সারা বাংলাদেশের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। এ পরিস্থিতির মধ্যেই লেখাটি সম্পূর্ণ করেছেন সিন্ধু। পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে তাঁর লেখা পেশের সময় এবং লেখা প্রকাশের সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে, যার দায়, ক্ষমতার, হিংস্রতার। —সম্পাদক
যে মুহূর্তে লেখা লিখছি, সত্যি বদলে যাচ্ছে, পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। হাসিনা বিদেশ পালাবার তাল করছেন। এদেশের বরাহনন্দনেরা জামাতের ভূত দেখে সবাইকে চুপ করাচ্ছেন। অথচ গলায় গুলি নিয়ে শুয়ে থাকা ছাত্রের পাশে আছাড়ি পিছাড়ি যাচ্ছেন মা। এ পর্যন্ত ষাটের অধিক। পুলিশ পারছে না, টোকোই ঢুকছে। টোকোই পারছে না লীগ ঢুকছে। কেউ না পারলে সবাই মিলে আক্রমণ। তাতেও চিঁড়ে না ভিজলে হেলিকপ্টারে করে সেনা নামানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে। পাবলিক জল দিচ্ছে, খাবার দিচ্ছে। রিক্সাওয়ালা আহতদের হাসপাতাল পৌঁছাচ্ছে। চারাপাশে অনবরত এই। শুরুটা রংপুরের আবু সইদ, শুরুটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের থেকেও। রাবার বুলেট দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা যায় বাংলাদেশি ডালকুত্তারা দেখিয়ে দিয়েছে। আসল বুলেটও চলছে লাগাতার। আহত পুলিশকে আবার বাঁচাচ্ছে ছাত্ররাই। আর মাইনের পুলিশ, নিজেদের সন্তান-সন্ততির বুকে নাগাড়ে গুলি চালাচ্ছে। রক্তাক্ত লাশ রাস্তা দিয়ে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য ভয় দেখানো, উদ্দেশ্য দমন। ছাত্রেরা ভয় পায় নাই। স্বচ্ছ ঢালের আড়ালে পুলিশের হেলমেট ও মাথা। তাও ভয় আটকানো যাচ্ছে না। দেখাতে চাওয়া ভয় স্বচ্ছ ঢালের ওপার থেকে ঢুকে পড়ছে তাদেরই চোখ দিয়ে মাথার ভিতর হু হু। ছাত্ররা হুংকার দিচ্ছে, আয়, আয় না! দেখে নেব। পুলিশ লাশ ফেলছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের লাতাড়ে লাথাচ্ছে। আর ঠাণ্ডা ঘর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাবুরা বিশ্লেষণ করছেন, আন্দোলন ঠিক কতটা জামাতি। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো, ওয়ার্কাস পার্টি এই ফ্যাসিস্ট রেজিমেরই অংশ। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের বড়দারা ‘জামাত ন্যারেটিভ’ চালাচ্ছেন। খানিকটা হাসিনার সমর্থনেই। জামাত-বিএনপি যে বাংলাদেশে এত ক্ষমতা, তা বোধহয় তারা নিজেরাও জানে না। এপারের বড়দারা জানে। আর ওদিকে বাংলাদেশের আকাশ বেয়ে জ্বলন্ত মেট্রো গড়িয়ে যাচ্ছে। খণ্ডযুদ্ধে হেলিকপ্টারে করে উড়ে আসা পুলিশ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে ফিরে যাচ্ছে হেলিকপ্টারেই। বিজিবির এপিসি দখল করছে ছাত্র-জনতা। বরিশাল ও কুমিল্লায় বিজিবি সারেণ্ডার করছে। ভীত হাসিনা বৈঠক চেয়েছেন অবশেষে। লাথি মেরে বসার চেয়ার সরিয়ে দিয়েছে ছাত্ররা। মাথা উঁচু করে প্রত্যাখান করেছে। মূজিবের ভাষণ তুলে বলেছে, “রক্তের দাগ শুকায় নাই। ঐ শহীদের রক্তে পাড়া দিয়ে আরডিসিতে মজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।” আর বৈঠক নয়। এতগুলো প্রাণ ঝরে গিয়েছে। বৈঠক আগেআ করা উচাত ছিল। হাসিনা স্পেন যাচ্ছেন। হাসিনা পালিয়ে যাচ্ছেন।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
এ আন্দোলন এখন আর কোটা সংস্কারের আন্দোলন নাই। ১৮ কোটি জনতার মাঝে প্রায় দু লাখ মাত্র মুক্তিযোদ্ধার কোটা যখন সরকারি চাকরির ৩০ শতাংশ করা হল, তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল ছাত্রছাত্রীরা। সে ২০১৮ সাল। চাপে কোটা বাতিলে বাধ্য হয় সরকার। বল ঠেলে দেয় আদালতে। আদালতের রায়ে কিছুদিন আগে সে কোটা ফের বলবৎ হয়েছে। তাতেই আন্দোলনের সূত্রপাত। কিন্তু এবারেও ভোট হতে না দিয়ে হাসিনার বোধহয় আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। বললেন, “মুক্তাযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কী রাজাকারদের নাতিপুতিরা পাবে?” এই কথাতে খেপে গেল ছাত্রেরা। কোটা সরানোর দাবি তাদের ছিল না। জায়েজ ২৬ শতাংশ কোটা তারা রাখতেই চেয়েছিল। কিন্তু বাকি তিরিশ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাতিলের জন্য আন্দোলনের জন্য তাদের রাজাকার দাগিয়ে দেওয়া হল। তারা স্লোগান দিল,
“চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার
তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার
বলে কে বলে কে সরকার সরকার”
তারপরেই পুলিশ এবং ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। ছাত্র আন্দোলনের উপর এত বর্বর রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণের নজির বিশ্বে হয়তো অতি সামান্যই। ষোলো অবধি ছ’জন শহীদ হয়েছিলেন, আজ এ পর্যন্তই ষাটোর্ধ্ব ছাত্রকে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। শতাধিক গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আহতের হিসেব নাই। তবু ছাত্ররা লড়ছে। জামাত-বিএনপি ক্ষীর খেতে এসেছিল। নোটিশ দিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়ানো হয়েছে। যে মুহূর্তে লিখছি, যে মুহূর্তে লেখাটা বেরোচ্ছে, হয়তো আরও কিছু হয়ে গিয়েছে। এত দ্রুত পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, অক্ষরে ধরা অসম্ভব। ইন্টারনেট পরিষেবা ছিন্ন। বাংলাদেশের কোনও খবর বাইরে আসছে না। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর চোখে গলায় পুলিশের গুলি করার কথা বলতে বলতে হাউহাউ কেঁদে ফেলেছিলেন যে বন্ধু, তার কোনও খবর পাচ্ছি না। আন্দোলনের সামনে থেকে খবর দিচ্ছালেন যে বন্ধুরা, তাদেল কোনও খবর পাচ্ছি না। জানি না তারা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। আবু সাঈদের দু-হাত ছড়ানো শরীর আমার চোখের উপর ভাসছে। হঠাৎ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া তার। ক্যামেরার পাশের সেই গলা, আর্তনাদ, গুলি খাইসে, গুলি খাইসে একটা। পুলিশ গুলি চালাবে সে বুঝতে পারে নাই, এত বোকা তাকে মনে হয় নাই। তার প্রোফাইলে সে লিখেছিল, শহীদ হলে তার লাশ রাস্তায় ফেলে রাখতে। যতক্ষণ না বিজয় মিছিল করে ছাত্ররা ফিরছে ততক্ষণ যেন তা দাফন করা না হয়। পরাজিতের লাশ যেন তাঁর বাড়িতে না ঢোকে। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এই সাহসের সঙ্গেই। একে রোমান্টিসিজম দিয়ে ছোট না করাই ভালো। তার লাশ এখনও দাফন হয় নাই ছাত্রীদের মনে। শাহাদত বৃথা যায় না। শহীদের মরেন না। আজ আরও জান গিয়েছে। রক্তে ক্ষোভে লাল বাংলাদেশের রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে বুটের শব্দ অশ্লীল। আন্দোলনে মানুষ নেমে যাচ্ছেন। রিক্সাওয়ালারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন, পুলিশকে গালি দিচ্ছেন। ভদ্রবিত্তরা ওজন করছেন, কতটা জামাতি হল আন্দোলন! বিজিবি নির্বিচারে গুলি করে মারছে। ছাত্র-জনতা হুঙ্কার দিচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে গোলাগুলি চলছে। শহীদ ছেলের মৃত্যুসংবাদ দিচ্ছেন মা। নবম শ্রেণির ছাত্রের ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকছে। চার ঘণ্টা আগে স্ট্যাটাস দেওয়া মুগ্ধ স্রেফ নাই হয়ে যাচ্ছেন। বহু ছাত্র নিখোঁজ। সন্ধান চেয়ে পোস্ট করছেন বাবা মা। কোটা সংস্কার আন্দোলন আর কোটা সংস্কার আন্দোলন নাই। তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশ সংস্কার আন্দোলন। খণ্ড যুদ্ধে খণ্ড যুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, স্বপ্নের জন্য লড়াইয়ের ক্ষমতা মানুষের এখনও ফুরায় নাই। এপার বাংলার নিষ্ক্রিয় শুয়োরের বাচ্চা বুদ্ধিজীবীদের চিনে রাখুন। প্রয়োজনে ছালটাল ছাড়িয়ে নিন। আর সঙ্গে রাখি অপেক্ষা, এপার বাংলার ছাত্রেরা কবে শিক্ষানীতি, শিক্ষার অধিকার নিয়ে এমন লড়াই লড়বেন, তারই অপেক্ষা।
যে মুহূর্তে লেখা লিখছি, সত্যি বদলে যাচ্ছে, পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। রাজাকারের অর্থ বদলে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার অর্থ বদলে যাচ্ছে। ছাত্রের লাশ টেন হিঁচড়ে ট্যাঙ্কে তুলছে সেনা। ছাদে শুইয়ে রাখছে। লাশ প্রদর্শন করতে করতে ট্যাঙ্ক চলছে। আওয়ামী লীগের অফিস ভেঙে খানখান করছে ছাত্রেরা। ট্রাক ট্রাক টোকোই আসছে। মুক্তিযোদ্ধার বেশে হেলমেট পরে লীগের ক্যাডার হিসেবে দেখা যাচ্ছে গুণ্ডাদের। এলোপাথাড়ি লাথি মারছে ছাত্রদের পুলিশ। ফেলে কোপাচ্ছে। বিনা ওয়ার্নিং-এ গুলি চালাচ্ছে। ‘দোহাই একটু আস্তে মারুন’ জাতীয় গান করবেন না দয়া করে। অশ্লীল লাগে। বরং ‘কথা ক’ জাতীয় প্রতিবাদী গান হোক আরও। প্রতিবাদে প্রতিরোধে পালাক পুলিশ, পালাক র্যাব, পালাক সেনা, পালাক লীগ। ফ্যাসিস্ট শক্তির ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে ছাত্ররা উপড়ে নিক জুলুমের নলি। দলে দলে, হাজারে হাজারে মানুষ অধিকারের জন্য লড়ছেন। আশা, যেন এ লড়াই সফল হয়। কিন্তু সফল না হওয়ার সম্ভাবনাকেও বাদ দিতে পারি না। আন্দোলন যদি সফল নাও হয়, বন্ধু, এ লড়াই ব্যর্থ যাবে না। প্রতিবাদে প্রতিরোধে আরও বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হবে মাত্র।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
শাশ্বতী লাহিড়ী
5 মাস আগেসবিশেষ অভিনন্দন লেখক, সিন্ধু সোম মহাশয়কে। এমন ধাঁচের নির্দ্বিধ লেখা খুঁজে বেড়াই মনে মনে। নিজেদের দ্বিচারিতা ছুঁড়ে ফেলে আমরা কেন যে পারিনা, ঘটমান সত্যের সম্পর্কে অন্তর্গত দ্দ্রোহের স্বরে কথা বলে উঠতে কিংবা লিখতে ! বাংলাদেশের মতো সমস্ত পৃথিবীতেই এখন শুধু আগ্রাসী হানাদারের রিরংসা আর দখলদারির ঔদ্ধত্য আবহমান। অথচ কী আশ্চর্য নির্লিপ্ত আমরা, অন্তত যারা নিজেদেরকে বিবেক সম্পন্ন ও সচেতন মানুষ বলে বিশ্বাস করি । আপনার লেখার মধ্যে দিয়ে আপনার ভেতরের দ্রোহের আগুনটাকে স্পর্শ করতে পেরে তৃপ্তি পেলাম । আলব্যের কামু কে মনে পড়ছে। বলতে চেয়েছেন, একমাত্র দ্রোহ ' ই জীবিতের অস্তিত্বের জন্যে অমোঘ পথ। আপনার এমন আরও নির্দ্বিধ লেখা পাবার অপেক্ষায় রইলাম। নমস্কার জানবেন।
শাশ্বতী লাহিড়ী
5 মাস আগেসবিশেষ অভিনন্দন লেখক, সিন্ধু সোম মহাশয়কে। এমন ধাঁচের নির্দ্বিধ লেখা খুঁজে বেড়াই মনে মনে। নিজেদের দ্বিচারিতা ছুঁড়ে ফেলে আমরা কেন যে পারিনা, ঘটমান সত্যের সম্পর্কে অন্তর্গত দ্দ্রোহের স্বরে কথা বলে উঠতে কিংবা লিখতে ! বাংলাদেশের মতো সমস্ত পৃথিবীতেই এখন শুধু আগ্রাসী হানাদারের রিরংসা আর দখলদারির ঔদ্ধত্য আবহমান। অথচ কী আশ্চর্য নির্লিপ্ত আমরা, অন্তত যারা নিজেদেরকে বিবেক সম্পন্ন ও সচেতন মানুষ বলে বিশ্বাস করি । আপনার লেখার মধ্যে দিয়ে আপনার ভেতরের দ্রোহের আগুনটাকে স্পর্শ করতে পেরে তৃপ্তি পেলাম । আলব্যের কামু কে মনে পড়ছে। বলতে চেয়েছেন, একমাত্র দ্রোহ ' ই জীবিতের অস্তিত্বের জন্যে অমোঘ পথ। আপনার এমন আরও নির্দ্বিধ লেখা পাবার অপেক্ষায় রইলাম। নমস্কার জানবেন।