preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
খণ্ডিত সত্তার ভেকধারী আখ্যান
রিভিউ

খণ্ডিত সত্তার ভেকধারী আখ্যান

তরুণ লেখক সিন্ধু সোম (১৯৯৫) প্রথম আখ্যানে (‘শ্রীমালবিজয়’, ২০২৩, উপন্যাসের বদলে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘একটি আনখাই গদ্যপাঁচালি’) অস্তিত্ব-দর্শন-বোধ-শূন্যতা দ্বারা মস্তিষ্কের প্রবল রক্তক্ষারণ সঞ্চারে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রথম আখ্যানেই তিনি রীতিমতো স্বতন্ত্রতার দাবি করেন। ভাষার নানামাত্রা, কথনের নানা জারণ, ন্যারেটিভের ক্রমাগত রূপান্তর ও অস্তিত্বের দংশনক্ষত সংরূপকে বিবিধ প্রকরণে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

একুশ শতকের প্রারম্ভিক দুই দশক অতিক্রান্ত সময়ে এসে উপন্যাসের ধারণাটাই বদলে গেছে। সময়ের চাপে, আধুনিকতার ক্রমাগত  ভাঙন ও রূপান্তরে উপন্যাস নামক বৃত্ত নিজেই ভেঙে সদা অভিনব পথ খুঁজতে অগ্রসর হয়েছে। ফর্ম নিয়ে ভাঙচুর, ঐতিহ্য সন্ধান, পুনর্নির্মাণ, ভাষার বিবিধ প্রকরণ, কথনের নানাভঙ্গি, উপস্থাপনের অভিনব ছক দ্বারা বাংলা আখ্যান নিত্য নতুন পরিসরে যাত্রা করেছে। অস্তিত্ব-অবসাদ-নৈরাজ্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-মধ্যবিত্তের আত্মগ্লানি-মেটাফোর, সময়ের অসুখকে উপস্থাপনের বিবিধ আঙ্গিক ও বিশ্লেষণে লেখকের মননলব্ধ অভিজ্ঞানকে বারবার প্রমাণ করছে। তরুণ লেখক সিন্ধু সোম (১৯৯৫) প্রথম আখ্যানে (‘শ্রীমালবিজয়’, ২০২৩, উপন্যাসের বদলে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘একটি আনখাই গদ্যপাঁচালি’) অস্তিত্ব-দর্শন-বোধ-শূন্যতা দ্বারা মস্তিষ্কের প্রবল রক্তক্ষারণ সঞ্চারে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রথম আখ্যানেই তিনি রীতিমতো স্বতন্ত্রতার দাবি করেন। ভাষার নানামাত্রা, কথনের নানা জারণ, ন্যারেটিভের ক্রমাগত রূপান্তর ও অস্তিত্বের দংশনক্ষত সংরূপকে বিবিধ প্রকরণে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

দেবার্ঘ্য গোস্বামী ‘ঊনচারণ’ আখ্যানের শুরুতেই উচ্চারণ করেছিলেন—‘গল্পরা নিজেরাই গল্প করবে নে’। সিন্ধু সোম জানালেন—“তা গল্প বলার শখ এত এতোল বেতোল জাগে কেন কিছু বুঝলেন? এই এক নতুন উপসর্গ হয়েছে। আজকাল যেখানে সেখানে ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে মালটাকে। তার আগে একটা করে গল্প আসে, পরে আরেকটা!” (শ্রীমালবিজয়, কেতাব-e, প্রথম প্রকাশ, ২০২৩, পৃ. ০৩) এই আগে আসা গল্প আর পরে আসা গল্প নিয়ে এই আখ্যান পথ চলেছে। ক্ষণিক অবসরে অবসরে ভাষা বদলে গেছে। বিচ্ছিন্ন নৃমুণ্ডমালা নিয়ে তিনি সম্পূর্ণ নিকেতন গড়তে চেয়েছেন অথবা সেই উদ্দেশ্য নেই। যে সময় ক্রমেই ভাঙছে, যে সময়ের বিশ্বাস বড় পরিবর্তনশীল, জীবনের অভিপ্রায়-কর্মপন্থা নড়বড়ে, চিরন্তর আদর্শ-নীতি-রাজনীতি বলে কিছু নেই সেই সময়ের আখ্যান যেমন স্থিতিশীল হবে না তেমনি সম্পূর্ণ হতে পারে না। সিন্ধু সোম সেই কাজটাই করেছেন। সেই ন্যারেটিভে বিবিধ ছিন্নসূত্র, গল্পের আস্তরণ, দর্শনের অধিগত বিদ্যার প্রয়োগ, অস্তিত্বের চূড়ান্ত মোকাবিলা-শূন্যতা-সত্তা-আমিত্বের জারণ ও ভাষার বিবিধ ডিসকোর্স দ্বারা যে ফর্ম সিন্ধু সোম আবিষ্কার করেন তা একুশ শতকের আখ্যানকে নব্য পথ দেখায়।

গল্প বলা বা গল্প গড়ার দিকে সিন্ধুর মন নেই। নিজেই জানিয়েছেন এটি ‘একটি আনখাই গদ্যপাঁচালি’। গদ্যের প্রতি বিশেষ ঝোঁক। আঞ্চলিক ভাষা তরঙ্গে আবহমান বাংলার চলমান জীবনের খানাতল্লাসি চালানো। এলোমেলো গল্পবীক্ষণে চলিষ্ণু জীবনের ঘনয়ামান সাঁচ এর উদ্দেশ্য। সেখানে মিথ-পুরাণ-লোকায়ত দর্পণ-পির-জোড়াবটতলা-বিশ্বাস-সংস্কার-বামুন-বদ্যি-কায়স্থ এক রেখায় চলে। গাজিপির-জোড়াবটতলা-মধুর স্বপ্ন-প্রতারণা-মোহ-মোহহীনতা-অন্ধকার, মূর্তিহীনতা সমস্ত মিলিয়ে এ আখ্যান প্রকৃতপক্ষে অদৃশ্য, লৌকিক-অলৌকিক বাস্তবকে ধরতে চেয়েছে ভিন্ন সমীকরণে। রাজতান্ত্রিক আধিপত্য, ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য, জনপদের সত্য, আধিপাত্যের ধর্ম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সিন্ধু সোম পৌঁছে যেতে চান জনপদের মিথের গভীর সত্যে। রাজা বিরূপাক্ষ রায়ের দৈবমূর্তি নিখোঁজ হওয়া, গাজীপিরের গণনায় মূর্তি বাড়িতেই আছে। পিরের দয়ায় যে পুরোহিত বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের চোখ খুলছিল তিনিই মুসলিমদের নিষিদ্ধ করে দিলেন। জোড়াবটতলা ক্রমে সীমানা হয়ে উঠল, ক্রমে বুড়াশিবমন্দির নামে পরিচিত হল। মিথের আড়াল দিয়ে জনসংস্কৃতির রূপান্তরকে চিহ্নিত করেছেন সিন্ধু সোম। সম্প্রীতির সংস্কৃতি কোন আড়াল দিয়ে আধিপত্যের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হল। জনসংস্কৃতির আদিম রূপটি কেমন ছিল, ঐতিহ্যের দেশে ধর্মমত কীভাবে পাশাপাশি ছিল। কিন্তু মিথ্যা, ব্রাহ্মণ্যবাদ, প্রতাপ, বিশ্বাসের আড়াল দিয়ে প্রকৃত স্বরূপটি বিকৃত হয়ে যায়। বয়ানে ধরা দেয়—

“আবার এক ট চাপা গুঞ্জন শুনা যায় দোরের বাইরে। মোসলা পাড়ার বাইর টথে ধীরে পালক ঝাইড়ে সুরয, তাথে হাল্কা তাপ মাটি পায়ে লতায় পাতায় বাইড়ে যায় লক লক। বীরেন চট্টো বলেন সপনে ছাইমাখা ভোলা উয়ার হাইথেই পেরায় তুইলে দিছিলেন মুরত। তুরা বলৈদ্যা, পীরক বিশ্বাস করিস, আর ভোলার কথায় তুদের অক্ত জ্বলে না?” (তদেব, পৃ. ২৫)

সিন্ধু সোমের এ আখ্যান জমির তলদেশের কেঁচো, আলগা মাটি, ভৌমজলের সন্ধান দেয়। তিনি গল্প বলেই সেই তলদেশে যে সাংস্কৃতিক বাতাবরণ ছিল তা খুঁচিয়ে খুচিয়ে দেখান। অনামিকা, মিলন, ঝুমুর, মণিদের নিয়ে মাল যুবকের গল্পপাঁচালি আমাদের পাঠাভ্যাসকে শুধু রীতিমতো হোঁচটই খাওয়া না চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আঞ্চলিক ভাষা ও আবহমান গদ্যের আধুনিক প্রয়োগের স্মার্টনেস কত মধুর হতে পারে, কত গভীর হতে পারে, কত রসসিক্ত হতে পারে তা সিন্ধু সোম প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে সেই পাঠ উদ্ধার রীতিমতো জটিল, বন্ধুর।

দেবেশ রায় ‘আঠার শতকের বাংলা গদ্য ও উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য’ (অখণ্ড) গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন আমাদের আদিগদ্য ও উনিশ শতকের সাংবাদিক গদ্যের কত বৈচিত্র ছিল। তেমনি মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে বহু শব্দ হারিয়ে গেছে। নবজাগরণের পাল্লায় যে গদ্যের জন্ম হল তা থেকে মধ্যযুগের সাহিত্যের কাঠামো কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ঔপনিবেশিক বৃত্তে গদ্যের নানা রূপান্তর আধুনিক হয়ে উঠল বটে কিন্তু আমরা আমদের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলাম। রামকুমার মুখোপাধ্যায় সেই খাদ্যাভ্যাস, শব্দবৈচিত্র নানাভাবে ফিরিয়ে এনেছেন। সিন্ধু সোম প্রথম আখ্যানেই সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। প্রাচীন বাংলা শব্দ, আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ, আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে মিশ্রজাত আধুনিক গদ্যের স্বরূপ কেমন হতে পারে তার পরীক্ষা চালিয়েছেন। প্রাচীন গদ্য, আধুনিক গদ্য, আঞ্চলিক ভাষার ক্রিয়াপদযুক্ত বাক্যপ্রয়োগ ও উত্তর আধুনিক গদ্যের যতিচিহ্নহীন ক্রমাগত পথচলা মিলিয়ে সিন্ধু একটি পুনর্নির্মাণ করেছেন। বৃত্তভাঙা গদ্যে জাতিদ্বন্দ্ব, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-মুসলিম, দেবতাদের প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা দখলের নজরানা ও ক্ষমতাহীনের পৃথক ভুবন গড়ে তোলার বয়ানের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে চলে।

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ব্রাহ্মণ সমাজের করুণ দারিদ্র্যের চিত্র আছে। স্বপ্নময় চক্রবর্তী ‘চতুষ্পাঠী’ উপন্যাসে দেখিয়েছিলেন সময়ের চাপ উদ্‌বাস্তু পরিবারের সংস্কৃত শিক্ষা, পুরাতন বিদ্যায়াতন ও ব্রাহ্মণ্যবাদ কীভাবে ধাক্কা খেয়ে হেরে যাচ্ছে। সিন্ধু সোমের এ আখ্যানেও সময়ের চাপে ব্রাহ্মণ্যবাদের পরাজয়ের চিত্র আছে। বিজন ভট্টাচার্য ‘গোত্রান্তর’ নাটকে উচ্চারণ করেছিলেন যুগের ক্ষেত্রে আজ গোত্রান্তর সত্য। শিক্ষাদীক্ষায় অর্থনীতিতে ব্রাহ্মণের থেকে অন্যরা এগিয়ে এসেছে। এখানেও তাই হয়েছে। বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকারীদের তুলনায় বৈদ্যরা এগিয়ে গেল। জাতিদ্বন্দ্বে ব্রাহ্মণ পরিবারে যে কুলুপ লেগেছিল তা উত্তর পুরুষের মাস্টার হওয়ায় কিছুটা লাঘব হয়েছে। কিন্তু সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। আখ্যান রাঢ় অঞ্চল থেকে কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত। কেলিয়ারি থেকে ভাম (পায়েসের গন্ধ) পর্যন্ত দীর্ঘ। ব্রাহ্মণ-বৈদ্য থেকে অস্তিত্ব সংকট, অস্তিত্ব রক্ষার নানা টানাপোড়েন নিয়ে বিদ্যমান। অস্তিত্ব যেন অন্ধকারের ছায়া হয়ে ধরা দিয়েছে। বুড়াশিবতলা থেকে নাগকেশর ফুল, মাঠঘাট-পল্লি থেকে জনপদের সুঘ্রাণ বয়ে বেরিয়েছে। মাল যুবক তুমুলভাবে শিল্পী হতে চায়। অথচ পথ জানে না। নিজের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে। কিন্তু ভাষা তো কৃত্রিম নয়। বেরিয়ে আসে প্রকৃত সত্য। বিচ্ছন্ন সূত্র ধরে সে শিল্পী হতে চায়, প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। সমাজ-ইতিহাসকে অস্তিত্বের খণ্ড অংশ হিসেবে দেখে। মনে মনে ভাবে সেই খণ্ড সত্তার সঙ্গে শিল্পের কোনো যোগ নেই। সে প্রত্যাখ্যানের ভাষ্য রচনা করতে চায়—

“কোথেুকে পেচ্ছাপের গন্ধ আসছে…নাকে লাগছে নাতো! যেন বুকের কাছটা…কিন্তু কিছু করা হয়ে উঠছে না…সময় কী? সমাজকে চুদে দাও, আমার সময় কী? তা আমার কোথায় লেগে থাকে? ছাদটা দুলে দুলে ওঠে…ডানা ও কাপড় ভিজে বড় আরাম হে সন্ন্যাসী…শিল্পের কাছে শিল্পীর দায়বদ্ধতা…আর কারো কাছে নয়…এত বাইনারি…শিল্প আর শিল্পী কি আলাদা অস্তিত্ব? আলাদা বৃত্ত? স্বয়ংসম্পূর্ণ? কিচ্ছু বুঝতে…মাথা জ্যোৎস্নায় ভাসছে…আমি কবন্ধ গোওওও…” (তদেব, পৃ. ৭৩)

কিন্তু কবি কথিত সেই যে বাক্য—‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/ নিবে যায় বারে বারে’। প্রকৃত আধুনিকতা কী তা সে জানে না। বিশ্বায়ন, ভোগবাদে তা জানার অবকাশও থাকে না। আধুনিক শিক্ষা দ্বারা মার্জিত রুচির অধিকারী হলেই তো আধুনিকতা আসে না। তা আসে জাতিসত্তা-ভাষিক উত্তরাধিকার বহনে। উৎকট আধুনিকতা আন্তর্জাতিক ও বিশ্বনাগরিক করে তোলার লহমায় সব তালগোল পাকিয়ে দেয়। ভাষাচ্যুত, সমাজচ্যুত, স্বধর্মচ্যুত, সংস্কৃতিচ্যুত হয়ে এক ভুলভুলাইয়ায় মিশে যায়। সেই ভেকাধরী কালচারকে সিন্ধু সোম কাউন্টার করেন। মান্য ভাষার শরীর থেকে ছালচামড়া ছাড়িয়ে মেদহীন অংশটুকু রেখে দেন। ভাষার কৃত্রিম সৌন্দর্যে তাঁর মোহ নেই। বরং উপভাষার গড়ন দিয়ে তিনি নিখাদ বাংলা ও বাঙালির সন্ধান করে যান। হাজার বছরের ঐতিহ্যের বাঙালি, জাতিদ্বন্দ্বের অন্ধকার, মিথের বিচ্ছিন্নতা ও ভূগোলের বৈচিত্রকে ধরে জীবনের শাশ্বত সত্যে পৌঁছে যান। তেমনি বলার ভাষাটাও নতুন। প্রচলিত কথনভঙ্গি থেকে সিন্ধু সোম অনেক দূরে চলে যান। সেখানে দেবেশ রায়ের ক্রমাগত প্রবাহমানতা, শহীদুল জহিরের কথা বলার ছক, ইলিয়াস-নাবরুণ-সুবিমল মিশ্রের খিস্তি খেউড়পূর্ণ কাউন্টার, সতীনাথ-ওয়ালীউল্লাহের চেতন-অবচেতন স্তর আবার তারাশঙ্কর-সতীনাথ ভাদুড়ীর আঞ্চলিক স্তর-লোকায়ত বিন্যাস নানামাত্রায় সংযুক্ত থাকে। হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির কৃত্রিমতা ভেঙে সিন্ধু এক অদ্ভুত জারণক্রিয়া ঘটিয়ে দেন।

সময়ের স্বর, অস্তিত্ব দংশনের আধিপত্য, আত্মপ্রতিষ্ঠার ছলাকলার মধ্যে বন্ধুত্ব-প্রেম-যৌনতার নানাবিধ ছক গড়ে ওঠে। আধা শহর-আধা গ্রাম, শিক্ষিত হয়ে বেকার, জাতিগত পেশা, কর্মসংস্থানে অনীহা, আদর্শের দ্বন্দ্ব নিয়ে আধুনিক পৃথিবীর গল্প শোনাতে চান। ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, অন্ধকার, আত্মগ্লানি, বিবমিষা নিয়ে আখ্যান অস্তিত্ব দংশনের ষড়রিপুকে যেমন আবিষ্কার করে তেমনি যান্ত্রিক সভ্যতাকেও যেন আক্রমণ করে—

“আদর্শ! ধুয়ে ধুয়ে জল খাবো বাঁড়া! আদর্শ! সঙ্গে দাঁড়াতে গেলে না একটা মিনিমাম যোগ্যতা লাগে! দয়া চুদিয়ে এখন না গাঁয়ে থাকতে পারি, না শহরে! একসময় গুচ্ছের স্বপ্ন আসত মাথার মধ্যে, এখন সেগুলোর লাশ ঘোরাফেরা করে। মর্গের একজনই ডাক্তার, সে আমি। কে কাকে কাটা ছেঁড়া করে বুঝতে পারি না। স্কুলটা আমাকে কম শেষ করেনি। ঝুমুরকে তুই বেচে দিলি। আর এই অঞ্জলি, মাংসপিণ্ড। জীবনটাই চুদিয়ে গেল।” (তদেব, পৃ. ৭৮)

যৌনতা-মৃত্যু-অন্ধকার-অস্তিত্ব নিয়ে আখ্যান জীবনের অক্ষিগোলকে প্রবেশ করতে চেয়েছে। অস্তিত্বের চোরাবালিকে স্বীকার-অস্বীকারের মধ্য দিয়ে জীবনের অবগুণ্ঠনের উন্মোচন যেমন আছে তেমনি আত্মচরিতের সঙ্গে সংলগ্ন চরিত্রের আক্ষেপ-ক্রোধ নিয়ে আধুনিক ভোগবাদী সভ্যতার অসুখকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছে। শিল্প, শিল্পীর আত্মপ্রতারণা, সার্থক শিল্পী হবার জন্য অনুকরণ, নিজস্ব সত্তা বিসর্জন, শিল্পের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন ও বীক্ষণ আখ্যানকে নান্দনিক সত্যে নিয়ে যায়। লেখক চরিত্র ও ঘটনাকে স্থাপন করেছেন অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক পরম্পরায়। চরিত্রের স্কন্ধে অতীতের নাভিশ্বাস, ঐতিহ্যের চোরা শ্বাস, আধিপত্য ঝুলে থাকে। চরিত্র তা অস্বীকার করতে চাইলেও কোনো ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। মাল যুবক যত সভ্য, আধুনিক, শিল্পী, নান্দনিক ও কৃত্রিমভাবে ভদ্রতা বিলাসী হতে চায় তত কদর্য রূপ বেরিয়ে আসে। কৃত্রিম সভ্যতা ও সেই সভ্যতার ধারকবাহক মানুষকে সিন্ধু সোম প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর গড়া মানুষ সামগ্রিক মানুষ। কদর্য, মাটি মেশানো ঘ্রাণ, জীবনের সম্পৃক্ত সত্য নিয়ে সম্পূর্ণ মানুষ। নায়ক মাল যুবক শিল্পী হতে গিয়ে মিথ্যা বলে, আত্মপ্রতারণা করে আবার পিছিয়ে আসে। দ্বন্দ্বে ভোগে। গ্রাম-শহরের ব্যবধান, শূন্যতা রচিত হয়। মানুষের যৌনতা, ক্লেদ, আকাঙ্ক্ষা, কদর্য রুচি, শিল্পবোধ বেরিয়ে আসে। সিন্ধু সোম ক্রমেই সরে সরে যান। বিচ্ছিন্নতার সূত্র ধরে জীবনের আনাচে কানাচের সংবাদ, ক্লেদ, বিবমিষা, অন্ধকার এনে জীবনকে দুমড়ে মুচড়ে দেন। মাল যুবকের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে নানা যৌনতা, চিত্রকল্প, জাতিদ্বন্দ্ব, জনপদের অভ্যন্তরীণ সত্য, আর্ট-আর্টিস্ট দ্বন্দ্ব, জীবনের চাপানউতোর, সত্য-মিথ্যার অবয়ব, ক্লেদ, অন্ধকার মিলিয়ে সামগ্রিক চালচিত্র এতো বন্ধুর যে প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খাওয়ায়। মাঝে মাঝে দার্শনিক প্রত্যয়, জীবন জিজ্ঞাসা, প্রশ্নবানে জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করার অভিপ্রায় ও মধ্যবিত্তের ট্যাবু ভেঙে অন্তর্মুখীন সত্য উন্মোচন এবং শব্দের অভ্রভেদী মাত্রা নির্ণয়ে আখ্যান নশ্বর সত্যের সিংহদরজা খুলে দেয়।

স্বপ্ন-স্বপ্নহীনতা, প্রেম-প্রেমহীনতা, যৌনতা-যৌনহীনতা, শূন্যতা-অন্ধকার-অবয়ব-বস্তুগত সত্য-ভাবগত সত্য, বিবিধ প্রকরণ ও বিরোধাভাস মিলে যন্ত্র যুগের আখ্যান ‘শ্রীমালবিজয়’। নায়কের অভিলাষ, স্বপ্নসেতু, স্মৃতিসৌধ, কামনা, শৃঙ্গার রস নিয়ে আখ্যান গদ্যে ঢেউ তোলে। ভাবসম্পৃক্ত করে অতীতের কাব্যসেতু। সেই পরম্পরায় শ্রেণিতত্ত্ব, জীবনের অন্ধকার, নারীর অবমাননা, পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য ঝুলে থাকে। সিন্ধু সোম কেবলই প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। গদ্যের তীব্রগতিতে জনপদের সত্য, লোকাল কালার, জীবনের বিবমিষাকে ব্যক্ত করে চলেন। লৌকিকের মাঝে অলৌকিক, অলৌকিক থেকে লৌকিক, উদ্ভট, বাস্তবহীনতার পথ ধরে চরম বাস্তবকে প্রতিপন্ন করার ক্ষুরধার বয়ান ও ভাষা আখ্যানে তীব্র ঘূর্ণি সৃষ্টি করে। পরিণামহীন অগ্রসর, অস্থিতিশীল চড়াইউতরাই, ভাঙন-গড়ন নিয়ে আখ্যান সাবলীল হয়ে ওঠে। সিন্ধু সোম নানা মেটাফোর প্রয়োগ করেছেন। পিঁপড়ে, সাপ, জমি, ফসল, পাখির মধ্য দিয়ে শ্রেণিতত্ত্ব, জনপদের বিভেদ, জাতিবিদ্বেষ, সংগ্রামের নথিনামা বড় রহস্যময় আবরণে ঢেকে রাখেন। মাল যুবকের সঙ্গতা-নিঃসঙ্গতা, অস্থিরতা ও ক্রমে বদলে যাওয়া অভিমুখের মধ্য দিয়ে জীবনের চোরাবালি যেমন স্পষ্ট হয় তেমনি সংযুক্ত চরিত্রদের স্কন্ধে ঝুলে থাকে তাত্ত্বিক সত্যের আলো। বহুবিধ মেটাফোর, স্বপ্ন-স্মৃতি-ভ্রান্তি দ্বারা জীবনের শূন্যতা ক্রমেই চক্রাকারে পরিবর্তিত হতে থাকে।

পিঁয়াজের খোসার মতো যে জীবন, যে জীবনে পিঁয়াজ, পিঁপড়ে, বাস্তুসাপ মেটাফোর, যে জীবন আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত ছিন্ন করতে সিদ্ধহস্ত, যে জীবন শিল্পের মহিমা সম্পর্কে অবগত অথচ পরাজিত হয়ে শ্রমিকে পরিণত সেই জীবনের বহুমাত্রিক সত্য সন্ত্রাসের চিত্র এ আখ্যান। মালদের ইতিহাস, ভাষিক রাজনীতি, ব্যক্তির দাম্ভিক সত্তা, আত্মপ্রত্যয়ে চোরাবালি সমস্ত মিলিয়ে সিন্ধু সোম ব্যক্তির উত্থান-পতনের বহমান জীবনের রংতুলি আঁকেন। সে জীবন মিথের, সে জীবন উদ্‌বাস্তু-স্থানীয় মানুষের সংকটের, জাতিগত বিবাদের ও জাতিসত্তার ধারাবাহিক ইতিহাসের। শ্রেণিতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, সাম্প্রদায়িকতাকে নানা মেটাফোরে সঞ্চারিত করে অদৃশ্য জালে মাল যুবকের চাহিদা রূপান্তরের সেতু ধরে জীবনের চোরাবালি আবিষ্কার করেছেন। যার মধ্যে প্রকৃষ্টভাবে লুকিয়ে আছে উপভাষাগত ভূগোলের মিথ ও স্থানিক সত্য। সেই সত্যকে চেতন-অবচেতন-শিল্প জিজ্ঞাসা-শত্রুমিত্র-জীবন গঠনের ভ্রান্তিতে ও ঔপনিবেশিক-উত্তর ঔপনিবেশিক বয়ানে নির্মাণের বহুমাত্রিক বলয় একুশ শতকের আখ্যানে নতুন দরজা খুলে দিয়েছে।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

ড. পুরুষোত্তম সিংহ (১৯৯১)। বাসস্থান রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর। ‘অমর মিত্রের গল্পবিশ্ব: আখ্যানের বহুমাত্রিকতা’ শিরোনামে এম.ফিল. ডিগ্রি অর্জন করেন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। ‘অমর মিত্রের উপন্যাস: বিষয় বৈচিত্র ও শিল্পরূপ’ শিরোনামে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। কর্মসূত্রে রয়েছেন রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ে। গবেষণামূলক গ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা চারটি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ— ‘পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্প: আলেখ্যের অন্দরমহলে’, ‘বাংলা ছোটোগল্পে মুসলিম জনজীবন’, ‘নিত্য মালাকার: কবিতার নিঃসঙ্গ যাত্রা’, ‘উত্তরবঙ্গের কথাসাহিত্য’। ছাত্র সহযোগী গ্রন্থ লিখেছেন দশটি। প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ১৭০ এর অধিক। দৈনিক পত্র ও লিটল ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। সম্পাদনা সূত্রে জড়িয়ে আছেন ‘চয়ন’, ‘চৈতন্য’ পত্রিকার সঙ্গে। পেয়েছেন ঊষার আলো যুব পুরস্কার। উত্তর আধুনিক সাহিত্যস্রোতের নানা বীক্ষণ নিয়ে নিয়মিত গবেষণায় নিযুক্ত আছেন।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন