“এই মুহূর্তের বড়ো খবর রাজস্থানের জয়পুরে নেমেছে ইজরাইলের ফাইটার জেট… রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় চলছে বেআইনিভাবে বসবাসকারী পাকিস্তানি নাগরিক খুঁজে বের করার কাজ… ভারতের আকাশ সীমা বন্ধ করে দেওয়া হল পাকিস্তানি বিমানের জন্য… এই মুহূর্তের বড়ো খবর…” রূপ সারারাত ধরে একই খবর দেখতে থাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। দেখতে থাকে কোন দেশের কতগুলো বোমারু বিমান আছে, যুদ্ধের ট্যাঙ্ক আছে, আছে কত পদাতিক বাহিনি… আছে কত গোলা, বারুদ, মিসাইল… যুদ্ধ লাগলে টিকবে কে বেশিদিন…
রূপ কামিজের সুক্ষ ডিজাইনের কাজটা শেষ করে সেলাই মেশিনটাকে থামিয়ে দু-হাত দিয়ে কামিজটাকে মাথার উপরে তুলে ভাল করে খুঁতখুঁতে চোখে কাটিঙের কাজটা দেখতে থাকে! তার ভুরুর গভীর খাঁজ দেখে বোঝা যায় সে খুব একটা খুশি হয়নি এই কাজটার ফিনিশিং দেখে। তারপর সে মাটিতে ফেলা সালওয়ারের সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকে ডিজাইন মিলল কি না, চোখে তখনও তার গভীর ভ্রূকুটি।
—আরে তু ইতনা ক্যায়া দেখ রাহা হ্যায় রূপ? ঠিক তো লাগ রাহা হ্যায়!
রূপ পিছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখে তাদের চিকন ফ্যাক্টারির মালিক মনীশজি কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মাথা ঘুরিয়ে আবার সালওয়ার কামিজের দিকে তাকিয়ে বলল, “উঁহু, কোমরের কাছটা আরও গোল হত।”
—আরে ঠিক হ্যায়, মুঝে সমঝ নেহি আয়া মাতলব কিসিকো সামাঝ নেহি আয়েগা।
—লেকিন মুঝে তো আ রাহা হ্যায় না!
মনীশজি রূপের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বলে, “তু মেরা স্টার কারিগর হ্যায়, একদিন বহত বড়া ডিজাইনার বানেগা তু।” তারপর গম্ভীর মুখে বলে, “লেকিন তু আজ ঘর যা, আজ হাওয়া আচ্ছা নেহি হ্যায়, কাভিবি জঙ্গ ছিড় সাকতা হ্যায়।”
“কেন কী হয়েছে?”, রূপ অবাক হয়ে জানতে চায়। “তু নিউজ নেহি দেখা ক্যায়া? কাশ্মীরমে টেরারিস্ট লোগ হিন্দুওকো ঢুন্ড ঢুন্ডকে মারা হ্যায়।”
ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফেরার সময় রূপের বেশ ভয় করতে থাকে। দিনের আলো নিবে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে, রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান, ভ্যানেও সে ছাড়া আর মাত্র একজনই প্যাসেঞ্জার রয়েছে। অন্যদিন এইসময় ফাঁকা ভ্যান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু আজকের ছবি একদম আলাদা। শুধু মন্দির আর মসজিদের সামনে একটু জটলা চোখে পড়ল তার, বাদবাকি রাস্তা প্রায় ফাঁকা। নস্করপুরের হাটের সামনে পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা। অন্যদিন সন্ধের হাট গমগম করে কাঁচা বাজারের খরিদ্দারিতে, আজ শুধু কয়েকটা গরু আর শুয়োর চরছে ফাঁকা বাজারে, মানুষ নেই।
বাড়ি ফিরে বিভিন্ন খবরের চ্যানেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে রূপ। বউ বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়লে মোবাইল ফোনে আবার খবর দেখে সে, প্রায় সারারাত। সকালে বউ ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করল, “কী হইল গো, এখনও ঘুমাইছ যে? কাজে যাইবা না?” রূপ উত্তর দেয় না। দেশের অবস্থা ভালো না, আজ আর কাজে যাবে না। সেদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠে সারাদিন খবরের চ্যানেল চালিয়ে বসে রইল সে। সারা দেশে নাকি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, ভারত পাকিস্তানের নাকি যুদ্ধ হবে। সন্ধেবেলায় পাড়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে সে, সেখানে তখন তুমুল ঝগড়া চলছে দুই দলের। এক দল বলছে ভারতের নাকি এক্ষুনি পাকিস্তানকে কবজা করে নেওয়া উচিত, আরেক দল বলছে যুদ্ধ করতে নাকি অনেক খরচা, যুদ্ধ হলে আনাজপাতির দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে, তাই ভারতের যুদ্ধ করা উচিত নয়। রূপ ভাবে চাল ডালের দাম বাড়লে সে সংসার চালাবে কী করে? কিন্তু তারপর মনে হয় যুদ্ধ হলে বেশ হয়, কোনোদিন যুদ্ধ দেখেনি সে। প্যাটন ট্যাঙ্ক, সেপাই, গোলাগুলি, যুদ্ধ বিমান… এসব ভাবতেই গা গরম হয়ে যায় তার। নাহ্! ভারতের উচিত পাকিস্তানকে কঠিন শাস্তি দেওয়া।
“এই মুহূর্তের বড়ো খবর রাজস্থানের জয়পুরে নেমেছে ইজরাইলের ফাইটার জেট… রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় চলছে বেআইনিভাবে বসবাসকারী পাকিস্তানি নাগরিক খুঁজে বের করার কাজ… ভারতের আকাশ সীমা বন্ধ করে দেওয়া হল পাকিস্তানি বিমানের জন্য… এই মুহূর্তের বড়ো খবর…” রূপ সারারাত ধরে একই খবর দেখতে থাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। দেখতে থাকে কোন দেশের কতগুলো বোমারু বিমান আছে, যুদ্ধের ট্যাঙ্ক আছে, আছে কত পদাতিক বাহিনি… আছে কত গোলা, বারুদ, মিসাইল… যুদ্ধ লাগলে টিকবে কে বেশিদিন…
পরদিন সকালেও রূপ দেরি করে ঘুম থেকে উঠল, বউয়ের গজগজানি কানে না তুলে বেরিয়ে পড়ল চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে। সেদিনও চায়ের দোকানে আগের দিনের মতোই চলছে তুমুল বাগবিতণ্ডা। কিন্তু সেদিন আর রূপ চুপ করে শুধু সবার কথা শুনল না, সে নিজেও অংশ নিল সেই বাগবিতণ্ডায়। এই দু-দিনে খবর দেখে দেখে সে অনেক কিছুই শিখে নিয়েছে, তাই সে আর শুধু অন্যের মুখের ঝাল খেতে রাজি নয়, সে-ও শুনিয়ে দিল যুদ্ধ হলে ভারত কেন জিতবে! সাথে আরও জানাল ভারত সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের থেকে কোন কোন দিক থেকে এগিয়ে। এসব কথা শুনে একদল জনতা রূপকে নিজেদের দিকে টেনে নিল, অন্য দল মুখ বেঁকাল। রূপ খুশি হয়ে তার দলের সবাইকে একদফা চা সিগারেট খাইয়ে দিল। সে নিজেও খুশি হল সবাই তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনছে বলে! সে নিজেও ঘন ঘন সিগারেট খেতে লাগল।
“এই মুহূর্তের বড়ো খবর কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতীয় সেনা তাঁবু ফেলেছে, চলছে কুচকাওয়াজ… ভারতের রণতরী হাজির হয়েছে পাকিস্তানের জল সীমার অনতিদূরে, চলছে টহলদারি…”
“রূপ তু ইয়া তো ফিরসে ছুট্টি লেলে, ইয়া কাম কর লে! কামপে আনেকে বাদ মেশিনকে সামনে বৈঠকে নিউজ মত দেখ!”
রূপ মাথা ঘুরিয়ে মনীশজির দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ কাজই তো করছি।” বলে আবার মোবাইলে খবর দেখতে থাকে। মনীশজি রূপের ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হয়ে চোখ তুলে চারপাশে তাকায়, দেখে কারখানার বাকি সব কর্মচারী তার দিকে তাকিয়ে আছে, তারা মজা নিচ্ছে মনীশজির অবস্থা দেখে। সবাই জানে রূপ হল এই কারখানার এক নম্বর কর্মচারী, সে কোনোদিন মনীশজির সাথে গলা তুলে কথা বলে না, কিন্তু আজ সবার সামনে সে মনীশজির অবাধ্য হচ্ছে, তারাও দেখতে চায় মনীশজি এবার কী করে? মনীশজি আবার তাকায় রূপের দিকে, সে একইরকম মোবাইলে খবর দেখে যাচ্ছে। “কেয়া হুয়া মেরা বাত কান মে নেহি ঘুসা ক্যায়া? আগার ইহা কাম কারনা হ্যায় তো ঠিক সে কর, নেহিতো নিকাল যা ইহা সে! কোই বাবুগিরি নেহি চালেগা ইহা!”, গলা তুলে বলে মনীশজি! তারপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয় সবার উপরে। হ্যাঁ এবার সবার চোখে ভয় দেখা যাচ্ছে। মনে মনে খুশি হয় মনীশজি।
রূপ টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুলে বলে, “তাহলে আমার হিসাব মিটিয়ে দিন। আমি আর কাল থেকে আসব না।” বলে ভুরু কুঁচকে মনীশজির ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনীশজি অবাক হয়ে বলে “নোকরি ছোড় দেগা তো বিবি বাচ্চেকো খিলায়গা কেয়া? সোচকে দেখা হ্যায়?” রূপ গর্বের সাথে বলে, “কিছু-না-কিছু কাজ তো পেয়েই যাব, আর কিছু না পেলে আমি আর্মিতে যোগ দেব।” মনীশজি দু-বার খাবি খেয়ে বলে, “আর্মি?”
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
একদিন চায়ের দোকানের ঝগড়া হাতাহাতিতে পৌঁছায়, রূপ যখন চায়ের দোকান থেকে বাড়ি ফেরে তখন তার জামা, প্যান্ট দুটোই ছিঁড়েছে, কপালে কালশিটের দাগ। এসব দেখে রূপের বউ বাচ্চাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।
রূপ এখন একা একাই ঘরে সারাদিন খবর দেখে। রূপের চুলে জট পড়েছে, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এখনও সে রোজ সকালে নিয়ম করে চায়ের দোকানে জ্ঞান দিতে যায়। যদিও এখন আর কেউ তার কথা খুব একটা শুনতে চায় না। তার টাকা ফুরিয়েছে, দোকানে বাকি পড়েছে, সে আর সবাইকে চা সিগারেট খাওয়াতে পারে না।
কিছুদিন হল রূপ সাইকেলে করে খাবার ডেলিভারির কাজ নিয়েছে। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও তার বউ ফিরে আসেনি।
আর হ্যাঁ, যুদ্ধ থেমে গেছে।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন