বায়োপসি রিপোর্ট শুনে সেদিন কাদিরার পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল অনিশ্চতার অতলে। চোখের সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়ারা মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছিল আকাশে। মাথার ভিতরটা ফুটো কলসির মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। পাশে ভাই না থাকলে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল আর কি। ভাই কোনো রকমে ধরে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে দেওয়ায় সে-যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। ভাইয়ের ও অবস্থা তথৈবচ, পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র দুলাভাই আসলামের ক্যানসার শুনে সে-ও কেমন যেন হয়ে পড়েছিল। পুরুষ মানুষ তো, কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে লেগে পড়ে বোনকে সামাল দেওয়ার কাজে। কাদিরা ভাবে সামান্য ক-দিনের জ্বর থেকে এই। এরকম তো অনেকেরই হয়। তাই বলে…
আজ স্কুল থেকে ফিরে একটুও বসবার সুযোগ পায়নি কাদিরা, সকাল ৭:৪৫-এ ট্রেন ধরে যাওয়া, সন্ধে সাড়ে ছ-টায় বাড়ি ফেরা। সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে রান্নাবান্না করে খাবার সব টেবিলে সাজিয়ে, নিজে নামমাত্র খেয়ে টিফিনে কিছুটা ভরে টোটো ধরা। টোটো থেকে নেমে দৌড়ে দৌড়ে তিন নম্বর প্লাটফর্ম। ট্রেন লেট না থাকলে বেশিরভাগ দিনই ট্রেন আর সে একইসাথে প্লাটফর্মে ঢোকে। ট্রেনে উঠে বসলে তবে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা যায়। কাটোয়াতে এই ট্রেন থেকে নেমে আবার ট্রেন বদল করে তবে পৌঁছানো যায় কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে। সেখান থেকে স্কুল আবার টোটো। দৈনিক চারবার যানবাহন বদল করে যাওয়া-আসা সত্তর সত্তর এক-শো চল্লিশ কিলোমিটার জার্নি। জীবনের মতোই তার এই যাত্রাপথ বড়ো দীর্ঘ তবুও এমনি করেই কেটে যাচ্ছে সময় দিন মাস বছর।
প্রথম দিকে খুব অসুবিধা হত। এখন অনেকটাই মানিয়ে নিতে পেরেছে, মানে মানিয়ে নিতে হয়েছে। এখন তবুও তো রাস্তাঘাট ও যোগাযোগে অনেক সুবিধা হয়েছে। সে যখন প্রথম জয়েন করেছিল তখন না ছিল রাস্তাঘাট না ছিল প্রয়োজন মতো পর্যাপ্ত ট্রেন বাস। প্রথম দশ-এগারো বছর স্কুলের কাছাকাছি ভাড়া বাড়িতে কাটিয়েছে। মেয়ে একটু বড়ো হওয়ার পর তাকে হাই স্কুলে ভর্তি করার প্রয়োজনে এবং শাশুড়ি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ফিরে আসতে হয়েছে নিজের বাড়িতে। সেই থেকে শুরু হয় কাদিরার ডেলি প্যাসেঞ্জারি। একবিংশের নারী জাগরণের যুগেও নারীর স্বাধিকার সেই সোনার পাথরবাটি। কোনো কোনো প্রগতিশীল পুরুষ খোঁটায় বাঁধা দড়ির দৈর্ঘ্য একটু বাড়িয়েছে এই যা। নারী প্রগতির ধ্বজাধারী প্রগতিশীল পৌরুষ খোঁটা খুলে যেমন দেয়নি তেমনই উলটো দিকে দড়ি ছেঁড়ার প্রবণতা খুব স্পষ্ট নয়।
মাসখানেক রোগে ভুগে শাশুড়ি চিরদিনের মতো চলে যাওয়ার আগে বাড়ির বড়ো বউ হিসেবে তার হাতে সংসারের বাড়তি দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গেছে। পাঁচ বছর পর সে দায়িত্ব আর বইতে পারেনি। দেওরদের ও ননদের বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিয়েছে সকলকে। এমনিতে এখন খুব একটা অসুবিধা না হলেও, গত মাস দুই ধরে আসলাম, তার স্বামী হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সে আর ধকল নিতে পারছে না। তারও তো শরীর। কিন্তু পারছি না বললেই বা শুনছে কে? একমাত্র মেয়ে এমবিবিএস ইন্টার্ন। হোস্টেল হাসপাতাল আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
দু-মাস আগের ঘটনা, দু-সপ্তাহ ধরে আসলামের জ্বর ছাড়ছে না, সুস্থ সবল মানুষ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে ন্ খাওয়ায় রুচি নেই। এক গ্রাম প্যারাসিটামল শরীরের উত্তাপ এক-শোর নীচে নামালেও বেশিক্ষণ শীতল রাখতে পারছে না শরীর। ডাক্তারের নির্দেশে শুরু হয় নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ধরা পড়ে ইনটেসটাইন টিউমার। অপারেশনের জন্য নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। অভিজ্ঞ সার্জেন ডক্টর সামসুল হক রিপোর্ট ও রোগীর উপসর্গ দেখে অপারেশন করা থেকে বিরত হন। পরামর্শ দেন বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে। রাতারাতি চড়া দামে ফ্লাইট-এর টিকিট কেটে ব্যাঙ্গালোর মনিপাল হাসপাতাল। অপারেশনের আগের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে বায়োপসি রিপোর্টে ধরা পড়ে কর্কট রোগের বিষ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
বায়োপসি রিপোর্ট শুনে সেদিন কাদিরার পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল অনিশ্চতার অতলে। চোখের সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়ারা মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছিল আকাশে। মাথার ভিতরটা ফুটো কলসির মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। পাশে ভাই না থাকলে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল আর কি। ভাই কোনো রকমে ধরে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে দেওয়ায় সে-যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। ভাইয়ের ও অবস্থা তথৈবচ, পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র দুলাভাই আসলামের ক্যানসার শুনে সে-ও কেমন যেন হয়ে পড়েছিল। পুরুষ মানুষ তো, কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে লেগে পড়ে বোনকে সামাল দেওয়ার কাজে। কাদিরা ভাবে সামান্য ক-দিনের জ্বর থেকে এই। এরকম তো অনেকেরই হয়। তাই বলে…
ক্যানসার শব্দের মধ্যে এখনও যে একটা অসম্ভব রকমের আতঙ্ক লুকিয়ে আছে সেটা বোঝা যায় প্রিয়জন কেউ আক্রান্ত হলে। আগে গ্রামে একটা কথা প্রচলিত ছিল ‘ক্যানসার, নো অ্যানসার’। মেয়ে বার বার ফোন করে রিপোর্ট জানতে চাইছে। কাদিরা ভেবে উঠতে পারে না কী বলবে মেয়েকে? হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ লেখে ‘হাসপাতালের ভিতরে আছি, পরে কথা বলছি’। মায়ের এই অযথা কালক্ষেপ মেয়েকে বুঝিয়ে দেয় প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে সে যা আশঙ্কা করেছিল হয়তো সেরকম কিছুই ঘটেছে। আসলাম কে জানানো হয়নি কোনোকিছু। জানলে দুশ্চিন্তা আর ভয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। কাদিরা ভাবে সেজন্যই বোধ হয় প্রাথমিক রিপোর্ট দেখেই নবদ্বীপের ডাক্তার বলেছিল— সময় নষ্ট করার মতন সময় এখন আপনাদের হাতে নেই। যত দ্রুত সম্ভব ভালো জায়গায় সার্জারির ব্যবস্থা করুন।
পাঁচ ঘন্টা অপারেশনে টিউমার সহ ইনটেসটাইন-এর খানিকটা অংশ বাদ দিয়ে মানিপাল হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেছিল সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত না হলেও মারাত্মক বিপদের ঝুঁকিটা কমানো গেছে। পাঁচ দিন তারা দুই ভাই বোন নাওয়া-খাওয়া ভুলে হাসপাতালে রোগীর কাছে বসে থেকেছে। কখনো কখনো কাদিরা একা বাইরে বেরিয়ে কেঁদেছে আপনমনে। মানুষের সম্পর্কগুলোর মতো জীবনও কত ভঙ্গুর। খুব কাছের মানুষ সব বিপদে-আপদে পাশে থাকে, অথচ রাগের মাথায় মুখ ফসকে বলে ফেলা একটা দুটো খারাপ বাক্য যেমন ছিন্ন করতে পারে সব মায়া সব টান, তেমনি একটা ছোট্ট শব্দ ‘ক্যানসার’ নিমেষে জীবনের সব রঙ-রূপ-রস মুছে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
প্রথম তিন দিন তারা ভাত খায়নি। সঙ্গে থাকা চিড়ে মুড়ি আর হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে শুকনো খাবার কিনে খেয়েছে। চতুর্থ দিন আসলামের অবস্থা একটু ভালো বুঝে তার ভাই হাসপাতালের কাছেই ভাড়া নেওয়া ঘর থেকে সেদ্ধভাত করে এনেছে। তাও খেতে পারেনি কাদিরা। অপারেশনের পর চেতনানাশকের প্রভাব কমতেই আসলাম সম্পূর্ণরূপে কাদিরার উপর প্রভাব বিস্তার করে বসে। তাকে এক মিনিটের জন্য ও কাছ ছাড়া করতে রাজি নয়। এমনকী বাথরুম গেলেও বার বার খোঁজ করেছে। পাঁচ দিন এককাপড়ে থাকতে বাধ্য করেছে। লোকে শুনলে হাসবে অসলামরা চার ভাই এবং তার বাপ হাসপাতাল ভীতিতে গভীরভাবে আক্রান্ত, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘নোসোকোমোফোবিয়া’। হাসপাতালে কোনো আত্মীয়-স্বজন ভর্তি থাকলে দেখতে যায় না। আত্মীয়-স্বজন বা পাড়াতে কেউ মারা গেলে মাটি দিতে যাওয়া তো দূরের কথা, দেখতে পর্যন্ত যায় না। বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কখনো জানাজায় অংশ নেয়, কখনো নেয় না। পারিবারিক সম্পর্কগুলো রক্ষার দায় গিয়ে পরে বাড়ির মেয়ে বউদের উপর। আসলামকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাড়িতে সকলে একমত হলেও সঙ্গে যাওয়ার জন্য তার ভাইরা কেউ রাজি হল না। কাদিরার পক্ষে একা মেয়েমানুষ সব কিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই শেষপর্যন্ত কাদিরার মেজো ভাই ঔষধের দোকান বন্ধ করে দিয়ে চলে এসেছে। কাদিরা মেয়ের কাছে গোপন রাখেনি কোনো কিছুই। ছয় মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে এমবিবিএস কমপ্লিট করবে যে মেয়ে, তার কাছে তার বাবার চিকিৎসার বিষয়ক তথ্য গোপন রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি কাদিরা। প্রথম দিকে মেয়ের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে, দুশ্চিন্তা করে কষ্ট পাবে ভেবে এড়িয়ে যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু পরে বুঝে দেখেছে মেয়ের সাহায্য তার লাগবে। বাড়ির কাউকে প্রয়োজনে পাওয়া যে যাবে না সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত। এখান থেকে বাড়ি ফিরলেই রিপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র দেখে মেয়ে ঠিকই সব বুঝে যাবে। তখন!
মানিপাল হাসপাতালের ডাক্তারদের তৈরি করা প্ল্যান ও পরামর্শ মতো বাড়ি ফিরে কল্যাণী এইমস এর অঙ্কোলজি বিভাগে পরবর্তী চিকিৎসা শুরু হয়েছে। একুশ দিন পর এক ডোজ করে ইঞ্জেকশন কেমো হাসপাতালে এক দিনের জন্য ভর্তি করিয়ে নিতে হয়। তার পর চোদ্দ দিন চলে ওরাল কেমো, বাড়িতে। এই সময় নিয়ম করে খাওয়া আর ঘড়ি ধরে ওষুধ। সামনে পরীক্ষা। সিলেবাস শেষ করা বাকি। সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগের আরেকটি পোস্ট দীর্ঘদিন ধরে শূন্য অবস্থায় পড়ে আছে তার স্কুলে। শিক্ষক নিয়োগের কোনো সরকারি সদিচ্ছা নেই। সম্পূর্ণ চাপটা তার ঘাড়েই এসে পড়ে, বিশেষ করে নবম ও দশম শ্রেণীর। তাই বাধ্য হয়ে প্রথম ডোজ কেমোর পর আঠাশ দিনের মাথায় স্কুল যাওয়া শুরু করেছে সে। সর্বক্ষণের একজন কাজের লোক আছে বটে কিন্তু আজকাল যা দিন পড়েছে কাজের লোকের উপরই বা কতটা ভরসা করা যায়। শাশুড়ি গত হয়েছেন বছর বারো হয়ে গেল। তিনি বেঁচে থাকলে এসব নিয়ে কাদিরাকে ভাবতে হত না। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বড়ো ছেলের উপর মায়ের সম্পূর্ণ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বজায় ছিল। এখন বাড়িতে থাকছে তার মা, তিনিও বয়স্ক। তার উপর আবার শাশুড়ি। জামাইকে তিনি জোর করে কিছু বলতেও পারেন না। শুধু সময় মতো খাবার আর ওষুধটা এগিয়ে দেন। বাকিটা রোগীর মুড মেজাজ ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
কাদিরার স্কুল যাওয়াটা কোনো মতেই মানতে পারছে না আসলাম। সে চায় কাদিরা সব সময় তার নাগালের মধ্যে থাকুক। সে তো সব পুরুষই চায়। কিন্তু সে-ই তো একদিন বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে কাদিরাকে চাকরি করতে পাঠিয়েছিল। আজ তারই মনে হচ্ছে বাড়ির বউদের চাকরি করা সংসারের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে ভাবলে বাড়ির বউদের চাকরি করা সংসারের জন্য বিশেষভাবে মঙ্গলজনক। নাহলে একটা ছোটো বইয়ের দোকান চালিয়ে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে মেয়েকে পড়ানো তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব হত না। তার ব্যায়বহুল চিকিৎসাও সম্ভব হত না। এত কথা ভাববার জন্য সে হয়তো এতক্ষণ বেঁচে থাকত কি না সন্দেহ। তা সত্ত্বেও আসলাম শুরু করে সামান্য অনিয়ম। বিকেল বেলায় একা হাঁটতে বেরিয়ে রাস্তার ধারে কিংবা হাটতলার মোড়ে চায়ের দোকানে জল খেয়ে নিচ্ছে। ক্রনিক ডায়াবেটিসের রুগী খাচ্ছে কড়া মিষ্টি দুধ চা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভুলে যাচ্ছে খালি পেটে ওষুধ খেতে। যদিও খালি পেটে খাওয়ার ওষুধ খেতে ভুলে যায়নি এমন কোনো মানুষ খুঁজলে পাওয়া যাবে না। ক-দিন ধরে কিছু অসংগতি চোখে পড়লেও স্কুলের কাজের চাপে সবটা দেখে উঠতে পারেনি কাদিরা। রবিবার সকালে খাবার দিতে গিয়ে দেখে চাদর ঢাকা নিয়ে শুয়ে আছে আসলাম। চাদর সরিয়ে গায়ে হাত দিতেই চমকে ওঠে কাদিরা।
—একি! জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে।
—যাক! তোমার কি আর সময় আছে?
কথাটা কানে লাগে কাদিরার। চোখের কোনায় জমে ওঠা মুক্তোদানাগুলো অবহেলা আর অবজ্ঞার মাটিতে ঝরতে না দিয়ে কর্তব্যকর্মে মন দেয়। লোকটা বরাবরই একটু অলস কিন্তু অকর্মণ্য নয় কখনো। মাঝেমধ্যে দু-একটা দিন ঠোকাঠুকি হলেও খামতি ছিল না ভালোবাসায়, দূরত্ব ছিল না সম্পর্কে। যদিও চেঁচামেচি সে-ই বেশি করে, আসলাম চুপচাপ শোনে, খুব বাড়াবাড়ি না করলে সাধারণত উত্তর না দিয়ে প্রশ্রয়ই দিত। কিন্তু এখন, এই অসুস্থতার পর কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে আসলাম, কথায় কথায় বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। ঘরের পুরুষ অসুস্থ থাকলে কার আর ভালো লাগে, সে-ও তাই চাইছে যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়। শরীর যেন সবল থাকে তাই বেশি বেশি খাবার খেতে জোর করছে। খুটিনাটি সব কিছু ডাক্তারকে নিয়মিত রিপোর্ট করছে। যেগুলো না-পসন্দ আসলামের। শান্ত স্বভাবের মানুষটি মাঝে মাঝে রেগে যাচ্ছে। সব কথা ডাক্তার কে বলা যাবে না। তার খিদে না পেলে খাবে না। থার্মোমিটারটা মুখ থেকে সরিয়ে নিলেও থার্মোমিটার থেকে তার চোখ সরে না। এক-শো চার। কী করবে সে এখন! মানিপাল হাসপাতালের ডাক্তার বার বার বলে দিয়েছিল— দুটো জিনিস খেয়াল রাখবেন। দেখবেন জ্বর যেন না আসে। আর ওজন যেন না কমে। যতদিন এই দুটো ঠিক থাকবে কোনো চিন্তা নেই।
মোবাইল হতে নিয়ে ফোন করতে থাকে হাসপাতালের নম্বরে। দু-তিন বার ফোন করে না পেয়ে মনে পড়ে আজ রবিবার। তার দিশেহারা ভাবটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। কী করবে ভেবে না পেয়ে মেয়েকে ফোন করে। সব শুনে বিরক্ত হয়ে মেয়ে বলে— বাপী যদি নিজের ভালো নিজে না বোঝে তুমি একলা মেয়েমানুষ কী করবে? কিন্তু এই একলা মেয়েমানুষই তো সব কিছু সামলাচ্ছে।
—দ্যাখো, কেমোর ডাক্তারের সাথে কথা না বলে কোনো ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। প্রেস্ক্রিপশনের পিছনে স্যারের পার্সোনাল নম্বর লেখা আছে।
—সেটাই তো খুঁজছি তখন থেকে।
—দ্যাখো একটা নতুন ফাইলে ঢোকানো আছে।
—আমি দেখছি। বলে ফোনটা কাটতে উদ্যত কাদিরা।
—আর শোনো, যদি ফোন না পাও তাহলে একটা প্যারাসিটামল ছ-শো পঞ্চাশ মিলি দিতে পারো। আমি এখানে স্যারের সাথে কথা বলে একটু পরে জানাচ্ছি।
প্রেস্ক্রিপশনটা হতে পেয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরে পায় কাদিরা। একবার রিং করতেই ওপ্রান্ত থেকে উত্তর আসে— বলুন।
—আসলাম শেখ।
—কী হয়েছে?
—এক-শো চার জ্বর।
—ক-দিন ধরে?
অসহায় চোখে আসলামের দিকে তাকায় কাদিরা। অস্ফুটে উচ্চারণ করে, ‘কতদিন’? আসলাম ইশারায় দেখায় দুই।
—দু-দিন।
ডাক্তারবাবু দুটো ওষুধ বলে দিলেন আর ডেঙ্গু টাইফয়েড ম্যালেরিয়া টেস্ট করতে বললেন।
পরদিন রিপোর্ট হাতে এল, টাইফয়েড। আবার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ওষুধ দিলেন। তিন দিন খাচ্ছে। আজ থেকে আর জ্বরটা আসেনি। তবে শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে। খেতে পারছে না। মুখময় ঘা। এত বড়ো অপারেশনের পর ওজন কমতে দেয়নি কাদিরা। কিন্তু আসলামের সামান্য ভ্রান্তি সর্বনাশ করে দিল। প্রায় সাত কেজি ওজন কমে গেছে। তিন দিন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় কাটিয়ে আজ স্কুল গিয়, ছিল। ট্রেন লেট ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।
রান্নাবান্না শেষ করে ন-টায় আসলামকে খাইয়ে সবে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতলটা হাতে নিয়ে ছিপি খুলে এক চুমুক দিয়েছে, রান্নাঘরে টেবিলে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। কাদিরা উঠল না। একবার বাজা শেষ করে ক্লান্তিহীনভাবে আবার বাজতে শুরু করল। এবার বাধ্য হয়ে উঠতে হল। মোবাইলটা হাতে নিতে নিতে আবার কেটে গেল। কাদিরা দেখল পাঁচটা মিস কল আসলামের একমাত্র বোন রুবিনার। বাঙ্গালোর থেকে ফেরার পর একবার দেখে গেছে বড়ো ভাইকে ঘণ্টা খানেকের জন্য। ভাইয়ের কাছে দিন কতক থাকার তার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু উপায় নেই, নার্সারিতে পড়া মেয়ের টিউশন কামাই হবে, সামনে পরীক্ষা। শেষ ফোন করেছিল এক সপ্তাহ আগে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও রিংব্যাক করতে হল। চার মিনিট আঠারো সেকেন্ড কাদিরার ক্লান্ত মগজে ঝড় বয়ে গেল। সব কথা মনে না ধরে রাখলেও দু-তিনটে বাক্য তাকে বিধ্বস্ত ও বিচলিত করে তুলল।
—আমার ভাইটার জীবনের কোনো দাম নেই না তোমার কাছে? ঘরে ক্যানসার রোগী আর উনি মাস্টারি করে বেড়াচ্ছেন। রঙ্গতামাশা করে বেড়াচ্ছেন। আর কেউ যেন চাকরি করে না। কর্কশ ধ্বনিতরঙ্গে শব্দগুলো ফিরে ফিরে ক্রমাগত বেজে চলেছে তার কানে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে যায় কাদিরা। ন-টা পঞ্চান্ন। ঠিক দশটায় ওষুধ দিতে হবে। উপরে গিয়ে জলের বোতল আর ওষুধ নিয়ে আসলামের কাছে গিয়ে দেখে সে তখন ফেসবুকে ডুবে। অগত্যা অপেক্ষা, কখন তিনি চোখ তুলে তাকে দেখবেন…
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন