সুপ্রিয় চৌধুরীর ‘আঁজলায় ধরে থাকা ৭০’-র পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন পার্থ প্রতিম ঘোষ। কেতাব-ই পাঠপ্রতিক্রিয়া প্রতিযোগিতার প্রথম স্থানাধিকারী এই পাঠপ্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হল কেতাব-ই ব্লগে।
আঁজলায় ধরা, মন টানা ‘৭০’
সত্তর দশক! এক বিশেষ কালপর্ব শুধু নয়, একটা বিশেষ যুগের নাম সত্তরের দশক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, যার শুরু ও শেষ নয়টি দশকে, তারপর, উত্তর স্বাধীনতা পর্বের সব চেয়ে বড় কাল্ট, যুগ বোধ করি অশান্ত সত্তর৷ এর শুরু আর শেষ মাত্র পাঁচ বছরে (১৯৬৭-১৯৭২)। আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিতে এই কাল ধরা আছে উত্তর চব্বিশ পরগনার এক ছোট্ট রেল কলোনিতে। কাঁচরাপাড়ায়। ঐ রেল কলোনির পাশেই ছিল এক মস্তবড় ঝিল! তার নাম মথুরা ঝিল৷ ঐ ঝিলের আশে পাশের জঙ্গল আর ঠিক ওপারে গয়েসপুর অঞ্চল ছিল বিপ্লবীদের মফস্সলি মুক্তাঞ্চল৷ ভদ্র-শান্ত মধ্যবিত্তের কাছে যে অঞ্চল হয়ে উঠেছিল নিষিদ্ধ৷ আমার বাল্যস্মৃতির কুঠুরিতে সত্তর দশক চিহ্নিত হয়ে আছে আমার রেল কর্মী বাবার মুখে৷ আমাদের কোয়ার্টারে আশ্রয় নেওয়া রোগা পাতলা ছোট্ট খাট্টো চেহারার এক মানুষের মধ্যে। যাঁকে আমি তিমির কাকু বলে ডেকেছি। যিনি রোজ রাতে আমাকে নিত্য নতুন গল্প শোনাতেন৷ রবিন হুডের গল্প বলতেন৷ এক সপ্তাহের বিস্তারে তৈরি হওয়া এক সম্পর্ক। যার একপারে ছিলেন ক্ষীণকায় এক যুবক এবং অন্যপারে মাত্র আট বছর বয়সী এক বালক আমি। সেই সম্পর্কটার নাম ৭০ দশক! মাত্র এক সপ্তাহ জুড়ে এক বালককে দেশ বিদেশের গল্প শুনিয়ে তিমির কাকু চলে গেলেন শুনশান গভীর রাত্রে, মথুরা ঝিলের ধারে। সেখান থেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন৷ সেই বালকটির কান্নার নাম সত্তর দশক! সেই চলে যাওয়াটাও আমার সত্তরের দশক। শুনশান রাস্তা ঘাট! CRP-দের টহল! অনতিকাল পরেই বাংলা দেশ যুদ্ধ। বনগাঁ রোড দিয়ে চলে যাওয়া মাটি কাঁপানো ট্যাংকারের সারি৷ আর, গভীর রাতে, সেই ছোট্ট রেল কলোনিতে ডিফেন্স পার্টির হুইসল বেজে বেজে ওঠায় বালকের ঘুম ভাঙে৷ কেন সেই হুইসল! চোরের আগমনকে চিহ্নিত করতে নাকি অন্য কারণে, সেটা বোঝবার বয়েস সেই আট বছরী বালকের ছিল না। সেই শুন শান রাস্তা ঘাট, ডিফেন্স পার্টির চার সেলের গামা টর্চ, আর সারি সারি রাখা বাঁশির ছবি, সে-ও আমার সত্তরের দশক।
সেদিনের সেই মফস্সলি, শান্ত আর অন্তর্মুখী বালকটি আজ ষাটোর্ধ্ব। তার হাতে এসে গেল সুপ্রিয় চৌধুরীর লেখা এক নন ফিকশন। নাম— ‘আঁজলায় ধরে থাকা ৭০’। না, এই বই সত্তর দশক আর বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ নিয়ে কোনও বিশ্লেষণী নিবন্ধ নয়৷ চব্বিশটি ছোটো ছোটো চুম্বকের মত স্মৃতির আলাপ এই বই। এমন একজনের লেখা, যিনি তাঁর সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ জীবনটাকে বাজি রেখে ঝাঁপ দিয়েছিলেন আগুনে৷ তাই, এই স্মৃতিলেখা পরোক্ষ নয়৷ বরং এক ব্যাক্তির ব্যাপ্ত জড়িয়ে থাকার স্মৃতি-আকর।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
সুপ্রিয় বাবুর লেখনী বেগবান৷ পঞ্চাশ বছরের দুরত্বে দাঁড়িয়ে, তিনি যে সত্তরের স্মৃতিকে দেখেছেন এই বইয়ের টুকরো আখ্যানের মধ্যে, সেই দেখায় আর নেই বিদ্বেষের ঝাঁঝ৷ তাই বোধ করি, এক অশান্ত সময়ের টুকরো ব্যক্তিগত ছবিকে তিনি জীবিত করতে পারলেন, দূরের প্রেক্ষণী দিয়ে, হিউমারের আধারে। পরিচয় করালেন এমন এমন আশ্চর্য চরিত্রের সাথে, যাঁরা অনেকেই আজ বিস্মৃত প্রায়। সেই সব আশ্চর্য চরিত্র, যাদের মধ্যে স্বপ্ন দেখা, জীবন বিসর্জন দেওয়া স্ট্রিট ফাইটাররা যেমন আছে, আশুবাবুরা যেমন আছেন, সদ্য প্রয়াত প্রতুলবাবু আছেন, তেমনি আছেন বিরোধী শিবিরের অদ্ভুত কিছু মানুষ, যেমন রূপদর্শী, গৌরকিশোর ঘোষের মত নির্ভীক লেখক ও সাংবাদিক৷ আছেন, ‘চিনে বাঘার’ মত কোনও কংশাল, যিনি আশ্রয় দিয়ে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন কিছু বিপন্ন বিপ্লবীকে। লেখকের হিউমারের পরিচয় মেলে প্রতিটা লেখার শিরোনামে।
এই বই চরিত্রে জার্নাল ধর্মী। স্মৃতিতে অনুপুঙ্খ ধরে রাখার বর এই লেখক কোন ভূতের রাজার কাছে পেয়েছিলেন তিনিই জানেন৷ সে প্রসাদ ছাড়া এমন বই লেখা সম্ভব ছিলনা। চরিত্রে সমান্তরাল ক’টি বই, যেমন শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’ অথবা স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘সাদা কাক’। এই লিখন-চরিত্র লেখক সুপ্রিয় চৌধুরীর হাতের ম্যাজিক৷ যিনি তাঁর যে কোনও লেখাকে বেগবান আর ‘আনপুটডাউনেবল’ করে রাখতে পারেন।
এই বইটা সুপ্রিয় বাবুর লেখনীর সিগ্নেচার বহন করেও বিশিষ্ট, তার কারণ এই বইয়ের বিষয়।
সত্তর এর অশান্ত দশক, বহু ঔপন্যাসিকের উপজীব্য হয়েছে৷ যেমন- সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’, অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘আট টা ন'টার সূর্য’ অথবা, ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘লোল্যান্ড’। মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’-কেও ভোলা সম্ভব নয়৷ সুপ্রিয় চৌধুরীর প্রথম যে উপন্যাস ‘দ্রোহজ’, সেটিও নকশাল আন্দোলনের পটভুমিতেই লেখা হয়েছিল। মনে পড়বে আজিজুল হকের ‘জেলখানার নোট বই’ অথবা ‘নকশালবাড়ি, তিরিশ বছর আগে ও পরে’- র কথা।
বৈশ্বিক ইতিহাসেও বিপ্লবীদের স্মৃতিকাহিনী কম নেই৷ রোজা লুক্সেমবার্গ-এর ‘জেলখানার চিঠি’ বা চেক বিপ্লবী Alexander Dubec এর ‘Hope Dies last’-এর কথা মনে করা যেতে পারে৷ ভোলা যাবে না চে গুয়েভারার ‘Memoir’-এর কথাও।
এই সমস্ত বইয়ের মিছিলে, সুপ্রিয় বাবুর বইটিও ঊজ্জ্বল সংযোজন হয়ে থাকে লেখকের ব্যক্তিগত স্পর্শের উষ্ণতার জন্যে৷ একটা উত্তাল আর নির্ভীক সময়, যাকে লেখক ‘আঁজলায়’ যত্ন করে ধরে রেখে দিলেন চব্বিশটি লেখার পরিসরে, তার মূল্য বড় কম নয়।
ফেলে আসা একটি যুগ, যার আগুন প্রায় নিভে গেছে, কিছু স্ফুলিঙ্গ আজো জ্বলছে হয়ত এদিক ওদিক, সেই ফেলে আসা সময়ের ছাইটা আজ এই মুহূর্তেও যাদের কাছে নেড়ে চেড়ে দেখা প্রাসঙ্গিক মনে হবে, সুপ্রিয় বাবুর বইটি তাদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন