প্রকাশিত হল নিত্যানন্দ অধিকারীর গুচ্ছ কবিতা— ‘শূন্য হাতের রেখা’।
১
একটা সামান্য দুর্ঘটনায় চির খেয়ে গিয়েছিল তোমার কলারবোন
এম্বুলেন্সকেও আমি বিলাসিতা ভেবে বায়না ধরেছি জানলার ধার
অস্ফুটভাবে আমাকে প্রলোভন দিয়ে তুমি চলে গিয়েছিলে
দিন-কয়েকের বিশ্রামে
তোমার ওভারকোটে হাজার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছিল
ঘাম আর লৌহ মিশ্রিত একটা ঝাঁঝালো গন্ধ,
তার আবার কোনো পকেটও ছিল না,
তোমার চুম্বনের উপর আস্থা রেখেই আমি ঘুরেফিরে তোমার খোঁজ করতাম
তোমার উপস্থিতির চেয়ে ক্ষণিকের খুশি মাথাচারা দিয়ে উঠেছিল
নির্বুদ্ধিতায়।
নিজেকে সারিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেই আমি না বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ছি বুকে
আর কে যেন আমাকে ছিনিয়ে নিল; এরকম একটা দৃশ্যে
তুমি অত্যন্ত আদরের সঙ্গে কাছে ডেকে
হাতে তুলে দিয়েছিলে একটা ঘোলাটে এক্স-রে প্লেট, আর
বলেছিলে— এটা দিয়ে আকাশ দেখবি
যখন সূর্যকে গিলে খাবে রাহু।
২
প্রতি সোমাবার আমরা দখল করে নিতাম
মিউনিসিপ্যালিটির কলের চাতাল
সেইদিন ছিল আমাদের পূণ্যস্নান এবং আরও একটা মজার বিষয় ছিল
চাতালের মুখে কাদামাটি দিয়ে জল জমা করে
একটা আস্ত সুইমিং পুল বানিয়ে ফেলবার প্রক্রিয়া।
সেই থেকে যেখানে তোমার পায়ের পাতা ঠিকঠাক ডোবে না
সেখানেই আমার ডুবে মরবার ভয়
তা ছাড়া আমোদে ভরপুর সেই চোখদুটো আমি আজকেও বহন করে চলেছি,
স্বাস্থ্যের সম্ভাবনায় তুমুল লাইফবয় যত বেশি গায়ে ঘষে নিতে
কী ভীষণ ফেনায় ঢেকে যেত তোমার শরীর
আমি তাতে জেব্রা এঁকে দিতাম,
স্নান সেরে বাড়ি ফিরে আসবার পরও তোমার ভিতরে বেঁচে থাকত
সেই জেব্রা-সত্তা
যার ফলে তুমি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে মাসাইমারার বিশাল প্রান্তরে
যেখানে সামান্য ঘাসের ঝোপেও ঘাত মেরে বসে আছে রাজ-পরিবার
দাঁতালের ধুসর উদর
তোমার নির্দেশিত ক্ষেত্রফলের বাইরে
আমাদের যাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না
সেখানে যতটুকু ঘাস আর লতাপাতা তা থেকে আমরা
আজও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছি।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
৩
দীর্ঘ আটত্রিশ বছর সাধনার পর এই তুমি প্রসন্ন হলে
সম্মুখে প্রকট হয়ে বললে— ‘তথাস্তু’
এই পুনর্জন্মের মানে বেঁচে থাকবার জন্য যেটুকু সময়ের প্রয়োজন ওটুকুই
এখন দারিদ্রসীমার অনেক নীচে নেমে আমি যাপনে প্রস্তুত
এবং আমার কোনো পরমেশ্বর নেই
যার সামনে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তির প্রয়োজন আছে
তবুও আমি ইলিশের গন্ধ এড়িয়ে অন্য গলিপথ ধরে ঘরে ফিরি
আতা বা সবেদা কিনতে ভয় পাই
ওই ফলে কোনো প্রসাদ হবে না বলে
অথচ এও জানি, কিছু তো কুলিয়ে যায় আর পাঁচ-জনের মতন
রেশনের থলি আমি দখল করিনি এবং স্বল্পবেতনভূক কর্মচারীদের মতো
কিছু মাসোহারা থেকে আয়ুষ্মান হয়ে ওঠবার সংকীর্ণতায়
আমি কোনোদিনই পিতলের রেকাবি সাজাতে পারিনি পরিপাটি করে
এবং গঙ্গাস্নানের পর পথেই গু-মাড়িয়ে অশুচি রয়েছি সেই থেকে
এই পুনর্জন্মের কাছে একটা শীর্ণ নর্দমা চাই যার সর্পিল অন্ধকারে
কোনোরকমের আলো প্রবেশ না করে।
তবু আমি সেখান থেকেই ফুল-বেলপাতা ছুড়ে দেব দেবতার পায়ে
এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো বাঁচার প্রক্রিয়া আমি অবলম্বন করব না।
৪
কোনো এক প্রত্নতাত্ত্বিক এসে তোমাকে খনন করে খুঁজে দেখবে
সেরকম পোড়ো হয়ে ছিলে
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর
তোমার ভিতরে পাওয়া গেল এক গুপ্তধনের সন্ধান
কিছু নামজাদা প্রসপেক্টর আন্দাজ করছে একটা পাথরের খনির
আমি নিশ্চিত করে শুধু এটুকুই বলেছি; তবে চুনি হতে পারে
কারণ তোমাকে ছুঁলেই হাতে লেগে যাচ্ছিল বেদানার চ্যাটচ্যাটে রস
সকলের চাউনিতে তখন একটাই রা— ‘শালা এবারে তোর কপাল খুলে গেল বলে’
অথচ পাথুরে জমিতে দীর্ঘদিন বসবাস করে আমি ক্লান্ত।
আমি উদ্বেগমিশ্রিত অস্থিরতায় এ-ঘর ও-ঘর করছি আর
সকলকে বলছি আরেকটু তাড়াতাড়ি
পাঁজাকোলে সাবধানে তোমাকে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছি এই ভয়ে
কোনোরকমভাবেই যাতে আমার ভাগ্য আঘাতপ্রাপ্ত না হয়
একটা অনন্ত নলের মুখে ক্যামেরা লাগিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে
ওখানকার বর্তমান পরিস্থিতি
আমি দম বন্ধ করে সেইসব বিশেষজ্ঞদের ভরসায় আছি যারা প্রয়োজনে
পৃথিবীর নাভি পর্যন্ত খনন করতেও সক্ষম
দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি
সমস্ত ঐশ্বর্য থেকে মুক্তির অপেক্ষায়।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখিরনিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
SamirBarui
1 দিন আগেঅসাধারণভাবে ব্যাক্ত করেছেন মুক্তির অপেক্ষার।