উঁচু করে বাঁধা চুল, স্লিভলেস গাউন পরিহিত একটা শরীর এবার এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রতিম জড়ানো গলায় বলে, ‘ম্যা... ম্যাডাম...’ তারপর ডুবে যেতে থাকে, ক্রমশ ডুবতে থাকে কী এক ভীষণ নরম গহ্বরে... শুধুই সুগন্ধ ভেসে আসে। প্রতিম কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি হেঁটে চলেছে একটা টানেল বরাবর।
‘চা না কফি, কী খাবে?’ ‘কিছু না, কী কারণে ডেকেছেন, সেটা জানালে উপকৃত হতাম। আসলে একটা কনকল আছে একটু পরেই। হাতে খুব বেশি সময় নেই’।
কথাটা শুনেই মার্কামারা সিনেমার খলনায়কের মতো হেসে ওঠে মিস্টার গুপ্ত। হাসিটা কানে লাগে প্রতিমের। বিরক্তিটা বাড়ছে, এবার খুব দ্রুত উঠে চলে যাবে, তার আগে সেক্রেটারি ফস করে বলে বসে, ‘হাসালে প্রতিম, কৃষ্ণকলির কৃষ্ণগহ্বরে ক্রমাগত আসা-যাওয়া অথচ বলছ হাতে সময় নেই’!
যতদূর দেখা যায়, কেউ নেই। ধু ধু রাস্তার মাঝমধ্যিখানে দাঁড়িয়ে প্রতিমের হঠাৎ যেন ভয় করে খুব। মাথার ওপর রোদ। এত তীব্র রোদে বেরনো অভ্যেস নেই তার। অথচ হাজারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ক্যাব কিছুতেই গন্তব্য অব্দি গেল না। অবশ্য যে কারণ দর্শালো, তার পর আর তর্ক করে লাভ নেই। যেখানে লাগেজ সমেত তাকে নেমে যেতে হলো, সেখানেই নাকি ক্যাব সার্ভিসের সীমানা শেষ। এর পর অতিরিক্ত টাকা দিলেও চালক যেতে নারাজ। নিয়মলঙ্ঘনের জন্য আর বেশি চাপ দেয়নি প্রতিম। বরং ইদানীংকালে এমন ভয়ঙ্কর নিয়মনিষ্ঠা দেখে বেশ মজাই লেগেছে। তবে রাস্তায় পা দিতেই মধ্যে যে ফুরফুরে ভাবটুকু ছিল মনে, তা যেন টুক করে বাষ্প হয়ে গেলো।
এখনও অন্তত ৫-৭ মিনিট হাঁটা পথ তো বটেই। কমপ্লেক্সের গেট পেরিয়ে টাওয়ারগুলোর মাথা চোখে পড়ছে। অগত্যা রুকস্যাক কাঁধে, ট্রলি সুটকেসটা টানতে টানতে হাঁটে প্রতিম, হাঁটতেই থাকে। শুনশান রাস্তায় শুধু একঘেয়ে ঘষটে ঘষটে চলা ট্রলির চাকার শব্দ। দু-পাশে দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলা ন্যাড়া জমি। আর অদ্ভুত নৈঃশব্দ। সত্যিই কি কোনো শব্দ নেই? কিচ্ছু না, এতটুকু না? পরখ করতে ইচ্ছে হয়। এক মুহূর্ত দাঁড়ায় প্রতিম। ট্রলির ঘড় ঘড় শব্দটা থামে আর তার পর শব্দহীন অনন্ত শূন্যতা।
কিছুটা গা ছমছম করে। একবার পিছনে তাকায়— হাই রোড মিশে গেছে দিগন্তে। ওপাশে অনেক মাইলস্টোন পেরলে তবে চেনা মুখ, চেনা অভিঘাতের কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে। ট্রলিটা টানতে টানতে এগিয়ে যায় প্রতিম— মাথার উপরে দৃশ্যমান আকাশ ক্রমশ কমে আসতে থাকে। শ্রাবস্তীপুরে এই প্রথম এলো প্রতিম। একটু নিরালা চেয়েছিলো সে, কিঞ্চিৎ থমকে-থাকা অনুভূতির মতো একাকী সময়। ইন্টারন্যাশনাল হাইওয়ের একধারে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জেগে ওঠা এই শ্রাবস্তীপুর উপনগরীটি নির্জন, বিত্তশালীদের অত্যাধুনিক আস্তানা। প্রায় ফুট দশেক উঁচু মসৃণ বালিপাথরের একটা প্রকাণ্ড পাঁচিল এসে মিশেছে মূল দরোওয়াজায়— বালিপাথরের গায়ে ত্রিমাত্রিক আয়না-অক্ষরে লেখা শ্রাবস্তীপুর আর্বান ভিলেজ। মধ্যদিনের রোদে লেখাটার দিকে তাকালেই চোখ ধাঁধায়। প্রতিমের মাথা ঘোরে। হঠাৎ কেমন ভরশূন্য লাগে। চোরাবালি গ্রাস করার মতো যেন সে ক্রমশ নেমে যাচ্ছে কোথাও। কোনোমতে ট্রলিব্যাগটা টেনে হেঁটে যায় সিকিউরিটি কেবিনের দিকে।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
পাশের ফ্ল্যাটের অনমিত্র প্রায় সমবয়সী। তিরিশ পেরনোর আগেই অর্থ ও যশ দুই হস্তগত। প্রতিভাবান তরুণ উদ্যোগপতি। এই ফ্লোরে সে আর অনমিত্র ছাড়া আর একটি ফ্ল্যাট আপাতত নির্জন। ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা অরবিন্দ সমাজপতির কথা আগেই শুনেছে প্রতিম। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সরোদবাদক। এখন ছুটি কাটাতে গিয়েছেন কোনো পাহাড়ে। অনমিত্র বেশ বন্ধু মানুষ। বহু বছর বিদেশে কাটানোর প্রভাব সম্ভবত। প্রথম দিনই সন্ধ্যাবেলা ডিনার ও দামি ওয়াইন হাতে নিজে থেকেই এসে উপস্থিত।
‘ভাবলাম আলাপচারিতাটা সেরে ফেলা যাক। আর প্রথম দিন, রান্নাবান্নার ব্যবস্থাপনা কতদূর তো জানা নেই, তাই…’ হাত বাড়িয়ে দেয় অনমিত্র।
করমর্দনের সময় মানুষটার ব্যক্তিত্বের খানিক আভাস মেলে— দীর্ঘ ১০ বছরের কর্পোরেট অভিজ্ঞতা প্রতিমকে শিখিয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে কীভাবে করমর্দনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া যায় রাগ, বিরক্তি, অ্যাক্সেপ্টেন্স। প্রতিম নিজেই দৃঢ় করমর্দনে বিশ্বাসী। মানুষটা সে আদতে খুবই আবেগপ্রবণ। অনমিত্রের করমর্দনে একটা নিবিড় সখ্য অনুভব করে প্রতিম। সেদিন সন্ধ্যায় ডিনার খেতে খেতেই প্রথম প্রসঙ্গটা উঠল।
‘ভারি ভালো লাগল’, বলে প্রতিম।
‘কী?’
‘এই যে আপনি নিজে থেকেই চলে এলেন। এই মরুভূমির বুকে প্রথম দিনেই প্রতিবেশীর হাতের এমন অপূর্ব সুখাদ্য কল্পনারও অতীত’।
অনমিত্র বেশ মন খুলে হেসে ওঠে। ওয়াইনের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে বলে—
‘এমনিতে আমাদের এই কমপ্লেক্সের বাসিন্দারা খুবই অতিথিবৎসল এবং পরোপকারী। এই যে এমন একটি ধারণা রয়েছে যে বিত্তশালীদের অত্যাধুনিক গ্রাম মানেই কেউ কারো দিকে ফিরে দেখে না, এমনটা একেবারেই নয় কিন্তু’।
‘বেশ তো...’
‘আমি যতদূর জানি, ৭ টি টাওয়ার মিলিয়ে মোটামুটি ৩৫০-টি পরিবার থাকে, মানে শুধু অকুপায়েড ফ্ল্যাটগুলোর কথাই বলছি। এর মধ্যে অন্তত ১৫০-২০০ জনকে দেখবেন কিছুদিনের মধ্যেই আপনাকে নামে মনে রাখতে শুরু করবে’।
‘বলেন কী’!
‘হ্যাঁ, তার একটা কারণ আছে। অ্যাসোসিয়েশন খুবই উদ্যোগ নিয়ে এই কমিউনিটি-আবেগটা জিইয়ে রাখে। অগুনতি গ্রুপ আর ক্লাব আছে মশাই এখানে। প্রথম প্রথম আমারও একটু অসুবিধে হতো। ফি সপ্তাহে বিচিত্র সব অ্যাক্টিভিটি। তবে এখন ভালো লাগে। একা লাগে না আর’।
‘আপনি একা? মানে ব্যক্তিগত প্রশ্ন যদিও’।
অনমিত্র হেসে বলে, ‘ভাগ্যিস একা। দোকা হলেই বরং সত্যিই ব্যক্তিগত প্রশ্ন হতো মশাই। একটা সাবটেক্সট জুড়ে থাকে সব সময়। এই দোকাটি কে? কোথায় থাকে, পরিচিত না অপরিচিত বা আপনি কি চিনলে কি ভালো হতো… এন্ডলেস, টায়ারলেস কোয়েশ্চেনস’।
প্রতিম মুচকি হাসে, কিছু বলে না।
অনমিত্রের খাওয়া শেষ। সে ওয়াইনের গ্লাস হাতে উঠে পড়ে। গ্লাসটা মৃদু নাচাতে নাচাতে ডাইনিং হলটা ঘুরে ঘুরে কথা বলে।
‘হ্যাঁ… যে কথাটা বলছিলাম। আমি একা কিন্তু লোনলি না। আর এই কমপ্লেক্সে থাকার এটাই মজা। এখানে কেউ আপনাকে একা একা গুমরে মরতে দেবে না মশাই।
কথাটা বলতে বলতেই আচমকা দু-বাহু তুলে, চোখ বুজে দুলে দুলে বলতে থাকে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা সবার তরে’।
খুব জোরে হেসে উঠতে গিয়েও থমকে যায় প্রতিম। প্রথম চটকায় মনে হয়েছিল সারকাজম। কিন্তু অনমিত্র যেন একটা ঘোরের মতো আউড়ে যায় কথাটা বেশ কয়েকবার, উদ্বাহু ভঙ্গিমায়। প্রতিম চুপ করে বসে থাকে।
অনমিত্র চোখ খুলে খুব শান্ত অথচ ধাতব গলায় বলে, ‘শুধু একজন ছাড়া’।
প্রতিমের ভুরুতে ভাঁজ, ‘কে সে?’
‘আপনার খাওয়া শেষ? তবে আসুন দেখাই’।
বারান্দার দিকে হেঁটে যায় অনমিত্র। স্লাইডারটা সরিয়ে দিতেই নাতিশীতোষ্ণ সান্ধ্য হাওয়া হু হু করে ঢুকে পড়ে ডাইনিংয়ে। সন্ধ্যায় কমপ্লেক্সটা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় প্রতিমের। ২১ তলা টাওয়ারগুলো আগু-পিছু করে মোটামুটি একটা হাফ সার্কেলে দাঁড়িয়ে এমনভাবেই যে প্রত্যেকটি টাওয়ার থেকেই বাকি ৬টি টাওয়ার চোখে পড়বে। কমপ্লেক্সের ঠিক মাঝামাঝি একটা বিরাট লন, একপাশে চিলড্রেন্স পার্ক। একটি বড় গ্যাজিবো, আর লনের একদিকের প্রান্ত বরাবর সারি সারি কুঞ্জবিতান। একটা সর্পিল পথ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।
অনমিত্র বলতে থাকে, ‘আমরা ব্লক এফ-এ। ওইপাশ থেকে দেখুন এ, বি, সি। প্রত্যেকটা টাওয়ারের মাথায় একটা করে পেন্টহাউস আর চারটি করে দুপ্লে’।
‘হুম জানি, ব্রশিওর-এ দেখেছি’।
এবার ব্লক সি-এর পেন্টহাউসের দিকে দেখুন।
প্রতিম দেখে নিকষ কালো জমাট বাঁধা অন্ধকার, আলাদা করে কিছুই বোঝা যায় না।
‘একটা কথা একেবারে বেদবাক্যের মতো করে মনে গেঁথে নিন। ব্লক সি–এর পেন্টহাউসে ভুলেও কখনো যাবেন না। না মানে না’।
প্রতিমের বেশ মজা লাগে।
‘কেন হানাবাড়ি নাকি!’
অনমিত্র হঠাৎ যেন একটু কড়া গলায় বলে, ‘মশকরা নয় প্রতিম, ওখানে যাবেন না। ওখানে যিনি থাকেন তাঁর সাথে বন্ধুত্বও করবেন না। এ-কমপ্লেক্সে নতুন কেউ এলে তাকে সাবধান করে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব, আমরা মানে যারা এখানে অনেকদিন ধরে আছি। যাবেন না, দ্যাটস ইট’। দ্রুত ভিতরে চলে যায় অনমিত্র।
প্রতিম তাকিয়ে থাকে সেই নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে। সে রাতে অনমিত্র আর বেশিক্ষণ থাকেনি। দু-একটা সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পরেই সে বিদায় নেয়। প্রতিমও আর জোর করেনি। আবার একপ্রস্থ ধন্যবাদ পর্ব সেরে, বেডরুমে গিয়ে ঘুমনোর তোড়জোড় করতে করতে সে খেয়াল করে— এই ঘরের জানলা থেকেও ব্লক সি-টা চোখে পড়ে।
পরের দিন ঘুম ভাঙে ভোর ভোর, কলিং বেলের শব্দে। ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুলেই দেখে অনমিত্র দাঁড়িয়ে। মুখে একগাল অমায়িক হাসি, পরনে জগিংয়ের পোশাক। প্রতিম ঠিক এই সারপ্রাইজের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু বাধ্য হয়ে যেতে হলো জগার্স গ্রুপের সাথে আলাপ পরিচয় সারতে। আর সেখানেই নামটা প্রথম শোনে— কৃষ্ণকলি। ব্লক-সি পেন্টহাউসের বাসিন্দা।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন