preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি!
ডায়াস্পোরা

রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি!

ডায়াস্পোরার বাঙালির সাধারণ যাপনের মধ্যে ফাঁক-ফোকর দেখা হয়েছে এই লেখায়। সে অর্থে এ লেখা তিক্ত, কিঞ্চিৎ কটু, জীবনের মতনই।

সেই রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শিরোনাম করতে হলো। বাঙালির বিতর্ক ও বিশ্বাসে, কলহ ও কালচারে, বাইরে ও বারান্দায় তিনি ঢুকেই যান। উপায় থাকে না।
তবে এটাও ঠিক যে, প্রবাসী বাঙালিদের কিছু বলতে হলে, ছলেকৌশলে খানিক ‘ইংরেজি’ গুঁজে দিলে কাজ হয় ভাল! আমি এটাকে বলি ‘এন আর আই সিম্পটম’। এমনিতেই প্রবাসী বাঙালি হলো একটা আজব প্রজাতি, বিদেশ-বিশ্বের সর্বত্র তাদের একই অ্যানাটমি ও মরফোলজি। তাদের তামাশার উপসর্গ ও রোগসংক্রমণও অভিন্ন। অভিবাসী হিসেবে পরবাসে পড়াশোনা ও পেশার লড়াইয়ের পাশাপাশি, বাঙালি আরেকটা ‘প্যারালাল’ পটভূমিতে আপসহীন যুদ্ধ করে। সেটা হলো যত দ্রুত সম্ভব ‘বাংলা’ ভুলে যাওয়া। আর এই আত্মবিস্মৃতির সবচেয়ে সেরা ও সহজ রাস্তা হলো বাংলাভাষাটাকেই ভুলে যাওয়া। অথচ সেই প্রবাসী বাঙালিরাই ‘বেঙ্গলি কালচার’-এর কথা উঠলে একেবারে পুরনো প্রেমের মতো নস্টালজিক হয়ে পড়ে। তখন সেই ঢুলু ঢুলু চোখের ‘কালচারড’ বাঙালিকে, সেই ‘শুক্তো চচ্চড়ি খাইতে গর্ববোধ করি’ বাঙালিকে, বুটিকের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালিকে কে বোঝাবে যে, বাপু হে, যে কোনও কালচারের সর্বোচ্চ শক্তিটা হলো ল্যাঙ্গুয়েজ! ভাষা ভুলে ‘কালচার’ করা মানে ‘ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মা’র মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া’!
প্রবাসী বাঙালি নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছি, এবং আমেরিকায় থাকি, তাই নিজের নিরাপত্তার জন্য এই আলোচনায় আগে-ভাগে কিঞ্চিত ‘আমেরিকা’ আর ‘ইংরেজি’ চেলে রাখি। আবিশ্বের সাংবাদিকতায় প্রবাদপুরুষ হলেন সদ্য প্রয়াত হ্যারল্ড ইভান্স। ব্রিটেন থেকে অল্প বয়সে আমেরিকায় চলে এসে ‘বিখ্যাত’ হয়ে যাওয়ার পর উনি একটা বই লিখেছিলেন। ‘ডু আই মেক মাইসেলফ ক্লিয়ার? হোয়াই রাইটিং ওয়েল ম্যাটার্স’ নামের এই ‘চটি’ গ্রন্থটি সাংবাদিকতার শিক্ষাজগতে বিশ্ববিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটন ডিসি-এর ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে ওই কিংবদন্তির সঙ্গে মাত্র তিন মিনিটের কফি মিটের সুযোগ হয়েছিল আমার। বাংলা সাংবাদিকতা ছেড়ে চলে আসা আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় লজ্জাটা আমি পেয়েছিলাম সেদিন তাঁর শেষ কথাটায়। হ্যারল্ড বলছিলেন, ‘আমি তাকেই শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক বলে মনে করি, যে মাতৃভাষায় সাংবাদিকতা করে’!

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

সেদিন অনেকক্ষণ ধরে, মাথা হেঁট করে আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, মাতৃভাষার সঙ্গে কৃতি সাংবাদিকতার সম্পর্কটা কী? এবার সভয়ে একটা বাংলা বইয়ের নাম লিখি। ভয়ের কারণ, প্রবাসী বাঙালিদের একটা সুবৃহৎ অংশই বই পড়ে না। পড়লেও পড়ে ইংরেজি বই, কারণ তাতে পেশায় এবং বেঙ্গলি কমিউনিটিতে মর্যাদা বাড়ে। বাংলা বই পড়লে কেমন যেন গরিব গরিব কিংবা আনকালচারড লাগে। আমি একটা ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছিলাম, তাতে মূল প্রশ্নটা ছিল, ‘বাংলা বই পড়েন না কতদিন?’ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবাসী বাঙালির কাছ থেকে দৃশ্যতই গর্বিত উত্তর পেয়েছিলাম, ‘যতদিন থেকে এন আর আই, ততদিন থেকে বাংলা বই নাই’! যাকগে, যে বইটার কথা বলছিলাম, নীরদচন্দ্র চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালী’। ওই পুস্তকটিতে আমি হ্যারল্ডের মতামতের কাছাকাছি একটা তত্ত্ব পেয়েছিলাম। কাজেই আমি বেশ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিলাম যে, একজন সাংবাদিককে কীর্তিমান হতে হলে তাঁকে নিজের ভাষা, শিল্প, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পারঙ্গম হতে হবে। তাঁকে জানতেই হবে নিজ ভাষার বাগধারা, প্রবাদ, প্রবচন, এবং এমনকি ‘জোকস’-ও। আমি দেখেছি, বিশেষ করে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানের দিন, প্রবাসী বাঙালিরা হঠাৎ করে ‘রুট রুট’ বলে চেঁচাতে শুরু করে। ‘কালচার কালচার’ করে পাগল হয়ে ওঠে। অথচ তারা এটাই জানে না যে, শিকড়টা কোথায়? সংস্কৃতিটা কী? আর জানলেও, ভুল জানে!
প্রবাসী বাঙালিদের ধারণা, বছরে একবার পঁচিশে বৈশাখ কিংবা পয়লা বৈশাখটাই তথাকথিত ‘রুট’ বা বাঙালিয়ানা! বছরে একবার পিঠেপুলি বা তালের বড়া মানেই ‘সো কলড কালচার’ বা বাঙালিত্ব! পরবাসে চালু ধারণা হলো, নাচতে গাইতে জানলে অথবা এক দু’বার হাসির নাটক করলেই ‘হেব্বি কালচারাল’! অথচ বাঙালিত্ব বা বাঙালিয়ানা হলো একটা কনসেপ্ট, একটা দর্শন, একটা মূল্যবোধ। এবং সবচেয়ে বেশি করে একটা ‘বিদ্যা’, যা বুকের ব্যালকনিতে থাকে, মাথার মধ্যবর্তী হয়ে থাকে। আর ওই বিদ্যাটা থেকে আপনি উদ্ভাসিত হয় সংস্কৃতি, তাকে আয়োজন করে লোক-দেখাতে হয় না। রবি ঠাকুর বলেছিলেন আসল কথা, ‘হীরেটাকে বলি বিদ্যে, আর তার থেকে ঠিকরে আসা আলোটাকে বলি কালচার’! ভুল পথের পথিক প্রবাসীরা বিশ্বাসই করে না যে, নাচ গান নাটকেরও শিক্ষা লাগে, পড়াশোনা লাগে, চর্চা বা রেওয়াজ লাগে। প্রবাসীরা বিশ্বাস করে, ক্যারিওকি বাজিয়ে বেতালে বেসুরে একটু মিনমিন করলেই গান হয়ে যায়। ইউটিউব দেখে বলিউডের টুকলি করে কোমর নাড়ালেই সেটা নাচ। নাটক মানেই ভাঁড়ামো। মজার কথা, ওই ধরণের ‘নকলি’ নাচিয়ে নাটুকে গাইয়েরা ‘পারফর্ম’ করার পরে ‘গ্রেট জব’ অভিধা সহকারে তাদের গণ-আলিঙ্গনের পালা শুরু হয়ে যায়। কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করলেই হলো, সবাই হামলে পড়ে বলবে, ‘আহা, কালচার তো! করছে তো কিছু একটা’। সেখানেই শেষ নয়, ওই ‘অন্যায়’ সমালোচনার পরে, অপরাধের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে, সমালোচক ছয় থেকে বারোমাস কোনও পার্টিতে ডাক পাবে না। আর কে না জানে যে, প্রবাসীরা কতটা ‘ভাল’, তার বিচার হয় পার্টিতে আমন্ত্রণের সংখ্যা দিয়ে। অর্থাৎ, পার্টিতে নিমন্ত্রণটাও ‘বেঙ্গলি কালচার’, বাঙালির ‘রুট’!
কথায় কথায় আরেকটা কথা বলে প্রবাসী বাঙালিরা। ‘আমরা মশাই গ্লোবাল’! সাধারণত, এই শব্দটার অর্থ ‘আন্তর্জাতিক’। কিন্তু বাঙালিদের কাছে বহু ইংরেজি শব্দের বাংলা মানে নেই। কাজেই ‘গ্লোবাল’ কথাটার ইংরেজি ‘সিনোনিম’ হলো আসলে ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’! কী রকম? বাৎসরিক ‘ফ্লু শট’-এর মতো বাঙালিদের পয়লা ও পঁচিশে বৈশাখের ‘পার্টি’-তে প্রায়শই চরম ফুর্তির সঙ্গে হিন্দি গান গাওয়া হয়। মাঝেমধ্যেই সাউন্ড সিস্টেমে হিন্দি গান বাজিয়ে, তার সঙ্গে মুম্বইমার্কা কটিকম্পন হয়। প্রবাসী বাঙালিদের কাছে এটাই ‘রুট’। ওই সব অনুষ্ঠানে কোনও অতিথি শিল্পী গাইতে এলে, খুব কষ্ট করে গোটা কয়েক বাংলাগান শোনার পরেই তাঁকে ‘হিন্দি হিন্দি’ বলে জ্বালিয়ে মারা হয়। এটাই বাঙালির ‘কালচার’। অথচ কোনও বলি-আর্টিস্টের অনুষ্ঠান দেখতে গেলে সেই বাঙালিই কত লক্ষ্মীছেলে হয়ে নেচে-কুঁদে মরে! কারণ ওখানে ‘বাংলা বাংলা’ বলে চেঁচালেই হিন্দিওয়ালারা শূলে চড়িয়ে দেবে! বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে এমনও দেখেছি যে, গৃহকর্তা বাড়িতে ‘বার’ খুলে দিয়েছেন। ‘হ্যাপি নববর্ষ’-এর সঙ্গে ‘হ্যাপি আওয়ার’! কেয়া কম্বিনেশন! মিষ্টি দই আর রসগোল্লার মতো মদও কি বাঙালির কোনও নতুন ‘রুট’? না না, এটা বাঙালির ‘কমিউনিটি কালচার’! এটাও ধ্রুপদী বাঙালিয়ানা, এটাই মার্গীয় বাঙালিত্ব!
এরকমই একটা বাঙালিত্ব হলো, বাংলাভাষার জলাঞ্জলি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আবার একটা সহজ রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। সরল মনে উনি বলে ফেলেছিলেন, কেউ যদি মাতৃভাষা ভুলতে চায়, তাহলে সেটা একদিনেই পারে। আর ভুলতে না চাইলে, একশ’ বছরেও পারে না। ব্যাস, ‘ডলারায়িত’ বাঙালি প্রথম পথটাই বেছে নিলো। কে যেন বাংলায় হ্যাংলামি দেখাতে একটা আঁতেল মার্কা গান বেঁধেছিল, ‘আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’! হিন্দি এবং ইংরেজি ‘বলিতে গর্ববোধ করি’ গোছের বাঙালি বলল, গানে-টানে ঠিক আছে, কিন্তু বাস্তবে ও সব পুরা বাকোয়াস, রাবিশ। জন্মসূত্রে বুদ্ধিজীবী প্রবাসী বাঙালি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিলো, কৃতি বাঙালি হয়ে উঠতে হলে ‘ইংরেজি ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ আর হিন্দি সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’! কমপক্ষে জীবনের প্রথম প্রায় আড়াই থেকে তিন দশক মাছ-ভাত-মিষ্টির বাংলায় কাটিয়ে, আমেরিকায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই মাতৃভাষা ভুলে গেলো বাঙালি। প্রবাসী বাঙালিদের ভাবখানা এই যে, ফেলে আসা বাংলায় সব স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই ‘কনভেন্ট’, বাংলা বললেই ‘জিরো টলারেন্স’! সেই সব ‘মেম-সাহেব’ বাঙালি আমেরিকায় বসে গ্রহের ফেরে কখনও কোনও অপ্রকৃতস্থ মুহূর্তে একটা ইংরেজি বানান বা বাক্য ভুল লিখে ফেললেই কমিউনিটির লোক-আদালতে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। দ্রুত ভুল বুঝতে পরে, নাক-কান মুলে ক্ষমা চেয়ে, ইংরেজিতে ‘সরি’ বললে, ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। আর বাঙালি বাংলা বানান ভুল লিখলে প্রবাসের ‘হল অব ফেম’-এ জায়গা সুনিশ্চিত। খুব দায়িত্ব নিয়ে বলছি, শুদ্ধ বানান ও ঝরঝরে বাংলায় তিনটি বাক্য লেখার মতো বাঙালি মার্কিন মুলুকে বিরলতম, যদিও তাদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বাংলা মাধ্যমের ‘প্রোডাক্ট’। কয়েক পিস ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ বাঙালি অবশ্য এখনও আছে, যারা ব্যক্তিগত বার্তা (টেক্সট, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ) লিখতে গিয়ে কেবলমাত্র বাংলাই ব্যবহার করে। এই করুণ সংখ্যলঘুদের ব্যঙ্গ করে সংখ্যাগুরু ‘ইট ইন, স্লিপ ইন, ড্রিম ইন ইংলিশ’ বাঙালি বলে, ‘ইংলিশে ক্লিশে’!
আর যে প্রবাসী বাঙালিরা ‘ইংলিশে মিশে’ আছে, তাদের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কির বাণী হোল, ‘মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে ভিনদেশি ভাষায় হস্তক্ষেপ একটি সামাজিক বিচ্যুতি’। কিন্তু এ সব তো তত্ত্বকথা। এন আর আই বাঙালি ইংরেজির লেজ ধরে ‘বিশ্বজনীন’ হতে চায়, যেটা আসলে হীনমন্যতার ভালনাম। এনারাই ‘এন আর আই’, যারা কত পবিত্রতার সঙ্গে হিন্দি বলে! অবাঙালি কারও সঙ্গে কথা বলার সময়, অপরপক্ষ যখন স্বভাবতই ইংরেজিতে শুরু করেছে, প্রবাসী বাঙালি তখন সাত তাড়াতাড়ি হিন্দি-বন্দি হয়ে যাবে। এটা বাঙালির ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’, যার ডাকনাম আত্মদৈন্য। কোনও হিন্দিভাষী যখন ভুলভাল উচ্চারণ ও ব্যাকরণে বাংলা বলে, বাঙালি তখন ‘সো সুইট’ বলে গলে জল! কিন্তু কোনও বাঙালি যখন ভুলভাল উচ্চারণ ও ব্যাকরণে হিন্দি বলে, বাঙালি তখন অপমানে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়! এই প্রবাসী বাঙালিরা উৎসবে অনুষ্ঠানে পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দিয়ে জোর করে বাংলা কবিতা বলায় বা বাংলা গান গাওয়ায়। তাদের জঘন্য বাংলা অ্যাকসেন্ট সত্ত্বেও, ‘সো কিউট’ বলতে বলতে তাদের বাঙালি মা-বাবা বগল বাজায়। তবু কেউ তাদের বাংলাটা ঠিকমতো শেখাবে না। খুব সচেতন ভাবে বলছি, মার্কিন মুলুকে বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে বাড়িতে বাংলায় কথা বলা অভিভাবক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর এক উচ্ছিষ্ট সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘এ বি সি ডি’ (আমেরিকা বর্ন কনফিউজড দেশি) কচিকাঁচাগুলোর মধ্যে! আঙ্কেল আর আন্টি! অদৃশ্য হয়ে গেছে কাকু-জেঠু-মামা-মাসি-পিসির মতো সেই সব মধুর সম্ভাষণ! অথচ ওই সব সম্বোধনের মধ্যেই ছিল বাংলার অনুপম সংস্কৃতি। যারা এই সংস্কৃতি ভুলিয়ে দিলো, সেই অভিভাবকদের জীবনে কিন্তু আলো হয়ে ছিল সেই সব মন ভালো করা ডাক, রাঙাপিসি, মিষ্টিমাসি, কুট্টিমামা, ভালকাকু, চিনিবৌদি, দিদিভাই, দাদাভাই! একটু ন্যাকামি হলেও এখানে এক ছটাক রবি  ঠাকুর সেঁটে দিই। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক থাকাকালীনই বলরাজ সাহনি কবি হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন। পরে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে যান। এবং ইংরেজিতে কবিতা লিখে তিনি লন্ডনেও সুখ্যাত হয়ে যান। ওই সাফল্যের সময়ে বলরাজকে লেখা একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মাতৃভাষায় কবিতা লেখো। রক্ষিতা যতই সুন্দরী হোক, সে বউয়ের ভূমিকা নিতে পারে না’!
আমেরিকায় ট্যাক্স ফাইল করার মতোই ফি বছর ‘রুট’ খোঁজা বাঙালি একটা বিরাট কালচারের চাষ করে। বঙ্গসংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, গাদাগুচ্ছের ডলার ফুঁকে দিয়ে করা সেই বাঙালিয়ানার কী ডমক চমক, কী জেল্লা কী জমক! লোকারণ্য, মহাধূমধাম, দেদার খানা, শাড়ি-গয়নার বিপুল সম্ভার। অথচ এই বাঙালিত্বের দালালরা জানেই না যে, মার্কিন প্রবাসী কোন কোন বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র বা সাময়িকপত্রে নিয়ম করে বাংলা লিখছেন। কিংবা কোন কোন এন আর আই বাঙালি একটা ইংরেজি-প্রধান দেশে বসবাস করেও ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ পরে নিয়মিত বাংলা বই লিখছেন। বাংলা কালচারের ওই প্রমোটাররা খবরই রাখে না যে, মার্কিনবাসী ক’জন বাঙালি সন্তান-সন্ততি ইংরেজিতে লেখালেখি বা গানবাজনা করে জাতীয় স্তরে আমেরিকানদের তারিফ পাচ্ছে! বাংলা কালচারের ওই ‘বাৎসরিক’-এ শুধুই বাঙালিত্বের বাওসা হয়! বাঙালিয়ানার অনুসারী শিল্প হিসেবে ‘রুট’ খুঁজে পাওয়া বাঙালি ওই মহামানবের পুণ্যসাগরতীরে তারকাশিল্পীদের সঙ্গে সেলফি তোলে আর ফেসবুকে পোস্ট দেয়। এ সব বছরে মাত্র তিন দিন। তার মধ্যে একদিন আবার বেশি টিকিট বিক্রির জন্য একখান বলিউড লটকানো থাকে। প্রবাসী বাঙালিদের বাকি সময়টুকু শুধুই কন্টিনেন্টাল আর হিন্দিনেণ্টাল! বাংলা ভাষা যখন গেছে, তাহলে সামাজিক উৎসব আচারানুষ্ঠানই বা বাদ যাবে কেন! বিয়ের প্রীতিভোজ বা বউভাত এখন রিসেপশন। সঙ্গে দোসর মেহেন্দি আর ‘সাঙ্গিত’! নহবতের বদলে ডিজে, যা আসলে হিন্দিতে কোমর দোলানোর গোডাউন! আহা! আমাদের নকল করা ‘রুট’, আমাদের ‘সকল দেশের সেরা’ কালচার!
তা বেশ! আমেরিকায় এসে বাঙালি না হয় বিশ্ববোদ্ধাই হল! কিন্তু তাঁর জন্য শিকড় কাটতে হবে কেন? মূলটা ছিঁড়ে দিলে, গ্রিন হাউসে নিয়ে গিয়েও কোনও গাছকে বাঁচানো যায় না! বৈভবে বিলাসে বিত্তে মত্ত এন আর আই বাঙালির সেদিকে নজর দেওয়ার ফুরসতই নেই! কিন্তু তাহলে অমন ঘটা করে বাঙালিয়ানার ‘রুট’ কিংবা বাঙালিত্বের কালচার, এ সব ফাঁকা আওয়াজের কোনও দরকার ছিল কি? বাড়িতে বা বাঙালি কমিউনিটিতে একটু ‘বাংলা বাংলা’ করলে কি আমেরিকানরা প্রবাসী বাঙালিদের ডলার দেওয়া বন্ধ করে দিতো? আমি বুঝি না, পরবাসের বানানো শর্তে এই আত্মবিস্মৃতির কি কোনও দরকার ছিল? কী ক্ষতি হতো, আমরা যদি অন্তত আপনঘরের অন্দরে অন্তরে আমাদের ‘রূপসী বাংলা’ নিয়ে থাকতাম? ‘আম্রিকা’-এর আফিম খেয়ে বাংলার ভাষা শিল্প সংস্কৃতি, সব ভুলে গেলাম আমরা!
হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, তবু তারাপদ রায়ের একটা রচনাংশ মনে পড়ল, ‘এ সব কথা ভুলে যাওয়া যায় না, মনে রাখাও সম্ভব নয়। চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে একজন আরেকজনকে বলছে, এই কি জীবন, কালীদা? এ সব ঠিক মনে রাখার বা ভুলে যাওয়ার নয়। থাকে অথবা হারিয়ে যায়। কারও কিছু আসে যায় না’!

 


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

তরুন গোস্বামী

6 মাস আগে

খুব সুন্দর লেখা। আমি নিজে একজন reporter


Image Description

দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

6 মাস আগে

একেবারে চাবুক লেখা। আধুনিক বাঙালি প্রজন্মের এই স্বরূপ উন্মোচন অত্যন্ত জরুরি। বাঙালির আত্ম-বিস্মরণ ও পরানুকরণ নিজস্ব সংস্কৃতি সংহারের মূল কারণ। আরও এক বড় কারণ আত্মশ্রদ্ধার অভাব। পেশা ও ক্ষমতার ভাষার সঙ্গে প্রাণের ও আবেগের, নিজস্ব জ্ঞান ও আবেগের ভাষা গুলিয়ে ফেলা সুশিক্ষার চিহ্ন বহন করে না।


Image Description

পার্থ প্রতিম রায়

6 মাস আগে

বাঙালি শুধু প্রবাসে নয়, নিজের নাক কাটাকে সে স্বদেশেও গর্বের সাথে উদযাপন করে। বঙ্গ সন্তানের সন্তানেরা বাংলাভাষা শিক্ষা কে বর্জন করে আধুনিক আর 'কর্পোরেট' হবার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই বাঙালি বিজ্ঞানী হলেও অক্ষয়কুমার দত্তের নাম শোনেনি, পড়া তো দূরের কথা। প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন শুনলে এরা অবাক হয়, আর সত্যেন বোস-মেঘনাদ সাহা মিলে জার্মান থেকে ইংরেজি তে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি গ্রন্থের সর্বপ্রথম অনুবাদ করেছিলেন শুনেও নিজেদের ইঙ্গবঙ্গামি নিয়ে লজ্জা পায় না। আপনি মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছেন। খুব সময়োপযোগী অপূর্ব লেখা।


Image Description

Sumita

6 মাস আগে

Sotti Khub Bhalo laglo …Ainata Jodi Mukher Samne dhore rakha jai tokhon nijer sikorer taantao proti niyoto onubhab ey thake . Apnar lekhar Khub onuragee ami


মন্তব্য করুন

লেখক

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় সাংবাদিকতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর স্নাতকোত্তর, যদিও স্নাতকস্তরে তিনি বিজ্ঞানে সাম্মানিক। কলকাতায় সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন। ছাত্র রাজনীতি করেছেন, সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেছেন লিটল ম্যাগাজিন আর গ্রুপ থিয়েটারের সাথে। নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন বেতার ও দূরদর্শনে। এখন কর্মসূত্রে সপরিবারে আমেরিকা প্রবাসী। এখনো নিয়ম করে লেখেন কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন