দমদম স্টেশনের আন্ডার পাসটা কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে। সিঁড়ি বেয়ে নামছিল লোকটা। পিছনে বলাকা। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ঢুকছে। মাথার উপর রেলের চাকার গমগম শব্দ শুনে ভিতর ভিতর কিছুটা কুঁকড়ে গেল বলাকা। এর পরের বারাসাতগামী ট্রেন অনেক দেরীতে। বলাকা আনমনা হয়ে হাঁটছিল। খেয়াল করেনি, কখন যেন লোকটা হাঁটা থামিয়ে ওর পিছনে এসে গেছে। সামনে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে না পেয়ে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বলাকা। ঠিক তখনই ঘরঘরে শব্দে কানের একদম কাছেই কে যেন গেয়ে ওঠে, “রাত অকেলি হ্যায়…”
১
দত্তপুকুর লোকালটা চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল হেলতে দুলতে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করছিল বলাকার। আজকেও দেরি হয়ে যাবে অফিস পৌঁছতে।
টোটো চালকের মুখটা মনে পড়তেই, রাগটা গলা বেয়ে উঠে আসতে চাইছিল। রাস্তায় সুন্দরী মহিলা পুলিশকে ঝাড়ি মারতে গিয়ে সিগন্যাল না খেলে, ট্রেনটা ধরা যেত। একটানা বেশ কয়েকবার জোরে শ্বাস নিয়ে ধরে রাখলো বলাকা। তারপর আসতে আসতে ছেড়ে দিল। ব্রিদিং এক্সারসাইজ। সামান্য একটু কাজ হ’ল। রাগটা গিলে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
মাঝেরহাট লোকালটা ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে। বারাসতে ট্রেনটা ফাঁকা হ’ল বেশ কিছুটা। লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে, বসার জায়গা পাওয়া গেল সহজেই। সিটে গুছিয়ে বসে, চারপাশটা একবার দেখে নিল বলাকা। আন্ডা-বাচ্ছা নেই আপাতত। রাগটা একটু একটু করে কমে আসছে। ব্যাগ থেকে ইয়ার ফোনটা বার করে কানে গুঁজে নিতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
***
বেশ রাত হয়ে গেছিল অফিস থেকে বেরোতে। শেষ মুহূর্তে আরও একগাদা কাজ ঢুকে এসে গেল। বলাকার ক্লান্ত লাগছিল। স্টেশন চত্বর এখন ফাঁকা প্রায়। একটু আগেই মুশলধারে বৃষ্টি হয় গেল। হাওয়ায় ভাসমান জলকণা, শীত ধরাচ্ছে শরীরে। বলাকা হেঁটে এসে দাঁড়ালো প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল টাইম পিস টার নীচে। একটা কুকুর গুটি মেরে শুয়ে রয়েছে স্টিলের বেঞ্চের নীচেই। আপ বনগাঁ লোকালটার ঘোষণা হচ্ছে যান্ত্রিক স্বরে।
—টিকিট কেটেছেন?
পিঠের পিছনে, শরীরের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করলো একজন। বলাকা চমকে উঠেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা পোষাকের একজন রেলকর্মীকে আবিষ্কার করলো সে। যেন হঠাৎ শূন্য থেকে আবির্ভূত হয়েছে।
লোকটা সোজাসুজি বলাকার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। পার্স থেকে মান্থলি টিকিটটা বের করে এগিয়ে দিল সে। লোকটা বলাকার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই হাত বাড়িয়ে ধরলো টিকিটটা। তারপর ভ্রু উঁচিয়ে পার্সের দিকে ইঙ্গিত করলো। বলাকার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। বললো, এক্সকিউজ মি!
—আইডি কার্ডটা দেখি একটু। বললো লোকটি।
বলাকা পার্স ঘেঁটে আইডিটা বার করে দিল। লোকটি আইডিটা পকেটস্থ করে, টিকিটটা দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললো, মান্থলির ডেট তো ওভার ম্যাডাম। আসুন আমার সঙ্গে।
বলাকার গোটা শরীরটা শিরশির করে উঠলো। লোকটা বলাকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এগিয়ে গেল প্ল্যাটফর্মের আন্ডার পাসটার দিকে। বলাকা বুঝতে পারছিল না এই মুহূর্তে কি করা উচিত। টিকিটের ডেট পেরিয়ে গেছে, অথচ তার খেয়াল নেই। নিজের উপর বিশ্রী একটা রাগ দানা বাঁধছিল ক্রমশ।
দমদম স্টেশনের আন্ডার পাসটা কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে। সিঁড়ি বেয়ে নামছিল লোকটা। পিছনে বলাকা। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ঢুকছে। মাথার উপর রেলের চাকার গমগম শব্দ শুনে ভিতর ভিতর কিছুটা কুঁকড়ে গেল বলাকা। এর পরের বারাসাতগামী ট্রেন অনেক দেরীতে।
বলাকা আনমনা হয়ে হাঁটছিল। খেয়াল করেনি, কখন যেন লোকটা হাঁটা থামিয়ে ওর পিছনে এসে গেছে। সামনে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে না পেয়ে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বলাকা। ঠিক তখনই ঘরঘরে শব্দে কানের একদম কাছেই কে যেন গেয়ে ওঠে, “রাত অকেলি হ্যায়…”
***
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
এক ঘুমে দমদম। বিশ্রী স্বপ্নটা দেখে জেগে উঠলো বলাকা। চোখ খুলতেই রোদের দমকে কিছুক্ষণের জন্য আবছা হয়ে এলো বাইরেটা। ট্রেনটা ঢিমেতালে পাঁচ নম্বরে ঢুকছে। বলাকা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে পড়লো। দমদম স্টেশন ঢুকতে না ঢুকতেই ট্রেনের ভিতর যথারীতি গুঁতোগুঁতি শুরু হয়ে গেছে। বলাকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। রেসে প্রথম না হলেও চলবে তার।
হাতের নখ গুলোর রং চটে গেছে। বাজে দেখতে লাগছে বড্ড। একটা বড় করে শ্বাস নিল বলাকা। শান্ত থাকা দরকার। পরবর্তী স্টেপগুলো একবার ঝালিয়ে নিল মনে মনে।
গুঁতোগুঁতি করতে করতে লোকজন নেমে গেছে। বলাকাও নেমে এলো ট্রেনের বাইরে। প্ল্যাটফর্মে এখনও ভিড়টা রয়েছে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করা দরকার। ভিড় থাকলে কাজটা হবে না।
রোদের তাপ অসহ্য মনে হচ্ছে ক্রমশ। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভিড়টা পাতলা হয়ে এলো। বলাকা নিজের অজান্তেই একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে গেল আন্ডার পাসটার দিকে।
২
—ম্যাডাম, একটু দাঁড়াবেন। দয়া করে টিকিটটা একটু দেখাবেন।
বলাকার শরীরটা টানটান হয়ে উঠলো। ইচ্ছে করছিল, লোকটার মুখে, হাতের বড় বড় নখ গুলো বিঁধিয়ে দিতে। কিন্তু বলাকা শান্ত রইলো। হেসে এগিয়ে দিল আই কার্ড আর সঙ্গে মান্থলি টিকিটটা।
লোকটা বলাকার দিকে তাকিয়ে, অদ্ভুত ভাবে হাসছিল। টিকিটের দিকে ফিরেও তাকালো না একবার।
—অর্ধেক মাস পার হয়ে গেল। টিকিট দেখি, ছাড়া আর কিছুই বলে উঠতে পারেননি এখনও। এভাবে এগোলে, নম্বর চাইবেন কবে?
কথাগুলো বিনা বাধায় বেশ সরগর ভাবে বলে ফেললো বলাকা। নিজেরই আশ্চর্য ঠেকলো বিষয়টা।
লোকটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। এদিক ওদিক ঘার ঘুরিয়ে দেখে নিল, আশেপাশে আর কেউ নেই। এক বুক দম নিয়ে, বেশ কনফিডেন্সের সঙ্গেই বললো, ‘সবুরে মেওয়া ফলে। ছোট বেলায় পড়েছিলাম।’
কথাগুলো বলে একইরকম ভাবে হাসতে লাগলো লোকটা।
বলাকার মাথাটা গরম হচ্ছিল ক্রমশ। একবার চোখ বন্ধ করে নিয়ে, রাগটা গিলে ফেললো আবার। বললো, ‘মেওয়া ফলে গেছে। বেশি অপেক্ষা করলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।’
লোকটার হাসি থামার নাম নেই। পকেট থেকে পেনটা হাতে নিয়ে, বলাকার মান্থলি টিকিটের উপরেই খসখস করে লিখে দিল নিজের নাম আর ফোন নম্বর। তারপর টিকিটটা এগিয়ে ধরলো বলাকার দিকে।
বলাকা দুই আঙুলের ফাঁকে কাগজটা ধরে উল্টে দেখলো একবার। লোকটার নাম তন্ময়।
তারপর সোজাসুজি লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ফোনালাপে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। কাল রবিবার। দেখা হচ্ছে নাগের বাজার সিসিডিতে। ঠিক বিকেল চারটের সময়। আজ আসি।’
একটা আলতো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে লোকটার দিকে তাকালো বলাকা। তারপর সোজা এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
৩.১
রবিবার দিনটা ছুটি বলে মনে হয়না বলাকার। সকালে একটু ল্যাদ খেয়ে দেরী করে ঘুম থেকে উঠলেই মনে হয়, হুশ করে শেষ হয়ে গেল দিনটা। আসল ছুটি শনিবার অফিস থেকে বেরোনোর পর থেকে রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবধি। পরের দিন সকালে ওঠার তাড়া নেই।
আজকে সকালেও সেই বিশ্রী স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গেল। বিগত বেশ কিছু দিন থেকেই চলছে এটা। সেই একই স্বপ্ন; ফাঁকা স্টেশন, অদ্ভুত হাসিওয়ালা সেই টিকিট চেকার, আর জনশূন্য সাব ওয়েতে…
আর ভাবতে পারলোনা বলাকা। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো বিছানায়।
বেড সাইড টেবিলে রাখা ছোট্ট ঘড়িতে সকাল দশ’টা বাজছে। অন্যান্য দিন এই সময়ে দমদমে নেমে যায় সে। দমদম স্টেশনের প্রসঙ্গ মনে আসতেই সেই অপ্রীতিকর ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো বলাকার। বিগত ১৪, ১৫ দিন ধরে চলছে ব্যাপারটা। দমদম স্টেশনে নেমে আন্ডার পাস বরাবর মেট্রোর এন্ট্রি পয়েন্টের কিছুটা আগেই দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা। ভদ্রলোক পেশায় একজন টিকিট চেকার। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশের নীচেই। নিত্যদিন বলাকাকে ডেকে টিকিট দেখতে চাইছেন। না, মোটেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়; তার কারণ, সেই প্রথম দিনই বলাকা নিজের অগ্রিম মান্থলি টিকিট, সঙ্গে আই-কার্ডটিও দেখিয়েছে। তবুও প্রতিদিন বেছে বেছে তাকে ডেকে দাঁড় করিয়েই, টিকিট দেখতে চাইছে লোকটি। বোঝাই যাচ্ছে অকারণ হেনস্থা করছে লোকটা। যেন মজা পেয়েছে।
বলাকা বোঝে, লোকটা আলাপ করতে চায় তার সাথে। সরাসরি কিছু বলতে পারছে না, তাই নিজের পদের ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে ক্রমাগত।
বলাকা চেষ্টা করেছে, ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে, অন্য গেট দিয়ে ঢুকে, বা সময় বদল করে লোকটাকে এড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু বলা বাহুল্য কোনো কিছুতেই লাভ হয়নি। লোকটা জোঁকের মত লেগে রয়েছে।
মাথাটা ধরে আসছিল বলাকার। বিছানার উপর রাখা ফোনটার ভাইব্রেশন মোডে রাখা ছিল। ফোনটা উল্টে দেখলো, চিরশ্রী ফোন করছে। ফোনটা রিসিভ করলো বলাকা।
বললো, ‘বলো...’
৪
ক্যাফেটা ছিমছাম। তবে পরিপাটি করে সাজানো। বলাকা ঠিক বিকেল চারটের সময় পৌঁছে গেছে। এখন চারটে বেজে দশ। ক্যাফেতে লোকজন বিশেষ নেই। বলাকার টেবিলটার উল্টো দিকেই কিছুটা তফাতে একজন মাত্র বসে রয়েছে, ল্যাপটপ চালিয়ে। আর দরজার পাশ ঘেঁষা টেবিলটায় বসে কফি খাচ্ছে একজন।
বলাকা একটা কোল্ড কফি অর্ডার করেছিল। ক্যাফের মনোরম ঠান্ডায় বসে, কফির অল্প অল্প সিপ নিচ্ছিল। আরও মিনিটখানেক পর ক্যাফের কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো তন্ময়। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো বলাকাকে। বলাকা হাত উঁচিয়ে ডাকতেই, একগাল হেসে এগিয়ে এলো।
বলাকা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বললো, ‘প্রথম দিন বলে মাফ করে দিলাম। দেরী করে আসা লোকজন, আমার পছন্দ নয়।’
তন্ময় দুহাত তুলে নাক, কান মলে বললো, ‘ভীষণ দুঃখিত। আসলে ডিউটি ছিল আজ। আমাদের তো রবিবার মানেই ছুটি, এমন ব্যাপার নয়। কোনোরকমে ম্যানেজ করে এসেছি।’
বলাকা সিপ নেওয়া থামিয়ে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলল, ‘সেকি! আমার তো আবার রবিবার ছাড়া ছুটি নেই। দুজনে একসাথে সময় কাটাবো কি করে?’
তন্ময় হঠাৎই একটু থতমত খেয়ে গেল যেন। তারপর সামলে নিয়ে, একটা হাত বলাকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওসব আমরা ম্যানেজ করে নেব।’
বলাকা, তন্ময়ের হাত দুটো দেখলো। তারপর বললো, ‘এই প্যাচ প্যাচে গরম থেকে এসেছেন, ঘেমো হাত দিয়ে না ছুঁলেই ভালো।’
তন্ময়ের চোখ দুটো জ্বলে উঠেই নিভে গেল মুহূর্তে। তারপর হেসে, হাতটা সরিয়ে নিল।
বলাকা মেনুটা আঙুলের টোকা দিয়ে এগিয়ে দিল। তন্ময় ঘাড় বেঁকিয়ে একবার দেখলো বলাকাকে। তারপর মেনুটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো।
উল্টে পাল্টে দেখে শুনে, নাক মুখ কুঁচকে, বলাকার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি যেটা নিয়েছো, ওটাই বলে দিই!’
বলাকা কাঁধ দুলিয়ে বললো, ‘হোয়াটেভার!’
তন্ময় ওয়েটারকে ডেকে, একটা কোল্ড কফি অর্ডার করে দিল।
—কাল তোমার কথা শুনে বেশ সাহস পেয়েছি। সত্যি গত দু সপ্তাহ ধরে তোমার সাথে আলাপ করতে চেয়েও পারছিলাম না। আসলে…
বলাকা মাঝে পথে থামিয়ে দিল। তারপর বললো, ‘তাই বলে রোজ রোজ আমার পথ আটকে টিকিট দেখতে চাওয়াটা মোটেও জাস্টিফায়েড নয়।’
তন্ময় একহাত জিভ কেটে বললো, ‘আমি দুঃখিত। কিন্তু দেখো, ওরকমটা না করলে, আজ তুমি আর আমি এই ক্যাফেতে একসাথে বসে গল্প করতাম না হয়তো!’
বলাকা ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে হাসলো।
—আমার নামটা তো জানো তুমি। তোমার নামটাই জানা হয়নি এখনও।
বলাকা ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে হেসে বললো, ‘এত তাড়া কিসের? ঠিকুজি বানাবেন! নাকি বিয়ের কার্ড ছাপাতে দেবেন?’
তন্ময় খিলখিলিয়ে হেসে উঠে মাথা দোলাচ্ছিল।
ঠিক এই সময়ে একটা কান্ড ঘটলো। ক্যাফের দরজা ঠেলে উদভ্রান্তের মত ভেতরে ঢুকে এলো একটি মেয়ে। তারপর সোজাসুজি এগিয়ে এলো বলাকার দিকে।
তন্ময় খেয়াল করলো বলাকার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে, যেন যেকোনো মুহূর্তে ঠেলে বেরিয়ে আসবে।
মেয়েটা কোনোরকম ভনিতা না করে সরাসরি একবার তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে, বলাকাকে উদ্দেশ্যে করে বললো, ‘এই ক্যালানেটার জন্য, তুমি আমার সাথে ব্রেকাপ করে নিলে জান!’
বলাকা এই চরম অস্থির অবস্থাতেও খেয়াল করলো, তন্ময়ের শরীরটা এক সেকেন্ডের জন্য ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত করে ঝটকা দিয়ে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো।
মেয়েটা ততক্ষনে চেয়ারে বসে বলাকাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে আরম্ভ করেছে। বলাকাও কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে এই আচমকা আক্রমণে।
কোনোরকমে মেয়েটাকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
তন্ময় ও ততক্ষনে প্রাথমিক শকটুকু কাটিয়ে উঠে, বাক শক্তি ফিরে পেয়েছে। বললো, ‘এসব কি! এ কে?’
মেয়েটা চেয়ারে বসেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তখনও।
উল্টোদিকের দেয়ালের কাছে বসা ছেলেটা ল্যাপটপ বন্ধ করে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে, আর মজা নিচ্ছে গোটা ব্যাপারটার। ওয়েটারটাও এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে।
—স্যার, ম্যাডাম এভাবে ক্যাফের মধ্যে চিৎকার, চেঁচামেচি করবেন না। আমাদের বাকি কাস্টমাররা বিরক্ত হবেন। প্লিস...
মেয়েটা কান্না থামিয়ে চিৎকার করে বললো, ‘কোথায় কাস্টমার? মাছি মারছো বসে বসে।’
ওয়েটারটা কি বুঝলো কে জানে! চুপচাপ কেটে পড়লো। সম্ভবত অথরিটির কাউকে ফোন করতে গেল।
বলাকার বড্ড অসহায় লাগছিল। কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে, একবার মেয়েটার দিকে আর একবার তন্ময়ের দিকে তাকাচ্ছে সে।
এবারে তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চিৎকার করে বললো, ‘হু ইস শি? হোয়াট দ্যা ফা# ইস হ্যাপ…’
তন্ময়ের কথা শেষ হ’ল না। কাঁদতে কাঁদতেই উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। চোখের জল সম্ভবত চোখেই শুকিয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত ঘষে খ্যানখ্যানে স্বরে বললো, ‘এখান থেকে ফুটে যা ক্যালানে কার্তিক। বলাকা আমার। শুধুই আমার।’
তন্ময় স্তম্ভিত হয়ে গেল নিমেষে। বলাকার শরীর কাঁপছিল। দাঁড়াতে না পেরে ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। তন্ময়ের বাক শক্তি আবার লোপ পেয়েছে। কোনো রকমে বললো, ‘মা…মানে! কী…কী বলতে চাইছেন আপনি!’
—তোকে না আমি বললাম, এই সম্পর্কটাতে আমি আর থাকতে চাইনা। তুই তবুও আমার পিছন পিছন এলি এখানে সিন ক্রিয়েট করার জন্য?
তন্ময় চমকে তাকিয়ে শুনলো, কথা গুলো বলছে, বলাকা।
বলাকা, তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘সরি তন্ময়। তোমার সাথে প্রথম দিন দেখা করতে এসেই এমন অপ্রীতিকর একটি ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে ফেললাম তোমায়।’
মেয়েটার কান্না থেমে গেছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘এখন আমি অপ্রীতিকর ঘটনা হয়ে গেলাম তোমার কাছে!’
একটু থেমে জোরে জোরে বার কয়েক শ্বাস টেনে বললো, ‘দুদিন আগে অবধি যার বুকে মাথা রেখে, নিচিন্তে ঘুমোতে তুমি, তাকেই কিনা অপ্রীতিকর বলছো…’
কথা বলতে বলতেই কাঁধ থেকে চুলের গোছা সরিয়ে দিল মেয়েটি। লালচে খয়েরি রঙের একটি দাগের উপর আঙুল রেখে বললো, ‘এই দাঁতের দাগগুলো কি তবে ভূতে বানিয়েছে! তোমার পাশবিক আদরের চিহ্ন এগুলো।’
তন্ময় আর নিতে পারলোনা ব্যাপারটা। উঠে দাঁড়িয়ে, হতবাক চোখে বলাকার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কান্ট বিলিভ! তুমি লেসবো! মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে! ছিঃ ছিঃ!’
‘তন্ময়, প্লিস; আই ক্যান এক্সপ্লেইন। মানছি আমার আর ওর একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তোমায় দেখার পর, আমি বুঝেছি, আমার জীবনে ঠিক কিসের অভাব ছিল এতদিন!’
বলাকা হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের হাত দুটো ধরার চেষ্টা করতেই, তন্ময় কয়েক হাত পিছিয়ে গেল।
বলাকা চেয়ার সরিয়ে এগিয়ে এসে ধরতে গেল তন্ময়কে। তার আগেই মেয়েটি, বলাকার হাত চেপে ধরে, টেনে নিল হঠাৎ। বললো, ‘কী দিতে পারিনি তোমায় আমি! বলো...’
মেয়েটা আরো অনেক কিছু বলছিল। তন্ময় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। প্রায় দৌড়ে, ক্যাফের দরজা ঠেলে, নিমেষে বেরিয়ে গেল বাইরে।
৩.২
ফোনটা রিসিভ করতেই অন্য প্রান্ত থেকে, সেই চিরপরিচিত খ্যানখ্যানে গলায় চিরশ্রী বললো,
—রেডি, মেরি জান!
—হুম।
—ইয়েতি আর অ্যামাজনের পর এটাই হবে বাঙালির তৃতীয় বৃহত্তম অভিযান। দমদম অভিযান। কথাগুলো বলে, খ্যাকখ্যাক করে হাসছিল চিরশ্রী।
বলাকাও হেসে বললো, ‘নৌটঙ্কি না মেরে, কাল যথা সময়ে হাজির হয়েন। তাহলেই হইবো।
‘তথাস্তু। এখন রাখি, আর একবার রিহার্স করে নিই।’ বলে ফোন রেখে দিল চিরশ্রী।
বলাকার বুকের উপর থেকে যেন বেশ কিছুটা ওজন নেমে গেল।
চিরশ্রী বলাকার কলেজ জীবনের বন্ধু। বর্তমানে অফিস মেট। সেই সঙ্গে সবচেয়ে ভালো বন্ধুও। বলাকার যেকোনো দরকারে, না বলতেও হাজির হয়ে যায় মেয়েটা। যেন আস্ত একটা মুশকিল আসান।
গত পরশু অফিস ফেরত, পাবে গিয়েছিল দুজনে। বলাকা সচরাচর নিজের সমস্যা নিজের অবধি রাখতেই পছন্দ করে। তবে সেদিন কী হয়েছিল কে জানে! মদ খেয়ে, টিকিট চেকার লোকটার উপদ্রবের কথা, সবটাই বলে ফেলেছিল চিরশ্রীর সামনে। চিরশ্রী সবটা শুনেছিল মন দিয়ে। তারপর আচমকাই অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
সেই রাত্রে বাড়ি ফিরে, ফ্রেশ হয়ে, সবেমাত্র বিছানায় ধপাস হয়েছে বলাকা। চিরশ্রী ফোন করেছিল। শরীর জুড়ে ঘুম নামছে তখন। চিরশ্রীর নামটা দেখেই, আধ বোজা চোখে ফোনটা ধরেছিল বলাকা।
তারপর পাক্কা বিশ মিনিট ধরে গোটা প্ল্যানটা, প্রায় পাখি পড়ানোর মত করে বুঝিয়েছিল চিরশ্রী। বলাকা প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেও, সেটা ধোপে টেকেনি।
আজ সেই প্ল্যানের এক্সিকিউশন ডে। সময় বিকেল চারটে। দমদম ক্যাফে শপ।
৫
—এবার থাম। মালটা গন।
চিরশ্রী, বলাকাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালো। বললো, ‘ভাগ্গিস ছড়িয়ে ফেলিসনি বিশেষ। তোর এক্সপ্রেশনগুলো যাচ্ছেতাই রকমের ফেক লাগছিল। আর হোয়াট ওয়াস দ্যাট! তোমায় দেখে বুঝেছি, আমার জীবনে কিসের অভাব…. উফফ, পুরো রুনরুন সেন।’
বলাকা মুখ ভেঙেচে বললো, ‘থাম ভাই। ওভার অ্যাক্টিংয়ের জন্য যদি কোনো অ্যাওয়ার্ড থাকতো, তবে সেটা তোর নামে হ’ত। বিমল এলাইচি, দানায় দানায় কেশরের শক্তি প্রেসেন্টস; শ্রীমতি চিরশ্রী দেবী ওভার অ্যাক্টিং অ্যাওয়ার্ড গোস টু…’
চিরশ্রী কূট করে একটা চিমটি কেটে দিল বলাকার হাতে। তারপর উল্টো দিকের দেয়াল ঘেঁষা টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর বেস্ট অ্যাক্টিং অ্যাওয়ার্ড গোস টু… এই যে আপনি, অনেক হয়েছে। এবারে উঠে আসুন।’
ল্যাপটপ হাতে নিয়ে উঠে এসে, বলাকাদের টেবিলটায় বসলো অঙ্কুশ। অঙ্কুশ চিরশ্রীর বয়ফ্রেন্ড। ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বললো, ‘তোমরা যা খেল দেখালে! উফ, ছোটবেলায় টিকিট কেটে যাত্রা পালায় এমন পারফরম্যান্স দেখা যেত।’
চিরশী চোখ পাকিয়ে তাকালো শুধু। বলাকা হাসছিল। বড্ড শান্ত লাগছিল তার। মাথা দুলিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেল, দরজার পাশেই বসা ছেলেটা একমনে বই পড়ছে আর দ্বিতীয় কাপ কফিতে চুমুক দিচ্ছে আবেশে। কেমন যেন নিস্পৃহ ভাব। এত কান্ড ঘটে গেল, তবুও যেন হেলদোল নেই।
বলাকার ছেলেটাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছে এর আগেও।
চিরশ্রী, অঙ্কুশের হাত ধরে বললো, ‘লেসবো প্রেমিকাকে বিয়ে করবেন তো, প্রেমিক বাবু!’
বলাকার ভারী আরামবোধ হয় এদের একসাথে দেখলে। সেই কলেজ জীবনের জুটি এদের।
অঙ্কুশ খপ করে চিরশ্রীর হাতটা ধরে, চকাস করে একটা চুমু খেয়ে নিল। বললো, ‘কাঁধের কাছে দাগটা কি সত্যিই ভূতে বানিয়েছে!’
চিরশীর ফর্সা গাল দুটো নিমেষে রক্তাভ হয়ে উঠলো।
বলাকা চোখ গোল্লা গোল্লা করে তাকিয়ে বললো, ‘আসেপাশে OYO-TOYO আছে কিনা, একবার খুঁজে দেখি।’
***
সোমবার সকাল। আজ সময়মত স্টেশনে পৌঁছে দত্তপুকুরটা ধরতে পেরেছিল বলাকা। দমদমে নেমে, বেঞ্চের উপর বসে, ভিড়টা পাতলা হওয়ার অপেক্ষা করছিল। লোকজন কমে আসতেই সাবওয়ে দিয়ে তরতর করে নেমে, মেট্রোর এন্ট্রি পয়েন্টের সামনে পৌঁছে গেল সে।
সাদা জামা, কালো ট্রাউজার। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানেই। বলাকা গটগট করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো সামনে। পার্স থেকে মান্থলি টিকিট আর আই-কার্ডটা এগিয়ে দিল।
লোকটা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।
মাস্কের নীচে কান এঁটো করা হাসি ফুটে উঠলো বলাকার মুখে। একবুক শ্বাস নিয়ে, মেট্রোর গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, গুনগুন করে গেয়ে উঠলো, ‘রাত অকেলি হ্যায়...’
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন