রজতের নিজের জীবনটা সেকেন্ড ক্লাস। তাই মেয়ে টুকুনকে ঠেলে ফার্স্ট ক্লাসে তুলে দিতেই হবে। তারপর নিশ্চিন্ত?
আশপাশের সব স্কুলের রেজাল্ট বেরিয়ে গেল, টুকুনের স্কুল এতদিন কী করছিল কে জানে! ওইটুকু মেয়েদের খাতা দেখতে কতক্ষণ লাগে রজতের চেয়ে ভাল করে কেউ জানে না। একে তো এত দেরিতে রেজাল্ট বার করছে, তার উপর আবার এতক্ষণ লাগাচ্ছে। কোনো মানে হয় না। মেয়ের স্কুলগেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধ্বংস করতে করতে রজত ক্রমেই চটে উঠছিল। বাবার উত্তম মধ্যম, মায়ের চোখের জল, বউয়ের মুখ ঝামটা যা পারেনি; সিগারেটের দাম সেই অসাধ্য সাধন করেছে। হাফপ্যান্টে সিগারেট ধরা রজত ছমাস হল ধূমপান একদম ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু টুকুনের দিদিমণিরা আজ আবার বাজে খরচটা করিয়েই ছাড়ল। এবার যেন অন্যবারের চেয়ে বেশিই দেরি করছে রেজাল্ট বার করতে। ডিসেম্বরের রোদে এমনিতে মাথা গরম হওয়ার কথা নয়, বরং দিনদুয়েক হল জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে বলে রোদে দাঁড়িয়ে বেশ আরামই লাগছিল আর সব বাবা-মায়েদের। কেবল রজতের মনে হচ্ছিল গা পুড়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভৌতবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞানের সব নিয়মের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তার মানে ওটা স্রেফ মানসিক। বুঝতে পেরেই রজত সিগারেটটা কিনে ফেলল। তারপর দোকানের লাইটার দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে দুটো টান দিতেই, সামনে রোদে দাঁড়ানো দু-একটি মেয়ের মা ধোঁয়ার চোটে কাশতে শুরু করলেন। সকলে কটমটিয়ে রজতের দিকে তাকাল। কে যেন বলল “উফ! এইটুকু সময়ও সিগ্রেট না খেলে চলে না এদের।” অগত্যা রজত স্কুলের পাশের গলিটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে বাবা-মায়েদের সাইকেল, বাইক আর অপেক্ষমান টোটো ছাড়া কিচ্ছু নেই। স্কুলের দেড় মানুষ উঁচু পাচিল আর তিনতলা স্কুলবাড়িতে রোদও আটকে গেছে অনেকটা। কয়েকটা মিনিট রজতের উত্তেজনা কমেছিল, তারপর আবার যে কে সেই।
কে জানে কোন দিদিমণি মাইক নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্যে একের পর এক কীসব নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন মেয়েদের। তার একটাও রজতের কানে ঢুকছে না। ক্লাস তো শুরু হবে আর তিন-চারদিনের মধ্যেই। যা যা বলার প্রথম দিন প্রার্থনার সময়ে বলে দিলেই তো হয়। আজ সবাইকে ডাকা হয়েছে রেজাল্ট দেওয়ার জন্যে। এখন এসব উপদেশ দিতে হবে? “ধনধান্য পুষ্প ভরা” গাওয়া হয়ে গেছে, জাতীয় সঙ্গীত হয়ে গেছে। এবার সোজা যারা স্ট্যান্ড করেছে তাদের নাম ঘোষণা করে, হাতে মার্কশিটগুলো দিয়ে মেয়েদের বাড়ি যেতে দিন না বাবা। রজত মাস্টার হলে কখনো এইভাবে সময় নষ্ট করত না।
‘দাদা, একটু আগুনটা দেবেন?’ রজতেরই বয়সী একজন এসে চাইল। এও আরেক মেয়ের বাবা। তবে মেয়েটা উঁচু ক্লাসের, শাড়ি পরে।
‘আমার কাছে তো আগুন নেই, আমি দোকানের লাইটারটা দিয়েই ধরালাম।’
‘ও হো! মুশকিল হল। লাইটারটা বাড়িতে ফেলে এলাম…’
‘এতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারছেন না তো? স্বাভাবিক। এক ঘন্টার উপর হয়ে গেল এসছি। যারা রেগুলার খায় তাদের পক্ষে এতক্ষণ না খেয়ে থাকা…’
‘এক ঘন্টা! কই? মিনিট চল্লিশেক হয়েছে তো। এই দেখুন’ বলে লোকটা পকেট থেকে ফোন বার করে রজতের সামনে ধরল। কথাটা ঠিকই। রজত হিসাব করে দেখল স্কুল শুরুর ঘন্টা পড়ার পরে ৩৭ মিনিট কেটেছে।
‘আপনার মেয়ে কোন ক্লাসে?’ কথা ঘোরানোর জন্যে জিজ্ঞেস করল।
“মেয়ে না, নাতনি। আজ টেনে উঠবে।”
‘ও মা! আপনাকে দেখে তো বোঝাই যায় না!’ রজত না বলে থাকতে পারল না।
ভদ্রলোক বিলক্ষণ খুশি হলেন, লজ্জা লজ্জা মুখ করে গলা নামিয়ে বললেন ‘যাঃ! কী যে বলেন? চুলে রং করি তাই। নইলে আমারও আপনার মতই। সব পাকা।… আপনার মেয়ে কোন ক্লাস?’
‘সেভেনে উঠবে।’
বলেই কানে এল ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে যারা স্ট্যান্ড করেছে তাদের নাম ঘোষণা হচ্ছে। আধখাওয়া সিগারেটটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নর্দমায় ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে স্কুলের গেটের কাছে ফিরে গেল রজত। মাইকের আওয়াজটা গলির মধ্যে কেমন যেন কম কম লাগছিল। এরপরেই তো টুকুনদের পালা। কাল সন্ধেবেলা ফের সবকটা প্রশ্নের উত্তর লেখাতে গিয়ে ধরা পড়েছে, বাংলায় বিশেষ্য থেকে বিশেষণ করতে গিয়ে একটা ভুল করে এসেছেন মহারানি। সেকেন্ড সামেটিভ পর্যন্তও টুকুন সব সেকশন মিলিয়ে ফার্স্ট ছিল। এই পচা শামুকে পা কেটে না সেকেন্ড হয়ে যায়। সি সেকশনের সঞ্চয়িতার সঙ্গে মাত্র তিন নম্বরের ব্যবধান ছিল। টুকুনের খবর অনুযায়ী, ওই মেয়েটা বাংলায় বড্ড ভাল। সে নিশ্চয়ই এরকম বাজে ভুল করেনি। কাল রাতে অনেকদিন পরে খাসির মাংস হয়েছিল। সন্ধেবেলা ওই ভুলটা ধরা পড়ার পরে রজত কোনো স্বাদই পেল না। টুকুনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেল খেতে বসে। চুমকি খুব জুত করে রান্না করেছিল, বেচারি একেবারে চুপসে গেল। ও-ও তো আশা করে আছে মেয়েটা এবারে ফার্স্ট হবে। কেবল রজতের ঠাকুমারই এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তিনি ওদের হাবভাব দেখে খুব বিরক্ত হয়েছেন। রজতকে জোর ধমকও লাগিয়েছেন। “তর আর কাম নাই? অরে দিয়া এক কোশ্চেন কতবার লিখাইতাছস? কী লাভ এখন লিখাইয়া? যা ল্যাখার সে তো লিখ্যাই আইছে। অ্যাহন ভুল ধইরা কি তুই বদলাইতে পারবি? মিছামিছি মাইয়াডারে কাঁদায় দিলি, ভাল কইরা খাইতাছে না। এরপর শুইয়া শুইয়াও কাঁদব।” কথাটা ঠিকই। সকালে টুকুনের চোখ দুটো লাল ছিল, পড়তে বসে ঢুলছিল। অন্য দিন হলে রজত ধমকে ঘুম তাড়াত।
ফাইভের স্ট্যান্ড করা মেয়েদের নাম ঘোষণা শেষ হওয়ার পরেই আবার কী একটা গণ্ডগোলে ব্যাপারটা আটকে গেল। মাইক অন থাকায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সকলের কানে আসতে লাগল বড়দির গলা–
‘অ্যাই রাণু, এটা কোন ক্লাসের রেজাল্ট দিয়েছ? আগে সিক্স তো...’
‘মেয়েরা গোলমাল কোরো না। এতক্ষণ যেরকম শান্ত হয়ে ছিলে, সেরকম শান্তভাবেই অপেক্ষা করো। গণ্ডগোল করলে কিন্তু রেজাল্ট দিতে আরও দেরি হবে…’
‘আমি বাসন্তী দিদিভাইকে বলছি, যে মেয়েরা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তাদের সুশৃঙ্খলভাবে নিচে নিয়ে আসতে। অনেকে দেখছি ডেঞ্জারাসলি ঝুঁকে পড়ছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হবে?’
‘ক্লাস নাইনের মেয়েরা… অ্যাই, ওরা ক্লাস নাইন না?... হ্যাঁ, ক্লাস নাইনের মেয়েরা, তোমরা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছ। একদম চুপ করে বসো। না হলে কিন্তু তোমাদের রেজাল্ট শেষে অ্যানাউন্স করা হবে…’
‘কী, পাওয়া গেছে? দাও এদিকে। আরে বাবা ঠিক আছে…’
একটা করে সেকেন্ড কাটছে আর রজতের মনে হচ্ছে সিগারেটটা ফট করে ফেলে দেওয়া ভুল হল। এমনিতেও অতগুলো টাকা দাম। প্রায় অর্ধেক ফেলে গেল বলে গা কচকচ করছিল, নেহাত ওটা হাতে নিয়ে এদিকে এলে সবাই গালাগালি দিত তাই উপায় ছিল না। এখন মনে হচ্ছে সিগারেটটা দরকার ছিল। টেনশনে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাইকে বড়দির একেকটা কথার পরে অত লম্বা নীরবতা কেন থাকছে, ভিতরে কী চলছে বুঝতে না পেরে রজতের মেজাজ চড়তে শুরু করল। চারপাশের এতজন অভিভাবক কী করে যে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে তা কিছুতেই মাথায় ঢুকল না। একেকজন ওরই মধ্যে হাসিঠাট্টা করছে দেখে রাগও হল। এদের মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই নাকি? বোধহয় মান্ধাতার আমলের লোকেদের মত ভেবে রেখেছে– যা-ই করুক, সেই তো বিয়ে দিতে হবে।
দুশ্চিন্তায় ডুবে গিয়ে শেষমেশ সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে যারা স্ট্যান্ড করেছে তাদের কয়েকজনের নাম শুনতেই পেল না রজত। সম্বিত ফিরতে প্রথমেই কানে এল ‘ফোর্থ– রঞ্জাবতী সেনগুপ্ত…’। চার থেকে দশের মধ্যে টুকুনের নাম নেই। তাহলে কি প্রথম দশেও নেই মেয়েটা? তা কী করে সম্ভব? বাকিরা লাস্ট সামেটিভে এসে এত নম্বর মেক আপ করে ফেলল! নাকি প্রথম তিনেই টুকুনের নাম বলেছে? রজতের নিজেকে জুতোপেটা করতে ইচ্ছে হল। কী করা যায়? যতক্ষণ না টুকুন বেরোয় ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? ওরে বাবা! আরও এক দফা উৎকণ্ঠা! করব না করব না করেও ঠিক পিছনে দাঁড়ানো মোটাসোটা বেঁটেখাটো ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল ‘বৌদি, সিক্সে ফার্স্ট কে হয়েছে বলল?’ মুখটা চেনা। রজতের মতই উনিও রোজ মেয়েকে দিতে আসেন, নিতে আসেন। মেয়েটার মুখও চেনা। ধারণা ছিল সে-ও ক্লাস সিক্সেই পড়ে, তবে টুকুনের সেকশনে নয়। কিন্তু ভদ্রমহিলা বললেন ‘আমি তো শুনিনি, দাদা। আমার মেয়ে তো ক্লাস ফাইভ। আর আমাদের মেয়ে তো স্ট্যান্ড করার মেয়ে নয়।’ মাঝেমধ্যে রজত টুকুনের সঙ্গে স্কুলে আসতে পারে না, সেদিন চুমকি আসে। তাতেই চুমকি টুকুনের অনেক বন্ধুকে চেনে, অনেকের বাড়ির লোকের সঙ্গেও আলাপ করে নিয়েছে, ফোন নম্বর রাখে। রজতের ওসব ভাল লাগে না। আলাপ হলেই তো জিজ্ঞেস করবে ‘আপনি কিসে আছেন?’ বা ‘আপনার কি সার্ভিস না বিজনেস?’ তাই রজত আগ বাড়িয়ে আলাপ করতে যায় না। এই নিয়ে চুমকি প্রায়ই অভিযোগ করে। বলে মেয়ের বন্ধুদের পরিবারের সঙ্গে সদ্ভাব রাখা উচিত। অনেক খবরাখবর পাওয়া যায়, বিপদ আপদ হলেও কাজে লাগবে। রজত পাত্তা দেয় না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে চুমকি ঠিকই বলে। অন্তত কয়েকজনের মুখ চিনে রাখা উচিত ছিল। এই অসহ্য মুহূর্তগুলো কাটাতে হত না।
তার মধ্যে আবার দেখা গেল একটা লোক গম্ভীর গলায় পাশের জনকে বলছে ‘রেজাল্টগুলো ক্লাসে ক্লাসে দিয়ে দিলেই তো পারে। এরকম সব স্টুডেন্টকে এক জায়গায় করে মাইক নিয়ে পাড়া জানিয়ে কারা স্ট্যান্ড করেছে বলার কী আছে?’
শ্রোতা বলল ‘কেন? ভালই তো। আমরাও বেশ বাইরে দাঁড়িয়েই জেনে যাচ্ছি।’
‘কী দরকার তোমার সঙ্গে সঙ্গে জানার? মেয়ে বেরোলে তো জানতে পারবেই।’
‘সে ঠিক আছে, কিন্তু ধরো, এটা একটা গর্বের ব্যাপার তো। সবাই জানল তুমি স্ট্যান্ড করেছ। এটা তো মেয়েদের উৎসাহ দেবে।’
‘যে স্ট্যান্ড করেছে তার জন্যে গর্বের। যারা স্ট্যান্ড করেনি তাদের খারাপ লাগতে পারে তো?
‘খারাপ লাগলেও তো ভাল। মোটিভেশন পাবে– আগামী বছর আমি স্ট্যান্ড করলে আমার নামও সবাই জানবে।’
‘লেখাপড়ার মোটিভেশন কি ওইভাবে হয়? কী জানি! আমার তো মনে হয় এতে যারা স্ট্যান্ড করেনি তাদের আরও নিরুৎসাহ করে দেওয়া হয়। যেন স্ট্যান্ড করেনি বলে সে এলেবেলে। কোনো দিদিমণি কি তাদের আলাদা করে বলতে যায়, মন দিয়ে পড়ো, সামনের বছর তুমিও স্ট্যান্ড করবে? তুমি স্কুলে পড়ার সময়ে কোনোদিন কোনো স্যার তোমায় ওরম বলেছিল?’
লোকটার পণ্ডিতি দেখে রজতের গা পিত্তি জ্বলে গেল। স্ট্যান্ড না করলে তো এলেবেলেই। টুকুনের মত যারা বছর বছর স্ট্যান্ড করে তাদের সারাবছর পরিশ্রম করতে হয়। এখন তো সেই আগেকার দিন নেই, যে শুধু অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে আদাজল খেয়ে লেগেই বাজিমাত হয়ে যাবে। এখন প্রত্যেকটা পরীক্ষায় এগিয়ে থাকতে হয়। নইলেই অন্যরা টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবে। এই দৌড়ে যাতে টুকুন পিছিয়ে না পড়ে তার জন্যে মেয়েটাকে কী অমানুষের মত যে খাটাতে হয় সে তো আর ওই আঁতেল লোকটা জানে না। টুকুনের সঙ্গে সঙ্গে রজত নিজেও খাটে। দুবেলা এককাঁড়ি ছাত্র পড়িয়ে যখন শরীরটা আর দেয় না, তখনো নিজেকে টেনে টেনে মেয়ের সঙ্গে রাত বারোটা অব্দি জাগিয়ে রাখে সে। আবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় নিজে ওঠে, টুকুনকে ওঠায়। তবে না প্রতিবছর স্ট্যান্ড করে মেয়েটা। এত করেও তো হাইস্কুলে এসে ফার্স্ট হওয়া হল না। ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে বি সেকশনের সোমাইয়া বলে মেয়েটা ঠিক পাঁচ নম্বরের জন্যে ফার্স্ট হয়ে গেল, টুকুন হল সেকেন্ড। অবশ্য সোমাইয়া ফার্স্ট সামেটিভ থেকেই দু নম্বরে এগিয়েছিল, কিন্তু টুকুনটা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল মেক আপ করে দিতে। মাটি করে দিল পিটি পরীক্ষার নম্বরটা। কী করে যে এত কম দিল কে জানে! পিটির তো ক্লাসই হয়নি ঠিক করে। একটার পর একটা বৃহস্পতিবার কেটেছে আর টুকুন বাড়ি এসে বলেছে ক্লাস হয়নি। পরীক্ষার আগে স্রেফ দুদিন অন্য ক্লাসের সময়ে পিটি ক্লাস হল, তারপর একদিন পরীক্ষা নিয়ে নিল। সে আবার সকলের একসঙ্গে পরীক্ষা। সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে পিটি করিয়ে যা খুশি একটা নম্বর বসিয়ে দিয়েছে আর কি। তা ওইভাবে যখন পরীক্ষা নিলি, তখন সবাইকেই গড়ে নম্বর দিয়ে দে। ওর মধ্যে আবার কমবেশি কেন বাবা? কিসের ভিত্তিতে কমবেশি?
প্রশ্নটা গার্জেন্স মিটিংয়ে করেছিল রজত। বড়দি আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন ‘আসলে পিটির যে দিদিভাই ছিলেন উনি তো রিটায়ার করেছেন, তার জায়গায় এখনো নতুন কাউকে পাইনি। ফলে আমাদের একজন এক্স-স্টুডেন্টকে দিয়ে ক্লাস করাতে হচ্ছে। তাই একটু ডামাডোল চলছে, বুঝলেন তো…’
‘কিন্তু তাহলে মার্কিংটা কিসের ভিত্তিতে হল?’ রজত ছাড়ার পাত্র নয়।
বড়দি উত্তর দেওয়ার আগেই এক অভিভাবক বললেন ‘তা ওই মেয়েটাকেই বলুন না রেগুলার ক্লাস নিতে।’
‘সেটা কি হয়, দাদা? ও তো পারমানেন্ট স্টাফ নয়, ওকে সামান্য হাতখরচের টাকা দিই আমরা। ওই টাকা নিয়ে এত বড় ইস্কুলের এতগুলো ক্লাসের পিটি ক্লাস রেগুলার কী করে নেবে বলুন? রিকোয়েস্ট করাও ঠিক না।’
এইসব অভিভাবককে রজতের একদম পোষায় না। এরা কাজের কথা বাদ দিয়ে আর সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতে চায়। আরে বাবা কে ক্লাস নেবে, কতগুলো ক্লাস নেবে– সেসব তো স্কুলের মাথাব্যথা। আসল কথা হল নম্বরটা ঠিক দেওয়া হচ্ছে কিনা। রজত কথাটাকে সেইখানে ফেরানোর ফুরসত পেল না, আরেকজন বলে উঠল ‘পিটির দিদিমণি তো রিটায়ার করেচে অনেকদিন, আমার বড় মেয়ে তকন নাইনে পড়ত। একনো নতুন দিদিমণি নিলেন না?’
বড়দি আবার ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন ‘নেওয়া না নেওয়া কি আর আমাদের হাতে, দিদি? আমরা তো সেই কবে রিকুইজিশন দিয়েছি। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো হচ্ছেই না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কী চলছে আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমি আর কী বলব? মেয়েরা সাফার করছে দেখে আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু…’
‘তাহলে আপনারা মার্কিংয়ের জন্যে অন্য কোনো ব্যবস্থা করুন,’ রজত কথার মাঝখানেই ঢুকে পড়ল। ‘সারাবছর ধরে একটা ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্ট যদি…’
‘কটা দিন একটু মানিয়ে নিতে হবে। আমাদেরও কিছু করার নেই, আপনাদেরও কিছু করার নেই,’ বেশ কড়া সুরে মাথার সব চুল পেকে যাওয়া এক দিদিমণি বললেন। ইনি বড়দি নন। কিন্তু চেহারার মধ্যে, কথা বলার কায়দার মধ্যে এমন কিছু আছে যে রজত গুটিয়ে গিয়েছিল। তবু, জরুরি কথাটা তো বলতেই হবে। সে মিনমিন করে হলেও বলেছিল ‘না, আসলে নম্বরটা র্যাঙ্ক করার ক্ষেত্রে খুব ম্যাটার করে যাচ্ছে তো, তাই…’
রজত বোঝে যে অনেকেই র্যাঙ্কের মর্ম বোঝে না। আসলে যে কখনো র্যাঙ্ক করেনি তার তো কিছু এসে যায় না। তার জীবনে কিছু না হলে সে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে না। সে জানে– লেখাপড়া করিনি তাই চাকরিবাকরি হয়নি, এখন হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ করে কোনোমতে দিন গুজরান করতে হবে। কিন্তু রজতের মত র্যাঙ্ক করেও যার কিছু হল না, সে বোঝে ফার্স্টের জায়গায় সেকেন্ড হলে কতখানি তফাত হয়। আদিম মানুষ যেভাবে একটুকরো খাবারের জন্যে প্রাণপণ লড়াই করত পশু বা অন্য মানুষের সঙ্গে, সেইভাবে প্রত্যেকটা নম্বরের জন্যে লড়াই করতে হয়। এক নম্বর এদিক ওদিক হলেই পিছলে পড়বে ফার্স্ট ক্লাস থেকে সেকেন্ড ক্লাসে। সেকেন্ড ক্লাস জীবন মানে বিশ্রী জীবন, সকলের কাছে মাথা নিচু করে বেঁচে থাকার জীবন। পৃথিবীতে দুটোই ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাসের লোকেরা যা চায় তাই খায়, যা চায় তাই পরে, যা ইচ্ছে তাই বলে। বাকি সবাই সেকেন্ড ক্লাস। তাদের বাঁচা মরা নির্ভর করে ফার্স্ট ক্লাসের লোকেদের ইচ্ছার উপরে। তাদের কিছু বলার অধিকার নেই, কেবল শোনার অধিকার আছে। ফার্স্ট ক্লাসের লোকেরা যা বলে সেটাই তাদের শুনে যেতে হয়। রজতের জীবনটা সেকেন্ড ক্লাসেই কেটে যাচ্ছে, কেটে যাবে। টুকুনকে কোনোভাবেই সেকেন্ড হতে দেওয়া যাবে না।
২
কিন্ডারগার্টেনে রজত কোনোদিন সেকেন্ড হয়নি। মা বলত ইংরিজিতে ভাল না হলে চলবে না। মায়ের উদ্যোগেই পাড়ার তারক মাইতি বিদ্যাভবনের প্রাইমারিতে ভর্তি না হয়ে চিলড্রেন অফ গড স্কুলে ভর্তি হওয়া। মা নিজে নিয়ে যেত, নিয়ে আসত, ক্লাস সিক্স অব্দি পড়াশোনার ব্যাপারটাও আগাগোড়া নিজে সামলাত। একমাত্র ছেলেকে মানুষ করার জন্যে এত দৌড়াদৌড়ি কিন্তু ঠাকুমা খুব ভাল চোখে দেখত না প্রথম দিকে। কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা নিয়ে মায়ের জেদ দেখে বলেছিল ‘পোলারে সাহেব বানাইব অ্যাক্কেরে। আমগো বাড়িতে য্যান বাংলা মিডিয়ামে পইড়া সকলে গণ্ডমূর্খ হইছে।’ কথাটা রজতের ঠাকুমার মুখে মানায়। রজতের জেঠু, কাকা, বাবা সকলেই বড় বড় চাকরি করত। পিসি পর্যন্ত ইংরিজিতে অনার্স। নেহাত বিএ পরীক্ষার পরেই লোভনীয় সম্বন্ধ এসে গিয়েছিল, তাই আর এমএ না পড়ে বিয়ে করে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আমেরিকা চলে যায়। অবশ্য মায়ের পালটা যুক্তি তৈরিই ছিল– ‘এখন দিনকাল বদলে গেছে। ওই ক্লাস সিক্স থেকে ইংরিজি শিখলে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে না। আমাদের যখন ক্ষমতা আছে তখন ফ্রি-তে প্রাইমারি স্কুলে পড়াব কেন? বাপন গরিব দুঃখীর ছেলে হলে আলাদা কথা ছিল।’
ঠাকুমা গজগজ করতে করতে বলেছিল ‘অত গুমর ভাল নয়। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।’ কথাটা আজকাল শয়নে স্বপনে জাগরণে মনে পড়ে রজতের। অবশ্য তখন ও কথায় মা, বাবা কান দেয়নি। স্কুলের প্রথম পরীক্ষা থেকেই ফার্স্ট হতে শুরু করায় ঠাকুমাও প্রসন্ন হয়েছিল। নাতিকে নিয়ে পাড়াসুদ্ধ গর্ব করে বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম নিয়ে আপত্তি হাওয়া হয়ে যায়। ক্লাস ওয়ানে উঠতেই মা বলল, এই ছোট কিন্ডারগার্টেনে পড়ে থেকে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। কোনো ভাল কনভেন্টে চলে যাওয়া ভাল। তখন আর কে জানত – বাবার অত ভয়ঙ্কর স্ট্রোক হবে, চাকরিটা থাকবে না। ক্লাস থ্রি থেকে কনভেন্টে পড়ার কথা ছিল। খেলার বন্ধুদের জাঁক করে সেকথা বলেও রেখেছিল রজত। তার বদলে যখন কিন্ডারগার্টেনের খরচাও সামলাতে না পেরে ক্লাস ফোরে তারক মাইতিতে ভর্তি হতে হল, রজতের চোখ ফেটে জল এসেছিল। বন্ধুরা কিছু বলেনি, কিন্তু রজতেরই মনে হয়েছিল লজ্জায় মাথা কাটা গেল। যারা পাড়ার মাঠে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ভাল ছেলে বলে রজতকে সমীহ করত, তাদেরই ক্লাসে গিয়ে বসতে হল। মা হাহাকার করেছিল ‘আমার আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে থাকতেও আপত্তি নেই। কিন্তু ছেলেটার ভবিষ্যৎ এইভাবে নষ্ট হয়ে গেল! একটা মাত্র ছেলে… কত স্বপ্ন ছিল…’
রজতের সদ্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া বাবা তখন ভীষণ মুখ খারাপ করত। বাবাকে অমন ভাষায় কথা বলতে রজত জন্ম থেকে শোনেনি। ‘কর না। তোর ছেলেকে জজ ব্যারিস্টার কর। আমাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আয়, তারপর যা ইচ্ছে কর মাগী। দুবেলা ভাতের ঠিক নেই, ছেলেকে ইংরিজি শেখাবে।’ মা ঝগড়া করলে আরও খারাপ খারাপ কথা বলত বাবা। নিজের কিডনি বেচে দিতে বলত, রাগ খুব চড়ে গেলে মাকে বেশ্যাবৃত্তি করে ছেলের পড়ার খরচ চালাতে বলত। লজ্জার মাথা খেয়ে কাকা, জেঠু, পিসিদের কাছে হাত পেতে মা বিশেষ সাহায্য পায়নি। মা বারবার অন্যের কাছে হাত পাতার মানুষও নয়। তাছাড়া হাত পেতে কদিনই বা চলে? উপায় নেই দেখে যখন বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার কাজ নিল, তখন বাবা আর ঠাকুমা দুজনেই অনেক কথা শুনিয়েছিল। ওসব ছোট জাতের কাজ। বামুনবাড়ির বউ কখনো ওসব করে? মা বলেছিল ‘পেটে ভাত না থাকলে কি জাত খেয়ে পেট ভরবে?’
বাড়ির পরিবেশ তখন লেখাপড়া করার মত ছিল না। চেঁচামেচি লেগেই থাকত। কিন্তু রজত ক্লাসে খুব পিছিয়ে পড়েনি। প্রথম পাঁচের মধ্যে সে থাকতই। যেদিন অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোত, বছরের মধ্যে সেদিনটাই হত সবচেয়ে আনন্দের দিন। মা বাড়ি ফেরার সময়ে চপ বা সিঙাড়া, রসগোল্লা নিয়ে আসত, বাবার মুখেও সেদিন সারাক্ষণ হাসি থাকত। যেন সেই আগেকার বাবা। সারাবছর মাকে মুখঝামটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রজতকেও কারণে অকারণে ধমকাত, কিন্তু সেদিনটায় বুকে জড়িয়ে শুধু আদর। মাকে বলত ‘দ্যাখো রমা, আমার কিচ্ছু নেই। চাকরি নেই, টাকা নেই, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমার ছেলেটা আছে। ও আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।’ মা বলত ‘ওইটুকু আশা আছে বলেই না দিনরাত এত খেটেও বেঁচে আছি। নইলে এসব আমার দ্বারা হয়? বিয়ের আগে কোনোদিন কুটোটা নেড়েছি? বিয়ের পরেও তো রানির মতই ছিলাম…’ তারপর বাবার দিকে চোখ পড়ে বাবার মুখটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে দেখে কথা ঘুরিয়ে দিত। ওই একটা দিন ঠাকুমাও ‘ঘাটে যাওনের বয়েসেও খুন্তি নাড়তাছি’ বলে বিলাপ করত না। বাড়িতে কেবল আলু আর লাউ থাকলে তা দিয়েও কী করে যেন তিন-চারটে পদ রেঁধে ফেলত। বাবা যে একসময় ভাল গান গাইত সেটা আবার টের পাওয়া যেত সেদিন। সন্ধে হলে গুনগুন করত প্রথমে। তখন ঠাকুমা রান্নাঘর থেকে বলত ‘মিনমিন করস ক্যান? গলা ছাইড়া গা। অমন গলা তর…’ বাবা বলত ‘না না। বাপন পড়ছে তো।’ মা বলত ‘থাক। একটা দিন একটু কম পড়লে কিছু ক্ষতি হবে না। তোমার গান কতদিন শুনি না। কী ছাইপাঁশ দেখছ টিভিতে? বন্ধ করো, একটু গান শুনি।’ তার বেশি বলতে হত না। রজত বইপত্তর গুটিয়ে ফেলে এক লাফে আলমারির মাথা থেকে নামিয়ে বাবার সামনে রাখত হারমোনিয়ামটা। কালেভদ্রে ব্যবহার হলে যেমন আওয়াজ বেরোবার কথা, তেমনটাই বেরোত। কিন্তু সে আওয়াজে কান না দিয়ে বাবার দরাজ গলায় মন দিতে শিখে গিয়েছিল ওরা।
সে সুখ চুকে গেল ক্লাস এইটে। রজত এখন বুঝতে পারে, পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আক্রোশেই বাবা অত দুর্ব্যবহার করত। তখন সেকথা বোঝার বয়স হয়নি বলে একেকসময়, নিজের কাছ থেকেও লুকিয়ে, বিড়বিড় করত ‘গেলে বাঁচি’। লোকটা না থাকলে বাড়িটা একটু ঠান্ডা হবে, মায়েরও কষ্ট কমবে। বাবার চিকিৎসার খরচ কম নয়, এদিকে রোজগেরে মানুষ একা মা। লোকটাকে ভাল রাখার জন্যে উদয়াস্ত খাটো, গু-মুত ঘাঁটো, আবার তার গালাগালিও হজম করো। মাকে কোন পাপে এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে কিছুতেই ভেবে পেত না সে। কিন্তু বাবাকে পুড়িয়ে এসে লোহা ছুঁয়ে বারান্দায় উঠে মায়ের দিকে তাকাতেই সব বদলে গেল। আধখানা সন্দেশের স্বাদ মুছে গিয়ে তার ঠিক আগে দাঁতে কাটা নিমপাতার স্বাদে ভরে গিয়েছিল মুখটা। রজত বুঝতে পেরেছিল, মায়ের সমস্ত পাতা ঝরে গেছে। আর গজাবে না। কিন্তু তখনো খুব একটা কষ্ট হয়নি। বরং মনে হয়েছিল খরচ কমে গেল, মায়ের পরিশ্রম কমে গেল আর বাবাও বেঁচে গেল। শেষদিকে তো মনে হত উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। কান্না পেল অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে বাড়ি ফিরে।
হাইস্কুলে ঢোকার পর সেবারই প্রথমবার এবং জীবনে শেষবার ফার্স্ট হয়েছিল রজত। ঠাকুমা তার পথ চেয়ে বসেছিল বাইরের সিঁড়িতে, ঘরের জানলা বন্ধ। ওই জানলাটা খোলা রাখাই নিয়ম ছিল, যাতে বাবা খাট থেকেই রজতকে দেখতে পায় গলির মুখে আসা মাত্র। উঠোনে এসে সাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে ‘কত নম্বর হলি?’ মায়ের ওই ছমাসেই হাতের শিরা ফুটে উঠেছিল, অর্ধেক চুল পেকে গিয়েছিল, গলার স্বর নেমে গিয়েছিল কয়েক পর্দা। সেদিন সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফিরে রেজাল্ট দেখে মা খুশি হল কিনা বোঝা যায়নি। কেমন বোকা বোকা হেসে বলেছিল ‘এ মা! মিষ্টি আনতে ভুলে গেলাম যে?’ তখন রজত বাবার জন্যে কেঁদে ফেলে। মা কাঁদেনি, কাঠ হয়ে বসে ছিল। রজতের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ওর কপাল ভিজিয়েছিল ঠাকুমা।
নাইনে উঠতেই শুরু হল গোলমাল। কথা নেই বার্তা নেই, অন্য স্কুল থেকে এসে ভর্তি হল রঘু। রাঘব বিশ্বাস। ক্লাসের আর কেউ রজতের ধারেকাছে আসতে পারত না। যে-ই থার্ড হোক না কেন, রজত তার চেয়ে ১০-১৫ নম্বর বেশি পেত সব মিলিয়ে। কিন্তু রঘু হতভাগাকে কিছুতেই হারানো যেত না। সে ফার্স্ট হবেই। কখনো ভূগোলে মেরে দেয়, কখনো অঙ্কে একশোয় একশো পেয়ে বসে থাকে। মাস্টারমশাইরাও ক্রমশ রজতের চেয়ে রঘুকে বেশি ভালবাসতে শুরু করলেন। সামান্য ‘রবীন্দ্রনাথ’ রচনা– সেটা পড়েই নিতাই স্যারের সে কী প্রশংসা! ‘রাঘবের রচনাটা ক্লাসের প্রত্যেকে পড়বে। রচনা লেখা মানে কেবল এত সালে জন্মেছিলেন, অমুক স্কুলে পড়েছিলেন, এই এই বই লিখেছেন আর অত সালে মারা গেছেন লেখা নয়। ওগুলো প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা লেখে। তোমরা মাধ্যমিক দিতে চললে, হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছ, এবার একটু বড় হও বাবারা।’ অথচ রজত ক্লাস সেভেনেই এমন ‘শীতের সকাল’ রচনা লিখেছিল, যে ওই নিতাই স্যারই স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। রঘুকে হিংসা করা অবশ্য শক্ত ছিল। ছেলেটার মনটা বড়। কোনো বই ধার চাইলে কোনোদিন না বলেনি। অনুপাতের অঙ্কে সামান্য দুর্বলতা ছিল রজতের। গোবর্ধন স্যারের ক্লাসে বিশেষ লাভ হয়নি, বরং টিফিনে ফুটবল খেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে রঘু যা কষে দেখিয়ে দিত তাতেই জলের মত বোঝা হয়েছে। রজতদের বাড়িতেও এসেছে রঘু। নিজে নিজেই গোটা তিনেক বই ঘেঁটে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণের যে উত্তর লিখেছিল রজত, তার জন্যে শঙ্খ স্যার খুব প্রশংসা করেছিলেন। তারপর থেকেই রঘুর যাতায়াত শুরু। নাইনের হাফ ইয়ার্লি, অ্যানুয়াল; টেনের প্রি-টেস্ট, টেস্ট– চারটের একটাতেও রঘুকে টপকাতে পারেনি রজত। টেস্ট পরীক্ষার পরের তিনমাস দিনরাত এক করে পড়েও মাধ্যমিকে রঘু পেল ৭০০, রজত ৬৯৯। রজত হাল ছাড়েনি। ভেবেছিল ইলেভেন, টুয়েলভে রঘুকে দেখে নেবে। কিন্তু দুজনের ক্লাসই আলাদা হয়ে গেল।
রঘুর বাবার কোথায় ট্রান্সফার হয়ে গেল, ওরা চলে গেল সবুজগ্রাম ছেড়ে। রজত অনেক কষ্টে প্রাইভেট টিউশনি ছাড়াই মাধ্যমিক অব্দি চালিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক ওভাবে চলে না, জয়েন্ট পেতে গেলে তো একেবারেই নয়। অথচ মাকে মুখ ফুটে বলাও যায় না সেকথা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চিন্তা তাই গোড়াতেই বিসর্জন। আগেকার মা হলে রজত সে সুযোগ পেত না। মা ঠিক বলত ‘দরকার হলে একবেলা খেয়ে কোচিংয়ের পয়সা জোগাড় করব। কিন্তু জয়েন্ট দিতেই হবে।’ মায়ের চোখমুখের অবস্থা তদ্দিনে বেশ খারাপ। মাঝেমাঝেই চোখগুলো কেমন ঘোলাটে লাগে। তাকিয়ে থাকে, অথচ কিছুই শুনতে পায় না। সারাজীবনের কর্মঠ মা প্রায়ই কাজে বেরোতে চায় না, কারণ জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রজত নিজের বিবেচনায় নিচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করে তখনই, মায়ের চাপ কমাতে। ভাল মাস্টার হিসাবে নামডাকও হয়ে যায় অল্প দিনেই। ব্যাপারটা হেড মাস্টারমশায়ের পছন্দ হয়নি। তিনি ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন ‘মাধ্যমিকে তুমি আমাদের স্কুলে সেকেন্ড পজিশন। তোমার উপরে মাস্টারমশাইদের কত আশা জানো? এদিকে তুমি নাকি লেখাপড়া ফেলে টিউশন করে বেড়াচ্ছ?’
‘লেখাপড়া ফেলে করছি না স্যার। ওই…নিজের খরচটুকু নিজে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা আর কি। মা একাই তো এতবছর টানল… এখন আমি কিছু কিছু দায়িত্ব নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি…’
হেডস্যার কথাটাকে পাত্তাই দিলেন না।
‘শোনো বাপু, মার সবচে সাহায্য হবে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে। আর তার সবচে সোজা রাস্তা হল মন দিয়ে লেখাপড়া করে একটা ভাল চাকরিতে ঢোকা। কিন্তু তুমি যে রাস্তায় এগোচ্ছ, ওতে কিস্যু হবে না, নিজের লেখাপড়ার ক্ষতি ছাড়া। আমি কতবছর মাস্টারি করছি জানো? বত্তিরিশ বছর। তার মধ্যে লাস্ট দশ বছর বাদই দিলাম না হয়। কারণ হেডমাস্টার হবার পর থেকে পড়ানোর কাজ অনেক কম, অফিশিয়াল কাজ বেশি। তা ওই বাইশ বছরের এক্সপিরিয়েন্স থেকে তোমায় বলছি, পড়ানো অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ। যা এনার্জি খরচ হবে, নিজের পড়া করতে বসে দেখবে শরীর আর দিচ্ছে না। ঢুলে পড়ছ।’
‘সামলে নেব, স্যার। আমি তো জয়েন্ট দেব না, তাই অতটা চাপ…’
‘বাবা! এত বড় সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছ ইলেভেনে উঠতে না উঠতেই? তোমার বাবা নেই; জ্যাঠা, কাকা, মামা– তেমন বড় কেউই যখন নেই মাথার ওপর, তখন স্যারেদের সঙ্গে একবার পরামর্শ করা উচিত ছিল না?’
‘জানি স্যার, কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কী করব? আপনি তো জানেন নিজে নিজে পড়ে জয়েন্ট দেয়া না দেয়া সমান। আর আমার তো কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার মত অবস্থা নয়…’
এরপর আর হেডস্যার কথা বাড়াননি। তবে আড়াই বছর পরেই অবসর নিতে হবে। তারপর একখানা শস্তা জয়েন্টের কোচিং সেন্টার খুললে যে ছাত্রছাত্রীর অভাব হবে না, সেকথাটা বুঝতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। তিনি নিজে বায়োলজির, গিন্নি অঙ্কের। কেমিস্ট্রি আর ফিজিক্স পড়ানোর লোক জোগাড় করে ফেললেই যে কেল্লা ফতে, তা বুঝতে পেরে তিনি যারপরনাই আহ্লাদিত হন। ঘন দাড়ির আড়ালে তাঁর প্রসন্নতা অবশ্য রজত টের পায়নি। টের পেতে দিলে তা প্রধানশিক্ষকসুলভ হত না।
পড়ানোর পরিশ্রম সম্পর্কে হেডস্যার যা বলেছিলেন সেটা যে ভুল নয় তা টের পেতে অবশ্য বেশিদিন লাগেনি রজতের। কিন্তু টাকার দরকারটা আবার প্রায় সেই সময়েই বেড়ে গেল। মা যে সুস্থ নেই সেকথা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলেছিল অনেকদিন। কারণ অসুস্থ মানলেই ডাক্তার দেখাতে হবে, দেখালেই ওষুধপত্র। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলে যায়, তার উপর আবার চিকিৎসার খরচ! কিন্তু মা যেদিন সন্ধে উতরে গেলেও বাড়ি ফিরছে না দেখে খুঁজতে বেরোতে হল, আর কোথাও খুঁজে না পেয়ে পুলিসে খবর দিতে হল, সেদিনই বোঝা গেল, মায়ের অসুস্থতা স্বীকার না করে উপায় নেই। পুলিস নয়, রাত এগারোটা নাগাদ মাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছিল সবুজগ্রামের বাসিন্দা একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। ভাগ্যক্রমে সে একেবারে অন্য লাইনের একটা লোকাল ট্রেনে ব্যবসা করতে উঠে রজতের মাকে দেখতে পায়। প্রথমে উনি চিনতেও পারেননি। তারপর চিনতে পেরে বাড়ি যেতে চেয়ে কান্নাকাটি।
এমন ভুলো মহিলার হাতে বাচ্চাদের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না। রজত একবার ভেবেছিল মায়ের কাজটা নিজে নিয়ে নেবে। বাচ্চাগুলোর বাবা-মায়েদের আপত্তিও ছিল না, বাদ সাধল ঠাকুমা। ‘তরে বড় মানুষ বানাইব বইল্যা তর মায়ে কী না করছে? অ্যাহন তুই ল্যাখাপড়া ছাইড়া দিয়া বড়লোকের পোলাপান আনা নেয়া করবি? হেইডা কি ন্যায্য কতা?’ রজত তখন ক্লাস টুয়েলভ, আঠেরোয় পা দেয়নি। কিন্তু দুনিয়ায় প্রায় কিছুই যে ন্যায্য নয় তা বুঝতে বাকি নেই। সেকথাই সে ঠাকুমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। ঠাকুমা বলল ‘সে তুমি যা ভাল মনে হয় করো। কিন্তু মনে রাইখো, মা চিরকাল কারো থাকে না আর আমার তো তিনকাল গিয়া এককালে ঠ্যাকছে। অ্যাহন ল্যাখাপড়া ছাইড়া দিলে পরে কিন্তু হাত কামড়াইবা। সারাডাজীবন কি পরের বাচ্চা দেয়া নেয়া কইরা কাটাইবা? হেইডা একখান কাম হইল শিক্ষিত পোলার?’ শেষপর্যন্ত টানাটানির সংসার পড়িয়ে চালানোই ঠিক হয়েছিল, কারণ পড়াতে পড়াতে খানিকটা পড়া হয়। তাছাড়া ঠাকুমার তখনো আশা ছিল – ‘একখান ইশকুল মাষ্টার তো হইয়াই যাবি, দাদু। তাইলেই আমাগো আর চিন্তা নাই।’ রজতেরও সুপ্ত ইচ্ছা তেমনই ছিল। তদ্দিনে চুমকি হ্যাঁ বলে দিয়েছে। শুধু টিউশনি করে যে ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না, তা রজত ভাল করেই জানত। নিজের বোন থাকলে তাকে কি একটা বেকার, টিউশনি করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হত সে?
উচ্চমাধ্যমিকটা পড়ে, পড়িয়েই পাস করা গিয়েছিল। রজতের সেকেন্ড ক্লাস জীবনের সেই শুরু। ক্লাসে সেকেন্ড থেকে সোজা সেকেন্ড ডিভিশন।
৩
টুকুনটা রূপে লক্ষ্মী হয়নি। মেয়েটার আর দোষ কী? বাপ, মা দুজনেরই গায়ের রং কালো। অবশ্য চুমকি ভাগ্যিস কালো, নইলে কি আর রজতের এ জন্মে পাওয়া হত তাকে? তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কে দেখেছে, গুণের খবরই বা কে রেখেছে? ভাগ্যিস এক প্লেট মিষ্টি খেয়ে, মিষ্টি হেসে “আমরা জানাব” বলেই চলে যেত সবাই! তাই তো প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুভাষ স্যার স্রেফ টিউশন করা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হলেন শেষপর্যন্ত। ফরসা হলে চট করে কারোর পছন্দ হয়ে যেত, তারপর হাজার কান্নাকাটিতেও স্যারের মন গলানো যেত না। বিশেষ করে যেখানে চুমকির মাও সিনেমার নায়িকাদের মায়ের মত ছিলেন না। সে কথা থাক। কথা হচ্ছে টুকুন রূপে লক্ষ্মী যখন হয়নি, তখন রজত ওকে গুণে সরস্বতী করে তুলবেই। শুধু লেখাপড়ায় ভাল হলে তো আজকাল চলে না। রজতের ছোটবেলায় যেগুলোকে ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি’ বলত বড়রা, মেয়ের সেগুলোকেও ঘষে মেজে এমন করে ফেলতে হবে যেন দরকারে তাই দিয়েই পেট চলে যায়।
‘আহা! গানবাজনা কি পড়াশোনার মত নাকি? কেবল খাটলেই ওসবে ভাল হওয়া যায়? ওসব গুণ মানুষ নিয়েই জন্মায়। নয় তো হয় না’ চুমকি বলে। গানের ক্লাসে কি আবৃত্তির ক্লাসে যাওয়া নিয়ে টুকুন কোনোদিন আলস্য করলে যখন রজত বকাবকি করে, তখন ঠাকুমাও বলে ‘সাধ করে পাতা পাতলে কী হয়? দেওইয়ার ওজন আছে।’ রজত ওসবে কান দেয় না। এখন অব্দি কান দেওয়ার দরকার পড়েনি। কারণ দেওয়াইয়া যথেষ্ট দিয়েই পাঠিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আবৃত্তির দিদিমণি সকলের সামনেই টুকুনকে নিজের সেরা ছাত্রী বলেন। ক্লাস সিক্সের ঢ্যাঙা মেয়েটা যখন বকের মত গলা বাড়িয়ে বলে ‘তোমার কিবা অভাব আছে/ভিখারি ভিক্ষুকের কাছে!’ তখন মনেই হয় না ও ক্লাস সেভেন। রজত পরিষ্কার বুঝতে পারে– সামনে বসা শ্রোতাদের বুক টনটনিয়ে ওঠে। উঠতে বাধ্য। এমনি এমনি কি আর পরপর প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পায়? অধিকাংশ জায়গায় ফার্স্টও হয়। গানের মাস্টার শরৎদাও বলে ‘মেয়েটার সামনে বলব না, রজত। কিন্তু গলায় বড় সুর রে। এই বয়েসে অমন সুর সহজ কথা না। গানটা কিন্তু পড়াশোনার চাপ বাড়লে ছাড়িয়ে দিস না। আমি বলছি, ওর মধ্যে মাল আছে। তবে ওকে আবার বলিস না আমি এই কথা বলেছি। তোরাও সামনে বেশি প্রশংসা করবি না কিন্তু। মাথায় যদি একবার ঢুকে যায় আমি ভাল গাই, তাহলেই হয়ে গেল।’ রজত ওই ভুল করার ছেলে নয়। সে জানে ভালর কোনো শেষ নেই, শেষ করতে নেই। ওরকম ভাল হাজার হাজার আছে। তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। তবে নিশ্চিন্ত।
টুকুন চেষ্টা করলেই পারবে। ওর বয়সে রজত এতকিছু একসঙ্গে পারত না। ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময়ে রজত থোড়াই রাত একটা-দেড়টা অব্দি পড়তে পারত। পরীক্ষার আগের কয়েকদিন তেমন করতে হলেও ঘুমে চোখ বুজে আসত। অথচ টুকুন কখনো বেশি রাত অব্দি পড়তে বললে মুখ ভার করে না, পরীক্ষা সামনে থাকুক আর না-ই থাকুক। একেকদিন রজতেরই কষ্ট হয়, মায়া হয় মেয়েটার জন্যে। মনে হয় মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে ‘আজ থাক। বম্মার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়, মা।’ নিজেকে আটকাতে রজত উঠে রান্নাঘরে যায়, পরপর দু গ্লাস জল খায়। নিজের ঘুম পেলে চোখে জলের ঝাপটা দেয়, কিন্তু যে টাস্কটা করতে দিয়েছে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত টুকুনকে ছাড়ে না। ঠাকুমা আজকাল বয়সের ভারে আর চেঁচামেচি করতে পারে না। তাছাড়া বলে বলে হদ্দ হয়ে গেছে, তাই বলা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু চুমকি রাতে শুয়ে মাঝেমাঝে কেঁদেই ফেলে।
‘এত অত্যাচার কেন করো মেয়েটার উপরে? মাঝরাত অব্দিও পড়বে, আবার সকাল সাতটা না বাজতে টেনে তুলে দেবে। ওইটুকু মেয়ের এত সহ্য হয়? পরীক্ষার সময় করলে একরকম। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই, এ কী কথা!’
‘শুধু পরীক্ষার সময়ে দিনরাত পড়লে হয় না চুমকি। সারাবছর এইভাবে পড়ে বলে সবসময় স্ট্যান্ড করে। আমি সকাল সন্ধে যে গাধাগুলোর পেছনে লেগে থাকি তাদের কজন ওইভাবে পড়ে? পড়ে না বলেই সেরকম রেজাল্ট হয় না…’
‘তা সবসময় স্ট্যান্ড করার দরকার কী?’
‘মানে! কী আজেবাজে বকছ? কম্পিটিশন কোন জায়গায় গেছে দেখতে পাও না? ভাল ভাল ছেলে চাকরিবাকরি পাচ্ছে না। যাদবপুর, শিবপুর, আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বাড়িতে বসে আছে শয়ে শয়ে ছেলেমেয়ে। আমাদের সময় স্ট্যান্ড করলে তাও কিছু না কিছু হয়ে যাবে গ্যারান্টি ছিল। এখন ফার্স্ট হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
‘আরে সবে তো ক্লাস সিক্স…’
‘সবে ক্লাস সিক্স মানে? এখন থেকে তৈরি না হলে মাধ্যমিকে একটা এলেবেলে রেজাল্ট করবে, তারপর এই আমাদের মত জীবন হবে। তাই চাও তুমি? তাও তো ইংলিশ মিডিয়ামে দিতে পারিনি। ওখানেই তো আদ্ধেক পিছিয়ে পড়ল। অন্তত এই লাইনের একেবারে সামনে থাকতে না পারলে কী করবে? কী খাবে?’
‘উফ! আচ্ছা, একটা পরীক্ষায় ফার্স্ট কজন হয়? যারা হয় না তাদের কি কিছুই হয় না নাকি? এত যে…’
‘যারা হয় না তাদের কী হয়? দেখছ না পিকুকে? আমার মত হাল তো নয়। চিরকাল ভাল ইস্কুলে, ভাল কলেজে পড়ল। তারপরেও শুকনো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পরশু রাজেনদার সাথে দেখা হল, বলল এতদিন পরে কী একটা কম্পানিতে নাকি চাকরি পেয়েছে। মোটে বিশ হাজার টাকা মাইনে, তাও এক বছরের কনট্রাক্ট। সকাল আটটায় যায়, বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা, মাঝেমাঝে নাকি রোববারেও যেতে হয়। ভাবো একবার। ছেলেটাকে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ম্যানেজমেন্ট পড়িয়েছিল রাজেনদা।’
‘আরে বাবা টুকুন তো মেয়ে। চাকরিবাকরি কিছু না হলেই যে চলবে না তা তো নয়…’
‘মানে! কী যা তা বলছ? এত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছি কেবল একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব বলে!’
‘তা বিয়ে তো এমনিও দিতে হবে, অমনিও দিতে হবে।’
‘সে আলাদা কথা। ভাল কাজকম্ম করলে মেয়ের ওজন হবে, সেই মত জামাই হবে। নইলে একটা আলফাল কারো হাতে দিতে হবে। ভাল হবে সেটা?’
‘অত নাক ভাল নয়। বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চাইলে হয়?’
এই কথার পরে অন্য পাশ ফিরে চুপ করে যায় রজত। কারণ তার মনে হয়, চুমকির মনে কোথাও একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে। সে এতবছর পরেও হয়ত ভাবে, রংটা ফরসা হলে তাকে এই জীবন কাটাতে হত না। হয়ত রজতকে ভালবাসে বলে রাগ করে কখনো একথা বলে না, কিন্তু টুকুনের কথা বলতে গিয়ে আসলে সে নিজের কথাই বলে। মনের গভীরে হয়ত তার চাঁদ ধরার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু একে রজতের সঙ্গে ক্লাস নাইন-টেন থেকে প্রেম, তার উপর কালো বলে একের পর এক সম্বন্ধ ভেঙে যেত। তাই রজতকেই মেনে নিতে হয়েছে। তেমন রাতে এই ভাবনায় সারারাত রজতের ঘুম আসে না। ঘর গেরস্থালির কাজের ক্লান্তিতে চুমকি অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ে, রজত এপাশ ওপাশ করে। তারপর একসময় উঠে পড়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। উল্টোদিকের বাড়ির বাবলু অনেক রাত অব্দি ওর ল্যাপটপে কাজ করে গান চালিয়ে দিয়ে। ছেলেটার গানের রুচি আছে। ‘মেরে মহবুব কয়ামত হোগি/আজ রুসওয়া তেরি গলিয়োঁ মে মহব্বত হোগি’ শেষ হলে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নর্দমায় ছুড়ে ফেলে রজত ঠাকুমার ঘরে যায়। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও টুকুনের মুখটা আশার আলোয় উদ্ভাসিত থাকে। রজত মশারি তোলে। উদ্দেশ্য মেয়ের ঘুম না ভাঙিয়ে দুগালে দুটো চুমু খেয়ে চলে আসা। কিন্তু কোনো কোনো দিন টুকুন দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে, তারপর বাবার গালে চুমু খায়। সজাগ অবস্থায়, নাকি ঘুমের মধ্যে তা বোঝা যায় না। কারণ চুমু খাওয়ার পরেই হাতদুটো আলগা হয়ে যায়।
সেইসব রাতের পরের ভোরে রজতের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়লে টুকুনই এসে ডেকে তোলে। বেসিনে দাঁত মাজতে মাজতে আড়চোখে চুমকির দিকে তাকিয়ে রজতের অপরাধবোধ হয়। কারণ সকালে ওর কাজের উৎসাহ দেখলে নিশ্চিত বোঝা যায়, চুমকির মোটেই কোনো অভিযোগ নেই পয়সাওলা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি বলে। খামোকাই রজত বারবার ভুলভাল চিন্তা করে নিজের ঘুম নষ্ট করে। কিন্তু সে যা-ই হোক, টুকুনকে কিছুতেই মন ছোট করতে দেওয়া যাবে না। তাকে ফার্স্ট করতেই হবে। সবেতে ফার্স্ট।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
৪
সেই নার্সারি থেকেই প্রতিবার রেজাল্টের দিন রজতের মনে হয় মেয়েটা স্কুল থেকে বেরোতে বড় দেরি করছে। সে জানে ললিতমোহন বালিকা বিদ্যাভবন এখন যত বড় স্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার তুলনায় স্কুলগেটটা বড্ড ছোট। তার উপর টুকুনের ক্লাসটা দোতলায়, বেরোতে সময় লাগবে। কিন্তু মন সবসময় মাথার কথা শুনলে তো কথাই ছিল না। অনেকসময় মাথাই যে ভুল করে, মন ঠিক বলে– সেকথা রজতের চেয়ে ভাল করে কেউ জানে না। যেমন মা যেদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটু ভাঙল, রজতের মন স্পষ্ট বলেছিল– এবার মা মারা যাবে। অথচ সেরকম ভাবার কোনো কারণ ছিল না। অপারেশনের আগেরদিন সে যখন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে ‘ডাক্তারবাবু, মা বাঁচবে তো?’ উনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। ‘আরে মশাই হাঁটু ভাঙলে মানুষ মরে নাকি? খুব বয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে অন্য কমপ্লিকেশন থাকলে হয় অনেকসময়। আপনার মা তো মোটে একষট্টি!’ কিন্তু বাঁচল না তো। বাড়ি আনার কয়েকদিন পরে ঘুমের মধ্যে চুপচাপ মরে পড়ে রইল। সকালের আগে টেরও পাওয়া যায়নি।
শুধু সেবারই নয়।
সকাল, বিকেল টিউশনি করে দুবার এসএসসি পরীক্ষায় সুবিধা করতে না পারার পর তৃতীয়বারে দারুণ প্রস্তুতি হয়েছিল। পরীক্ষাও হল খুব ভাল। বারবার হিসাব করে রজত নিশ্চিত হয়েছিল, এবারে সে পাস করে যাবেই। ঠাকুমা শুনে ঠাকুরের ছবিতে হাত ছুঁইয়ে বলেছিল ‘আমগো দুঃখের দিন এইবারে শ্যাষ হইল। কম কষ্ট করছস? বৌমাও বিয়ার আগে থিকাই করতাছে। ঠাকুর তো আর পাষাণ না, যে মুখ তুইল্যা চাইব না।’ চুমকি মাসকাবারির খাতায় লিখে ফেলেছিল কী কী করতে হবে চাকরিটা হয়ে গেলে। বাড়িটা রং হয়নি অনেককাল। ‘শোনো, ভেতরে আপাতত চুনকাম হলেই হবে, বাইরেটা কিন্তু সুন্দর করে রং করাব। পাড়ার আর সব বাড়িগুলো কীরকম ঝকঝক করে…’
‘তুমি ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে একটা বাইক কিনে নিও। দুবেলা ছাত্র পড়াচ্ছ, অন্য কাজের খাটনিও বাঁচবে, সময়ও বাঁচবে।’
‘আরে ধুর! চাকরি পেয়ে গেলে আর এত টিউশনি করব নাকি? সময়ও পাব না। কোথায় স্কুল হবে তার ঠিক আছে? আসতে যেতে সময় যাবে, তার উপর ডেলি প্যাসেঞ্জারির খাটনি আছে। কমিয়ে ফেলব,’ রজত বলেছিল।
‘তাহলেও। যদি খুব দূরে স্কুল হয় তাহলেও তো বাইক থাকলে ভাল। যাতায়াত নিজের হাতে।’
কখনো আবার চুমকির উলটো দুশ্চিন্তা হত।
‘আচ্ছা, যদি অনে-এ-এক দূরে স্কুল হয়? ওই যে জিতুদার বউয়ের যেমন হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ওরকম হয় অনেকের। আমারই একটা স্টুডেন্টের মা তো সেই বীরভূমের লাভপুরে একটা স্কুলে পড়ায়। এতদূর থেকে যাতায়াত করা যায় না বলে ওখানেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। শনিবার স্কুল করে আসে, সোমবার সকালে চলে যায়।’
চুমকির মুখটা অন্ধকার হয়ে যেত। রজত তাতে বেশ মজা পেত। গম্ভীর মুখে বলত ‘সেরকম হলে আমিও স্কুলের কাছেই থাকব। কিছু তো করার নেই।’
‘ও মা! আমি একটা বুড়ি মানুষ আর এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে একা একা থাকব!’
‘থাকবে। যাদের বরের ট্রান্সফারের চাকরি হয় তারা থাকে না? আমার বড়জেঠু তো রেলে চাকরি করত। সারাজীবনই কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে থেকেছে। বড়মা মেয়েদের নিয়ে এই বাড়িতে থাকত। তুমিও তেমন থাকবে।’
চুমকি অভিমানে উঠে চলে যেত। খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে বলত ‘আমি জানতাম তোমার মায়াদয়া নেই। আমি না হয় বাজে দেখতে, বেশি লেখাপড়া জানি না, ঠ্যাকায় পড়ে বিয়ে করেছ। মেয়েটা তো তোমার নিজের। তার জন্যেও কষ্ট হবে না তোমার?’
ঠাকুমা পাশের ঘর থেকে উঠে এসে রজতের চুলের মুঠি ধরে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে দিত। তারপর চুমকিকে বলত “অরে মাইয়া, তর কি মাথায় বুদ্ধি আর হইব না? শয়তানটা তর পিছনে লাগতাছে বোঝস না? বলে চক্ষে হারায়, ও নাকি দূরে গিয়া থাকব। হনুমানের মতোন সাগর পাইরাইয়া চইল্যা আইব দেহিস। আর এই যে আমার এট্টুকুন পুতিন হইছে, হেইডারে না দেইখ্যা কি একদিনও থাকন যায়?’
‘না ঠাকুমা, সত্যিই অনেককে অনেক দূরের স্কুলে দেয় কিন্তু। খুব অসুবিধা হলে আবার পরে পরীক্ষা দিয়ে স্কুল বদলাতে হয়। সেরকম হলে যে কী হবে…’
‘গাছে কাঁটাল থাকতে গোঁপে তেল দিস না বাপ। আর তেমন হইলে আমি থাকুম এইহানে। যে কয়দিন আছি, শ্বশুরের ভিটা ছাইড়া যামু না। অদের তুই নিয়া যাস। মাইয়াডার তো সাত চড়ে রা নাই, কোনো শখ আহ্লাদও নাই। আবার আমাগো কালের মতোন বরের থিকা দূরেও থাকব, হেইডা কোনো কতা হইল?’
তা এসব কথা যখন চলছে, তখন রজতের মন কিন্তু বারবার কুডাক দিত। মনে হত ঠিক এমন একটা কিছু ঘটবে যার ফলে চাকরিটা হবে না। হল না তো। থাকার মধ্যে ছিল বাড়িটা। সেটা বেচে দিলে মানুদা যে টাকাটা দিতে বলেছিল তা জোগাড় হয়ে যেত। কিন্তু চারজনে মিলে দাঁড়াত কোথায়? সম্বল বলতে আর ছিল চুমকির গয়না। রজত না চাইতেই চুমকি সেটা বিসর্জন দিতে রাজি ছিল। রজতই পারল না নিতে।
‘আমার তো তুমি আছ। তোমার চাকরি হোক, আবার গয়না গড়িয়ে দেবে এখন।’
‘বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিও না তো! আবার গয়না গড়িয়ে দেবে। স্কুলমাস্টারের একেবারে লাখ লাখ টাকা মাইনে কিনা। আমার তো ফুটো পয়সাও ছিল না। তোমার বাবার টাকা ছিল বলে ওই কটা গয়না পেয়েছ। ওতে আমি হাত দিতে পারব না।’
‘আমার জিনিস, তোমার জিনিস কি আলাদা নাকি?’
‘এই জিনিসটা আলাদাই। বউয়ের গয়না বেচা মহাপাপ। আমার বাবা-মা উপর থেকে দেখছে না? চরম অভিশাপ দেবে। ও আমি পারব না।’
রজত ভেবে দেখেছে, রাঘব বিশ্বাসের মত ফার্স্ট বয়দের জীবনে এসব সমস্যা হয় না। রঘুর মত রেজাল্ট করতে পারলে স্কুলমাস্টারির চাকরির ভরসায় বসে থাকতে হত না, ঘুষ না দিলে চাকরি হবে না– এমনও হত না। আজকাল ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি হচ্ছে না বটে, ওদের সময় দিব্যি টকাটক চাকরি হয়ে যেত। এক ক্লাসে পড়া কত ছেলে আজ স্বদেশে বিদেশে ইঞ্জিনিয়ার। আর টুকুনকে যদি ডাক্তার করা যায় তাহলে তো কথাই নেই। এত বড় দেশে ডাক্তারের পেশেন্টের অভাব হবে না কোনোকালে। কিন্তু সেখানেও কম্পিটিশন। চারদিকে এত ডাক্তার। একেবারে সেরা ডাক্তার না হলে পসার জমবে না। স্রেফ আরও একজন ডাক্তার হয়ে লাভ নেই।
‘অদ্বিতীয়ার বাড়ির লোক কে আছেন?’
স্কুল প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। তাহলে এবারেও মনই ঠিক। খারাপ কিছু হয়েছে।
‘এই যে, আমি। কী হয়েছে দাদা?’
‘বড়দি ডাকছেন।’
বড়দির ঘরের বাইরে বেশ বড় করেই লেখা আছে– HEADMISTRESS। রজত দৌড়ে সে ঘরের দিকেই যাচ্ছিল, পিওন বলল ‘ওদিকে না। এই ঘরে আসুন।’
ঘরটা বোধহয় সিক রুম। দুটো বেঞ্চ জুড়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে টুকুনকে। ওদের বড়দি মানুষটি গোলগাল, দেখলে রাগতে পারেন বলে মনে হয় না। কিন্তু গলার স্বরে বোঝা গেল বেশ অসন্তুষ্ট। ‘এর তো ভীষণ লো প্রেশার। মেয়ের শরীরের দিকে একটু নজর দিতে পারেন না?’
রজত কী বলবে ভেবে পেল না। বারো বছরের মেয়ের আবার লো প্রেশার হয়! টুকুন ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। অন্য এক দিদিমণি জানালেন ‘আজকে স্কুলে এসে থেকে ওকে কীরকম অসুস্থ অসুস্থ লাগছিল। বাড়ি নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখান।’
‘একটু ভাল করে ডাক্তার দেখাবেন। ব্লাড টেস্ট-ফেস্ট করান, অ্যানিমিয়া আছে কিনা দেখুন। আমি তো ক্লাস টিচার, আমার অনেকদিন থেকেই কেমন দুর্বল দুর্বল লাগে। মাঝেমাঝেই দেখি ফার্স্ট পিরিয়ডে ঝিমোচ্ছে,’ এক অল্পবয়সী দিদিমণি বললেন।
বড়দি রীতিমত ধমকে বললেন ‘এইটুকু মেয়ে, চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। মেয়েটার মুখের দিকে ঠিক করে তাকিয়েও দেখেন না, নাকি?’
টুকুন বলে উঠল ‘না দিদিভাই, কাল রাতে আসলে শুতে দেরি হয়ে গেছিল…’
‘কটায় শুয়েছিস?’
“সাড়ে বারো…”
‘অ্যাঁ! অত রাত অব্দি জেগে থাকতে দেন কেন মেয়েকে? কী করছিলিস? টিভি দেখছিলিস নিশ্চয়ই?’
‘না, টিভি তো প্রায় দেখেই না,’ রজত শেষমেশ মুখ খোলার জোর পায়। ‘পড়াতে পড়াতেই রাত হয়ে গেল আর কি।’
‘বাপ রে! রেজাল্টের আগেরদিন এত কী পড়াচ্ছিলেন, দাদা?’ টুকুনের ক্লাস টিচার হেসে ফেলেন। ‘অদ্বিতীয়া তো যথেষ্ট পড়াশোনা করে। তাতেও আপনি খুশি না?’
বড়দিরও মুখে হাসি ফোটে। ‘মেয়েকে শুধু ক্লাসে ফার্স্ট করলেই হবে না। শরীরটা আগে, বুঝেছেন? এবারে রেজাল্ট নিতে এসে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। কোনোদিন যদি পরীক্ষা দিতে এসে অজ্ঞান হয়ে যায়? তাহলে ফার্স্ট হতে পারবে? যতই রাত জেগে পড়াশোনা করান।’
‘ফার্স্ট! ফার্স্ট হয়েছে?’
‘ও মা! মাইকে অ্যানাউন্স করা হল তো! আপনি তখন ছিলেন না বাইরে?’
রজত বোকা বনে যায়।
‘যা-ই হোক, মেয়ে তো বলল সাইকেলে করে নিয়ে যান। এখন সাইকেলে নিয়ে যাবেন না, রিকশা ডাকুন। আবার মাথা ঘুরে গেলে মুশকিল হবে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে ভাল করে খাওয়া দাওয়া করান, ঘুমোতে দিন একটু।’
রজত সাইকেলটা স্কুলের উল্টোদিকে রাজুর দোকানে রেখে দিয়ে টুকুনের সঙ্গে রিকশায় চেপে বসে। ওর মাথাটা কাঁধে রেখে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ে। সত্যিই তো! বড় ক্লান্তি মেয়েটার মুখে, খেয়ালই করা হয়নি। বাড়িতে আজ আগে বকাবকি করবে চুমকি আর ঠাকুমা, আনন্দ হবে পরে। আয়োজনটা তো চাই। জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে রিকশা থামিয়ে নলেনগুড়ের রসগোল্লা আর এক ভাঁড় দই কেনে রজত। টুকুনের দইটাই বেশি পছন্দ। রিকশায় উঠতে গিয়ে চোখ পড়ে খবরের কাগজ লাগানো বোর্ডটায়। পরীক্ষা পাস করে চাকরি পাচ্ছে না বলে ছশো দিন হয়ে গেল রাস্তায় বসে আছে অনেকে। রজত জানে ওসব করে কিছু হবে না। হওয়ার বয়স পেরিয়ে গেছে। টুকুনকে নিশ্চয়ই ওসব ভাবতে হবে না। ও তো ফার্স্ট হয়েছে। যারা রাস্তায় বসে আছে তারা কেউ কি ফার্স্ট হত?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন