preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
সাম্প্রতিক অতীত
গল্প

সাম্প্রতিক অতীত

দুর্গাপদর মাথার মধ্যে এখন বন্যার অনর্গল স্রোতের মতো রোজ ঘোরাফেরা করে এইসব স্মৃতি। তার ঘর, রোগশয্যা, তাকে ঘিরে থাকা ওষুধপত্র, নয়না, তার ছেলে-মেয়েদের ছবিগুলো একটু একটু করে যেন উবে যেতে থাকে তার মন থেকে। অতীতের ওজনে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে।

দিন দিন মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে দুর্গাপদর। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীর এখনকার মুখগুলো মাঝে মাঝে আবছা হয়ে যাচ্ছে ওর স্মৃতিতে। এখন তারা সামনে এলে কখনো কখনো মনে ভেসে ওঠে নেগেটিভের মতো। সেই সময়ে তাদের কম বয়সের ছবির সঙ্গে নেগেটিভটা মিলিয়ে ভিতরে ভিতরে এখনকার চেহারাগুলি তৈরির চেষ্টা করে দুর্গাপদ। কিন্তু কিছুতেই ঠিকঠাক পেরে ওঠে না। কী যে হয়েছে ওর মাথার ভিতর! অথচ তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারে এরা তার খুবই আপন। তার ভালো চায়। আবার মাঝে মাঝে তার স্পষ্ট মনে পড়ে সব কথা। এরা সকলে তার পরিচিত না কি অপরিচিত, নতুন কেউ? সারাক্ষণ একটা দোলাচলে থাকে সে।

বছর পনেরো আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিল দুর্গাপদ। চাকরি যত দিন করত তত দিন মনটা হালকা ছিল ওর। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনাও কম ছিল। মাস গেলে ২৫-৩০ হাজার টাকা ঢুকে যেত অ্যাকাউন্টে। কালার টিভি, ফ্রিজ, রবিবারে কচুরি, খাসির মাংসের অভ্যাস, এইসব নিয়ে সংসার চালাতে নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে প্রথম জীবনে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল তাকে। সাড়ে তিন দশক আগে গ্রামের সমবায় ব্যাঙ্কে ১৭৫ টাকা বেতনের চাকরি জুটেছিল। জীবনে প্রথম চাকরি। তখন দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাতে বেশ অসুবিধা হত দুর্গাপদর। সংসার চালাতে মাস গেলে ৪০০-৫০০ টাকা প্রয়োজন হত। সেই ঘাটতি মেটাতে সে মন দিয়েছিল পুকুর লিজ় নিয়ে মাছচাষে। চাকরি পাওয়ার আগেও তাই করত সে। মাছ-পুকুর এসবের প্রতি বরাবর তার টান। সেই ব্যাবসায় কাঁচা টাকাও ছিল যথেষ্ট। বেতন আর সংসার খরচের মধ্যে ঘাটতিটা মিটিয়ে কিছু টাকা জমেও যেত প্রতি বছর। তবে সেই টাকা খরচ হয়েছে জলের মতো। যৌথ পরিবার ভেঙে আলাদা হতে হয়েছে তাকে। বাবার থেকে নতুন ভিটের জন্য কাঠা দুয়েক জমি পেলেও, আলাদা বাড়ি তৈরি করতে হয়েছে তাকে। হাত পড়েছে স্ত্রীর গয়নায়। নতুন বাড়িতে আসার পর পরিবারে সদস্যের সংখ্যা বেড়েছে। মেয়ের সংখ্যা এক থেকে বেড়ে হয়েছে দুই। ছেলে এক। সে-ই বড়ো। তার আর বড়োমেয়ের জন্ম যৌথ পরিবারে থাকাকালীনই। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য টাকা খরচ হয়েছে বেশ কিছুটা। দুই মেয়ের বিয়ের জন্য আলাদা করে টাকা রাখতে হয়েছে। পরিবারের ছোটো ছোটো আশাআকাঙ্ক্ষা মেটাতে হয়েছে।

কয়েক বছর কাটার পর, আগের থেকে দুর্গাপদর আয়ও বেড়েছিল বেশ কয়েক গুণ। ছোটো মেয়েটা হওয়ার পর চাকরিতে উন্নতিও হয়েছিল তার। গ্রামের কোঅপারেটিভ ছেড়ে সে রওনা দিয়েছিল জেলার সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কে। আর্থসামাজিকভাবে হ্যারিকেন জ্বলা, টালির চাল, মাটির মেঝের ঘরের অতি নিম্নবিত্ত থেকে সামান্য উপরে উঠে গিয়েছিল দুর্গাপদ। মাথার উপর পাকা ছাদ, কারেন্টের ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। কিন্তু ওইটুকুই। এর বেশি উপরে ওঠা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। দুর্গাপদ খুব আশা করেছিল, তার ছেলেটা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। সমাজে অর্থনৈতিকভাবে সামান্য উঠে যাওয়ার পর তার মেশামেশির বৃত্তটাও কিছুটা বদলে গিয়েছিল। ভেবেছিল, এর উপর ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হলে সমাজে তার সম্মান একলাফে বেড়ে যাবে অনেকটা। যেমন তার বন্ধুবৃ্ত্তের অনেকের হয়েছে।

সপ্তাহের প্রায় প্রতি রবিবারই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ত হত দুর্গাপদকে। কারণ, পুকুরে জাল ফেললে হাজার খানেক টাকা আয় হতই। আলো ফোটার আগেই পুকুরে মাছ ধরতে জড়ো হত জেলেরা। তাদের সঙ্গে কাটাতে হত বেশ কিছুটা সময়। ওই সময় দুর্গাপদ ছিল নিটোল মৎস্যজীবী। কোন মাছের কেমন আচরণ, জলের কতটা গভীরে তারা থাকে, কখন তারা গর্ভবতী হয়, সেই সময় কীভাবে তারা জালের ফাঁদ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, এইসব তখন তার নখদর্পণে। আলো ফোটার ওই মুহূর্তে দুর্গাপদ হয়ে উঠত মাটির মানুষ। পুকুরের পাড়ে ঘোরাঘুরি করত চায়ের কাপ হাতে। জেলেদের কাজের তদারক করত। চা শেষ করে কাপটা লুঙ্গির কোঁচড়ে ফেলে রেখে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে ফেলত বিড়ি। অন্য সময় অবশ্য সে সিগারেটই টানত। মাছের আড়তে আড়তদার ও পাইকারদের সঙ্গে তার কথাবার্তা ছিল পাক্কা ব্যবসায়ীর মতো। উপর্যুপরি ধারবাকির কথায় কাঁচা খিস্তি বেরিয়ে যেত তার মুখ দিয়ে। মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ যে-ভাষায় তার রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি, ভালোবাসা প্রকাশ করে, জেলেদের সঙ্গে মাছধরার দিনগুলোর ভোরবেলায় দুর্গাপদও ছিল তেমনই। অবশ্য এসব না বলে উপায়ও ছিল না। ঠকতে ঠকতেই সে শিখে ফেলেছিল জীবনে এক-দুধাপ করে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল। যেখানে যেমন চলে আর কি। আবার এই দুর্গাপদই সপ্তাহের অন্যান্য দিন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ন-টার দিকে গড়ালে চান-খাওয়া সেরে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে রওনা দিত অফিসের দিকে। তখন সে পুরোদস্তুর ব্যাঙ্ককর্মী। প্রখর ধৈর্য নিয়ে তখন সে সামলাত ব্যাঙ্কের ক্যাশ কাউন্টার। তখন তার ওঠা-বসা এলাকার বড়ো ব্যবসায়ী থেকে কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কে দুশো-পাঁচশো টাকা জমা রাখা বা তোলার জন্য ভিড় করা সাধারণ মানুষ, সকলের সঙ্গে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে চা-জলখাবার খেয়ে, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে দুর্গাপদ কখনো রওনা দিত বন্ধুদের সঙ্গে তাস পেটাতে বা কখনো আড্ডায়। তখন সে ফুলবাবু। সেই আড্ডায় ভিড় জমাতেন এলাকার শিক্ষক, অবসরে মোটা পেনশনের উপর নির্ভর করে থাকা চাকুরেরা। মাঝে মাঝে তারা খসার মতো যোগ দিতেন এলাকার দু-একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অধ্যাপকও। কখনো কখনো আসতেন এলাকার পার্টির দু-এক জন নেতাও। পার্টির নেতারা আড্ডায় এলে আলোচনা হত, মার্ক্সবাদ, শ্রেণিবৈষম্য, শ্রমিক-কৃষকের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে। পার্টির নেতারা সময় পেতেন কম। তবে তাঁরা আড্ডায় যোগ দিয়ে চলে যাওয়ার পরেও কয়েকটা দিন রেশ থেকে যেত তাঁদের কথাবার্তার, বিষয়বস্তুর। গুরুত্বপূর্ণ লোকজন আড্ডায় যেদিন কম থাকত সেদিন অবশ্য এলাকার নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির ফোয়ারা উঠত আড্ডায়। বাংলা-ইংরেজি সবরকম গালাগালও চলত সেই বৃত্তে। আবার ডাক্তার অধ্যাপকরা আড্ডায় এলে উঠত মহাকাশ বিজ্ঞানের কথা। আলোচনা চলত বেদবেদান্তে লেখা মানুষের মুক্তির পথ নিয়েও। দুর্গাপদ শুনত সব। বলা ভালো গোগ্রাসে গিলে খেত আলোচনার ভালো-মন্দ। সে যে কথা বলার চেষ্টা যে করত না এমন নয়। কিন্তু এমন ভারী ভারী ঝকঝকে সব বিষয়ের মাঝে তার সামান্য কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের চাকরি, মাছেদের জীবন বর্ণনা আলোচনায় ঠাঁই পেত না। অঙ্কের শিক্ষক পূর্ণেন্দুবাবু তো একদিন তাকে বলেই ফেলেছিলেন, “কী সব মাছ-টাছের কথা বলছ দুর্গা! ওসব জেলে-টেলেদের ব্যাপার। এগুলো আবার এখানে কেন।” সেই কথার খোঁচাটা আজও ভুলতে পারে না দুর্গাপদ। মাথায় গেঁথে আছে তার।

আড্ডার বন্ধুদের থেকে শুনে চোখ খুলে গিয়েছিল দুর্গাপদর। জেনেছিল, ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং হল অতি পবিত্র পেশা। অবশ্য তখন এখনকার মতো অলিতে-গলিতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল না। জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলে আশপাশের দু-পাঁচটা গ্রামে নাম ছড়িয়ে পড়ত কৃতীর। সকলেই জানত, ওতে একবার মাথা গলাতে পারলে আর চিন্তা নেই। মনে মনে সে খুব চাইত, তার ছেলেও যেন এমনই হয়। কিন্তু হিসাব মেলাতে পারেনি সে। বাপের মতো ছেলেরও ভক্তিপ্রীতি সাহিত্যেই। অঙ্ক থেকে ছেলে কয়েক-শো মাইল দূর দিয়ে যেত। মাধ্যমিকে জীবনবিজ্ঞান ও জড়বিজ্ঞানে ভালো নম্বর পেলেও, অঙ্কে টায়েটুয়ে পাশ করেছিল সে। তারপর নিজেই জানিয়েছিল, সায়েন্স নিয়ে মোটেও নয়, সে পড়াশোনা করবে আর্টস নিয়েই। দুর্গাপদ চোখের সামনে সে-দিন দেখতে পেয়েছিল তার মনে মনে তৈরি করা স্বপ্ন কাচের মতো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে এক সময় মারধর-শাসন করলেও, সে-দিন তার সিদ্ধান্ত শোনার পর আর রাগ করতে পারেনি। তবে স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে রক্তে ভিজিয়ে দিয়েছিল তার বুকের ভিতরটা। সে-কথা আর কাকেই-বা বলবে দুর্গাপদ! এসব তার মনে আছে স্পষ্ট।

আসলে টাকাপয়সার অভাবে নানা সময়ে জীবনভর অপদস্থ হতে হয়েছে দুর্গাপদকে। আড্ডায় তার কথা গুরুত্ব পেত না। তাতে সে যতই একেবারে নীচতলা থেকে সামান্য হলেও উপরে উঠে আসুক-না-কেন। তার উপর বড়ো মেয়েটার বিয়েটাও বেশ গণ্ডগোলের হল। দেখাশোনার সময়ে পাত্রের যতটা আর্থিক সংগতি ছিল বলে দেখা গিয়েছিল, বিয়ের পর একটু একটু করে তার পলেস্তারা খসে গেল। নোনা ধরা দেওয়ালের পুরনো বাড়ি যেমন হয়। ছেলেটাও বেসরকারি একটা কোম্পানিতে সামান্য কাজ করে। আয় মোটামুটি। চলে যায়। তবে বাড়িতে থাকতে পারে না। কাজের সুবিধার জন্য কলকাতায় পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকতে হয়। সপ্তাহে তার দেখা মেলে এক বার। সেই চাকরিতেও অনিশ্চয়তার একশেষ। নিত্য সুতোর উপর হাঁটা। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দুর্গাপদ বুঝতে পারে তার ছেলের তার থেকে উপরে উঠতে এখনও ঢের দেরি আছে। সে-ও খুব মন থেকে চায়, তার যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে যেন তার ছেলে শুরু করে। সে যেন আরও অনেকটা দূর এগিয়ে যায়। তবে সে নিজে সেই অবস্থা দেখে যেতে পারবে কি না তা নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ বাসা বাঁধে তার মনে। এইসব ভাবতে ভাবতেই একদিন রির্টায়ারমেন্টের সময় এল। আর অবসর নেওয়ার মাস দুয়েকের মাথাতেই সেরিব্রাল অ্যাটাক।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

সেরিব্রাল অ্যাটাক তাকে ধাক্কা দিয়েছিল অনেকটা। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর, প্রথম প্রথম দুর্গাপদ ভাবত, সে এখনও চাকরি করছে। তার মনে হত, কতদিন অফিস কামাই হচ্ছে! চাকরিটা আদৌ থাকবে কি না তা নিয়ে খুব আশঙ্কা হত তার। ভাবত, অফিসে গিয়েই কম্পিউটারের কি-বোর্ডে হাত সড়গড় হতে হবে অতি দ্রুত। প্রত্যেক ব্রাঞ্চের কর্মীদের এ নিয়ে কড়া নির্দেশ পাঠিয়েছে হেড অফিস। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কড়া ওষুধের ঘোরের মধ্যে শূন্যে হাত বাড়িয়ে কম্পিউটারের এন্টার কি-টা খুঁজত দুর্গাপদ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করত, কম্পিউটারটা চালানো তাকে শিখতেই হবে। ছেলেকেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন করত সে। তারপর অবশ্য অনেক কাল কেটে গিয়েছে। ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়েছে সে। বুঝতে পেরেছে, তার অবসর নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন সে অসুস্থ। কিন্তু অসুখটা ঠিক কিসের তা আর মনে পড়ে না তার। রোজ সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সাত-আটটা ওষুধ খেতে হয় তাকে। তার স্ত্রী তাকে একটা একটা করে খাইয়ে দেয় সময়মতো। মাঝে মাঝে তার হাঁপের টান ওঠে। স্ত্রী তার দিকে নেবুলাইজ়ার এগিয়ে দেয়। সে আরও বেশি অসুস্থ হলে ছেলে-মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে। ডাক্তার ডাকে, ওষুধ আনে। উদ্‌বেগ প্রকাশ করে। কখনো রেগেও যায়। এইসবের মধ্যেই জীবনের সুদূর অতীত ও সাম্প্রতিক অতীতকে বেছে আলাদা করে ফেলার অভ্যাস তৈরি করে ফেলে দুর্গাপদ। এখন সে সুযোগ পেলেই চলে যায় পুরনো দিনে। অনেক দিন আগে ফেলে আসা সময়ে।

চাকরির শেষ দিকে অফিসে কম্পিউটার আসার স্মৃতি এখন আর মনে পড়ে না দুর্গাপদর। খালি মনে আসে, জীবনের শুরুর দিকের কথা। তার বাবাও ছিল জেলা কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের কর্মী। কিন্তু ম্যানেজারের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় চাকরি ছেড়ে দেয় দুর্গাপদর বাবা। কিছু জমিজায়গা ছিল তাদের। সেটাই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছে তাদের। ধান জমি, আম-লিচুর বাগান একটু একটু করে বেচে ছয় ছেলে, এক মেয়ের সংসার টেনেছিল দুর্গাপদর বাবা। এর মধ্যে বড়োলোক আত্মীয়দের কাছে ধারের টাকা শোধ করতে তাঁকে জমি বেচে দিতে হয়েছে অনেক কম দামেই। তখন বাড়িভরতি খিদে পেট। বাজার থেকে আনা চালের ব্যাগ উনুনে বসানো হাঁড়িতে উপুড় করে দেওয়াই রেওয়াজ ছিল তাদের বাড়িতে। ড্রামে আগাম দিন কয়েকের চাল রেখে দেওয়ার মতো বিলাসিতা দেখাতে পারত না দুর্গাপদর মা। এই টানাটানির সংসারে দুর্গাপদ তো বটেই, তার কোনো ভাই-বোনের পড়াশোনাও বেশি দূর গড়ায়নি। অষ্টম শ্রেণি থেকে কলেজের দরজাতেই তারা ঘোরাফেরা করেছে সাত ভাই-বোনের প্রত্যেকে। কম বয়স থেকেই লেগে পড়তে হয়েছে উপায়ের ধান্দায়।

সারাদিন শুয়ে শুয়ে অনেকদিন আগের সেইসব কথা এখন খুব মনে পড়ে দুর্গাপদর। তার বাবা-মা মারা গিয়েছে অনেকদিন আগে। সে-কথা মনে আছে। গত পরশু মারা গিয়েছে তার মেজ ভাই। ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী দুর্গাপদকে জানাল সে কথা। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে প্রথমে চমকে উঠল দুর্গাপদ। তারপর, দু-চার জনের কাঁধে ভর দিয়ে ভাইকে শেষ দেখা দেখেও এল। মেজ ভাইকে ওই অবস্থায় দেখে চোখে জল এসে গেল তার। কিন্তু আজ আর সে-কথা মনে নেই তার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুর্গাপদ তার স্ত্রীকে বলল, ‘‘শক্তিকে একবার ডাকো। ওর সঙ্গে আমার কিছু দরকারি কথা আছে।’’ স্বামীর কথা কানে ঢুকলেও এড়িয়ে যান নয়না। দুর্গাপদও কিছুক্ষণ একই বুলি আওড়ানোর পর আপনাআপনি চুপ করে যায়।

ইদানীং দুর্গাপদর খুব মনে পড়ে দীপার কথা। ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে মানুষ হয়েছিল তারা। দীপাকে প্রথম থেকেই তার ভালো লাগত। দীপার চোখের ইশারা কিছুটা পড়তে পারলেও, কোনোদিন সেভাবে বলা হয়ে ওঠেনি সেই কথাটা। কারণ আশঙ্কা হত, দীপা যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এই আশঙ্কাই তাকে বহুদিন তাড়া করে বেড়িয়েছিল। আসলে দীপাকে বলার মতো খুব বেশি কিছু ছিল না দুর্গাপদর। কীই-বা আছে তার। কীই-বা সে দিতে পারত দীপাকে। জীবনে বার বার ধাক্কা খেতে খেতে একটা একটা করে সিঁড়ি পেরোতে হয়েছে দুর্গাপদকে। এখনকার চেয়েও কঠিন সেইসব দিন গিয়েছে। তবে দীপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বেশ মুষড়ে পড়েছিল দুর্গাপদ। তারপর থেকে সব কিছু আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতাও তার মন থেকে একটু একটু করে চলে গিয়েছিল। এসব স্মৃতি এখন তাজা হয়ে ওঠে দুর্গাপদর মনে। সতেজ হয়ে তারা ডালপালা মেলে। দীপার মুখ, ভ্রূভঙ্গি, প্রতিটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ এইসব এখন শুয়ে শুয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় দুর্গাপদ, ঠিক যেন সিনেমা। ঠিক যেমনটা সে দেখত তার পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়সে। আজকাল এই অনন্ত সিনেমাটা থেকে আর বেরোতে ইচ্ছা করে না দুর্গাপদর।

দীপার বিয়ে হয়েছিল কলেজের শুরুর দিকেই। কোনো এক বিয়েবাড়িতে দীপাকে দেখে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল অনুপমের। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার অনুপম দীপার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তার বাবা-মায়ের মাধ্যমে। এর পরের ঘটনাক্রম এগিয়ে গিয়েছিল তরতর করে। দীপার বাবা নিমাইবাবুও এত ভালো পাত্র পেয়ে হাতছাড়া করেননি। হাড়হাভাতে দুর্গাপদর প্রতি তাঁর মেয়ের দুর্বলতা থাকলেও, নিমাইবাবু ছিলেন ঘোরতর সংসারী। সেই দুর্গে মেয়ের আবেগের বেনোজল তিনি ঢুকতে দেননি কোনোভাবে। কিন্তু বিয়ের বছর দশেকের মাথায় বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় অনুপমের। ওদিক ভাঙলেও, তত দিনে সময় গড়ে দিয়েছে দুর্গাপদর সংসার। এইসব ভাবতে ভাবতে দুর্গাপদর মনে হয়, কেন যে সেই দিনগুলিকে প্রিয়তম মনে করে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি! ভাবে, সে বা দীপা যা হয়েছে তা তো তারা হতেই চাইনি। হয়তো চেয়েছিল অন্য কিছু। কিন্তু জীবনের সেইসব পাপড়িগুলি কোনোদিন মেলেই ধরা হয়ে ওঠেনি তাদের।

দুর্গাপদর মাথার মধ্যে এখন বন্যার অনর্গল স্রোতের মতো রোজ ঘোরাফেরা করে এইসব স্মৃতি। তার ঘর, রোগশয্যা, তাকে ঘিরে থাকা ওষুধপত্র, নয়না, তার ছেলে-মেয়েদের ছবিগুলো একটু একটু করে যেন উবে যেতে থাকে তার মন থেকে। অতীতের ওজনে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে।

এমনই এক দিনে দুর্গাপদর আধখোলা চোখের সামনে অল্প শব্দ করে খুলে যায় তার ঘরের ভেজানো দরজা। আধো অন্ধকার ঘরটা বাইরে থেকে আসা আলোয় কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুর্গাপদ দেখতে পায়, দরজায় এক নারীর অবয়ব। মাঝারি গড়ন। ফেলে আসা দিনের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরটার ভিতরে। সে কি দীপা না নয়না? মাথায় ঘন হয়ে আসা ঘোরের মধ্যে ঠাওর করতে পারে না সে। তার চোখের পাতা বুজে আসে।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

Tridib Bhattacharya

1 দিন আগে

চমৎকার লেখা


Image Description

Sudipta Acharyya

21 ঘন্টা আগে

বেশ গল্পটা, ছোট গল্পের একজন শক্তিশালী লেখক হয়ে উঠছেন কনাদ মুখার্জি।


Image Description

Sudipta Acharyya

21 ঘন্টা আগে

বেশ গল্পটা, ছোট গল্পের একজন শক্তিশালী লেখক হয়ে উঠছেন কনাদ মুখার্জি।


মন্তব্য করুন

লেখক

কণাদ মুখার্জি, জন্ম: ১৯৭৯, শিক্ষা: বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথমে ইংরেজি ভাষা ও পরবর্তীকালে সাংবাদিকতার ছাত্র। পেশায় সাংবাদিক। গ্রামের মানুষ। শহরে পেটের দায়ে আসা। মূলত ফেসবুকে লেখালিখি। গল্প লেখা এই প্রথম।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন