সম্প্রতি কলকাতার গিরিশ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল নাট্যনন্দিনী উৎসব। থিয়েটারে পুরুষপ্রাধান্যের বিপরীতে এ বছরই শুরু হল এই কার্যক্রম। উদ্যোক্তা সবার পথ গোষ্ঠী জানিয়েছে, প্রতি বছরই কোনো না কোনো মহিলা নাট্যকর্মীকে সামনে রেখে এই কর্মসূচি জারি থাকবে। এ বছরের নাট্যনন্দিনী অনুষ্ঠিত হল সঞ্জিতাকে নিয়ে।
আমরা সাধারণত পুরুষ নাট্য ব্যক্তিত্ব অথবা পুরুষ অভিনেতাদের নিয়ে বিভিন্ন নাট্যোৎসব দেখতেই অভ্যস্ত। বাংলা থিয়েটারও তার ব্যতিক্রম নয়। যার ফলে নারী অভিনেতা, পরিচালক এবং নাট্যকার স্পটলাইটের দূরেই থেকে যান। যদিও বাংলা থিয়েটারে মহিলা অভিনেতা এবং মহিলা নাট্য ব্যক্তিত্বের অবদান অনস্বীকার্য। বিনোদিনী দাসী থেকে শুরু করে মঞ্জুশ্রী, ঊষা গাঙ্গুলি এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মতো আইকনিক মহিলা অভিনেতারা তাঁদের বৈচিত্র্যময় চরিত্রে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন। মহাশ্বেতা দেবী এবং শাঁওলি মিত্রের মতো নাট্যকাররা বাংলা থিয়েটারকে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে তৃপ্তি মিত্র এবং অর্পিতা ঘোষের মতো পরিচালকরা পরীক্ষামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে শৈল্পিক ল্যান্ডস্কেপকে রূপ দিয়েছেন।
পিতৃতান্ত্রিকতার প্রচলিত ধারা ভেঙ্গে নাট্যদল সবার পথ বাংলা থিয়েটারে একটি অগ্রণী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এই প্রথমবার শুরু হল মহিলা নাট্য ব্যক্তিত্ব কেন্দ্রিক নাট্যোৎসব যা বাংলা থিয়েটারে মহিলা অভিনেতাদের উল্লেখযোগ্য অবদান উদযাপনের লক্ষ্যে একটি অনন্য উৎসব - নাট্যনন্দিনী।
নাট্যানন্দিনী, থিয়েটারে মহিলাদের অবদান উদযাপন করার জন্য নিবেদিত, যা শুধুমাত্র ভারতে নয় আন্তর্জাতিকভাবেও একটি যুগান্তকারী প্রচেষ্টা।
নাট্যনন্দিনী ২০২৪ সাল থেকে শুরু হল এবং প্রতি বছর এক একজন মহিলা অভিনেতা বা থিয়েটার প্র্যাকটিশনারকে কেন্দ্র করে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এই অদ্বিতীয় উৎসবের লক্ষ্য হল বাংলা থিয়েটারে মহিলা অভিনেতার অতুলনীয় প্রতিভা, অবদান এবং কৃতিত্ব উদযাপন করা।
প্রথম বছর সবার পথ নাট্যগোষ্ঠী তাদের পুরোধা এবং বর্তমান সময়ের বহুমুখী এবং দক্ষ নাট্য ব্যক্তিত্ব সঞ্জিতাকে কেন্দ্র করে উৎসবটির আয়োজন করেছিল ১৭ থেকে ২১ শে এপ্রিল, গিরিশ মঞ্চে।
সঞ্জিতা এই মুহূর্তে দশটিরও বেশি বাংলা থিয়েটারে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করছেন। তিনি এন এস ডি, ভারত রঙ্গ মহোৎসব এবং থিয়েটার অলিম্পিকের মতো উল্লেখযোগ্য মঞ্চে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অভূতপূর্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। ঊষা গাঙ্গুলি, এবং শ্রী প্রকাশ ভট্টাচার্য-এর নির্দেশনায় সঞ্জিতা ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করেছেন, যা বহুল প্রশংসিত হয়েছে। সম্প্রতি সবার পথ-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নাট্যনন্দিনী। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে মহিলা নাট্য ব্যক্তিত্ব ও মহিলা অভিনেতা কেন্দ্রিক নাট্যোৎসব এই প্রথমবার।
“আমি ধর্ষণের বিরুদ্ধে” – এই উচ্চারণকে বিশ্বাস এবং পাথেয় করে সবার পথ নাট্যগোষ্ঠী ২০১৩ সাল থেকে বার বার সোচ্চার হয়েছে তার পথনাটিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রযোজনায়। নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে নারীমুক্তি এবং নারীর অধিকার নিয়ে। “না” কে না বলতে পারাটাও একটা শেখা। একটা যাপন। বারবার তাদের প্রযোজনায় উঠে এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।
নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে সবার পথ নারী মুক্তি নিয়ে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কথা বলার মাধ্যমে জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সংগ্রাম করে চলেছে। নিয়মিতভাবে সেমিনার, ওয়ার্কশপ আয়োজন করে চলেছে। এই নাট্যগোষ্ঠী পথ নাটিকা দিয়ে পথ চলা শুরু করলেও সবার পথ-এর প্রথম প্রসেনিয়াম থিয়েটার “নকলি না” এবং পরবর্তীতে “ত্রিনয়ন” এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় দলটিকে। এটি সঞ্জিতা নির্দেশিত প্রথম প্রসেনিয়াম নাটকও বটে। সঞ্জিতার একক অভিনয় এবং নির্দেশনার মাধ্যমে ত্রিনয়ন থিয়েটার জগতের একটি মাইলস্টোন। ত্রিনয়ন নাটকটি দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রিত এবং প্রভূত প্রশংসিত হয়।
ত্রিনয়ন পরবর্তী মঞ্চ প্রযোজনা “খত” মূলত সাদত হাসান মান্টো, কৃষাণ চন্দর এবং সুবোধ দাসের গল্পের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দেশভাগের সময় ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের নারীদের সহিংস যন্ত্রণার অকথ্য গল্পগুলি অন্বেষণ করে এই নাটক। সঞ্জিতার নির্দেশনায় “খত” জনমানসে আলোড়ন তুলেছে খুবই অল্প সময়ে। নাটকটিতে সুরকার সঞ্জিতার এক অনন্য নিদর্শন পাই আমরা। এছাড়াও সঞ্জিতার নির্দেশনায় এবং অভিনয়ে সবার পথের সাম্প্রতিকটম প্রযোজনা “জেরি এবং টম” বাংলা থিয়েটারে এক নতুন ধারাকে প্রতিফলিত করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, সঞ্জিতা নির্দেশিত এবং একক অভিনীত অন্তরঙ্গ নাটক “শীতলপাটি”, মহামারী সময়ের বাংলা থিয়েটারের প্রথম নাটক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। গ্লাভস প্যাপেট নিয়ে এই নাটকটি দর্শক, সমালোচক সহ সমস্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত প্রায় একশটি সফল প্রদর্শন হয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশে।
সঞ্জিতার নেতৃত্বে সবার পথ, কলকাতা থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল এবং অন্যান্য রাজ্যেও পথ নাটক প্রদর্শন করেছে। শুধুমাত্র ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাস্তায় বা মঞ্চে প্রসেনিয়াম পারফরম্যান্সের জন্যই নয়, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বা নারী মুক্তির সাথে সম্পর্কিত অন্য যেকোনও বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠার জন্যও যথেষ্ট পরিচিত সবার পথ।
তার অভিনয় দক্ষতার পাশাপাশি সঞ্জিতা নাট্যরূপ করেছেন বিভিন্ন নাটকের তার মধ্যে পূর্বউল্লেখিত “খত”, “জেরি এবং টম” উল্লেখযোগ্য। ত্রিনয়ন, শীতলপাটি ছাড়াও সঞ্জিতার অনুনকরণীয় অভিনয় দক্ষতা আমরা দেখতে পাই মনসামঙ্গল, আরশি, সিরাজউদ্দৌল্লা, বিল্বমঙ্গল কাব্য, আমি ও সে, তিন মোহনা, আবৃত্ত, রক্তকরবী, পরশি বসত করে, হন্তারক, চণ্ডালিকা, না তোর জন্য, জন্মান্তর ইত্যাদি নাটকে। বাংলা থিয়েটার ছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন বিভিন্ন চলচ্চিত্রে। তার মধ্যে এ তুমি কেমন তুমি, চিলড্রেন অফ ওয়ার, রুনানুবন্ধ, ঘাসজমি, দোআঁশ, অঙ্ক কী কঠিন, গোলেম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পেয়েছেন সেরা অভিনেতার পুরষ্কার।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
নাট্যনন্দিনী-র পাঁচদিনব্যাপী এই উৎসবে আয়োজক সবার পথ ছাড়াও আশোকনগর অভিযাত্রী, দ্বিতীয় সত্তা, নান্দীপট অংশগ্রহণ করে। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, অংশুমান ভৌমিক, অরূপ রায়, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, শঙ্কর দেবনাথ, মনসিজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বেরা। উৎসবের উদ্বোধন হয় তিন নবীন নন্দিনীর হাত ধরে – ডানা, ঝিল এবং মেঘা। পাঁচদিন সঞ্জিতা অভিনীত পাঁচটি নাটকের মঞ্চায়ন হয় কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, সুমন সেনগুপ্ত, সঞ্জিতা এবং প্রকাশ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায়। সম্মান জানানো হয় বিশিষ্ট মহিলা চিত্রগ্রাহক কোয়েলা এবং গিরিশ মঞ্চের নাট্যকর্মী শিখাদি-কে। এই উৎসবে সবার পথ দলের নবীন শিল্পীদের হাতে আঁকা উত্তরীয় এবং লকেট দিয়ে বরণ করে অভিবাদন জানিয়েছে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি নাট্যদলের মহিলা নাট্যকর্মীকে। পাঁচদিনের উৎসবে মঞ্চ পরিচালনায় ছিলেন চিত্র পরিচালক সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরিন্দম সাহা।
এই সময়ের এক সামগ্রিক শিল্পী ও নাট্যব্যক্তিত্ব সঞ্জিতা এবং থিয়েটারের প্রতি তার অবদান, নাট্যনন্দিনী উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে সবার পথ বাংলা থিয়েটারে নারীর অগ্রণী ভূমিকা এবং তার উজ্জ্বল প্রভাকেই সম্মানিত করেছে, যা বাংলা থিয়েটারে এক অভূতপূর্ব প্রশংসনীয় পথকে প্রশস্ত করছে।
১৭ থেকে ২১ এপ্রিল, গিরিশ মঞ্চে যে পাঁচটি নাটক অভিনীত হয়েছিল, তার তালিকা নীচে দেওয়া হল।
১। ১৭ই এপ্রিল ২০২৪
নাটক: রক্তকরবী
নাটককার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সম্পাদনা, নির্দেশনা: কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
নন্দিনীর ভূমিকায় সঞ্জিতা
নাট্যদল: অশোকনগর অভিযাত্রী
২। ১৮ই এপ্রিল ২০২৪
নাটক: ত্রিনয়ন
নাটককার: উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়
কাহিনি, নির্দেশনা, একক অভিনয়: সঞ্জিতা
সুভগার ভূমিকায় সঞ্জিতা
নাট্যদল: সবার পথ
৩। ১৯শে এপ্রিল ২০২৪
নাটক: না তোর জন্য
নাটককার, নির্দেশনা: সুমন সেনগুপ্ত
এক বুড়ির ভূমিকায় সঞ্জিতা
নাট্যদল: দ্বিতীয় সত্তা
৪। ২০ শে এপ্রিল ২০২৪
নাটক: খত
নাটককার, সঙ্গীত, নির্দেশনা: সঞ্জিতা
দাদি, বিনতা, আম্মা-র ভূমিকায় সঞ্জিতা
নাট্যদল: সবার পথ
৫। ২১শে এপ্রিল ২০২৪
নাটক: আবৃত্ত
নাটককার: তীর্থঙ্কর চন্দ
নির্দেশনা: প্রকাশ ভট্টাচার্য
রাজলক্ষ্মী-র ভূমিকায় সঞ্জিতা
নাট্যদল: নান্দীপট
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন