অনাদি গোসাঁইয়ের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে দারোগা সুজয় মাহাতোর। বিশ্বামিত্র নাকি ওঁকে বলেছিলেন, তাহলে আমরা কী ধরে নেব মহাশক্তিমান ঈশ্বরের সামনে এমন কোনও অন্যায় ঘটে গিয়েছিল যা তিনি স্বয়ং ঈশ্বর হয়েও রোধ করতে পারেননি এবং তার ভিত্তিতেই ভগবানকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘ঠুঁটো’?
কেউ কেউ বলেন, চৈতন্য মহাপ্রভুকে নাকি জগন্নাথ মন্দিরেই খুন করা হয়েছিল, আবার কেউ কেউ এই কথাও বলেন যে, মানুষটিকে নাকি জগন্নাথ মন্দির থেকেই গুম করা হয়েছিল। সেই সব ঘটনারই কোনও ইঙ্গিত বহন করছে না তো ওই উক্তি?
উনিশ
ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।
অনাদি গোসাঁইয়ের শেষ কথাটা শুনে একটু গুম হয়ে গেছে আবদুল। সালাউদ্দিন মিয়াঁ অথবা মোহান্তি দুজনেই সমান। কেউ ঠিক জায়গায় নেই— এই কথাটার মানে কী? কে নেই ঠিক জায়গায়?
গোসাঁইজির মত মানুষ এমনি এমনি কোনো কথা বলেন না। ঠিকই তো সাল্লাউদ্দিনের কিছু বিষয় তার কাছেও এখন ধোঁয়াশা।
হঠাৎ এক ঝাঁক পাখির ডাকে সম্বিৎ ফেরে। দানা ছড়িয়ে দিচ্ছেন গোসাঁইজি। ছাতার, পায়রা, লেজঝোলা, ঘুঘু, শালিক-কে নেই। আর দেরি না করে উঠে পড়ে আবদুল। কোমরে গুঁজে রাখা রিভলভারটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। উঠতে গিয়ে খোঁচা খায়।
“চললাম গোসাঁইজি…।”
“সাবধানে থাকিস। বাড়ি গিয়ে একটু হলুদ আর চিনি লাগিয়ে দিস ফাটা জায়গাটায়। আমি লাগিয়ে দেব ভেবেছিলাম, মোহান্তি আসাতে সব গোলমাল হয়ে গেল...।”
“আপনিও সাবধানে থাকবেন। চন্দ্রপুরায় চারদিকে যা শুরু হয়েছে, তাতে কখন কী হয়ে যায় তা সত্যিই কিছু বলা যায় না। বৈগাপাড়ার পুরুতের কথা আমার কিন্তু ভালো ঠেকল না।” একটু থেমে এরপর যে কথাগুলো বলে আবদুল তা সত্যিই চিন্তা করবার মত, “আসলে আপনি তো কোনোপক্ষেই নেই। বাঁচতে হলে সাল্লুভাই কিংবা সদাশিব, কোনও একটা পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে।”
গোঁসাইজির, মোহান্তির কথাতেও কোনও ভাবান্তর হয়নি, এখন আবদুলের কথাতেও হয় না।
বিদায় নেয় আবদুল। সাইকেলটা ঠেসান দেওয়া ছিল একটা পলাশ গাছের গোড়ায়। জামার পকেট হাতড়ায় চাবির জন্য। না, নেই তো। পকেটেই তো রেখেছিল মনে হয়! প্যান্টের পকেটগুলো দেখে। না কোথাও নেই। তাহলে কী মন্দির-শানেই ফেলে এল?
তড়তড় করে আবার উপরে উঠে যায়। এতক্ষণে অনাদি ফিরে গেছেন নিজের ঘরে। বেশির ভাগ পাখি গেছে উড়ে। কেবল গোটা তিনেক চড়াই এখনও খুঁটে খাচ্ছে দানা।
ভালো করে এদিক ওদিক চোখ চালায় আবদুল। না, এখানেও নেই চাবি। আদৌ কি ‘লক’ করেছিল সাইকেলটা? চাবি খোলা অবস্থাতেই রেখে দেয়নি তো! চারদিকে চোরাগোপ্তা খুনখারাপি। ছোটোখাটো ঘটনাতেও কপালের বলিরেখা আজকাল স্পষ্ট হয়ে ওঠে আবদুলের। এটা হতেই পারে যে, কেউ পাথরের আড়ালে বন্দুকের ঘোড়া টিপে বসে আছে ওকে তাক করে। সেই হারামির বাচ্চাই হয়ত সাইকেলে চাবি দিয়ে রগড় দেখছে। মজা দেখতে দেখতেই সীসা ঢুকিয়ে দেবে কলজেতে। দাঙ্গার পর কোনো কিছুই বিশ্বাস নেই। যাই হোক, যে পথ ধরে শানে উঠেছিল সেই পথেই নেমে আসতে থাকে। সন্তর্পণে, পাথরের খাঁজে খাঁজে চোখ রেখে।
“এই যে চাবি।”
চকিতে মাথা তোলে আবদুল। সরস্বতী বৈগা, দাঙ্গায় খুন হয়ে যাওয়া পরমেশ্বর বৈগার মেয়ে। ডান হাত কোমরে রেখে বাঁ হাতের তর্জনীতে চাবির রিংটা ঘোরাচ্ছে। দু-এক মুহূর্ত ভ্যাবলা হয়ে তাকিয়ে থাকে আবদুল। হনুমান জয়ন্তীর পর আর দেখা হয়নি।
যে ফোন করলেও ধরেনি এতদিন, সে আজ স্বয়ং এইখানে! পরনে জংলা ডুরে শাড়ি। আদিবাসী শরীরে স্বাভাবিক মাদকতা। সাপের মত বিনুনি নেমে এসেছে চওড়া কাঁধ বেয়ে প্রশস্ত পিঠে। না, পিঠেও শেষ নয় কেশগুচ্ছ। যৌবন, ছলকানো কোমর পেরিয়ে ধাবমান আরও নীচে। “সাইকেলে চাবি লাগিয়ে পাহাড়ময় জরিপ করলে কি আর চাবি পাওয়া যাবে!”
ও তাহলে আবদুল ঠিকই ভেবেছিল। তালা দেওয়াই হয়নি। যাই হোক, বহুদিন পর সেই ছেনালি মাখানো ভঙ্গিমা। প্রাথমিক চমক সামলে নিয়ে কথা বলে আবদুল, “তুই এখানে কী করে এলি?”
“ওইসব ফালতু কথা ছাড় আবদুল। বিশ্বামিত্র সেনকে কোন কুত্তার বাচ্চা মারল রে?”
পেটে বিদ্যা আছে সরস্বতীর। রুকমনি মাহাতো বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস এইট অব্দি পড়েছে। বাংলা, হিন্দি ভাষায় স্বচ্ছন্দ তো বটেই, দু-চারটে ইংরাজি শব্দও বলতে পারে।
“দে চাবি দে। যেতে হবে। কাজ আছে আমার।”
“কাজ যে কী আছে সে তো আমি জানি। হনুমান মন্দিরে ঝামেলার প্ল্যান্টের কাজটাও তো গেছে…। যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে। বলছি বিশ্বামিত্র সেনকে মারল কোন হারামির বাচ্চা!”
দুম করে এমন একটা ঘাই মারা প্রশ্ন করবে সরস্বতী, ভাবতে পারেনি আবদুল। সামলে ওঠার আগেই আরও একটা কথা বলে সরস্বতী, যা আগেরটার থেকে আরও বিপজ্জনক, “রাধামাধবপুর মন্দিরে ওই মানুষটাকে ওই ভাবে মেরে কী বোঝাতে চাইছিস তোরা! হিঁদুদের ঘরে ঢুকে তাদের মারবি?”
“এইসব আনশান কী বকছিস তুই?”
“যা বলছি ঠিকই বলছি। বাপরে মেরেছিস এই বার বেছে বেছে ভালো মানুষগুলোকে টার্গেট করেছিস... হারামির বাচ্চা!”
“হেই মাগী মুখ সামলে কথা বল। নয়ত...”
“নয়ত কী করবি? খুন করবি?”
এখন সরস্বতীকে বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। আবদুল অন্য কথা বলে, “চাবি দিলে দে নাহলে আমি হেঁটেই চলে যাচ্ছি।” কথাটা বলেই তড়বড় করে নামতে শুরু করে।
“আরে যা যা তোর দেমাকের কে এত ধার ধারে?”
সরস্বতীর কথাটা শুনে দুই লাফে উঠে আসে আবদুল। সোজাসুজি তাকায় বৈগা পাড়ার মেয়েটার দিকে।
“বিশ্বামিত্র সেন খুন হয়েছে সেটা তুই জানলি কী করে?”
“খুনের খবর চাপা থাকে নাকি! আমি কেন সবাই জেনে গেছে এতক্ষণে...।”
অনাদি গোঁসাইয়ের দেওয়া প্রসাদটুকু ছাড়া সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি আবদুলের। রোদ্দুর চড়ছে ক্রমশ। পেটে খিদে থাকলে মাথার উপর সব পাখিকেই শকুন বলে মনে হয়। গলা চড়ে আবদুলের, “ঐ খানকির ছেলে সদাশিব মোহান্তি বলেছে বুঝি?”
এই কথাটা মাথার মধ্যে খামচা মারে সরস্বতীর। চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে আবদুলের পায়ের কাছে।
“এর থেকে বেশি তুই আর কী বলবি? সালাউদ্দিনের চামচারা এ ছাড়া অন্য কীই বা বলতে পারে?”
“মুখ সামলে কথা বলিস মাগী...।” কথাটা বলে লাফ দিয়ে গলা টিপে ধরে সরস্বতীর। কিন্তু যতটা জোর দিলে একটা মানুষের দম বন্ধ হয়ে যায়, ততটা জোর দিয়ে উঠতে পারে না। সরস্বতীর বিন্দুমাত্র ভয়-ডর নেই, সে স্থির তাকিয়ে থাকে দানবের মত আবদুলের চোখের দিকে, “কী হল মার! টিপে ধর গলা। একদিকে তোর জন্য ভালোই হবে। আমায় যদি মেরে দিস তবে তুই বাঁচবি। কিন্তু আমায় যদি বাঁচিয়ে রাখিস তবে তোকে আমি মারব। আজ নয় কাল...”
আবদুলের কী হয় কে জানে! বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারে না মেয়েটার দিকে। দীঘল চোখ জোড়ায় ডগডগে আগুন। ছাই হয়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ সরিয়ে নেয় ওই চোখের থেকে। আবদুলের হাত দু’খানা নিজের থেকেই আলগা হয়ে ছেড়ে দেয় রাজহংসীর গ্রীবা।
একটা পাথরে ধপ করে বসে পড়ে আবদুল।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
কুড়ি
চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।
টেবিলের উপর রাখা ফোনটার দিকে চোখ যায় সুজয় মাহাতোর। যখন তখন বেজে উঠতে পারে এসপির বাঁশি। বিশ্বামিত্রের খুনটা নিয়ে ডিপার্টমেন্টের ঘুম উড়ে গেছে, এবং সেটাই স্বাভাবিক।
এসপি বলেছিলেন যে সেক্টর ফোর পুলিশ স্টেশনে এসেছিলেন তাই এখানে ঘুরে গেলেন, কিন্তু কথাটা হজম হয়নি মাহাতোর। এতদিন ধরে পুলিশে আছেন, কে সত্যি আর কে মিথ্যা বলছে বুঝতে পারেন।
ফোনের পাশে একটা সুদৃশ্য পেপার ওয়েট। হাতে নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করার পর উঠে পড়েন চেয়ার ছেড়ে। সারা ঘরে একটা পাক মারেন।
অনাদি গোসাঁইয়ের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে দারোগা সুজয় মাহাতোর। বিশ্বামিত্র নাকি ওঁকে বলেছিলেন, তাহলে আমরা কী ধরে নেব মহাশক্তিমান ঈশ্বরের সামনে এমন কোনও অন্যায় ঘটে গিয়েছিল যা তিনি স্বয়ং ঈশ্বর হয়েও রোধ করতে পারেননি এবং তার ভিত্তিতেই ভগবানকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘ঠুঁটো’?
কেউ কেউ বলেন, চৈতন্য মহাপ্রভুকে নাকি জগন্নাথ মন্দিরেই খুন করা হয়েছিল, আবার কেউ কেউ এই কথাও বলেন যে, মানুষটিকে নাকি জগন্নাথ মন্দির থেকেই গুম করা হয়েছিল। সেই সব ঘটনারই কোনও ইঙ্গিত বহন করছে না তো ওই উক্তি?
মহাপ্রভু সম্পর্কে খুব কিছু জানেন না সুজয়। অনাদি গোসাঁইয়ের মুখেই যেটুকু শোনার শুনেছেন। মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখেছিলেন। এগিয়ে এসে তুলে নেন। ফোন করতে যান ‘চন্দ্রপুরার চৈতন্য’, অনাদি গোস্বামীকে। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল! আবদুলকে বিদায় দিয়ে অনাদি নিজেই এসে হাজির হলেন থানায়। তাঁর আরও কিছু বলার আছে।
তিনি ঘরে ঢুকে বসতে না বসতেই দারোগাসাহেব বলেন, “বলুন গোসাঁইজি আবার কী ভেবে আপনার আগমন! এই তো সবে আমরা মন্দির থেকে এলাম!”
অনাদি বলেন, “বিশ্বামিত্র সেন আরও বলেছিলেন, ‘মানুষরূপী স্বয়ং ঈশ্বর নিজেই তখন নিজের অপ্রকট লীলা দেখছেন...।’ হ্যাঁ..., যতদূর মনে পড়ছে হুবহু এই বাক্যটাই উনি বলেছিলেন। আমার ঠিক মনে নেই কথাটা আপনার কানে দিয়েছিলাম কিনা, তাই আবার চলে এলাম এটা বলতে। যদি এই কথা থেকে কোনও সূত্র পাওয়া যায়...।”
দারোগা বলেন, “সত্যি কথা বলতে কী মহাপ্রভু সম্পর্কে খুব বেশি ধ্যান ধারণা আমার নেই। একজন বাঙালি হিসেবে যতটুকু জানার তার থেকে বেশি কিছু জানি না। তবে এটা জানি, চৈতন্য মহাপ্রভু যে সে কেউ নন।”
গোঁসাইজি প্রসঙ্গে ঢুকতে চান, “না... মানে আমি বলতে চাইছিলাম, বিশ্বামিত্র বাবুর বলা ওই কথাগুলোর মধ্যে কোনও গূঢ় ইঙ্গিত আছে কী? এটা একটু আলাদা করে খতিয়ে দেখলে হত না?”
“আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখা হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এই কথাটার খুব কিছু গুরুত্ব নেই, আলাদা করে। মহাপ্রভু খুন হয়েছেন বলে মনে করেন অনেকে এবং তাঁরা এটাও মনে করেন যে তিনি খুন হয়েছিলেন মন্দিরের ভিতরেই। জগন্নাথের সামনে। আর যদি খুন না হয়েও থাকেন, তবেও এই কথা বলা যায় যে, ভগবান জগন্নাথের সামনেই এমন কিছু একটা ঘটেছিল, যা মর্মান্তিক। ব্যাস এইটুকুই। এর থেকে খুব বেশি কিছু, বিশ্বামিত্র সেনের ঐ বাক্যের মধ্যে আছে বলে আমার মনে হয় না।”
মৃদু হেসে অনাদি বলেন, “ঠিক আছে আপনি যেটা ভালো বুঝবেন। কিন্তু শুধু ওই কথাটা বলা ছাড়া আমার আরও একটি দরকার আপনার সাথে আছে।”
“বলুন গোসাঁইজি!”
অনাদি তাঁর থলে থেকে একটা মোড়ক বার করে দারোগার দিকে এগিয়ে দেন। বলেন, “এটা আপনার জিম্মায় রাখুন।”
“কী এটা!”
“বিশ্বামিত্র সেন আমার কাছে রাখতে দিয়েছিলেন। বিশ্বরূপের পুঁথি।”
“বিশ্বরূপ! কে বিশ্বরূপ!”
“চৈতন্য মহাপ্রভুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। তিনিও ষোলো বছর বয়েসে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সন্ন্যাসে যাওয়ার আগে তিনি একখানি পুঁথি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন মাতা শচীদেবীর হাতে। আর একখানি রেখেছিলেন নিজের কাছে।”
দারোগা অবাক হয়ে বলেন, “এইটা কি সেইটা!”
“না। সেটার প্রতিলিপির প্রতিলিপি। আমাকে এইটুকুই বলেছিলেন বিশ্বামিত্র। এর বেশি আমি কিছু জানি না।”
“প্রতিলিপির প্রতিলিপি! আচ্ছা সে যাই হোক, এটি বিশ্বামিত্র নিজের কাছে না রেখে আপনাকে দিয়েছিলেন কেন!”
“উনি এটা আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিলেন-অনাদিবাবু আপনি একজন পরম ভক্ত। এই পুঁথি আপনার কাছেই থাকুক...”
একটু থেমে নিজের কথা শেষ করেন অনাদি, “কিন্তু, উনি এই ভাবে চলে যাওয়ার পর এটা বুঝে উঠতে পারছি না, এই বস্তুটি আদৌ আমার কাছে নিরাপদ কিনা! তাই এটি আপনার জিম্মায় থাকাই শ্রেয়।”
দারোগা সাহেব মোড়কটা খুলে দেখেন। বই নয়, মোটা একটা খাতা। ঝর্ণা কলম দিয়ে লেখা। দারোগা সাহেব ঝাড়খণ্ডী হলেও বাংলা পড়তে এবং লিখতে পারেন, ভালোই। পাতার পর পাতা উল্টে দেখেন। অক্ষরগুলো বাংলা হলেও ভাষা প্রায় কিছুই বুঝতে পারেন না। পয়ার ছন্দে লেখা আদি বাংলাভাষা।
“দেখে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। বাংলা হলেও এর মর্মোদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আপনি যখন বলছেন তখন এটা আমার কাছেই থাক।”
“আপনি আমাকে দায় মুক্ত করলেন দারোগা সাহেব।” বাক্যটা শেষ করে চেয়ার থেকে উঠে দারোগার সামনে হাত দুখানা জড়ো করেন, নমস্কারের ভঙ্গিতে।
দারোগা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে আসেন অনাদির কাছে। অনাদির দু'খানা হাত নিজের হাতে নেন, “দয়া করে আপনি আমার সামনে হাত জোড় করবেন না। চন্দ্রপুরার আর সবার মতই আমিও আপনাকে অন্য চোখে দেখি।”
গোঁসাইজির স্বভাব সুলভ স্মিত হাসিটি ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে, “আপনিও কি আমাকে চন্দ্রপুরার চৈতন্য মনে করে পাপের বোঝা বাড়াতে চান!”
“আপনি চন্দ্রপুরার চৈতন্য কিনা জানি না। কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছি, আজ যখন ‘হিন্দু-মুসলিম’ ধুয়ো দিয়ে কিছু মানুষ আখের গোছাবার চেষ্টা করছে, তখন আপনার মত একজন মানুষের খুব দরকার।”
কথাটা বলতে বলতে গোঁসাইজির হাত ছেড়ে পিছনের জানলায় গিয়ে দাঁড়ান দারোগা সাহেব। পাখিদের কিচির মিচির, পরিত্যক্ত জিপটার উপর। আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলপনা কাটছে সূর্য। ওই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা খানিক হালকা করার চেষ্টা করেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মনে পড়ে, স্বপ্ননীল বলে একজনের কথা বলেছিলেন গোঁসাইজি।
আচ্ছা এই স্বপ্ননীলের নাম্বারটা কোথায় পাওয়া যেতে পারে? বিশ্বামিত্রের নীল ডাইরিটায় পাওয়া গেলে ভালো, নাহলে গোঁসাইজিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এক্ষুনি। ওঁর কাছে থাকলেও থাকতে পারে।
একুশ
সোনারি। ঝাড়খণ্ড।
সোনারি জায়গাটা জামশেদপুরের একপ্রান্তে বলা যেতে পারে। একদিকে সোনারি আর একদিকে দলমা পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা। বর্ষার সময় এই নদীর রূপ ভয়ঙ্কর হলেও অন্য সময় ঠিক যেন—আমাদের ছোটো নদী। নদীর সমান্তরালে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটার নাম ভারি সুন্দর। মেরিন ড্রাইভ রোড। আর যে রাস্তাটা বাজার এবং সাঁওতালদের বস্তিটাকে পাশে রেখে, সোজা মেরিন ড্রাইভে গিয়ে পড়েছে তার নাম ‘রিভার মিট রোড’।
রিভার মিটের ধারেই অলকানন্দার আবাসন। পুরী থেকে কলকাতা যায়নি অলকানন্দা। বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য। মিটিং শেষ হলে উমানাথের সাথেই বেরিয়ে পড়েছিল। উমানাথ, গোয়ালিয়রের ফ্লাইট ধরে আর ও জামশেদপুরের। আগের থেকেই ঠিক ছিল হোটেল পদ্মনাভ থেকে বাড়িতে আসবে, দিন দুয়েকের জন্য।
অলকানন্দার বাবা অম্বিকেশ ঠাকুর সক্রিয় রাজনীতি করেন না কিন্তু মনে প্রাণে ভারতীয় হিন্দু মহাদলের সমর্থক। নন্দা তাঁর মুখেই শুনেছে, যে পিতামহ হৃষীকেশ ঠাকুর ছিলেন বি. এইচ. এম. ডি-র প্রতিষ্ঠাতা আশিস গায়কোয়ারের অত্যন্ত স্নেহভাজন। গায়কোয়ারের ডাকে সাড়া দিয়ে হৃষীকেশ জন্ম ভিটে ছেড়ে চলে যান নাগপুরে। পরবর্তী কালে, দলের সংগঠনকে শক্ত করার কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
অম্বিকেশ জিনগত ভাবে হৃষীকেশের থেকে যা পেয়েছেন তা হল জাত্যভিমান। একটু ভেঙে বললে বলা যায়, হিন্দুত্বের অহংকার। সেই অহং বোধ অম্বিকেশ আবার চাড়িয়ে দিয়েছেন অলকানন্দার মধ্যে। যা, ওকে এনে দাঁড় করিয়েছে, এই পলিটিক্যাল জীবনের স্টার্টিং পয়েন্টে।
যাই হোক, আজ নন্দা যখন বাড়ি ঢোকে ঘড়িতে তখন পৌনে চারটে। ঢুকেই ফ্রেশ হয়ে নেয় দ্রুত। খাওয়া দাওয়া সেরে ল্যাপটপ নিয়ে চলে যায় নিজের রুমে। পার্টির ম্যানিফেস্টো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে একসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আসে চোখ। শাটডাউন করে বিছানায় যায়।
একটা ছোট্টো পাওয়ার ন্যাপ। যখন চোখ খোলে তখন ঘরের মধ্যে মায়াবী আলো, যা দেখে বোঝা যায় খানিক বাদেই দলমাকে ছুঁয়ে সন্ধ্যা নামবে নদীর চরে। বিছানা ছাড়ে দ্রুত। উঠে গিয়ে সরিয়ে দেয় ডাবল উইন্ডোর পর্দাটা। দলমা পাহাড়ের রেঞ্জটা দেখা যায়। মুঠো মুঠো সবুজ। যেন ছোঁওয়া যাবে হাত বাড়ালেই।
থ্রি-কোয়ার্টারের উপর রিবকের টি-শার্ট তখন ভেঙে দিচ্ছিল সমস্ত ফর্মালিটি। দুই বুকে উপচে পড়ছিল গোধূলির হরেক কিসিমের আলো। হালকা লিপস্টিক আর একটা হেয়ার ব্যান্ডে প্রসাধন শেষ করে বেরিয়ে পড়েছিল অলকানন্দা, লাল রংয়ের লেডি বার্ডটা নিয়ে। রওয়ানা দিয়েছিল দোমোহিনীর দিকে।
দোমোহিনী হল খড়কাই আর সুবর্ণরেখার মিলনস্থল। সাধারণের ব্যাবহারের জন্য একটা ঘাট আছে। ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে। মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে যায় অলকানন্দা। বেশ কিছুটা গিয়ে থামে। সাইকেলটা লক করে নেমে আসে সুবর্ণরেখার পাড় ধরে। ঢাল খুব একটা খাঁড়াই নয়। একটু পা টিপে হাঁটলেই দিব্যি তলায় নেমে যাওয়া যায়।
নদীখাত অনেকটা প্রশস্ত। বন্যার ভয় নেই। সেইজন্য বোল্ডার ফেলা হয়নি। অনেক জায়গাতেই অল্প অল্প ঘাস গজিয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় দু-একটা পাথর বেরিয়ে আছে। সুবিধা মত একটা বসার জায়গা খুঁজে নেয় অলকা। যেখানে বসে তার ঠিক উল্টোদিকেই— দলমা। পাহাড়ের রঙ কালচে সবুজ কিন্তু সূর্য ডোবার সময়টায় শুধুই কালো। বিশাল এক দৈত্য, দিনান্তের সবটুকু আলো যেন নিজের ভিতর শুষে নিতে চায়।
বাঁ দিকে নজর দিলে দেখা যায় সেই জায়গাটা যেখানে খড়কাই এসে মিশেছে সুবর্ণরেখার সাথে। পাহাড়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওই দিকে তাকায় অলকা। এদিক পানে ভেসে আসছে একটা নৌকো। খড় বোঝাই। ঘাট থেকে আবার দুটো নৌকা আড়াআড়ি পাড়ি দিচ্ছে শিব মন্দিরের দিকে। চোখ জুড়ানো এক দৃশ্যপট।
ওই পারের মন্দিরটার নাম ‘দো-মোহিনী শিব মন্দির’। কোণাকুণি ওই গ্রামটার নাম যেন কী? ‘সাপড়া’ না কী যেন একটা? মনে পড়ে না কিছুতেই। ঘাটের কাছে মানুষগুলোকে এখান থেকে খুব ছোটো দেখায়। দেখতে দেখতে বিচুলি বোঝাই নৌকাটা দোমোহোনী পেরিয়ে অলকানন্দার সামনে চলে আসে। দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ শোনার চেষ্টা করে। না, কোনও শব্দ পাওয়া যায় না। কাছে মনে হলে কী হবে, এখান থেকে অনেকটাই দূর। দুই প্রান্তে দুজন মাঝির দাড় বাওয়ার ভঙ্গিমা বড় মোহময়। নন্দার শরীরের ভিতর ঢুকে আসে নদী। ‘অলকানন্দা’, সেও তো আসলে এক নদীরই নাম।
স্বপ্ননীলের কথা মনে আসে তার। উমানাথ বলেছেন, এখন ‘রেফারেন্স’ এর উপর নজর রাখা হবে খালি। কিন্তু অলকা জানে, আজ নয় কাল ঠিক খুন করা হবে তাকে।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন