আগেই বলা হয়েছে যে বিশ্বামিত্র হত্যা রহস্য মূলত যে তিনজনকে ঘিরে পাক খাবে, সেই তিনজন হল স্বপ্ননীল মিশ্র, আবদুল সামাদ এবং সরস্বতী বৈগা। স্বপ্ননীলের চন্দ্রপুরার পা রাখতে এখনও বেশ খানিক দেরি আছে। সেই সুযোগে আবদুলের গতিবিধির উপর আরও একবার দৃষ্টি দিয়ে নিলে ভালো হয়, কারণ সে ইতিমধ্যেই ওসি সুজয় মাহাতোর স্ক্যানারে। যদি এখনও সেই কথা জানে না সে। জানার পর কী করে সেটাই দেখার...
বিয়াল্লিশ
ফুলওড়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।
কাল সারারাত ঘুম আসেনি আবদুলের। একটা মুখই খালি পাক খেয়েছে মাথার ভিতর। সরস্বতী বৈগা। বাপ পরমেশ্বর মারা যাবার পর কালই প্রথম দেখা হয়েছিল ওর সাথে।
ধুরন্দর সালাউদ্দিন ছাড়া আর কারও ওদের ব্যাপার নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। প্রেম-পিরীতি, মুসল্লি পাড়া এবং বৈগা পাড়ার মধ্যে এই প্রথম নয়। আগেও হয়েছে। একমাত্র ওই হারামজাদাই সব ব্যাপারে ঢুকে পড়তে শুরু করেছে আজকাল। তবে ওই সাল্লুকে আর বেশি গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। দরকার হলে এইসব পার্টি-ফার্টি ছেড়ে দেবে সে। কোনও ঠিকাদারের কাছে ভিড়ে যেতে পারলেই ঘরে নিয়ে এসে তুলবে মেয়েটাকে। দেখবে কে আটকায়? সাল্লু কিছু বললে, শালা ওর চপার দিয়ে ওকেই দু’আধখানা করে দেবে। সাল্লু মিঞা গায়ে গতরে বাঘের মত হতে পারে কিন্তু আবদুলই কি কম যায় নাকি! একই সাথে চার জনের মহড়া নেওয়া তার কাছে কিচ্ছু নয়। বক্সিং থেকে শুরু করে ক্যারেটে, সবই জানা আছে তার। আবদুলের একটা ‘আপার কাটে’ একটা বুনো মোষও খানিক থমকে দাঁড়াবে বৈকি।
সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে ভোরবেলা চোখটা লেগে এসেছিল। মাথার কাছে রাখা ফোনটা ফড়ং-ফড়ং লাফাতে শুরু করলে তন্দ্রা কেটে যায়। ফোনটা তুলে দেখে। রতন বৈগা, সরস্বতীর দাদা।
দাঙ্গার পর থেকে অনেকবার ফোন করেছে রতনকে। কিন্তু, নাগাল পায়নি কখনও। রিং হয়ে গেছে প্রতিবার। ফোনটা ধরলেও দুম করে কথা যোগায় না আবদুলের মুখে। দু-এক মুহূর্ত স্তব্ধতার পর রতনের গলা শোনা যায়,
“কেমন আছিস?”
ধীরে বলা দুটো শব্দের মধ্যে বেশ খানিকটা বাতাস ভরে ছেড়ে দিয়েছিল রতন। সেই হাওয়া শুঁড় পাকিয়ে ঢুকে পড়ে আবদুলের বুকের ভিতর। এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে চায়। একটাই শব্দ তার দিক থেকে,
“ভালো...”
রতন বুঝতে পারে এই ‘ভালো’টা আসলে কোনও কথা নয়। এটাও, দলা পাকানো বাতাস খানিক। প্রসঙ্গে যেতে চায় রতন, “বলছি কাজের কোনও খবর হল?”
আবদুলের তবু রাধামাধব মন্দিরে মালীর কাজটা আছে, রতনের তাও নেই। দুজনে একসাথেই এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করত ডি-ভি-সি প্ল্যান্টে। সেই কাজ যাওয়ার পর সে সম্পূর্ণ বেকার এখন। তার মধ্যে ঘাড়ে সমত্থ বোন।
“না রে এখনও সেরকম কোনও খবর নেই…”
“হুমম...”
“অত চিন্তা করিস না। কিছু একটা হয়ে যাবে...”
“এরপর মনে হচ্ছে মন্দিরের কাজটাই করতে হবে…”
একটু অবাক হয়ে যায় আবদুল। যে হারামজাদা মোহান্তি ঠাকুর ওদের মন্দির-শানে উঠতে দেয় না, সেই মোহান্তি ওকে কাজ দেবে! সরস্বতী যে লিফলেটটা গতকাল ওকে দিয়েছে, সেটাও নাকি মোহান্তি সারা গাঁয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিলি করেছে। পাছে কারও সাথে ছোঁয়া লাগলে জাত যায়!
“ঐ খানে কী কাজ তোর?”
“ভোগ রান্নার...”
“তুই রান্না করবি ভোগ! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না রে...!”
“না আসলে মন্দিরে ঠিক নয়। সীমানায় বাইরে যে ঘরটা আছে…”
রতনের কথার ভাবগতিক ঠাহর করতে পারে না আবদুল,
“বুঝতে পারছি না কী বলছিস…!”
“বলছি... সীমানার বাইরে একটা ঘর আছে, যেখানে আমাদের মত ছোটোলোকেদের জন্য আলাদা বাসনপত্র, উনুন এইসব রাখা থাকে।”
“হ্যাঁ, সেটা জানি।”
“পরব লাগলে আমাদের মত যারা আছে তাদের জন্য রান্নাবান্না হয়। সেখানেই রান্নার কাজ...”
আর কিছু বলতে পারে না আবদুল। বুঝতে পারে মোহান্তি কোণঠাসা করে ফেলেছে রতনকে। রতন বৈগা, সদাশিব মোহান্তির ধ্যাস্টামোকে কোনোদিন প্রশ্রয় দেয়নি। সসম্মানে বাঁচতে চেয়েছে। সে আজ কিনা মেনে নিচ্ছে ওই হারামখোরদের বন্দোবস্ত!
ফোনটা কখন যেন কেটে দিয়েছিল রতন। এদিক থেকে বার পাঁচেক হ্যালো হ্যালো করার পর সেটা বুঝতে পারে আবদুল। রেখে দেয় ফোন। বাইরে আসে।
নিম গাছটা খাড়া উঠে গেছে উপরে। আট দশ হাত উঠলে তবে ডাল পালার নাগাল পাওয়া যায়। আবদুলের মসৃণ গা বেয়ে চড়তে কোনও অসুবিধা হয় না। কাটারিটা নিয়ে আসে ঘর থেকে। মুখে নিয়ে তড়বড় করে উঠে পড়ে উপরে। লম্বা সরুমত একটা ডাল কেটে নেমে আসে। এই ডাল থেকে কম করে গোটা পঁচিশেক দাঁতন বার করা যাবে। হাত-দা’টা দিয়ে সাইজমত কাটতে থাকে।
আবার একটা ফোন আসে। এইবার সালাউদ্দিন।
“খবর শুনেছিস ?”
“কী!”
“মসজিদে শুয়োর পড়েছে...”
“অ্যাঁ...সে কি! ওইখানে আবার কে শুয়োর ফেলতে যাবে!”
সালাউদ্দিনের ছেনালি উত্তর, “আরে বলদ ঐ খানে ফেলবে না তো কোথায় ফেলবে! তোর উঠোনে?”
তড়াক করে একটা লাফ দেয় আবদুল, “খবরদার মিঞা ভাই।”
“তা কী বলব…! তোর যেমন প্রশ্ন...”
এরপর সরাসরি একটা কথা জিজ্ঞাসা করে আবদুল,
“মসজিদে শুয়োর কে ফেলতে পারে বলে মনে হয়?”
“আবার সেই বোকার মত কথা। বড় রাস্তার ধারে চায়ের দোকানটা কার জানিস তো?”
কোন দোকানের কথা বলা হচ্ছে প্রথমে বুঝতে পারেনি আবদুল। দু-এক মুহূর্ত বাদেই বুঝতে পারে, ‘বড় রাস্তা’ মানে হাইওয়ে। আর ‘দোকানটা’ হল বৈগাপাড়ার পঞ্চায়েত প্রধান রকেট মুর্মুর। গাজী বটতলা থেকে আরও খানিক উত্তরমুখী গেলে, রাজপথের ডানধারে সেই চায়ের দোকান। সাধু বটের নীচে। গাঁয়ে ঢোকার আগে যেখানে বসে চা খায় মানুষজন। গতকাল অরবিন্দ অনন্তও খেয়েছিল।
ফোনের এইপাড় থেকে আবদুল বলে, “হ্যাঁ জানি। রকেটের...। তো!”
“ঐ আমাকে বলেছে এটা রতনের কাজ । তবে এর হিসাব কিন্তু আমরা নিয়ে ছাড়ব।”
“রতন! কোন রতন!”
“কটা রতনকে চিনিস তুই?”
“রতন বৈগা?”
“সে ছাড়া আর কে করতে পারে এই কাজ?”
সালাউদ্দিন যাই বলুক, একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারে না আবদুল। রতন, মুসলিম মহল্লায় ঢুকে এটা করতে যাবে কেন? যে এখন নিজেদের জন্য কী ভাবে দানাপানি জোটাবে সেই চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছে!
আর তাছাড়াও একটা কথা আছে, বাপ পরমেশ্বর, মারা গিয়েছে হনুমান মন্দিরের দাঙ্গায়। প্রতিশোধ নেওয়ার কথাই যদি ধরা হয়, তবে ঘুরপথে না গিয়ে সরাসরি সালাউদ্দিনের মুন্ডুটাই তো ও টার্গেট করবে। তা না করে এইসব! ধুসস...। এই রকেটের কথার উপর কেন এত ভরসা মোল্লা সাহেবের বোঝা মুশকিল!
আবদুল বলে, “রকেট কোত্থেকে জানল!”
“ওর কথা যে মিথ্যে হয় না সেই প্রমাণ তো আগেও পেয়েছিস। হনুমান মন্দিরে বৈগাদের জড়ো হবার খবরটা তো ঐ দিয়েছিল।”
হাসে আবদুল। বলে,
“এ আবার এমনকি কথা! হনুমান জয়ন্তীর দিন ঐ খানে হিন্দুদের জমায়েত তো প্রতিবছরই হয়। এই খবরের মধ্যে আবার আলাদা কী আছে! আর ও নিজে থাকে বৈগাপাড়ায়। ও জানবে না তো কে জানবে ওখানকার খবর? তবে সেই খবর যে ও আমাদের কানে তুলছে, সেটা যদি রতনরা জানতে পারে তবে ওকে কুপিয়ে দেবে।”
কসাই আবদুলের এই কথার উত্তরে বলে, “সে সব তো পরে হবে। তার আগে আমরাই রতনের হিসাব নেব।”
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
তেতাল্লিশ
শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। হাওড়া। অবশেষে চন্দ্রপুরার পথে পাড়ি দিল স্বপ্ননীল।
আচমকা এক মৃত্যুর খবর স্বপ্ননীলকে ভেঙেচুড়ে দিয়েছে। দেবতুল্য ওই মানুষটার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর সে কিছুতেই যেন নিজেকে সামাল দিতে পারছে না! পিতৃদায় কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে তাকে।
কলকাতা অথবা আশেপাশে, বিশ্বামিত্র বাবুর নিজের বলতে সেরকম কেউ নেই। দু-একজন আত্মীয় থাকলেও, বর্তমানে তারা প্রবাসী। এখনও কেউ খবর পেয়েছে কিনা কে জানে। সুজয় মাহাতো বলেছেন, যদি আত্মীয় স্বজন কাউকে না পাওয়া যায় তবে তাকেই মুখাগ্নি করতে হবে। পিতামহ ছাড়া আর যার সংস্পর্শে নিবিড় এক ছায়া অনুভব করেছিল স্বপ্ননীল, তিনি বিশ্বামিত্র সেন। তার মুখাগ্নির প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দেয় কী করে?
এখনও প্রথম সাক্ষাতের সেই দিনটার কথা মনে আছে।
ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ। কদিন পড়াশুনার বেশ চাপ ছিল। গঙ্গার নরম হাওয়ার শরীরখানা একটু জুড়িয়ে নিচ্ছিল স্বপ্ননীল। খেয়াঘাটের ঠিক পাশে, প্রাচীন বটগাছকে ঘিরে বাঁধানো এক বেদি। দু-চারজন বন্ধু মিলে বেশ জমাটি আড্ডা তখন সেখানে। হঠাৎ করে, সম্মুখে উদয় হলেন এক পৌঢ়। কৃষ্ণনগরের দিক থেকে এসেছেন খেয়া পার হয়ে।
“আচ্ছা রত্নাকর মিশ্রের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?”
সৌম্যকান্তি চেহারা। গভীর চাউনি। সবে একজনের থেকে আধখাওয়া সিগারেটটা নিয়েছিল নীল, ছুঁড়ে ফেলে। বিদায় নেয় বন্ধুদের থেকে।
“আসুন আমার সাথে।”
ওর পাশে পাশে হাঁটতে থাকেন ভদ্রলোক। খানিক এগিয়ে আসার পর স্বপ্নকে বলেন, “আপনি কি ওঁর পাড়াতেই থাকেন ?”
“হি ইজ মাই গ্রান্ডফাদার। আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না দয়া করে।”
“আসলে প্রথম সাক্ষাৎ তো...। যাই হোক, তা তুমি ওঁর নাতি… বাঃ বাঃ... কী নাম তোমার?”
“স্বপ্ননীল মিশ্র।”
“স্বপ্ননীল… বাঃ খুব সুন্দর নাম তো।”
‘পোড়া মা তলা’ ঘাট থেকে সোজা এগিয়ে গেলে বাঁদিকে অনেকগুলো লজ। ডান দিকে পরপর, দু’খানা পাইস হোটেল এবং একটা মিষ্টির দোকান। দোকান ফেলে ডানহাতে মোড় নিলে যে রাস্তাটা গঙ্গার সমান্তরালে চলে গেছে, সেটা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলেই মিশ্র পরিবারের আদি বাড়ি।
সিংহ দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টেপে নীল। দরজা খোলে আসুদা।
“দাদুভাই কোথায় গো?”
“ছাদে।”
নীল ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বিশ্বামিত্রকে বলে, “আসুন, ভিতরে আসুন...।”
গাড়িটা নড়ে ওঠায় সম্বিৎ ফিরে আসে স্বপ্ননীলের। ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে খানিকটা জল গলায় ঢালে।
আবার ফিরে যায়, বিশ্বামিত্রের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এর সেইদিনে।
আসুদা দরজা খুলে দিয়ে চলে গিয়েছিল ভিতরে। পায়ে পায়ে নীল উঠে আসে দোতালার ছাদে। পিছন পিছন বিশ্বামিত্র।
উপরে এসেই, রত্নাকর বাবুকে ডাকতে যাচ্ছিল স্বপ্ননীল। ইশারায় থামিয়ে দেন মিস্টার সেন। স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন, ওদের দিকে পিছন ফিরে আরাম কেদারায় বসে থাকা দীর্ঘকায় মানুষটির দিকে। রত্নাকরের পক্বকেশ কিন্তু ভঙ্গিমা ঋজু। তাঁর পদযুগল প্রসারিত সামনের দিকে আর পৃষ্ঠদেশ খুঁজে নিয়েছে আরাম কেদারার আশ্রয়। আজানুলম্বিত দুই হাত মাথার পিছনে।
বৃদ্ধের সম্মুখে খোলা আকাশ। একটা প্রকাণ্ড নীল মেঘ দেখা যাচ্ছে দূরে, যার পাদদেশ ছুঁয়ে আছে দুই রোধবতীর সঙ্গমস্থল। ভাগীরথী-জলঙ্গীর এই মিলনক্ষেত্র হল এক অদ্ভুত সীমান্তরেখা... রাইরূপে যাঁর অঙ্গ ঢাকা
গৌর বাঁকা, নয় সে একা।...
চৈতন্য মহাপ্রভুকে, শ্যাম আর রাধার মিলিত রূপ বলে মনে করেন অনেকে। দুই স্রোতস্বিনীর এই মিলন যেন তাঁরই রূপক। জলঙ্গীর নীল জলরাশি আর কেউ নন, স্বয়ং ঘনশ্যাম। আর, এইপ্রান্তের ভাগীরথী হল শ্যাম প্রেয়সী রাধা।
বিশ্বামিত্র বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন নিশ্চল। যেন দূর হতে কোনও ঋষিকে অবলোকন করছেন। বিশ্ববাবুর চোখের সামনে এমন একজন, যিনি সাধারণ কেউ নন, স্বয়ং মহাপ্রভুর বংশধর। বিশ্বামিত্রের সম্মুখে তখন এমন এক অন্তরীক্ষ, যেখানে একদিন ঘটেছিল বাংলা তথা ভারতবর্ষের অরুণোদয়, নবজাগরণের। আবেগতাড়িত হয়ে পড়া স্বাভাবিক বটে।
‘বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া-নিমাই ধরেছে কায়া।’
যে চৈতন্য মহাপ্রভুকে বিশ্বামিত্র জেনেছেন নিজের মত করে, আত্মস্থ করেছেন যাঁর বাণী, যাঁর প্রেমভাবে নিজ-অন্তর নিমজ্জিত করতে চেয়েছেন বারেবারে, আজ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন সেই মহাপ্রভুর বংশপ্রদীপকে। কাজেই নেশাতুর তো হবেনই।
চুয়াল্লিশ
চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সুজয় মাহাতো। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও দাঙ্গার অভিযোগে তুলে আনা যায় আবদুলকে। অন্তত জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তো আনাই যায়। কিন্তু সেটাও এই মুহূর্তে করতে চান না তিনি। এখনই ফোর্স নিয়ে আবদুলের এলাকায় গেলে হিতে বিপরীত হবে। মাইনরিটি কমুনিটির মানুষজনকে, পুলিশ ইচ্ছে করে হয়রানি করছে বলে আওয়াজ উঠে যেতে পারে। তবে, একবার কথা বলা জরুরি আবদুলের সাথে। কেন বিশ্বামিত্র খুন হয়ে যাওয়ার পর থেকে সে উধাও, সেই রহস্যটা খতিয়ে দেখা দরকার।
চন্দ্রপুরা স্টেশনের পাশের রাস্তাটাই ধরল দ্বিগু। কিছুটা গেলেই হাইওয়ে। দু-ধারে সর্ষের ক্ষেত। এদিকটায় এখনও ফসল কাটা হয়নি। বাতাসে শুকনো ফুলের রেণু আরও উজ্জ্বল করেছে চরাচর। হলদেটে রোদ্দুরের পেট চিরে চলে গেছে রাস্তা। বাঁ পাশে অনেক দূরে, ছোটো ছোটো কুঁড়ে ঘর আর ডান দিকে, চাষের জমির পিছনে সবুজ সবুজ টিলা।
নরম আলো-নরম হাওয়া, এস আই মহাদেবের মনটাকে বোধহয় একটু দুলিয়ে দিয়েছিল। না হলে তিনি কেন এই বমটকা সময়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠবেন, ‘চুপকে চুপকে চল রে পুর্বাইয়া…’! বোঝাই যাচ্ছে মহাদেবের চাপ, আর বড় বাবুর চাপ এক নয়।
এস পির ফোন এবং গ্লক সিরিজের রিভলভারে, সুজয়ের চোখে সর্ষে ফুল। পিছনে বসা মহাদেবের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান তিনি। মহাদেব বুঝে যান, ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’। গান থামে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সনাতন গাজীর বটতলায় গাড়ি এসে দাঁড়ায়। পুলিশের জিপ নিয়ে গ্রামে ঢুকতে চান না সুজয়। বটগাছের গোড়া থেকে হাত দশেক এগিয়ে গেলে, জমি বেশ খানিকটা নিচু। শুরু হয়েছে চাষের ক্ষেত। দ্বিগু বলে, “স্যার তাহলে আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি। ওই যে আবদুলের বাড়ির রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। আল বেঁয়ে সোজা গেলেই পেয়ে যাবেন।”
নেমে পড়েন সুজয় আর মহাদেব। মিনিট তিনেক হাঁটার পর, দারোগা এবং এস আই মাঠ ছেড়ে উঠে আসেন কাঁচা রাস্তায়। একটু এগিয়ে বাঁক নেন বাঁদিকে। সোনা মসজিদের পিছনে শিরিষ গাছের ছায়ায় একটা জমায়েত লক্ষ্য করা যায়। টুলের উপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে কেউ। জমায়েতের জন্য লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। আরও কাছে আসলে মানুষটাকে দেখতে পান সুজয়। সালাউদ্দিন মোল্লা। লোকাল মুসলিম সংগঠনের বড় লিডার। এখন নেতা হয়েছে। আগে খুন রাহাজানি করে বেড়াত। পাশেই ওয়াশিপুর। সেখানকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে ভালো দহরম মহরম ছিল। সম্ভবত এখনও আছে।
মসজিদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় জমায়েতের লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখে সুজয়দের। গাঁয়ের মধ্যে খাকি উর্দি! সহজ কথা নয়। পুলিশ দেখে সালাউদ্দিন দ্বিগুণ উৎসাহে চেঁচাতে শুরু করে। যে সব ঝাড়খন্ডী শব্দ কানে এসে আছড়ায় সেগুলি অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা এরকম,
“বন্ধুগণ ঐ দিক থেকে যত প্ররোচনাই আসুক না কেন আমরা চেষ্টা করব শান্ত থাকার। সংযত থাকার..., তবে হ্যাঁ...”
একটু থামে সালাউদ্দিন। যাতে, পরের শব্দগুলো বেশ মশলাদার করে বার করতে পারে, “যদি ধর্মের উপর, আমাদের ইসলামের উপর আঘাত আসে তখন আর চুপ করে বসে থাকা যাবে না। তখন আমাদের সর্ব শক্তি দিয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ।”
সুজয় মনে মনে হাসে। এই ধরনের কথাই সেদিন হনুমানজি-মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বলছিলেন এক জমায়েতে। শুধু ‘ইসলাম’ শব্দটার জায়গায় বলা হচ্ছিল ‘হিন্দুত্ব’।
আবার একটা বাঁক নেবার পর একজন সাইকেল আরোহী চোখে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলে আবদুলের বাড়ি দেখিয়ে দেয় সে।
দাওয়ার একদিকে, বিরাট নিম গাছটা। বাঁ দিকে, কঞি দিয়ে খানিকটা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভিতরে কিছু মরসুমি ফুল। গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া। মালির কাজ করে আবদুল। নিজের চৌহুদ্দির মধ্যে ফুল গাছ থাকাটাই স্বাভাবিক।
খাটিয়ার উপর, ছায়া মাখানো রোদে এক বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখা যায়। ওদের দিকে পিছন ফেরা। লুঙ্গির উপর সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। পিছন থেকেও বোঝা যায় হাত দুটো চলছে। বসে বসে কিছু একটা করছেন উনি।
“এটা আবদুলের বাড়ি?”
ঘুরে তাকান বৃদ্ধ। পুলিশ দেখে বোধহয় একটু চমকান ভিতরে ভিতরে,
“হ্যাঁ কেন বলুন তো!”
“ওকে একটু ডাকুন, দরকার আছে।”
“হ্যাঁ শুনেছি রাধামাধব মন্দিরে একজন খুন হয়েছেন। কিন্তু আমি যতদূর জানি আবদুল দু’একদিন হল মন্দিরে যাচ্ছে না।”
“হ্যাঁ। যাচ্ছে না বলেই তো আমাদের চলে আসতে হল।”
বৃদ্ধ আর খুনের বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে বলেন, “কিন্তু ও তো বাড়িতে নেই। আসার সময় দেখেননি মসজিদে সব জড়ো হয়েছে...।”
পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছেন বয়স্ক ভদ্রলোক।
মহাদেব বলেন, “হ্যাঁ সে তো দেখলাম।”
“ও সকাল থেকে ওখানেই আছে। কে নাকি মসজিদে মরা শুয়োর ফেলে গেছে! সেই নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে ভোর থেকে...।”
আঁতকে ওঠেন সুজয়, “মসজিদে শুয়োর!”
বৃদ্ধের সাদা দাঁড়ি বাতাসে ওড়ে। পুরাতন শ্বেত শুভ্র সেই ঝালরে একবার হাত বোলান তিনি, যেন ফেলে আসা জীবনের পাতা ওল্টান আলগোছে। বলেন, “সালাউদ্দিন তো ফোন করে সেটাই বলেছে আবদুলকে। তবে ঐ শুয়োর, সালাউদ্দিন নিজেও ফেলতে পারে এলাকা গরম করার জন্য। বয়স কি কম হল? ঐ হারামজাদাকে আজ থেকে চিনি?”
বৃদ্ধ কড়াই শুঁটি ছুলছেন। খাটিয়ার উপর একটা খবরের কাগজ পাতা। তার উপর সবুজ শুঁটিগুলো ছড়ানো। হয়তো বা নিজের ক্ষেতের। খোসা ছাড়িয়ে বড় একটা পাত্রে রাখছেন। সুজয় বলেন, “আবদুলকে একটা ফোন করে ডাকা যাবে?”
বৃদ্ধ পাত্রটা একদিকে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেন, “এখন ঐ হট্টগোলের মধ্যে ফোন ধরবে বলে মনে হয় না। আর যদিও বা ধরে, তাহলে আরও এক বিপদ হতে পারে...।”
“বিপদ বলতে?”
নিকানো উঠোন। বেশ খানিকটা উঠোনের পর মাটির বাড়ি। ফলসা গাছটা চোখে পড়ে। সেই গাছের ডাল এসে পড়েছে চালে। একটা বড় মুরগির পিছন পিছন আরও কয়েকটা বাচ্চা মুরগি পিল পিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে উঠোনময়। সুজয়ের মনে হয়, ছেলেবেলার বইয়ে ফেলে আসা এক পর্ণকুটির। কোথাও কোনও অশান্তির চিহ্নমাত্র নেই, তাও কেন যে এই সালাউদ্দিনরা...!
একটা মুরগির বাচ্চা ঢুকে পড়েছিল কঞ্চির বেড়া টপকে, ফুলের বাগানে। উঠে, পরম মমতায় সেটাকে বার করে দেন বৃদ্ধ। ফের খাটিয়ার এসে বসতে বসতে বলেন, “বিপদ বলতে..., মিঞাসাহেব সব হারামজাদাগুলোকে নিয়ে এখানে চলে আসতে পারে। মুসলিম গাঁয়ে হিঁদু পুলিশ, এই ছুতোয় একটা গোলমাল বাঁধাতে পারে।”
সুজয় কী একটা চিন্তা করেন দু-এক মুহূর্ত। তারপর বলেন,
“ঠিক আছে, আমাদের কথা বলার দরকার নেই, বলুন যে আপনিই ডাকছেন।”
ঘরের ভিতর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে আসেন। আবদুলের আম্মিজান। কাঁসার থালায় উপরে তিনটে গ্লাস। কিছু না বলে খাটিয়ার উপর রেখে চলে যান। বৃদ্ধ মৃদু হাসির আভা ছড়িয়ে বলেন,
“একটু বাতাসা ভেজানো জল। নিন খেয়ে নিন। রোদের মধ্যে এতখানি এসেছেন...।”
সুজয়ের খুব তেষ্টা পেয়েছিল। কথা না বাড়িয়ে চুমুক মারেন। ভিতরখানা জুড়িয়ে যায়। বুকের মধ্যে ধু ধু পিপাসা থাকলে কে হিঁদু আর কেই বা মুসলিম! সব জলই তখন অব্যর্থ বারিধারা।
তবে মহাদেব খান না। ওর বোধহয় জাতপাতের বাই আছে। বৃদ্ধ জোর করেন না। নিজে একটা গ্লাস নিয়ে চুমুক মারেন। খাওয়া হয়ে গেলে মৃদু হাসিতে ফিরে আসতে আসতে বলেন, “ওরা আপনাদের দেখেছে এদিকে আসতে... এখন আমি যদি দুম করে...।”
কথা শেষ হবার আগেই একটা সাইকেল এসে দাঁড়ায় বাড়ির সীমানায়। আবদুল। ঢোকার মুখে একটা খেজুর গাছ। সাইকেলটা হেলান দিয়ে এগিয়ে আসে সুজয়দের দিকে, “কী ব্যাপার আপনারা এখানে ?”
পুলিশ যদি বাড়ি এসে ঘাপটি মেরে থাকে তবে সবারই খানিক হড়বড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই চাঁদুর হাবভাব দেখে পুলিশই চকমকি। মহাদেব তড়বড় করে বলে ওঠেন, “আবদুল তুমি জান যে বিশ্বামিত্র বাবু খুন হয়েছেন।”
এই কথা শুনে আবদুলের সে রকম কোনও হেলদোল হয় বলে মনে হয় না। নির্বিকার ভাবে বলে, “হ্যাঁ জানি।”
সুজয়ের গলায় খানিক বড়বাবু সুলভ চাল, “বাঃ তাহলে তুমি জান...। খুব ভালো কথা..., তারপর থেকে মন্দিরে তোমাকে আর দেখা যায়নি। কেন?”
এইবার, আবদুলের কথা শুনে বোঝা যায় তার পলতেতে ভালোই আগুন ধরানো হয়েছে, এখন খালি ফাটার অপেক্ষা।
“তো! আপনাদের কি মনে হয়, মার্ডারের পর থেকে আমি মন্দিরে যাইনি বলে মার্ডারটা আমিই করেছি?”
এইদিক থেকে সুজয় মাহাতোর কাটা কাটা শব্দ, “কাউকেই আমরা সন্দেহের বাইরে রাখছি না।”
“সেটা আপনাদের ব্যাপার। আপনারা যদি এটাও ধরে নেন যে, আমিই খুন করেছি তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।”
সুজয় মাহাতোর প্রায় আটাশ বছর কেটে গেল পুলিশে। আগের থেকে পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন। তাই এখন আর বেশি কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়েন।
পিছন থেকে ভেসে আসে আবদুলের গলা, “আর কে বলল আপনাদের মার্ডারের পর আমি মন্দিরে যাইনি! কালকে গিয়েই তো গোসাঁইজির সাথে মোলাকাত করে এলাম! ইনভেস্টিগেশনের আগে ইনফরমেশনটা ভালো করে যোগাড় করতে হয় তো।”
আজকাল কথায় কথায় বেশ কিছু ইংরাজি শব্দ বলে আবদুল। যাই হোক পুলিশ এখন ইংরাজি শব্দ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অন্য কথা ভাবে। তারা ভাবে যে, তাহলে কি বলবন্ত সিং মিথ্যা কথা বলেছিল? অবশ্য এটাও হতে পারে যে, আবদুল গিয়েছিল কিন্তু বলবন্ত তাকে দেখেনি। সে হয়ত তখন অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত ছিল।
নাহ, এই বিশ্বামিত্র-হত্যা কেসটার খুব সমাধান খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন