preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ১০
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ১০

ফসল কাটার মরসুম। আল দিয়ে ভাগ করা জমি বেশির ভাগই শূন্য। শুকনো ধুলোর ঘূর্ণি উঠে যাচ্ছে আকাশে। যা দিক নির্দেশ করছে বাতাসের।
কিন্তু এত সত্ত্বেও এই দৃশ্যপট শুধুমাত্র, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’ নয়। চরাচর জুড়ে জীবনের এক অব্যক্ত মায়া যেমন আছে, সেরকমই আছে দুই মৃত্যুর কারবারি। যাদের চোখ আদৌ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী অবলোকনে ব্যস্ত নয় মোটেই। অনাদিকে কতটা মসৃনভাবে সরিয়ে দেওয়া যায় এই পৃথিবী থেকে সেই চিন্তাতেই মগ্ন তারা।
অনন্ত মহাষুররা খুন করতে চায় অনাদিকে। কেন, সে সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা আমাদের আছে। এই পর্বে অনাদির সাথে সাথেই আলোচিত হবেন ‘আদি’ও। অর্থাৎ আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে কী ঘটেছিল স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুর সাথে, তার‍ একটা রূপরেখাও হাজির করা হবে এই পর্বে।

উনত্রিশ

ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড। দুই চৈতন্য কথা। আদি ও অনাদি।

হাইওয়ের ধারে রকেট মুর্মুর চায়ের দোকান। বসে আছে অরবিন্দ এবং অনন্ত।

“চায়ে... লি জিয়ে …।”

অনন্ত বেঞ্চে বসে পা দোলাচ্ছিল আর অরবিন্দ কানখাড়া করে শুনছিল গাঁয়ের মানুষের কথা। রকেট মুর্মুর কথায় চমক ভাঙে।

রঙ-চটা ফাইবারের প্লেটে তিনটে কাচের গ্লাস। অর্ধেক পূর্ণ। অনন্তরা দুটো গ্লাস তুলে নিলে, রকেট এগিয়ে যায় উল্টোদিকে বসা ভ্যান চালকের দিকে।

অরবিন্দ ফুঁ দিতে দিতে একসময় প্রায় পুরোটাই গলাধঃকরণ করে ফেলে কিন্তু মহাষুর দু’খানা চুমুক মেরেই ক্ষান্ত হয়। চা পর্ব মিটে গেলে আবার রওয়ানা হয় ওরা। আরও খানিক যাবার পর থামে ত্রিচক্র যান। এইখানে ডিভাইডারের মধ্যে ফাঁক রাখা হয়েছে। রাস্তার ওপারে যাওয়ার জন্য। বাঁ দিক থেকে ডানদিকে আসে চালক। একটা মেঠো পথ নেমে গেছে সোজা। ডাইনে বাঁয়ে, মূলত সর্ষের ক্ষেত। মরসুম শেষ হয়ে এলেও অল্প কিছু ক্ষেতে এখনও দেখা যাচ্ছে হলুদ হলুদ ফুল।

অরবিন্দ উড়িয়া ছাড়াও বাংলা এবং হিন্দি বেশ ভালো বলতে পারে। ত্রি-চক্রযান চালকের সাথে হিন্দিতেই কথাবার্তা চালাচ্ছে সে।

কথোপকথনের অনুবাদ নিম্নরূপ,

“আচ্ছা এটাই কি সনাতন গাজীর বটতলা?”

“জি সাব। গাঁয়ের নাম ওইটাই। ওই বটগাছের নামে নাম।”

বলতে বলতে ডানদিকের কোনও একটা জায়গা দেখায় সে। বহুদূরে একটা বটগাছ দেখা যায়। গাছের মাথায় সাদা বকের মেলা। ওইটাই আসলে সনাতন গাজীর বটতলা।

“মসজিদটা যেন কোনদিকে?”

“এই রাস্তা ধরে কিছুটা গেলে তবে পাওয়া যাবে।”

বলতে বলতে হাইওয়ে থেকে নেমে যাওয়া মেঠোপথটাকেই দেখায় ভ্যানচালক।

“ঠিক আছে চলো...”

রাজপথের মত এই রাস্তা মসৃণ নয়। খানা-খন্দ নানা জায়গায়। ভ্যানের মটর বন্ধ করে দিতে হয়। প্যাডেলই ভরসা এখন। এইভাবে মসজিদ পৌঁছতে বেশ কিছু সময় তো লাগবেই। কালো আর ধূসরে মেশা যে আকাশসীমা তা এখন সামান্য কুয়াশাচ্ছন্ন। ডাইনে চাষের মাঠ শেষ হবার পর বৈগাপাড়ার সীমানা। গাছগাছালি ঘেরা ছায়া শ্যামল। সদাশিব মোহান্তির মত ঘুণপোকারা যে লুকিয়ে আছে ওই স্নেহছায়ার ভিতর তা এতদূর থেকে বোঝা যায় না।

ফসল কাটার মরসুম। আল দিয়ে ভাগ করা জমি বেশির ভাগই শূন্য। শুকনো ধুলোর ঘূর্ণি উঠে যাচ্ছে আকাশে। যা দিক নির্দেশ করছে বাতাসের।

কিন্তু এত সত্ত্বেও এই দৃশ্যপট শুধুমাত্র, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’ নয়। চরাচর জুড়ে জীবনের এক অব্যক্ত মায়া যেমন আছে, সেরকমই আছে দুই মৃত্যুর কারবারি। যাদের চোখ আদৌ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী অবলোকনে ব্যস্ত নয়। অনাদিকে কতটা মসৃনভাবে সরিয়ে দেওয়া যায় এই পৃথিবী থেকে সেই চিন্তায় তারা মগ্ন।

প্রতিহারীরা আগেও এই পথ ধরে গিয়েছে মসজিদে। তাও সে ভ্যানচালককে মসজিদের কথা জিজ্ঞাসা করল। কারণ, তারা যে এখানে মাঝে মাঝেই আসে সে কথা ঐ লোকটা যাতে বুঝতে না পারে। কী দরকার অহেতুক কাউকে নিজেদের ‘অবস্থান’ সম্পর্কে জানান দিয়ে। যতটা লুকিয়ে থাকা যায় ততই মঙ্গল।

বালুকাবেলার উপর দিয়া চলিতে চলিতে কখন যে বামপার্শ্বে গুণ্ডিচাবাড়ি ফেলিয়া চলিয়া আসিয়াছেন কহিতে পারেন না রামানন্দ। দ্বিপ্রহরে গম্ভীরা হইতে রওয়ানা হইয়াছিলেন। এক্ষণে সূর্য পশ্চিমাকাশে পাটে বসিয়াছে। অস্তগামী দিবাকর প্রকৃতির সহিত এক অদ্ভুত খেলায় মাতিয়াছে। জল স্থল অন্তরীক্ষ জুড়িয়া চলিতেছে সেই খেলা। জলরাশি লাল আভা শরীরে মাখিয়া,সোহাগে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে স্বর্ণাভ বালুতটে। দক্ষিণা বাতাসে বালুকারাশি পাক খাইয়া উঠিয়া, নাচিতে নাচিতে এইরূপে চলিয়াছে যেন স্বয়ং মহাপ্রভু মহানাম গাহিতে গাহিতে চলিয়াছেন, রামানন্দের সম্মুখে। বালুতটের সন্নিকটে বেশ কয়েকখানি করঙ্কবৃক্ষ চোখে পড়িতেছে। বৃক্ষের সুচারু পত্রশলাকায় সূর্যাস্তের পক্ব কদলীবর্ণ,বড়ই মনোমুগ্ধকর।

কিন্তু প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য যেন দেখিয়াও দেখিতেছেন না রামানন্দ। তাঁহার মন আসন্ন এক অমঙ্গল চিন্তায় ভারাক্রান্ত।

কী সেই অমঙ্গল! প্রকৃতপক্ষে কোথায় চলিয়াছেন তিনি? কাহারা অদৃশ্যে থাকিয়া এই ভয়ংকর ‘অমঙ্গল চিহ্ন’ আঁকিয়া দিতেছেন নীলাচলের জলে স্থলে? মিলিবে কি উত্তর?

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

ত্রিশ

সোনারি। ঝাড়খণ্ড।

স্বপ্ননীল এবং অলকানন্দার আলপ-পর্ব শেষ। এইবার আবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক অলকানন্দার বর্তমান অবস্থানে। বিশ্বামিত্র-হত্যা এবং মহাপ্রভুর অন্তর্ধান, উভয় রহস্যভেদের ক্ষেত্রেই অলকা এবং স্বপ্ননীল, এই দু’জনের বর্তমান স্থানাঙ্কন সুচারু ভাবে হওয়া প্রয়োজন।

সোনারি-জামশেদপুর। হোটেল পদ্মনাভর মিটিং শেষে অলকানন্দা দু-একদিনের জন্য এসেছে নিজের বাড়িতে। বিকেলবেলা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে। চলে এসেছিল দো-মোহনীর দিকে। দো-মোহনী হল সেই জায়গা যেখানে মিশেছে দুটি ধারা। সুবর্ণরেখা আর খড়কাই।

দলমা পাহাড়ের ঠিক উল্টোদিকে বড় একটা পাথরের উপর এখন বসে আছে অলকানন্দা। নদী-পাহাড়-জল-জঙ্গল দেখতে দেখতে যখন বুঁদ হয়ে গিয়েছিল নিজের ভিতর, তখনই মাথায় এসেছিল স্বপ্ননীলের কথা। ফিরে গিয়েছিল পিছনের দিনগুলোতে। মুখ ঘুরিয়ে আবার দো-মোহিনী ঘাটের দিকে তাকায়। মানুষজনের ব্যস্ততা বেড়েই চলেছে ক্রমশ। একটা নৌকা এসে ঘাটে লাগল।

আট দশজন নামতে না নামতে ভর্তি হয়ে যায় খেয়া। এখান থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে সাইকেল, বাইক, ভেড়াছাগল আর মানুষের ভিড়। ভেসে আসে ক্যাকোফনি। যা নিবিড় হয়ে অলকানন্দার ভিতর অলকানন্দাকে গেড়ে বসতে দিচ্ছে না।

যেখানে বসে আছে, সেখান থেকে সোজা নেমে গেলে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা। তারপর বয়ে গেছে জলধারা। স্রোতস্বিনীর ঠিক গা ঘেঁষে যে সবুজ সেখানে কিছু মানুষজন সান্ধ্য ভ্রমণরত। তাদের মধ্যে দু-একজন চিনে বাদাম অথবা লজেন্স বিক্রেতাও চোখে পড়ে।

“দিদি আজ নেহি লেনা হ্যায় ক্যায়া?”

আচমকা একটা বাক্যে চমকে ওঠে নন্দা। পিছনে ফেরে। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে হাসছেন মিটিমিটি। হাতে বুদবুদ ওড়ানোর যন্ত্র। কথাটা বলতে বলতে কাঁধের ঝোলা থেকে বার করেন সাবান জলের কৌটোটা। ঢাকনাটা খুলে ছোট্টো পাইপটা দিয়ে একটু জল টেনে ছেড়ে দেন বাতাসে।

ছোটো বড় নানা আকারের বুদবুদ উড়ে যায় সুবর্ণরেখার দিকে।

বৃদ্ধ মানুষটি বহুদিন ধরে চেনেন অলাকানন্দাকে। ফেননিভ জলের গুলি ওড়ানো খেলাটা যে মেয়েটির খুব পছন্দ, সে কথা তাঁর জানা। এই নদীর ধারে আজ থেকে আসছে না অলকা। আগে বাবার সাথে আসত এখন একা একা আসে।

“হাঁ... লেনা কিউ নেহি …!” বাচ্চাদের মত একগাল হেসে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অলকানন্দা। টাকার ব্যাগ থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দেয়। ভদ্রলোক দশ টাকা ফেরত দিতে গেলে বলে,

“আপ রাখ লিজিয়ে।”

বৃদ্ধ আর একখানা সাবান জল ভর্তি পাত্র ধরিয়ে দেন অলকানন্দার হাতে। তারপর ছোটো একটা প্লাসটিক পাইপ বার করেন ফতুয়ার পকেট থেকে।

বৃদ্ধ একগাল হেসে বিদায় নিলে অলকানন্দা আর দেরি করে না। পাত্র খুলে পাইপ দিয়ে টেনে নেয় জল, ঘুরে দাঁড়ায় পাহাড় আর নদীর দিকে। বুদবুদ তৈরি করে ছেড়ে দেয়। একবার-দুবার-বারবার...।

একের পরের এক স্বচ্ছ স্ফটিকের মত কাচের গুলি ভেসে যায় নদীর উপর দিয়ে দলমার দিকে। খানিক বাদে ‘বাবল’ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে নন্দার। প্রতিটি গোলাকার জলজ বুদবুদের মধ্যে একটাই মুখাবয়ব ভেসে উঠতে থাকে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে, ঐটা স্বপ্ননীলের মুখ। কাছ থেকে ক্রমশ চলে যাচ্ছে দূরে।

উমানাথ সিন্ধিয়া, অনন্ত মহাষুর, অরবিন্দ প্রতিহারী তথা ভারতীয় হিন্দু মহাদলের কাছে স্বপ্ননীল একটা ‘রেফারেন্স’ মাত্র।

আচ্ছা অলকানন্দার সাথেই বা কী সম্পর্ক স্বপ্ননীলের! কিছুদিনের চেনাজানা দুজনের মধ্যে। ব্যাস এইটুকুই। আর সেরকম কিছু তো নয়। তাহলে তার এত উৎকণ্ঠা কেন!

যখন কলেজ হোস্টেলে থাকত নন্দা তখন থেকেই তার যাতায়াত স্বপ্ননীলের বিবেকনগরের বাড়িতে। এখন সে থাকে যাদবপুরের ফ্ল্যাটে। এখনও সময় পেলে যায়। অত বড় বাড়িটায় একা থাকে নীল। তাও অলকা এতটুকুও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি কোনোদিন। কারণ, নীলের মায়াবী চোখে কখনও সন্দেহজনক কিছু দেখেনি। ছেলেটা কলেজের সময় থেকে আজ অব্দি কখনও চেষ্টা করেনি সুযোগ নেবার।

মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক লাগে দু’জনের। উত্তেজনার সেই পারদকে বেশ উপভোগ করে অলকা। এই তো সেদিন, মহাপ্রভু আর বুদ্ধকে নিয়ে তীব্র বাক-বিতণ্ডা হয়ে গেল দু’জনের মধ্যে।

সে যাই হোক, আসল যে কথাটা তা হল, সম্পর্ককে একটা নির্দিষ্ট নাম দেবার মত কোনও জায়গায় কি পৌঁছেছে ওরা? না, এখনও না। তাহলে, বাতাসে তৈরি হওয়া বুদবুদের মধ্যে যে মুখ ফুটে ওঠে, তা ক্রমেই কাছ থেকে চলে যাচ্ছে দূরে, এরকমটা মনে হয় কেন!

একত্রিশ

যাদবপুর। কলকাতা।

কী হয়েছিল সেইদিন মহাপ্রভুর সাথে...

স্বপ্ননীলের কথা যখন উঠেই পড়ল তখন আবার ফেরা যাক সেইখানে, যেখানে স্বপ্ননীলকে নিয়ে গল্প বলার শুরু।

আজ, আউটলেটে যায়নি নীল। পড়াশুনো করছে। কেন না তাকে শান দিয়ে নিতে হবে নিজের অস্ত্রে। মহাপ্রভুর সম্পর্কে শেষ অব্দি জানতে হবে। এ বই সে বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই মনে পড়ছিল, অলকানন্দার সাথে সেদিনকার তুমুল বাক বিতণ্ডার কথা। কী এমন বলেছিল নীল! না, ভারতে গণতান্ত্রিক চেতনার জনক হলেন চৈতন্য। খুব সাধারণ কথা। সে কথার পৃষ্ঠে কী বলল নন্দা!

“এত সহজে যা খুশি তাই বলে দেওয়া যায় নাকি! এই সব বলার আগে বুদ্ধের কথাটা মাথায় রাখতে হবে।”

এই কথাটাও যে খুব খারাপ তা নয়। কিন্তু বলার ভঙ্গিমায় রাগ হয়ে গিয়েছিল নীলের। খানিকটা উষ্মা প্রকাশ পায় ওর গলাতেও, “ও ...ডোন্ট বি সিলি ... মহাপ্রভুর কথা বলছি মানে এটা নয় যে বুদ্ধকে আমি ইগনোর করছি...। সেটা করার কোনও জায়গাই নেই। অ্যাকচুয়ালি দুজনের মধ্যে তুলনা করাটাই নিতান্ত বোকামি।”

“তুলনা কে করছে নীল! তবে ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনার জনক বললে কিনা তাই কথাটা এল। ‘জনক’ কাকে বলা হয় নীল? ‘দি পাইওনিয়ার’ ...।”

নীল চুপ করে থাকে। নন্দার কথা এবং ভাবের গতি প্রকৃতি বুঝতে চায়। এইদিকে খোঁচায় নন্দা, “ আমি কি ঠিক বলছি?”

নীল বলে, “আমার বাক্যটার মধ্যে ‘আধুনিক’ শব্দটা থাকলে বোধ হয় এতখানি সমস্যা হত না। বুদ্ধের সময়কাল কখন? খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় পাঁচশো বছর। মানে আজ থেকে তিন হাজার বছর আগের একটা সময়কাল। যে সময়ের ইতিহাস কুহেলিকাচ্ছন্ন। সময়ের সাপেক্ষে ওঁকে যদি আমরা ‘প্রাচীন’ বলে ধরে নেই, তাহলে মহাপ্রভুকে ‘আধুনিক’ বলতে আর কোনও বাঁধা থাকে না...। এতটা কনফিউশনও তাহলে...”

কথা বলতে বলতে উঠে গিয়েছিল নন্দা। গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জানলায়, যেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল শান বাঁধানো ঝিলটা। এখানে আসলেই কেন যেন নন্দার মনে হয়, সীমানা ঘেঁষা কৃষ্ণচূড়া গাছটা হাওয়ায় ভাসছে।

স্বপ্ননীলের কথা শুনে সহসা ঘুরে দাঁড়ায় জানলা থেকে। বাঁকা হাসি খেলে যায় লিভলস ঠোঁটে। স্ট্রেটেইন চুলে ঝুঁটিটা বোধহয় একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল। সেইটা নতুন করে বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে আসে জানলা ছেড়ে। সুডৌউল দুটো বুকের নিয়মিত ছন্দ। যথারীতি। মুহূর্তের জন্য চোখ আটকায় নীলের। সেই দুটো চেনা ঘোড়া ছুটে যায় ময়দানের সবুজ চিরে।

সোফায় নিজের শরীরটা ছেড়ে দিতে দিতে প্রসঙ্গান্তর ঘটায় নন্দা, “আচ্ছা নীল এই সব কথা ছাড়ো। তুমি এর মধ্যে আমাকে একদিন বলছিলে যে মহাপ্রভুকে গুম করা হয়েছিল। এবং সেটা করে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে। আচ্ছা কারা এই কাজ করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?”

“তুমি তো ইতিহাসের ছাত্রী। আমার বিশ্বাস এই সামান্য কথাটা তুমি আমার থেকে অনেক ভালো জান। জেনেও এখন না জানার ভান করছ। মহাপ্রভু শুধু যে বৈদিক বর্ণাশ্রমকে তছনছ করে দিয়েছিলেন তাই নয়, রাজা পতাপরুদ্র থেকে শুরু করে যবন হরিদাস, সবাইকে বসিয়েছিলেন এক সারিতে। সেই জন্যই...” একটু সময় নিয়ে আবার বলে নীল, “হ্যাঁ সেই জন্যই তাঁকে গুম করা হয়েছিল। এবং ঠেলে দেওয়া হয়েছিল স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে।”

একটুও পছন্দ হয়নি অলকানন্দার এই কথাগুলো। তুবড়ির মত জ্বলে উঠেছিল, “গুম কিম্বা খুন, কোনোকিছুই কিন্তু এখনও প্রমাণিত হয়নি। কেবলমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোনও কনক্লুশনে পৌঁছানো যায় না …।”

“কীসের প্রমাণ নন্দা! কার কাছে প্রমাণ করতে হবে! ঐতিহাসিক অন্নদাশংকর রায় থেকে শুরু করে বিপিন বিহারী মজুমদার, সবাই তো যা বলার বলেছেন। এদের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও একটা বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনও ধন্ধ নেই যে, মহাপ্রভুর অন্তর্ধান স্বাভাবিক নয়। আর সবকিছু কি বিজ্ঞানের মত করে প্রমাণ করা যায়! তাছাড়া...”

“তাছাড়া...?”

“তাছাড়া... সারকামস্টেনসিইয়াল এভিডেন্স আই মিন অবস্থানগত কোনও প্রমাণ যে নেই, সেটা তুমি কি জোর দিয়ে বলতে পার? তার রহস্যজনক অন্তর্ধানের এমন কোনও লজিক্যাল ব্যাখ্যা তুমি কি দিতে পারবে, যা থেকে এটা প্রমাণ হতে পারে, যে তিনি নিজের ইচ্ছায় লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন? যদি পার তবে বুঝব তাঁকে গুম করা হননি। এবং গোবিন্দ বিদ্যাধরের কিম্বা মন্দিরের পাণ্ডাদের, সত্যি সত্যিই কোনও মোটিভ ছিল না মানবচক্ষুর সামনে থেকে তাঁকে সরিয়ে দেবার! তুমি মহাপ্রভুর সময়কার ওড়িশার প্রেক্ষাপটটা যদি একটু বুঝতে পার তাহলে আমার কথা তোমার মেনে নেওয়া উচিত। ”

“কী সেই প্রেক্ষাপট? বল আমি শুনব।”

এরপর সন তারিখ সহ এমন ভাবে বলতে শুরু করে নীল যেন তার ঠোঁটোস্থ সেদিনের সেই পরিপ্রেক্ষিত, “ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই, হিন্দু এবং সম্পদশালী প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার সাথে বাংলার মুসলমান শাসকদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। গুন্টুর এবং নেল্লোর থেকে যে দুটি শিলালিপি পাওয়া গেছে সে দুটি থেকে জানা যায়, ১৫১০ সাল নাগাদ, যখন প্রতাপরুদ্র ব্যস্ত, বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণ দেবরায়ের সাথে যুদ্ধে, তখনই হোসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করলেন। রাজার অনুপস্থিতে তাঁকে সামলানোর দায়িত্ব পড়ল সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধর ভৈ-এর উপর। কিন্তু সুলতানি আক্রমণের মুখে ব্যর্থ হলেন তিনি। পালিয়ে আশ্রয় নিলেন পাহাড় জঙ্গল ঘেরা মহানদীর পাড়ে চূড়ঙ্গগড় দুর্গে।”

অলকানন্দা আদৌ কতটা শুনছে স্বপ্ননীলের কথা বলা মুশকিল। তাঁর অহংকারী গ্রীবায় তখন অপার যৌনতার ছায়া। সোফায় বসার যে ভঙ্গিমা, তাতে যেন দুই মধুভাণ্ড অক্লেশে, স্বপ্ননীলের চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে নীলাভ মদিরা। কিন্তু স্বপ্ননীলের কোনও কিছু খেয়াল করার যো নেই, সে বলার আনন্দে পাগলপারা।

“হোসেন শাহের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন, অর্থাৎ ১৫১০ সাল নাগাদই মহাপ্রভু এলেন নীলাচলে। দক্ষিণ থেকে প্রায় সেই সময়ই বাংলার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতাপরুদ্রও ঝড়ের বেগে হাজির হলেন সেইখানে। এরপর..., প্রতাপরুদ্রের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সুলতানি বাহিনী পিছু হটতে আরম্ভ করল। অবশেষে পরাজিত হয়ে গড়মান্দারণ দুর্গে আশ্রয় নিল সেই বাহিনী। প্রতাপরুদ্র দুর্গ অবরোধ করলেন। কিন্তু বিজয়নগরের যুদ্ধ ছেড়ে রাজার পক্ষে গড়মান্দারণ অবরোধ করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই তিনি গোবিন্দ বিদ্যাধরের উপর দায়িত্ব দিয়ে আবার ফিরে গেলেন দক্ষিণে। এর কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া গেল, গোবিন্দের নজর পড়েছে রাজ সিংহাসনের উপর। শত্রুপক্ষের সেনাপতির সাথে গোপন বোঝাপড়া করে তিনি তুলে নিলেন অবরোধ।”

এতখানি বলে পাঁজরে আবার খানিক নতুন বাতাস ভরে নেয় স্বপ্ননীল। তারপর আবার বলতে শুরু করে, “তুমিই বল নন্দা, বোঝাপড়া না হলে সম্পূর্ণ জেতা যুদ্ধ ত্যাগ করে মান্দারণের অবরোধ গোবিন্দ তুলে নেবেন কেন! আর এটাই হল শুরুয়াত, পরবর্তীকালে তিনি প্রতাপরুদ্রকে পর্যুদস্ত করার জন্য বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের সাথেও হাত মিলিয়েছিলেন।”

দীঘল আঁখিতে মোটা করে কাজল দিয়েছিল অলকানন্দা। কথার নেশায় মেতে স্বপ্ননীলের চোখ এড়িয়ে যায়, গহীন সে দৃষ্টি। উঠে এসে অলকানন্দা একটা হাত রাখে স্বপ্ননীলের পুরুষালি কাঁধে। রিনরিনে বাতাস চেরা একটা কণ্ঠ, কানে নয় যেন শরীরে ঢুকে যায় স্বপ্ননীলের, “আচ্ছা নীইইলবাবু...আমার একটা কথার উত্তর দিন তো আপনি...। গোবিন্দর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে মহামতি চৈতন্যকে হত্যা করার বা গুম করার সম্পর্কটা ঠিক কি? চৈতন্য কী এমন পাকাধানে মই দিয়েছিলেন গোবিন্দ বিদ্যাধরের!”

“যাচ্ছি সেই জায়গাটাতেই তো যাচ্ছি। বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক ঠিক সেই কাজটিই করে বসেছিলেন মহাপ্রভু। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে একটু সামনের দিকে। ১৫১০ থেকে আমাদের যেতে হবে ১৫১৪-য়।”

একটু সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করে নীল, “এই সময় প্রতাপরুদ্র খবর পান যে হোসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেই খবর পাওয়া মাত্রই প্রতাপরুদ্র, গৌড় আক্রমণ করতে চাইলেন। আগে ভাগে আক্রমণ করাই তিনি মনে করলেন আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়।

কিন্তু ততদিনে চৈতন্যের সাথে, শাহর ব্যক্তিগত সচিব দবীর খাস এবং রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা,শাকর মল্লিকের গোপন যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। কাজেই চৈতন্য জানতেন, গৌড়াধিপতি তখন কী পরিমাণে শক্তিশালী। তাকে আগবাড়িয়ে আক্রমণ করলে, প্রতাপরুদ্রের সমূলে ধ্বংস হতে যে বেশি সময় লাগবে না, তা তিনি সহজেই অনুমান করতে পারলেন। চৈতন্যের বাঁধাতেই সে যাত্রায় প্রতাপরুদ্র গৌড় আক্রমণের ইচ্ছা ত্যাগ করলেন। এরপর, চৈতন্য কৌশলে গৌড়াধিপতিকে দুর্বল করার চেষ্টা শুরু করলেন। একদিন রাতে রামকেলি বলে একটি জায়গায়, চৈতন্য দেখা করলেন শাকর মল্লিক এবং দবীর খাসের সাথে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল, হোসেন শাহের এই দুই মন্ত্রী গৌড় ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। এর ফলে যুদ্ধ গেল পিছিয়ে। প্রতাপরুদ্র প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছুটা বাড়তি সময়ও পেয়ে গেলেন। অন্যদিকে, দুই মহামন্ত্রীর অনুপস্থিতে হোসেন শাহ হয়ে পড়লেন দুর্বল। শেষমেশ, বিশ্বস্ত দু’জনকে ছাড়াই হোসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করলেন। বলা বাহুল্য, সেই যুদ্ধে যারপরনাই নাস্তানাবুদ হলেন গৌড়াধিপতি। এরপর, তিনি আর কোনোদিন ওড়িশার দিকে চোখ তুলে তাকাননি।”

অলকানন্দার শরীরে একটা ঘ্রাণ আছে। সেই গন্ধ যেন ক্রমে শুষে নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী যত আলোক তরঙ্গ। অলকার শরীর যেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ফেটে পড়তে চাইছিল তখন, পয়োধি যেভাবে আগুনের পাক শেষে উথলে ওঠার সাহস করে, ঠিক সেইভাবে। আর কণ্ঠস্বরে তখন তার, ঝড়ের রাতে কাচ-বাতি ভাঙার রিনিঝিনি, “উঁহু এখনও কিন্তু আমি আমার উত্তর পেলাম না নীইইল।”

“তার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হবে যে...। হ্যাঁ যা বলছিলাম, হোসেন শাহের যে এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে, তা গোবিন্দ বিদ্যাধরের হিসাবের বাইরে ছিল। মনে করা হয়, তিনিই নাকি প্রতাপরুদ্রকে প্ররোচিত করেছিলেন আগবাড়িয়ে গৌড় আক্রমণের জন্য। কিন্তু মহামতি চৈতন্যের জন্য রাজা সেই ফাঁদে পা দিলেন না। ফলে অতি সহজে মহারাজের ধ্বংসের এবং ওড়িশার সিংহাসন দখলের এক সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল গোবিন্দর। আর শুধু তাই নয়, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে চৈতন্য থাকতে প্রতাপরুদ্রের কোনও ক্ষতি করা যাবে না।”

এতখানি বলে স্বপ্ননীল অলকার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর, খুব ধীরে ধীরে বলে, “এইবার আমি কি বোঝাতে পারলাম ম্যাডাম, কেন গোবিন্দ হয়ে উঠেছিলেন মহাপ্রভুর শত্রু?”

“আর পাণ্ডারা...? তারা কেন চৈতন্যের শত্রু হয়ে উঠল শুনি...?”

“এইটা আরও অনেক সহজে বোধগম্য ম্যাডাম। জগন্নাথের পূজারিরাই ছিলেন ওড়িশার প্রকৃত ‘কিং মেকার’। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রতাপরুদ্রের মত একজন দৃঢ়চেতা মানুষের পক্ষে পূজারিদের সেই চরম আধিপত্য মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাণ্ডাদের সাথে

তিক্ততা শুরু হয়। মহারাজের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে পাণ্ডাদের সাথে চৈতন্যের দূরত্বও ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে... এ তো গেল পরোক্ষ কারণ, এছাড়া প্রত্যক্ষ কারণও ছিল।

“যেরকম?”

“চৈতন্যের স্মার্ত অনুশাসন বিরোধী কাজকর্ম পাণ্ডারা কোনোদিনই মানতে পারেননি। বিশেষ করে বেদান্তের বিরোধিতার মাধ্যমে শঙ্করাচার্যের বিরোধিতা হজম করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। নেহাত রাজার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তাঁরা সচরাচর মুখ খুলতেন না। আর জাতপাতের বিচার …? সে তো মহাপ্রভু একেবারেই মানতেন না। স্মার্ত অনুশাসন শিকেয় তুলে, সব ভেদাভেদ তুচ্ছ করে মহাপ্রভু উড়িয়ে দিয়েছিলেন এক টোটাল ডেমোক্রেসির জয়ধ্বজা। মার্কস... এঙ্গেলস তখন কোথায়... হা হা হা! কেবলমাত্র নাম সংকীর্তণের জোরে ঐ রকম একটা আলটিমেট গণতন্ত্র! না ভাবা যায় না। তার ‘বাড়াবাড়ি’ ক্রমেই চরমে পৌঁছল। বাড়তে বাড়তে সন্ন্যাসী চৈতন্য একদিন যখন শূদ্র রামানন্দকে আষ্টেপৃষ্ঠে আলিঙ্গন করে বসলেন, তখন কিন্তু পাণ্ডারা আর ক্ষোভ গোপন রাখতে পারলেন না। বলে ফেললেন,

“এই ত সন্ন্যাসীর তেজ দেখি ব্রহ্মসম।

তবে শূদ্রে আলিঙ্গিয়া কেন করেন ক্রন্দন।।”

এইদিকে,এই মহা সন্ন্যাসীর প্রতি ওড়িশার পাণ্ডাদের মনোভাবের কথা রাজা প্রতাপরুদ্রেরও অজানা ছিল না। তিনি এর পরিপ্রেক্ষিতে বললেন,

“রাজা কহে শ্রাস্ত প্রমাণ চৈতন্য হয় কৃষ্ণ।

তবে কেন পণ্ডিত সব তাহাতে বিতৃষ্ণ।।”

অলকানন্দার দুই হাত ছিল স্বপ্ননীলের কাঁধের উপর। নীল সোফায় বসে কথা বলছিল। আর পিছনে দাঁড়িয়েছিল নন্দা। আলোচ্য বিষয়ের উত্তেজনায় নীল খেয়ালই করেনি যে, সেই প্রথম এক শরীরকে ছুঁয়েছে অন্য এক শরীর। নীল কথা বলতে বলতে একজায়গায় বসেই দুই মৃণালবাহু আলতো করে ধরে অলকাকে নিজের সামনে নিয়ে আসে। চোখ রাখে গভীর দুই চোখের তাকায়। কিন্তু নীল তখনও ডুবে আছে নীলাচল আর মহাপ্রভুতে। তাই অত গাভীর দৃষ্টিকেও, সে হাতের তালুতে রাখা কর্পূরের মত উড়িয়ে দিয়ে বলে যায়, “জান অলকানন্দা স্বয়ং গান্ধীজীও হেরে গিয়েছিলেন পাণ্ডাদের কাছে।”

“সে কী রকম?”

“জাতপাতের বিষয়ে জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা যে কতটা কঠোর, তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। মহাত্মা গান্ধী নিজে চেষ্টা করেও জগন্নাথ মন্দিরে হরিজনদের প্রবেশাধিকার আদায় করতে পারেননি। শুধু তাই নয়, মহাত্মার মৃত্যুর পর পুরীর সমুদ্রে তাঁর চিতাভষ্ম বিসর্জন দিয়ে হরিজনরা মন্দিরে ঢোকার একটা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। অবশেষে...,ইয়েস অ্যাটলাস্ট ...বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সব জাতের হিন্দুরা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পান। আর এইদিকে মহাপ্রভু কী করেছিলেন...”

“কী করেছিলেন?”

“নিজ মহিমায় ভাস্বর হয়ে সেই কবেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, “...আচন্ডালে দেহ কোল”। সেদিন সেই অতি সঙ্কীর্ণ এক সময়ে এই ‘কোল’ দেওয়ার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সে কথা কি আমাদের বুঝতে বাকি থাকে নন্দা! বল ...তুমিই বল...”

একটু থেমে আবার বলে স্বপ্ননীল, “ এরপর আছেন পঞসখারা। যাঁদের আচরণ বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে তাঁরা ছিলেন মহাপ্রভুর অতীব নিকটের। কিন্তু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে যে তাঁদের সাথে মহাপ্রভুর ছিল এক অপূরণীয় দূরত্ব। আর শুধু তাই নয়, তাঁদের প্রধান জগন্নাথদাস সাঁট বেঁধেছিলেন পাণ্ডাদের সাথে। এই কথাও অনেকে বলেন যে মহাপ্রভুর মহাপ্রস্থানের দিন, তিনি সশরীরে হাজির ছিলেন জগন্নাথ মন্দিরে...। ”

“থাক আর বলার দরকার নেই স্বপ্ননীল। আমি যে একেবারে কিছুই জানি না, তা নয়।”

আর বোধহয় এইসব কথা শুনতে ভালো লাগছিল না অলকানন্দার,

“হ্যাঁ একজন ইতিহাসের ছাত্রীর না জানাটাই অস্বাভাবিক। জান, কিন্তু মান না। আমাকে মাঝে মাঝে তাই বাজিয়ে দেখ! ”

“ও ডোন্ট বি সিলি নীইইল...”

অলকার শেষ বাক্যের প্রতিটা শব্দে খেলা করছিল এক ঝাঁক বুনো মৌমাছি। যারা চুপ করে যাওয়া নীলের রোমকূপ খুঁটে খেতে শুরু করেছিল। নীলের খুব ইচ্ছে করছিল তখন, ঈষৎ ঝুঁকে থাকা দুই স্তনে ঠোঁট রেখে শুষে নিতে শরীর। শরীর শুধু শরীর...


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

nZkkAbWB

2 সপ্তাহ আগে

1


Image Description

nZkkAbWB

2 সপ্তাহ আগে

1


মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন