preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
সন্ত্রাস যেভাবে গল্প লিখিয়ে নেয়
গল্প

সন্ত্রাস যেভাবে গল্প লিখিয়ে নেয়

দিয়া শিল্প জগতের কেউ নয়। কিন্তু ও ছবি দেখতে পছন্দ করে। গান শুনতে ভালোবাসে। ভ্যান গখের একেকটা ছবি দেখে যেমন ও টের পায় একজন শিল্পীর সংঘর্ষ কত বহুমাত্রিক হয়! হতে পারে। যেমন— ভ্যান গখের একটা ছবি— ‘নুন, রেস্ট ফ্রম ওয়ার্ক’। ছবিটা দেখতে দেখতে ও টের পেত— কেবল দারিদ্র্য বা নিজের কাজ অন্যের বুঝতে না-পারার যন্ত্রণা নয়; নিজের মনোজগতের আলো দিয়ে স্বপ্ন দিয়ে বাইরেটাকে খুঁজতে চাওয়ার বুঝতে চাওয়ারও একটা যন্ত্রণা নিরবধি কুরে খেয়েছে গখকে। ‘নুন, রেস্ট ফ্রম ওয়ার্ক’-এ যে অনেক কমলা রঙের আলো আছে, যে স্বপ্ন খোঁজার চাবিকাঠি গখ খুঁজে পেয়েছিলেন, তা তাঁর অন্তরের। তবু, বাইরেও তার সন্ধান জারি রেখেছিলেন। জারি রেখেছিলেন বলেই গখ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছেন। যে-যন্ত্রণার উপশম আসলে পৃথিবীর কোনো অ্যাসাইলামের হাতে নেই। থাকতে পারে না। তাই অ্যাসাইলামেও নিজেই নিজেকে শুশ্রূষা দিয়েছেন। ছবি এঁকে। আরও আরও ছবি এঁকে।

সত্যি সত্যি সত্যিটা কী— এই প্রশ্নের উত্তর অনেকভাবে খোঁজা যায়। দিয়াকে অবশ্য খুঁজতে হয়নি। নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। মেঘ না-চাইতেই জলের মতো। অবশ্য সঠিক উপমায় বললে— ওল ফুলের মতো। যা গন্ধ-সর্বস্ব। যে-গন্ধে ব্রহ্মাণ্ড অব্দি ত্রাহিরবে ওলোট-পালট হয়। তখন যার পাশে যাই তারেই লাগে গন্ধ-দলন। অর্থাৎ কিনা মেঘ-না-চাইতেই-জল আসলে দুর্গন্ধে ভরা। দিয়া অবশ্য ওল-ফুলের কথাটা জানত না। জানত না তার দুর্গন্ধের কথাও। নিয়ন ওকে বলেছে। যে রাতের তারা দিয়ার এত প্রিয় সেই তারাগুলো অব্দি ওল-গাছের ফুল হয়ে গেছে। ক্রমশ কমে আসা যে পাখি তা সে ডাকুক, না-ডাকুক, যার সেই ভাষা দিয়া মুহূর্তে বুঝতে পারে, সেই বিরল পাখিদের ঠোঁটে অব্দি একটা করে ওল-ফুল।

ছাদের প্যারাপিটে হেলান দিয়ে দিয়া ক্রমশ ওল-গন্ধের ঢেউয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগল। কেবলই মনে হতে লাগল কী একটায় যেন হাত লেগে গেলেই আলাদিনের প্রদীপ আশ্চর্য হবে! তারপর সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য একটা আলোর গমক ও টের পেল। মুহূর্তে ও বুঝতে পারল একটা দরজার ম্যাচিং নাম্বার ওর দরকার। দরজার ম্যাচিং নাম্বারটা মনে করতে পারলেই ওর এই গন্ধ-সমুদ্রের ঢেউ থেকে মুক্তি মিলবে। ভুলে যাওয়া জিনিস খুব বেশি হাতড়াতে থাকলে মাথার ভিতরটা একসময় গাঢ় অন্ধকারের মতো বোবা হয়ে যায়। হঠাৎ হঠাৎই ওর মনে হল— বহুকাল মানুষের মুখ দেখেনি। একবার চেনা-পরিজনদের মধ্যে গিয়ে পড়লেই এই উত্তাল গন্ধ-সমুদ্র থেকে ওর মুক্তি মিলবে। নিয়ন দিন দুয়েকের কাজে বাইরে গেছে। তার আগেই ওকে চেনা-পরিধির মধ্যে, কাছাকাছি কোথাও পৌঁছতেই হবে। হবেই হবে। রাতটা কিছুতেই নাহলে কাটবে না। গন্ধের ল্যুপটা এরপর আস্তে আস্তে ওকে টেনে নেবে।

রাত প্রায় সাড়ে ন-টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি জনা চারেক বন্ধুর বাড়িতে গেলও দিয়া। তাদের সঙ্গে কথাও বলল। কিন্তু তারা তার কথা শুনতে পেল কি না, দিয়া বুঝতে পারল না। যেমন দিয়াও শুনতে পেল না, তাদের কথা। শুধু তাদের ঠোঁট নড়তে দেখল। প্রীতমের পড়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসেছিল দিয়া। প্রীতম দরজা ঠেলে কফি হাতে বারান্দায় ঢুকতে ঢুকতে দিয়ার উদ্দেশে কিছু বলছিল। কিন্তু কী বলছিল দিয়ার পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না, সে শুধু প্রীতমের ঠোঁট নড়তে দেখেছিল। সেইসঙ্গে প্রীতমের মুখ-টিপে ধরে রাখা হাসি। কিন্তু ঠোঁটের নড়ে ওঠা, খানিক চেপে ধরে রাখা হাসি, এসব পেরিয়ে দিয়া দেখছিল— একটা অস্পষ্ট ক্যানভাস। তারপর তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধরা পড়েছিল— দালির গলে যাওয়া ঘড়ির ক্যানভাস। আরেকটু পরে বুঝেছিল, হুবহু দালির ক্যানভাসে ঘড়ির জায়গায়, গ্রামার বইয়ের ছবিতে দেখা মানুষের বাগ্‌যন্ত্র। য,-বাগ্‌যন্ত্র ছবিতে গলে গলে যাচ্ছে। মাথার উপরে নীল আকাশ নয়— শামিয়ানার আদলে ওল-ফুলের গন্ধ ছেয়ে আছে। ওর এই হতভম্ব দশা দেখে প্রীতম ওকে ঝাঁকুনি দিল। দিয়া বুঝতে পেরেছে, ও কাউকে কিছু বোঝাতে পারবে না। ওকে দরজাটা খুঁজে বার করতেই হবে। নাহলে ওর পরিত্রাণ নেই।

প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় এই খর-গন্ধ-বয়-বেগের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে খেয়াল করেছে— সমস্ত বস্তুগত আকার গন্ধে কনভার্টেড হয়ে গেছে। হাত দিয়ে কিছু স্পর্শ করলে স্পর্শের অনুভূতিটুকুও আর নেই। স্পর্শের অনুভূতি যেন কোন ডাইমেনশনে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। বদলে হাত-পা-ত্বক সবই এখন ঘ্রাণেন্দ্রিয়র কাজ করছে। ফলে, হাত দিয়ে সে কোনো বড়ো বা ভারী কাজ করতে পারছে না। যেটুকু করতে পারছে— সবই গন্ধের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আর খানিক আন্দাজে। তবু খাওয়া স্নানের মতো কাজ করতেই হচ্ছে। কিন্তু খাওয়ার বদলে গন্ধের বাবল গলাধঃকরণের অনুভূতি ঘিরে ধরছে। জলের বদলে গন্ধের কুয়াশায় স্নান সারছে। নিয়নকে যতবার এসব বলতে গেছে— নিয়ন ছিটকে সরে গেছে। যা হয়তো স্বাভাবিকও।

এতসব কিছুর মধ্যেও দিয়ার চোখ মোটামুটিভাবে চোখের কাজ করছিল। (বিশেষত দিনের আলোয়।) এতে একদিকে প্রচণ্ড অসুবিধা হচ্ছিল, ঠিকই। যেমন— সে চোখ দিয়ে দেখল— ফলের ট্রেতে আঙুর রাখা আছে, কিন্তু যেই হাত দিয়ে খেতে গেল ওমনি হাত ঘ্রাণ খেয়ে খিদে চাপা দিয়ে দিল। কিঞ্চিৎ হলেও সুবিধা অবশ্য কিছু ছিল। মে-জুন মাসের প্রচণ্ড দাবদাহে সবাই যখন এসিরুমেও ঘামছে— ও দিব্যি ছাদে চলে যেতে পারত। গন্ধের কুণ্ডলী ওকে সুরাহা দিত। এরকমই এক দুপুর রোদে ছাদে ওঠার দিনে ও হঠাৎই আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে ঘুরেফিরে তাকাতে গিয়ে বুঝতে পারল— শিল্পজগতের পরিচিতবৃত্তের লোকজন। কেউ কেউ হয়তো-বা কাছের। কাছের মানে যাদের বাড়িতে যাওয়া-আসার সম্পর্ক আছে। উলটোটাও ঘটেছে। সেইসব বন্ধু এবং পরিচিতজনেরা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে যেন। তাদের প্রত্যেকের হাতে মোবাইলের অতিক্ষুদ্র সংস্করণের মতো এক গেজেট। তাতে তারা অদ্ভুত অদ্ভুত ধাতব আওয়াজ করছে। এবং সেই ক্ষেত্রে দিয়ার শ্রবণেন্দ্রিয় কাজ করছে। আর কী আশ্চর্য— কেবল নিয়েনের কথা শুনতে পাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র এবং একমাত্র এই ক্ষেত্রেই ওর শ্রবণেন্দ্রিয় কাজ করছে। একদিকে ছোট্ট সংস্করণের মোবাইলের ধাতব কর্কশ আওয়াজগুলো, অন্যদিকে গন্ধের আবরণ ওর মাথাকে পাথরের মতো নিরেট শক্ত আর ভঙ্গুর করে তুলছে। ওর মাথার স্নায়ু-কোষ-ঘিলুর অস্তিত্ত্ব ক্রমশ মুছে দিচ্ছে। মাথার অন্য অন্য সংবেদনগুলো ক্রমশ ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। সুরের সঙ্গে পায়চারি, একেকটা টেক্সট-এর সঙ্গে বিবাদ-বোঝাপড়া সব স-অ-ব ক্রমশ মুছে যাচ্ছে যখন— মানে একেবারে মুছে যাওয়ার আগে সভ্যতা শুরুর ঊষালগ্নে বাঁচার লড়াই-এর মতো করে কে যেন মাথার মধ্যে বারবার তীব্র মা-স্বরটিকে লাগাতে চেষ্টা করছে। যতবার মাথার ওই নিরেট পাথরে ঝাঁকসর্বস্ব আওয়াজের আছড়ে পড়া আর ভেঙে পড়ার প্রস্তুতি, ততবার ওই তীব্র মা-র একটা ঢেউ, শিহরন! দিয়া বুঝতে পারল পুরোটা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ার আগে কে যেন ক্ষোভটাকে সম্বল করে যুঝতে চাইছে।

আর ঠিক এরকম একটা অবস্থায় সুরের কুটোটুকু আঁকড়ে ভেসে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে যখন দিয়া— ওর হঠাৎ ভয়প্রসাদের কথা মনে হল। ভয়প্রসাদের আসল নাম অবশ্য অন্যকিছু। কিন্তু সেই আসল নাম শিল্পজগতের মাতব্বর হওয়ার পর থেকে সবাই ভুলে গেছে। আর সভ্যতা শুরুর দিন থেকেই যেহেতু সর্দারের বিপ্রতীপে আরেক সর্দারের ভূমিকা জুড়ে গেছে, সুতরাং, ভয়প্রসাদের বিপ্রতীপে একজন ত্যানাপ্রসাদের বিলক্ষণ উপস্থিতি জুটে গেছে। মুখ-দেখাদেখি বন্ধ থাকলেও ভয়প্রসাদ এবং ত্যানাপ্রসাদের একরকম মিথোজীবিতার সম্পর্ক আছে, পরস্পরের সঙ্গে। উভয়েরই লেঠেল-বাহিনীর অনুকরণে কিছু ঘোষিত-অঘোষিত বাহিনী আছে। যাদের উদ্দেশ্য অপর বাহিনীকে দমিয়ে রাখা। কিন্তু অন্যজনের উপস্থিতি খাদের কিনারায় এসে টাল-খাওয়ার উপক্রম হলেই অপর পক্ষ তাকে বাঁচাবেই বাঁচাবে। উভয়পক্ষের রাগ-ঘৃণা তখন সার্ফ-এক্সেলে কেচে ঝকঝকে রোদে শুকোতে দেওয়ার মতো সতেজ, শুভ্র।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

দিয়া শিল্প জগতের কেউ নয়। কিন্তু ও ছবি দেখতে পছন্দ করে। গান শুনতে ভালোবাসে। ভ্যান গখের একেকটা ছবি দেখে যেমন ও টের পায় একজন শিল্পীর সংঘর্ষ কত বহুমাত্রিক হয়! হতে পারে। যেমন— ভ্যান গখের একটা ছবি— ‘নুন, রেস্ট ফ্রম ওয়ার্ক’। ছবিটা দেখতে দেখতে ও টের পেত— কেবল দারিদ্র্য বা নিজের কাজ অন্যের বুঝতে না-পারার যন্ত্রণা নয়; নিজের মনোজগতের আলো দিয়ে স্বপ্ন দিয়ে বাইরেটাকে খুঁজতে চাওয়ার বুঝতে চাওয়ারও একটা যন্ত্রণা নিরবধি কুরে খেয়েছে গখকে। ‘নুন, রেস্ট ফ্রম ওয়ার্ক’-এ যে অনেক কমলা রঙের আলো আছে, যে স্বপ্ন খোঁজার চাবিকাঠি গখ খুঁজে পেয়েছিলেন, তা তাঁর অন্তরের। তবু, বাইরেও তার সন্ধান জারি রেখেছিলেন। জারি রেখেছিলেন বলেই গখ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছেন। যে-যন্ত্রণার উপশম আসলে পৃথিবীর কোনো অ্যাসাইলামের হাতে নেই। থাকতে পারে না। তাই অ্যাসাইলামেও নিজেই নিজেকে শুশ্রূষা দিয়েছেন। ছবি এঁকে। আরও আরও ছবি এঁকে।

দিয়ার হঠাৎ হঠাৎই খুব ভয় করে। ওল-ফুল নাম্নী গন্ধের কুয়াশা ওর ইন্দ্রিয়গুলোর কার্যক্ষমতা যেভাবে মুছে দিচ্ছে, ওর চিন্তা-কুঠুরিটাকেও কি পুরোপুরি গায়েব করে দেবে? তখন কি ও কোনো এক অচেনা-অজানা রাস্তায় একটা পাথর-খণ্ডের অবশেষ হয়ে পড়ে থাকবে? কোনো কোনো সন্ধানী লোক ওর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, তবু কেউই জানবে না একদিন এরকমই ওরও হেঁটে চলে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। কে জানে হয়তো নিয়নও ওই পথ দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ হয়ে!

দিয়ার পাথরবৎ শরীরে হঠাৎই যেন এক ভয়ের ঝাপটা লাগল। আর সেই ভয়ের ঝাপটায় দিয়ার মনে-পড়ার পৃষ্ঠাটা খুলে গেল। পাতা উলটে যাওয়ার আগে ওর মনে পড়ল কিছুদিন আগে ইনিয়েবিনিয়ে তোলা ভয়প্রসাদের কিছু কথা। মুখের ভেতর নড়বড়ে হয়ে যাওয়া দাঁত আর থাবার নীচে নখ লুকিয়ে রাখার সময় ভয়প্রসাদকে দেখে মনে হয়— তিনি একটা পাখির পালককেও ভয় পান। মানে পেতে পারেন আর কি! কিন্তু পর্দা তার কোমলতাগুলি হারালে তিনি ধাতব মেশিনের চেয়েও ধাতব। তার কার্যক্ষমতা ধাতব মেশিনের চেয়েও হিংস্র। তার কর্কশতা দ্রুতগামী চিলের চেয়েও কপট! তার ছলনা লুকোনো নখের চেয়েও চাতুর্যকামী। ভয় পাওয়া না ভয়-পাওয়ানো, এই দুটোর কোনটা যে ভয়প্রসাদের আসল সত্তা কেউই তার না-পায় কূল, না-পায় কিনারা। দিয়া ভয়প্রসাদকে প্রায় দেড় যুগ ধরে চেনে। দিয়াও হলফ করে বলতে পারে না, কোনটা আসল ভয়প্রসাদ। দিয়ার ভয়প্রসাদকে মনে পড়ার কারণ— তিনি শিল্প জগতের মসিহা। অবশ্য শুধু মসিহা বলেই নয়। এই গন্ধ-দলন-দশা শুরু হওয়ার শুরুর দিকে ভয়প্রসাদের সঙ্গে একটা এক্সিবিশনের উদ্‌বোধনে দিয়ার মোলাকাত হয়েছিল। সবজান্তা সর্বময় প্রভুর মতো ভয়প্রসাদ দিয়াকে তখন অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ভাষায় কিছু বলেছিলেন। ভয়প্রসাদ অ্যবস্ট্রাক্ট আর্টকে তেমন পাত্তা দেননি, কোনোকালেই। কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ভাষার সুযোগ কাজে লাগান, বিবিধ প্রয়োজনে। দিয়া জানে সেকথা। আরও কেউ কেউ নিশ্চয়ই জানেন সেকথা। কিন্তু ভয়প্রসাদের কাছে কেউ ভরসা করে না, বলতে।

কিন্তু দিয়ার ভরসা না-করে উপায় ছিল না। উপায় ছিল না কেননা, ভয়প্রসাদ দিয়াকে এতদিন তাই বুঝিয়েছেন। বুঝিয়েছেন— সন্দেহ যতই থাকুক, তিনিই ভরসার যোগ্য। এবং এই ভরসা তিনি যুগিয়েছেন কখনো বুকের ধুকপুকানি দেখিয়ে। তাতেও কাজ না-হলে প্রভাব খাটাতে চেয়েছেন। দিয়া ভেবেছে। একসময় অনেক ভেবে ভাবা বন্ধ করে দিয়েছে। এবং ভয়প্রসাদকে ভরসা করেছে। ভরসা করেছে। এবং সন্দেহ করেছে। সরে আসতে চেয়েছে। আবার জালে জড়িয়েছে।

দিয়া অবশ্য মুক্ত হতে চেয়েছিল। বিহঙ্গের মতো। পঞ্চমে ডাকা কোকিলটার মতো। মুক্ত হতে চেয়েছিল ভয়প্রসাদের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ভাষায় বলা কথাকে সম্বল করে। দিয়া তখন মনে মনে দরজাটার ম্যাচিং নাম্বার দিশেহারার মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। গন্ধ-দলন-পর্বের তখন ঊষাকাল। পীড়ন তত প্রচণ্ড নয়। কিন্তু দিয়া তার দিক হারিয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিল। ফলত, সকল তটের কাণ্ডারী ভয়প্রসাদকে সে খুলেই বলেছিল। বলেছিল, কেননা ভয়প্রসাদ তার বন্ধুজন। এটুকু দিয়া বিশ্বাস করেছিল। খারাপ-লাগাগুলো পেরিয়েও বিশ্বাস করেছিল। ভয়প্রসাদের মুখেও উঠতে-বসতে তা ধ্বনিত হতে দেখেছিল। বারংবার। ফলে বিশ্বাস না-করে দিয়ারও উপায় ছিল না।

ধাতব আওয়াজের তীব্র ঢেউ আর তীক্ষ্ণ শাসানিতে আজ যখন দিয়ার মাথা পাথরের মতো ভারী আর ভঙ্গুর— প্রাজ্ঞ ভয়প্রসাদের কথাটাই বাজছে তার কানে—

—দরজাটাই কি আর আছে? যেটা এত করে খুঁজছ, হয়তো দেখবে সেটা আর সেখানে নেই!

দিয়া নিজের মাথাটা অন্ধকার ল্যুপে একেবারে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগে বারংবার কথাটাকে আঁকড়ে ভেসে উঠতে চাইছে। দরজাটার ম্যাচিং নাম্বারটা খুঁজে পেতে চাইছে। ও বুঝতে পারছে যে করেই হোক দরজাটা ওকে খুঁজে পেতেই হবে। ওর একেকটা রাত সকাল হচ্ছে দরজাটা খুঁজে পাওয়ার আশায়। সকাল ক্রমে রাতের দিকে বয়ে যাচ্ছে স্রেফ দরজাটা খুঁজে পাওয়ার আশায়। এবং যতবার আশালতাটি গজিয়ে উঠছে ততবার ভয়প্রসাদের বলা কথাগুলো কানে ইকো হচ্ছে।

সূর্য কোনদিকে উঠে কোনদিকে অস্ত যাচ্ছে ক্রমে এই বোধ যখন লুপ্ত হয়ে আসছে, একদিন সত্যি সত্যি ও দরজাটার নিশানা খুঁজে পেল। কী আশ্চর্য— দরজার সাকিনে একটা পপলার গাছ বসানো! পপলার তো এখানে হয় না— তাহলে একা এই পপলার এল কোথা থেকে— এই ভাবনার কার্য-কারণে পৌঁছবার আগেই ওর পাকস্থলী অব্দি পাক খেতে লাগল। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখল— পপলার গাছটার ডালপালায় থরে থরে ওল-ফুল! গন্ধ-যন্ত্রণায় পাক খেতে খেতে অবশেষে পপলার পেরিয়ে একটা অন্য দরজার হদিশ পেল দিয়া। এরকম দরজায় বেল থাকতে পারে না। ছিলও না। অনেক করাঘাত করার পর ওর মনে পড়ল— ওর হাত করাঘাত করার জায়গায় ঘ্রাণেন্দ্রিয়র কাজ করছে। লাভ নেই, কিছুতেই। এমনকী হাত দিয়ে নাক চাপার ক্রোমোজম-বাহিত অভ্যেসও আজ ওর ঘাতক! অনেক কষ্টে দরজার একটা ফাটল আবিষ্কার করল দিয়া। সেই ফাটলে চোখ রেখে দিয়া নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারল না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঝাঁঝে পপলার-ওল-ফুল গন্ধে ঝাঁকুনি খেতে খেতে দিয়া দেখল— বিশাল ডায়াসের দুইদিকে ভয়প্রসাদ আর ত্যানাপ্রসাদ। তাদের মাঝখানে একটু উঁচুতে জায়ান্ট স্ক্রিন। আর তাদের সামনে থরে বিথরে ফুটে থাকা থুড়ি বসে থাকা তাদের ভক্ত-বাহিনী। নাকি ভয়াকুল-বাহিনী? কেননা সামনে থেকে না-দেখতে পেলেও দিয়া তাদের জড়বৎ বসে থাকায় কিঞ্চিৎ যেন ভয়ের ছাপ লক্ষ করেছিল।

তবু অত বিচার করার জায়গায় দিয়া ছিল না। ওর পাকস্থলীর কেব্‌ল-তারও যে ওর শরীর ছেড়ে মুক্তি চাইছে— দিয়া ভুলে গেছিল সেকথাও। দরজাটার ফাটলে চোখ রেখে ভয়াকুল না কি ভক্তকূল-বাহিনীর সঙ্গে দিয়াও দেখছিল, একটা ডেমো। শত্রুপক্ষকে নিকেশ করার ডেমো। সেই শত্রুপক্ষের একদম সামনে দিয়া। আর কারা ছিল— দিয়া তাদের মুখ দেখতে পায়নি। কেননা মস্তিষ্কের চিনতে পারার কুঠুরি ততক্ষণে অসাড় হতে শুরু করেছে। এবং ডেমো-ভিডিয়োটার পুরোটা দেখতে পারেনি দিয়া। তবে এটুকু দেখেছিল— ওর একমাত্র বেঁচে যাওয়া ইন্দ্রিয় চোখ; সেটাকেও উপড়ে নেওয়া হবে। আর এও বলা হচ্ছিল সেই ডেমোতে— যা ঘটছে তা আসলে কিছুই ঘটছে না। কেননা, ঘটনাগুলো অন্য কাউকে বোঝানো যায় না। কেননা, ওর শরীরে কোথাও একটা ভাইরাস ইনজেক্ট করা হয়েছে। ফলে যা ঘটছে তা জানা-বোঝার-অতীত কোনো ডাইমেনশনে। তবে ইন্দ্রিয়গুলো মুছে যাচ্ছে, যাবে।

দিয়া ডেমোটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা জিনিস লক্ষ করেছিল— ভয়প্রসাদ আর ত্যানাপ্রসাদের শরীরী ভাষার উল্লাস। গদির আরামে তাদের হাসি কী মোলায়েম! এত যুগের শত্রুতা ধুয়ে তাদের মাঝের রোদ্দুর কী নিশ্ছিদ্র!


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখিরনিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এখনও অব্দি প্রকাশিত হয়েছে ছয়টি কবিতার বই; একটি গদ্যসংকলন। কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও চাইনিজ ভাষায়। প্রিয় আসক্তি— বই, সংগীত, জঙ্গল।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন