলেছিলেন...”
“বলে যান...”
“মেয়ে তুই চৈতন্য মানে জানিস...? চৈতন্য মানে হল চেতনা। চেতনার মরণ নেই...। ”
“বুঝতে পারলাম না ম্যাডাম!”
“কথাটার মানে আমিও ঠিক বুঝতে পারি নি দারোগাবাবু...”
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
পঞ্চাশ
চন্দ্রপুরাগামী শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস।
এখনও স্মৃতিচারণে মগ্ন স্বপ্ননীল। সে যাচ্ছে বিরাট এক দায় কাঁধে নিয়ে। ‘পিতৃদায়’। কাজেই, হাজার চেষ্টা করেও স্মৃতি রোমন্থন থেকে নিজেকে বিরত করতে পারে না।
রত্নাকর বাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন বহুদিন আগে। পুত্র এবং পুত্রবধূ দুজনেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন, তাও কয়েক বছর হল। কিন্তু ওঁর গৃহে অতিথি আপ্যায়নের কোনও খামতি নেই। আবার উপরে উঠে এসেছে আসু। হাতে ট্রে। দুটো প্লেটে, নবদ্বীপের বিখ্যাত সরভাজা এবং পয়োধি। গ্লাসে জল। বিশ্বামিত্র বাবু সাজানো প্লেট দেখে কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত হন, “আহা এত কিছু আবার কেন...!”
মৃদু হাসি রত্নাকরের মুখে, “সামান্য আয়োজন, দয়া করে গ্রহণ করুন।
একটানা কথা বলে চলেছেন। গলা এতক্ষনে নিশ্চয়ই শুকিয়ে কাঠ। একটু ভিজিয়ে নিন।”
জলের গ্লাসটা তুলে নেন বিশ্বামিত্র।
“আহা শুধু জল কেন ? একটা সরভাজা মুখে দিয়ে তারপর খান।”
চামচ দিয়ে তুলে একটা সরভাজা মুখে দেন বিশ্বামিত্র। আবার এক ঢোক জল খান। গ্লাসটা নামিয়ে রাখেন। রত্নাকর বাবু এইবার সরাসরি একটা প্রশ্ন করেন, “এই যে বংশ তালিকা ...এর সাথে আপনার কাজের সম্পর্কটি ঠিক কী? আপনার কথা অনু্যায়ী, চৈতন্য মহাপ্রভুর দেহাবশেষ উদ্ধার করলেন আপনি। তাঁর উত্তরপুরুষদের খুঁজে বার করলেন আপনি। কিন্তু এত কিছু করে আপনি যে আসলে কোথায় ঠিক পৌঁছতে চাইছেন, সেটা কিন্তু এখনও অব্দি স্ফটিক স্বচ্ছ হল না আমার কাছে।”
দীর্ঘ পথ ভ্রমণের শ্রান্তি কিছুটা দূর হয়েছে ততক্ষণে। স্নিগ্ধ হাসি মিস্টার সেনের, “আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। পুরোটা অবগত হলে নিশ্চয়ই অনুধাবন করা যাবে, আমি ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাইছি।”
“হ্যাঁ বলুন, পুরোটাই শুনতে চাই।”
কৃষ্ণনগরের মিষ্টি বলে কথা। একটা খেলে আরও একটা খেতে ইচ্ছে করে। কথা শুরুর আগে ফের আর একটা মুখে ফেলে দেন বিশ্ববাবু। নীল একটা মোড়া নিয়ে আসে বসার জন্য। বাকি অংশটা আরম্ভ করেন বিশ্বামিত্র, “আমি চূরঙ্গগড় থেকে দেহাবশেষ পাওয়ার পর, ইতিহাসকে বিজ্ঞানের আলোকে ফেলে বিশ্লেষণ করার সুযোগ এসে গেল। আর সেটা করে, যে সত্য উপলব্ধ হবে তা হয়ত হবে অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সত্য সবার সহ্য নাও হতে পারে।”
“কাদের সহ্য হবে না বিশ্বামিত্রবাবু?”
“সহ্য হবে না সেই সব আজগুবি গল্পকারদের, যারা মহাপ্রভুর অন্তর্ধানটিকে সাত পাঁচ বাহান্ন করে আমাদের বুঝিয়ে এসেছেন এতদিন। খণ্ডন করতে চেয়েছেন ইতিহাসবিদদের যুক্তিকে। সহ্য হবে না সেইসব ধর্মের ধ্বজাধারীদের যারা নিজেদের প্রভাব পতিপত্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে মহাপ্রভুকে জোর করে সরিয়ে দিয়েছিলেন তার অনুরাগীদের সামনে থেকে। সহ্য হবে না, সেই সব ভক্তদের যাঁরা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে ঈশ্বরকে খোঁজেন না, মনের মধ্যে যে তীব্র অন্ধকার তারই ভিতর বেঁধে রাখতে চান ভগবানকে। এদের ভক্তি আসলে ভক্তি নয়, বিকারগ্রস্ততা। অজ্ঞানতাবশত তারা একথা স্বীকার করতেই চায় না যে, চৈতন্য মহাপ্রভুও আসলে রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ। তারা বলে, ভগবানের আবার মৃত্যু কি!”
এই কথার পর রত্নাকর মিশ্র এইরকম একটা প্রশ্ন করেন মিস্টার সেনকে যার থেকে এটা বেশ বোঝা যায়, রত্নাকর মিশ্রও চৈতন্য মহাপ্রভু সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, “আচ্ছা বিশ্বামিত্রবাবু আমি যতদূর জানি, মহাপ্রভুর মহাপ্রস্থান কোন মন্দির থেকে ঘটেছিল তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কিন্তু আপনি যে মহাত্মা শিশির কান্তি ঘোষের রেফারেন্স দিচ্ছেন, তিনি তাঁর ‘অমিয় নিমাই চরিতে’ বলেছেন মহাপ্রভু অপ্রকট হয়েছেন গুণ্ডিচা বাড়ি থেকে, এই খানেই তো সব কেমন যেন গুলিয়ে যায়। তাই না?”
বিশ্বামিত্র মৃদু হাসেন, “না গুলিয়ে যায় না। বরং সেটাই স্বাভাবিক। মহাত্মা শিশির কান্তি ঘোষও, মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের বিষয়ে আসলে কী বলতে চেয়েছেন সেটা পরিষ্কার নয়। সম্ভবত উনিও, অন্য চৈতন্য জীবনীকারদের মতই ইচ্ছে করে একটা ধোঁয়াশা তৈরি করতে চেয়েছেন মহাপ্রভুর বিষয়ে। ষষ্ঠখণ্ড, পঞ্চদশ অধ্যায়, প্রভুর অপ্রকট, পৃষ্ঠা ৮৫৯ থেকে আমি যদি পড়তে আরম্ভ করি তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আমার কথার সারবত্তা বুঝতে পারবেন।”
মিশ্র সাহেবের এইসব কথায় যেন খুব উৎসাহ নেই আর। তিনি তড়িঘড়ি চূড়ঙ্গগড়ে পাওয়া কংকালের কথায় ফিরে যেতে চান। বলেন, “থাক থাক তার আর দরকার নেই। আমরা বরং কঙ্কাল-প্রসঙ্গে ফিরি...।”
ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা। প্রকাণ্ড মেঘখানা ততক্ষণে চিলেকোঠার মাথার উপর। তবে, ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে তখনও খানিক দেরি। রত্নাকর বলে যান, “ঐ নরদেহ থেকে যে স্যাম্পল আপনি উদ্ধার করেছিলেন তার ডিএনএ টেস্ট এবং কার্বন ডেটিং করিয়েছিলেন কি?”
“হ্যাঁ কার্বন ডেটিং করিয়েছিলাম।”
বাক্যটা বলে দু-এক মুহূর্ত সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন বিশ্বামিত্র, “সন্দেহের একটা বাতাবরণ তৈরিই ছিল। বেশ কিছু ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে, কিছুদিন ধরেই বলে আসছিলেন, মহাপ্রভুকে মন্দিরের ভিতরেই গুম করা হয়েছে। তাঁরা কিন্তু 'খুন' নয়, গুম কথাটির উপর জোর দিচ্ছিলেন। মহাপ্রভু শেষবারের মত দেবালয়-কক্ষে প্রবেশ করার পর, দেবালয়ের দরজা বন্ধ করে তাঁকে রাতারাতি গুপ্তপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গুপ্তস্থানে এবং...”
“এবং!”
উত্তেজনায় গলা কাঁপে নীলের,
“এবং তারপর, কেটে যায় শয় শয় বছর। কয়েকজন গবেষক পরবর্তী কালে রীতিমত যুক্তি দিয়ে দেখান যে, গুপ্ত পথ দিয়ে তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?”
“কোথায়?”
“গোবিন্দ বিদ্যাধরের ‘'মুঠোয়’। দুর্ভেদ্য চূড়ঙ্গগড় দুর্গই ছিল সেই সময়ে এমন একটি জায়গা, যেখানে কুটিল গোবিন্দর প্রভাব ছিল সর্বাধিক। সমস্ত লজিক তো এটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে, সেখানেই তাকে নিয়ে গিয়ে গুম করার কথা। যাই হোক, এইবার আসি আসল পয়েন্টে...”
কথাটা বলে আবার মুহূর্তটাক বিরতি। তারপর ফের বলতে শুরু করেন, “এখন সেই দুর্গের আশপাশ থেকে..., হ্যাঁ, সেই দুর্গের আশপাশ থেকে এমন কোনও কংকাল পাওয়া গেল, কার্বন ডেটিং করে যার বয়স দেখা গেল পাঁচশো বছর, তাহলে? সবাই তো জানতে চাইবেই যে, ঐ দেহাবশেষ কার। তখন পুরো বিষয়টাকে উড়িয়ে দেওয়া অত সহজ হবে কি? এতদিন যেভাবে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল?”
“কী ভাবে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল?”
“ঐ যে বলেছি, নানা গাঁজাখুরি গল্প দিয়ে। মহাপ্রভুর অন্তর্ধান সম্পর্কে যে বাজার চলতি যে গল্পগুলো আমি আপনি জানি আর কী..., সেইগুলো দিয়ে।”
এতক্ষণে,বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ছাদে। চিলেকোঠায় ঝোলানো পায়রার বিরাট বাক্সটা। শেষ যে পায়রাটা পা দানিতে বসে বকবকম করছিল, সেটাও এবার খোপে ঢুকে যায়। বৃষ্টির দাপট ক্রমশ বাড়লে ছাদ থেকে উঠে পড়তে হয়। বাঁদিকে বিরাট একটা ঘর। ভাগীরথীমুখো। ছুটে গিয়ে আশ্রয় নেয় সবাই।
এইটা রত্নাকর মিশ্রের পড়ার ঘর। সারা বাড়িতে একটা বনেদিয়ানার ছাপ। বিরাট আলমারি গোটা দুয়েক। নতুন করে বার্নিশ করা হয়েছে। আধুনিক এল ই ডি আলো পিছলে যায় তাতে। তবে এই আলো সাবেকিয়ানার কাছে কিঞ্চিৎ খেলো।
বিশ্বামিত্র বাবুর মনে হয়, কোনও কিছুই এখানে ছোটো নয়। সবকিছুর একটা অন্যরকম ব্যাপ্তি আছে। সবথেকে যেটা অবাক করার মত তা হল, মহাপ্রভুর বিশাল অয়েলপেইন্টিংটা। দরজা দিয়েই ঢুকেই মুখোমুখি। কম করে সাত ফিট বাই চার ফিট। তৈলচিত্র যেন মাটি থেকে শুরু হয়ে ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। ছবিটার মধ্যে একটা ‘অ্যান্টিক’ ভাব আছে। দেখে মনে হয় রত্নাকরের আমলের নয়, বহু আগের। আর যে রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, তা তেল-রঙ নয়। অন্য কিছু।
রত্নাকর বাবু এবার আর আরামকেদারায় না বসে পড়ার টেবিলে বসেন। স্বপ্ননীলকে বলেন সামনের জানলাটা খুলে দিতে। বৃষ্টির ছাট আসে। তবে সেরকম কিছু নয়।
স্বপ্ন টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বামিত্র বাবু একখানা বেতের মোড়া টেনে নিয়ে আবার শুরু করেন নিজের কথা, “হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, আমি মহাপ্রভুর দেহাবশেষ পাওয়ার পর...।” কথাটা বলে একটু থামেন। মৃদু হেসে আবার বলতে শুরু করেন, “একটু ঘুরিয়ে বললে বোধহয় ঠিক বলা হয়, আমি যে দেহাবশেষটিকে মহাপ্রভুর বলে ভাবছি সেটি পাওয়ার পর, সেটিকে ধরে সামনের দিকে এগোতে চাইলাম। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খেলাম। কারণ মহাপ্রভুর সরাসরি কোনও বংশধর নেই। অতএব আমাকে বিশ্বরূপকে ‘খনন’ করা শুরু করতে হল। আশ্চর্য এবং অজানা কিছু তথ্য পেয়েও গেলাম যদি এখনও জানি না তা আদৌ সত্যি কিনা, কিন্তু আমি পেলাম। এবং সেই তথ্য ধরে অগ্রসর হয়েই ওই ‘আশ্চর্য’ বংশতালিকা আমি উদ্ধার করলাম বিশ্বরূপ ভ্রাতা লোকনাথের বংশধরের কাছ থেকে, যা আমি আগেই বলেছি। কিন্তু, আমার সেই তালিকা উদ্ধারের খবর কী ভাবে যেন চাউর হয়ে গেল বাইরে।”
আকাশ ছেঁচা জলে ঝাপসা চরাচর। তারই মধ্যে, বেশ কিছুটা দূরে, দু একটা আলোক উৎস সরে সরে যাচ্ছে এদিক ওদিক। ছোটো ছোটো স্টিমারের আলো। জলযানগুলি ভাগীরথীর বুক চিরে চলেছে, কোনও অলীক স্বপ্নপথে। মিশ্র সাহেব এইবার বেশ ভাব-গম্ভীর ভাবে বলে ওঠেন, “তাহলে আপনি কি ধরেই নিচ্ছেন মহাপ্রভুকে জগন্নাথ মন্দির থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোনও গুপ্তস্থানে এবং তারপর সেখানে তাঁকে গুম করা হয়েছিল?
বিশ্বামিত্র হাসতে হাসতে বলেন, “আমার ধরে নেওয়াতে জগতের কোনও কিছু অদলবদল হবে না। তবে এটা ঠিক যে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা পসিবিলিটির মধ্যে থেকে ‘রিয়েল ট্রুথ’ টাকে খুঁজে বার করার একটা চেষ্টা করা হবে।”
“কিন্তু আমার যে আরও একটা কথা আছে বিশ্বামিত্রবাবু। আপনি জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রভুর অন্তর্ধানের কথা বলছেন। এইদিকে আবার অনেকেই বলছেন প্রভুর অন্তর্ধান ঘটে রথের সময়। কিন্তু রথের সময় জগন্নাথ মন্দিরে আদৌ জগন্নাথ-বিগ্রহ থাকেই না।”
“একথা কিন্তু কখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি যে রথের সময়ই মহাপ্রভুর মহাপ্রস্থান ঘটেছিল। কেউ কেউ আষাঢ় মাসে, অর্থাৎ রথের সময়ের কথা বললেও, বহু গবেষকই কিন্তু অন্য কথা বলেন। তারা বলেন যে ঘটনাটি ঘটেছিল, বৈশাখ মাসে অক্ষয়তৃতীয়ার সময়। যাঁরা এই কথা বলেন তাঁদের মধ্যে, অচ্যুতানন্দ, দিবাকর দাস, মাধব পট্টনায়ক থেকে শুরু করে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক প্রভাত মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত আছেন। প্রভাতবাবু অবশ্য তাঁর বই ‘হিস্ট্রি অব চৈতন্য ফেথ ইন ওড়িশা’ তে বৈশাখ মাস এবং আষাঢ় মাস এই দুটি মাসের মধ্যে যে কোনও একটি মাস হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন।”
একটু সময় নিয়ে আবার বলেন বিশ্বামিত্র, “তাহলে কী দাঁড়াল রত্নাকর বাবু?”
“কী দাঁড়াল?”
“এটাই দাঁড়াল যে কোনও কিছু সম্পর্কেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। যেটা পারি তা হল, নিজের আবিষ্কার করা পসিবলিটিগুলোকে খালি খতিয়ে দেখতে।”
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
Technophilix India
4 দিন আগেবাহ