বাতাসে ছড়াচ্ছে আফিমের গন্ধ, এটা মাহাতো জানেন। এখন যারা পাওয়ারে আছে তাদের কাজই হচ্ছে ‘পোলারাইজেশন’ করা এবং সেটাকে প্রতিমুহূর্তে লালন পালন করা। কাজেই, মরা শুয়োর অথবা গরু নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবিত নন তিনি। বরঞ্চ, এখন অনেক বেশি চিন্তা হচ্ছে সেই দু’জনকে নিয়ে, যারা রাতের অন্ধকারে বসে মিটিং করে গেছে, আবদুলের বাড়িতে। কারা এরা! আবদুলের বাবাও যাদের চিনতে পারেননি! কোন অপারেশনের কথা বলেছে ওরা! এদের হাত দিয়েই ‘গ্লক’ সিরিজের রিভলভার ঢুকছে না তো চন্দ্রপুরায়?
এই গ্লকের সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছতে পারবে কি বিশ্বামিত্রের খুনির কাছে? দেখাই যাক...
বাষট্টি
চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।
বিশ্বামিত্রের শেষকৃত্য সেরে চন্দ্রপুরা থানায় যখন ফিরে এল সুজয় মাহাতো অ্যান্ড কোম্পানি তখন বেশ বেলা। ঘরে ঢুকেই চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিলেন মাহাতো। সারা দিন খুব ধকল গেছে। বড় ক্লান্ত লাগছে এখন। উল্টোদিকে বসে আছে স্বপ্ননীল। সেও খুব ক্লান্ত। কিন্তু সে এখনও জানে না, এই ক্লান্ত শরীরটা বয়ে নিয়েই তাকে আবার খানিক বাদে যেতে হবে এক অমোঘ নিয়তির দিকে। যেভাবে কাচপোকা ধায় আগুনের পানে।
না, আজ সকাল থেকে একটা ফোনও আসেনি উপর মহল থেকে। কিন্তু আসতে কতক্ষণ? শুধু এসপি নন, ডিজিও ফোন করতে পারেন যখন তখন। কারণ খাতায় কলমে প্রায় তিনদিন হতে চলল। তবে ওইসব নিয়ে আর ভাবছেন না মাহাতো। তাহলে মাথা থেকে আসল চিন্তাটাই হারিয়ে যাবে। ভাবতে হবে। বারে বারে ভাবতে হবে।
সব কাজের ফাঁকে ‘এ জি সি টি’ অক্ষরগুলোই মাহাতোর ধূসর মস্তিস্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে খালি। এখন আবার কেন যেন সরস্বতীর বলা কথাগুলোও মনে পড়ে। কোনও ক্লু যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। যা পাওয়া গেছে সেগুলি নিয়েই চিন্তা করতে হবে। পর পর সাজিয়ে দেখতে হবে সূত্রগুলোকে।
চোখ বুজতেই, মাথার অন্ধকারে লাইনগুলো ভেসে ওঠে। যা সরস্বতী বৈগা বলেছিল। বেশ জোরে জোরে আবৃত্তির ঢংয়ে বলতে থাকেন সুজয়। পুলিশের মুখে কবিতা! তাও আবার এই অসময়ে! হতবাক নীল,
একা নই আমি / আরও আছে দুজন / যারা বড় দামি...
বৈগা পাড়ার সরস্বতীকে নিজের মেয়ের মত ভালোবেসেছিলেন বিশ্বামিত্র। তাকে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি, সেটা তার অন্তরের কথা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যত সময় যাচ্ছে তত এটাই মনে হচ্ছে যে, বিশ্বামিত্রবাবু নিজের উপর হামলা হতে পারে এইটা আশঙ্কা করে, নানা জায়গায় নানা রকম সূত্র ছেড়ে গেছেন। আর তার এই ম্যাসেজের যদি সত্যি কোনও অর্থ থেকে থাকে, তাহলে এটা ধরে নিতেই হবে যে খুনিরা, বিশ্বামিত্র ছাড়াও আরও দু'জনকে টার্গেট করে রেখেছে। কে সেই দুজন!
বিশ্বামিত্র-বাল্মীকি—আছে আরও একজন, যারে প্রলয়ঙ্কর মানি...
একটা সিগারেট ধরান মাহাতো। হাঁ করে তাকিয়েছিল নীল। ওকে বলেন,
“না। কবিতা নয়। এটা একটা ম্যাসেজ, যেটা একজনকে পাঠিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র। এইটার মধ্যে কোনও রহস্য থাকলেও থাকতে পারে, কী বলেন?”
স্বপ্ননীল কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সুজয় অন্য কথায় যান, “যাই হোক, আজ দুপুরের মত চান খাওয়ার ব্যবস্থা থানাতেই করা হয়েছে। রাতের রাঁচি হাতিয়ারাতেই নিশ্চয়ই আপনার ফেরার রিজার্ভেশন? সন্ধ্যায় বেরোলেই হবে। আমি, মহাদেব অথবা বিজিতকে বলব, আমাদের গাড়িতে করে আপনাকে স্টেশনে ড্রপ করে দিতে।”
“আমি ভাবছি কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাব।”
নীলের কথায় হেসে ফেলেন সুজয়। বলেন, “ইজ ইট পসিবল! আপনি থাকবেন কোথায়? এক রাত্তির থানায় ঠিক আছে, কিন্তু রোজ রোজ…”
“দরকার হলে হোটেলে থেকে যাব...”
“এটা কলকাতা নয়, যে ইচ্ছে করলেই হাতের মুঠোয় সব কিছু পাওয়া যাবে...”
লম্বা একটা টান দেন সিগারেটে। কথা শেষ করেন, “আর তা ছাড়া হোটেলে থাকা নিরাপদ নয়... আপনার জন্য।”
“আমার জন্য নিরাপদ নয়...! কেন?”
“আপনি এমন একজনের জন্য এই পাহাড় জঙ্গলের দেশে পা দিয়েছেন যাকে মার্ডার করা হয়েছে। আপনিও যে, কখনও টার্গেট হবেন না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? রেলওয়ে ওভারব্রিজ এবং আরও কোথায় যেন, আপনাকে টার্গেট করা হয়েছিল না গত রাতে...?”
“হ্যাঁ। কিন্তু সে কথা আপনি বিশ্বাস করেন নি!”
“আমি বিশ্বাস করেছি কি করিনি সেটা ইস্যু নয়। বড় কথা হল পুলিশ রিস্ক নিতে পারে না। অতএব, আপনার ফিরে যাওয়াটাই বেটার।” কথাটা বলে চোখ বন্ধ করে সিগারেটে আবার দুটো টান মারেন দারোগা। সামনে বসে থাকে স্বপ্ননীল। কিছুটা ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দিতে দিতে মাহাতো কী ভাবেন কে জানে, তবে চোখ খুলে এক অদ্ভুত কথা বলেন, “আচ্ছা আপনার নামটা হল ‘স্বপ্ননীল’। কী তাইতো?”
এ যেন, সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ! পরের প্রশ্ন এসে কানে আছড়ায়, “আপনার নামের শেষে কী আছে না, ‘নীল’। যদি এরকম ধরে নেওয়া হয় নীল মানে ‘নীলকণ্ঠ’ তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
যে যা খুশি ধরতেই পারে। তাতে আবার সমস্যা কী! ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে স্বপ্ননীল। ওসি সাহেবের চোখে রহস্যের মায়াজাল। কেটে কেটে বলেন, “আচ্ছা প্রলয়ঙ্কর মানে কী?”
সকাল থেকে কারোর পেটে দানাপানি সেরকম কিছু পড়েনি। খিদের জ্বালায় বোধহয় সুজয়বাবুর মাথাটা গেছে। কিন্তু ওসি সাহেবের প্রশ্ন বলে কথা। ‘কুইজ’-এ অংশ নিতেই হয় নীলকে, “স্যার আমি বাংলায় অতটা ভালো নই। তবু যা মনে হয় বলি...”
“বলবেন বলেই তো জিজ্ঞাসা করলাম।”
“প্রলয়ঙ্কর মানে, প্রলয় বা ধ্বংস করে যে...”
“বেশ বেশ খুব ভালো। আচ্ছা... হিন্দু দেবদেবীর মধ্যে কাকে সেরকম মনে করা হয়? শিব... শিব কে? যার আর একনাম হল ‘নীলকণ্ঠ’। আপনার নামটা কী...”
অপেক্ষা না করে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দেন দারোগা সাহেব,
“স্বপ্ন...নীইল।” স্বপ্নের পর বেশ বড় করে ‘নীল’ শব্দটা উচ্চারণ করেন। ওইটুকু সময়ই যথেষ্ট, শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেবার জন্য। টেবিলের উপর একটা পেপার ওয়েট। মুঠোর মধ্যে নিয়ে চাপ দেয় নীল। ঠিক। হিসেব মিলে যাচ্ছে।
বিশ্বামিত্র আগেও বলছেন, ‘রেফারেন্স’ যাঁরা আছেন তারা টার্গেট হতেই পারেন, কিন্তু সেটা যে উনি অন্য কাউকে পাঠানো এক বার্তায় লিখে যাবেন এবং সেই বার্তা, অক্ষরে অক্ষরে মিলেও যাবে এইটা ভেবেই হতবাক হতে হচ্ছে।
এখানে পা দেবার পর, দু-দু’বার মার্ডারের অ্যাটেম নিয়ে, সন্দেহের আর কোনও অবকাশই আর থাকল না তবে...। সত্যি সত্যিই খুন করার চেষ্টাই করা হয়েছিল স্বপ্ননীলকে। চিন্তা করার শক্তিটাই উত্তেজনায় যেন লুপ্ত হয়ে যেতে চাইছে নীলের।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
তেষট্টি
চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।
“স্যার আপনার সাথে একজন বয়স্ক লোক দেখা করতে এসেছেন...”
দরজায় হাজিরা কনস্টেবল সুরিন্দর। দারোগা বলেন, “কে? নাম কিছু বলেছে?”
“না, নাম কিছু বলেনি। বলল যে আপনার সাথে বিশেষ দরকার।”
কী যেন খানিক চিন্তা করেন সুজয়। তারপর বলেন, “ঠিক আছে পাঠিয়ে দিন।”
সুরিন্দর ঘুরে দাঁড়ালে আবার ডাকেন সুজয়, “আর হ্যাঁ... আমার জন্য একটা চা আর বাটার টোস্ট পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ।”
“ঠিক আছে স্যার।”
ফিরে যায় সুরিন্দর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা বয়স্ক গলা কানে বাজে, “আসব স্যার...”
ভদ্রলোককে দু-একদিনের আগেই কোথায় যেন দেখেছেন সুজয়, “হ্যাঁ আসুন...!”
ঢুকে আসেন মানুষটি। সাদা লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি। মাথায় সাদা টুপি। ছুঁচালো দাড়িরও বেশির ভাগটা সাদা, যা গাল থেকে নেমে এসেছে বুক অব্দি। চোখদুটো দেখলে মনে হয়, যেন অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন। একেই কি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চোখ বলে?
টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক।
“বসুন।”
স্বপ্ননীলের পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দেন সুজয়। নীলকে বলেন,
“ঠিক আছে... মি. নীল আপনি এখন যান। গিয়ে চান খাওয়া দাওয়া সেরে নিন। সন্ধ্যাবেলা আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
স্বপ্ননীল উঠে যায়। সুজয় বৃদ্ধ ভদ্রলোককে আবার বলেন, “কী হল বসুন...। আচ্ছা আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি... ইয়েস... কোথায় যেন...”
শ্বেত শুভ্র মানুষটি মিটিমিটি হাসেন। বসতে বসতে বলেন, “কালকেই গিয়েছিলেন আমার বাড়ি!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। আপনি আবদুলের বাবা...। তা একেবারে থানায় দুম করে?”
“কারণ আছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেকগুলো চোখ এড়িয়ে তবে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। আপনার মনে আছে তো আমাদের ওখানে মসজিদে শুয়োর ফেলা হয়েছিল...”
“হ্যাঁ। এটা অনেক পুরনো কায়দা। দাঙ্গা লাগানোর...”
ওসিকে শেষ করতে না দিয়ে নিজের কথা বলেন আবদুলের আব্বাজান।
“আপনাকে আমি বলেছিলাম, ওটা ঐ পালের গোদা সালাউদ্দিনের কাজ।”
“হ্যাঁ বলেছিলেন। কিন্তু তার কোনও প্রমাণ আছে কি?”
“না। প্রমাণ নেই। তবে আমার স্থির বিশ্বাস ও ছাড়া এইরকম কাজ আর কেউ করতে পারে না। আমাদের এইখানে, এখনও হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা সেভাবে হয়নি। কিন্তু এবার হবে।”
“কী বলছেন হয়নি! এই তো কিছুদিন আগে, হনুমান জয়ন্তীর দিন ডি টাইপ ব্রিজের কাছে... মনে নেই আপনার! একজন মারা অব্দি গেছেন...”
“কজন মারা গেছে? না একজন। এইবার এমন কিছু একটা হবে, যাতে একজন-দু’জন নয়, মৃত্যু মিছিল দেখতে পাবেন।”
একটা বেশ স্থির বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছেন ভদ্রলোক। নড়ে চড়ে বসেন সুজয়, “কেন... এরকম কেন মনে হচ্ছে আপনার?”
নিজের অজান্তেই দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে নেন বৃদ্ধ। সুজয়ের গতকালই মনে হয়েছিল, জীবিকার কারণে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বাইরে ছিলেন। ভালো বাংলা বলেন। কোনও দেহাতি টান ছাড়াই। বৃদ্ধ বলে চলেন,
“কাল রাতের অন্ধকারে আমার বাড়ির দাওয়ায় মিটিং হয়েছে।”
“মিটিং! কীসের মিটিং! কেন রাতের অন্ধকারে কেন?”
“দিনের বেলা করলে মুশকিল তাই..., তবে ওটাকে ঠিক মিটিং বললে ভুল বলা হবে, মাত্র জনা তিনেক। আমার ছাওয়ালটাকে নিয়ে অবশ্য চারজন। তবে ও ছিল খুব অল্প সময়। চন্দ্রপুরা টাউনে গিয়েছিল, তাই পুরোটা থাকতে পারে নি।”
“কে কে ছিল!”
“সালাউদ্দিন আর...”
“আর...?”
“অরবিন্দ... আর একজন... আর একজন...”
পরের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারেন না বৃদ্ধ। এইদিকে, দু’নম্বর নামটা শুনে অবাক হয়ে যান মাহাতো। হিন্দু! মসজিদে মরা শুয়োর পড়েছে আর তারই মধ্যে একজন হিন্দু, মুসলিম গাঁয়ে ঢুকে মিটিং করছে! তাও আবার রাতের বেলা। স্ট্রেইঞ্জ!
“আপনি কি ঐ নামে কাউকে চিনতেন আগের থেকে ?”
দু’দিকে সজোরে মাথা নাড়েন বৃদ্ধ, “চেনা তো দূরের কথা, নামও শুনিনি কখনও। তবে গাঁয়ে আগে এসেছে কিনা আমি বলতে পারব না। সর্বত্র তো আর আমার পক্ষে চৌকি দেওয়া সম্ভব নয়।”
সুজয় এইবার একটা বাঁকা প্রশ্ন করেন, “না চিনলে আপনার বাড়ির দাওয়ায় বসে আলোচনা হচ্ছিল কেন?”
রাতের বেলা সালাউদ্দিনকে নিয়ে বেরিয়েছিল অরবিন্দ প্রতিহারী এবং অনন্ত মহাষুর। ‘অপারেশন অনাদি’র জন্য পায়ে হাঁটা পথটা সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিতে। দেখে নিতে চেয়েছিল হাঁটা পথে কী ভাবে পৌঁছানো যায় দুগ্ধায়। ফেরার পথে এসে বসেছিল আবদুলের বাড়ির দাওয়ায়। সেটাকেই আবদুলের আব্বাজান ‘মিটিং’ বলে ধরে নিয়েছেন। যাই হোক তিনি দারোগার কথার উত্তরে বলেন, “কেন আবার...! আমার ঐ গাধাটার জন্যই তো আসে... ওই তো এখন সালাউদ্দিনের এক নম্বর সাগরেদ।”
চা এবং বাটার টোস্ট আসে। একটা চুমুক দিতে দিতে সুজয় বলেন,
“আপনি কি আবদুলের কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ। তা ছাড়া আবার কার!”
“ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল সেটা বলতে পারবেন...”
“ঘরের মধ্যে থেকে, বেশির ভাগটাই শোনা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। তবে ঐ দু’জন হিঁদু হয়েও, হিঁদুদের বিপক্ষেই যে উসকানি দিচ্ছিল সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। না হলে সাল্লুর সাথে ওদের কী আর এমন আলোচনা থাকতে পারে!... আর... একটা কথা বার বার বলছিল...”
“কী?”
“অপারেশনটা হয়ে গেলেই যে কাজ শেষ হয়ে যাবে এরকম নয়। সবে শুরু।”
“অপারেশন! কী অপারেশন!”
“সেটা আমি বুঝতে পারিনি।”
ভ্রু সম্পূর্ণ কুঁচকে যায় দারোগার। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না কোন অপারেশনের কথা বলে হয়েছে। যদি বুঝতেন তাহলে অনাদির শেষ পরিণতি অন্যরকম হতে পারত। এইদিকে, একটু সময় নিয়ে নিজের কথা শেষ করেন বৃদ্ধ, “স্যার...ওদের কথাবার্তা যতটুকু শুনেছি তাতে একটা জিনিস আমি বেশ বুঝতে পারছি...যে মন্দিরে গরু পড়ল বলে। দাঙ্গার আগুন যখন লাগানো হয় তখন দুদিকেই লাগানো হয়, যাতে মাঝের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”
একটা বাটার টোস্টে কামড় বসিয়েছিলেন ওসি। গলাধঃকরণ হয়ে গেলে স্পষ্ট উচ্চারণ তাঁর, “তা আমার পক্ষে কি সব মন্দির মসজিদে পাহাড়া বসানো সম্ভব? ফোর্স কোথায়?”
“সে আমি জানি না। তবে আমার মনে হল আপনাকে একবার জানানো দরকার তাই...। ”
বাতাসে ছড়াচ্ছে আফিমের গন্ধ, এটা মাহাতো জানেন। এখন যারা পাওয়ারে আছে তাদের কাজই হচ্ছে ‘পোলারাইজেশন’ করা এবং সেটাকে প্রতিমুহূর্তে লালন পালন করা। কাজেই, মরা শুয়োর অথবা গরু নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবিত নন তিনি। বরঞ্চ, এখন অনেক বেশি চিন্তা হচ্ছে সেই দু'জনকে নিয়ে, যারা রাতের অন্ধকারে বসে মিটিং করে গেছে, আবদুলের বাড়িতে। কারা এরা! আবদুলের বাবাও যাদের চিনতে পারেননি! কোন অপারেশনের কথা বলেছে ওরা! এদের হাত দিয়েই ‘গ্লক’ সিরিজের রিভলভার ঢুকছে না তো চন্দ্রপুরায়?
‘গ্লক’ সংক্রান্ত যা ভেবেছেন দারোগা তা ঠিকই ভেবেছেন। কিন্তু ‘অপারেশন’ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কোন থই পান না। না পাওয়ারই কথা।
চৌষট্টি
ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।
পঞ্চায়েত থেকে ফিরে মেজাজটা খিচড়ে ছিল রতনের। এই বাপিকে সে আজ নয় কাল ঠিক শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। বাবলা গাছের নীচে খানিকক্ষণ বসে থাকার পর মনে হয় সময় যেন আর কাটছে না। এইদিকে বাবলার গুঁড়ি বেয়ে আধার নামতে এখনও ঢের দেরি।
দাওয়ার সামনে দিয়ে যে কাঁচা রাস্তাখানা চলে গেছে সেটা খানিক দূরে বাঁক নিয়েছে। দু’দিক পানে চলে গেছে দু'খানা মাথা। একটা মন্দিরের দিকে আর একটা ধানমাঠের দিকে। দাওয়ায় বসে পথের পানে চেয়েছিল রতন। যেখানে যেখানে মানুষের পা পড়ে সেখানে ঘাস নেই, কিন্তু তার দু’ধারের সবুজ চোখ জুড়িয়ে দেয়। ওই সবুজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল রতন। মনটা একটু নরম হয়ে এলে সে ভাবছিল এইবার পেট চলবে কী করে। তার মধ্যে আবার একঘরে হলে তো কথাই নেই।
ঘরের দাওয়ায় গোটা চারেক ধানি লঙ্কা গাছ। মেটে আলু সিদ্ধ, সরষের তেল আর একটা কাঁচালঙ্কা। এই দিয়েই দুপুরবেলা দু’থালা সাঁটিয়ে রতন গিয়েছিল মন্দিরে, সদাশিবের ধ্যাষ্টামোপানা মিটিং শুনতে।
পথের একদিকে কয়েক ঘর বৈগার বসবাস। অন্যদিকে খানিক নিচু জমি। ওই জমিতে আকন্দ আর বুনো গাছের ঝোপ। সেই ঝোপের মধ্যে আবার বেশ কিছু খেজুর গাছ। শীত শেষ হয়ে গেছে কিন্তু গাছের গলায় এখনও হাড়ি বাঁধা। দূরে একখানা খেজুর গাছে একটা কোকিল ডাকছিল তারস্বরে। সেই ডাক ছাপিয়ে আরও একটা শব্দ কানে আসে রতনের। বমি করছে সরস্বতী। কিন্তু রতন খুব প্যাঁচঘোচের মানুষ নয়। সেই শব্দে তার ধুনকি কাটে বটে কিন্তু তলিয়ে কিছু ভাবা তার ধাতে নেই। সে উঠে ঘরের পানে যায় ধীরে ধীরে।
বাপের একখানা মাছ ধরার জাল পড়েছিল মাচার উপর। ঘরে ঢুকেই মইখানা লাগিয়ে উঠে পড়ে তড়বড় করে। এককোণায় লটকে ছিল জালটা, ছেঁড়া লেপ কাঁথার পিছনে। নামিয়ে আনে। না, সেরকম কিছু হয়নি, এক ধারে একটা ফুটো ছাড়া। পরমেশ্বর বৈগা নিজে জাল বুনতে পারত কিন্তু রতন ওসব করে নি কোনোদিন। সরস্বতীর কাছ থেকে, খুব সরু একটা লাইলন দড়ি চেয়ে নিয়ে বসে পড়ে বাবলা গাছের তলায়। মেরামতের চেষ্টা শুরু করে। আপাতত এদিক ওদিক বেঁধে ফুটোটাকে ছোটো করে নিতে পারলেই কাজ চলে যাবে। হাঁক দিয়ে ডাকে বোনকে,
“সরস্বতীইই... মোমটা জ্বালিয়ে দিয়ে যাতো একটু...”
“একটাই মোমবাতি পড়ে আছে...”
“কেরোসিনের বাতিটা দিয়ে যা তবে।”
আর কোনও উত্তর আসে না ভিতর থেকে। মিনিট খানেকের মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে হাজির হয় সরস্বতী।
“একটাই আছে বললি...”
বাবলা গাছের নীচে মাটি শুকনো খটখটে। মোমবাতিটা আটকে চলে যায় সরস্বতী। কোনও উত্তর করে না। লাইলনের দড়ি থেকে, ছোটো টুকরো বার করতে হলে, কাটার থেকে পুড়িয়ে নেওয়া সহজ। তাই মোমটা চেয়েছিল রতন।
বৈগাপাড়া থেকে দামোদরের দূরত্ব খুব একটা নয়। এই গাঁয়ের অনেকেই মাছ ধরতে যায় নদীতে। মৎস্য শিকার এখানকার লোকজনের পেশা নয়, তবুও। অনেক সময় বড়সড় পাঙাস ট্যাংরা অথবা ছোটোখাটো কাছিম পাওয়া গেলে, বেচে দেয় চন্দ্রপুরা বাজারে। দু-পয়সা যা পাওয়া যায় তাই লাভ। কাছিম আবার খুল্লামখুল্লা বিক্রি করা মুশকিল। লুকিয়ে চুরিয়ে বেচতে হয়।
নিজের কাজে যখন মগ্ন রতন তখন একটা গলা শুনতে পায়, “হেই শোন এদিকে...”
চোখ তোলে। মোহান্তি ঠাকুর আর তার শাগরেদ বাপি হাঁসদা। চৌহুদ্দির বাইরে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিচ্ছে। এই হারামজাদাগুলোকে দেখে আবার মাথা গরম হয়ে যায়। বসে বসেই রতন বলে, “কী ব্যাপার? এখানে আবার কী করতে এসেছিস বাপি!”
“শোন না এইদিকে..., কথা আছে...।
“বল।”
“কাছে না আসলে বলা যাবে না রে...”
“মন্দিরে রান্নার কাজটা করলে আমি জানিয়ে দেবো।”
“কোন রান্নার কাজ!”
“ঐ যে ছোটলোকদের জন্য যে রান্না হয়, মন্দিরের বাইরে...।”
রতনের কথায় শ্লেষ ছিল। কিন্তু শকুন মোহান্তি গায়ে মাখে না। আবার কাছে ডাকে। অগত্যা উঠে যায় রতন, “হ্যাঁ বলুন কী হয়েছে?”
“তুইও যেমন। আজকের পঞ্চায়েতে তো শেষ অব্দি না থেকেই তিড়িংবিড়িং করে চলে এলি। তোদের তো একঘরে করা হয়েছে রে। তোর রান্না আর কে খাবে...! সে কথা নয়, একটা অন্য কথা বলার জন্য এখন আসতে হল আমায়।”
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।”
“বলছি বোনটাকে একটু সামলিয়ে রাখ...।”
“নৌটোঙ্কির দরকার নেই। কাজের কথা বলুন। কেন কী হয়েছে? মন্দিরে গিয়ে আপনাকে ছুঁয়ে দিয়েছি নাকি...”
পাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বাপি হাঁসদা। কথা বলে এতক্ষণে, “আবদুলের সাথে আগানে বাগানে, মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে খেয়াল রাখিস না তুই! মন্দিরেই তো একবার বললাম কথাটা। খেয়াল করিসনি বুঝি!”
“যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াক, আমি যা বোঝার বুঝে নেব । তুই নিজের চরকার তেল দে। নয়তো...”
হাঁসদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তেড়েমেড়ে। থামায় মোহান্তি। রতনের দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখ আবদুল মুসল্লি...। বৈগা পাড়ার লোক কিন্তু তোদের ছাড়বে না। একঘরে করা হয়েছে তোদের ঠিকই। কিন্তু তাতে তাদের আঁশ মিটবে বলে মনে হয় না। আরও কিছু না করে বসে...।
“আর কিছু আবার কী করবে অ্যাঁ?”
“এই ধর কোনও একদিন রাতেরবেলা ঘরে আগুন দিয়ে বসল...হে হে ...তখন কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবি না।”
একটা ভয় রতনের শরীরের ভিতর মোচড় মেরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য কথাটা বলেছিল সদাশিব মোহান্তি। কিন্তু ফল হয় উল্টো। এই কথায় হাসি পেয়ে যায় রতনের। বলে, “আরে ঠাকুর একটা জিনিস জানেন আপনি?”
কিছু বলে না মোহান্তি। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে রতনের দিকে, যেন একটা গঙ্গা ফড়িংয়ের নিষ্ফল ফড়ং ফড়ং দেখছে।
বলে যায় রতন, “ঠিকাদারের কাজটা যাওয়ার পর বৈগা পাড়ার বেশির ভাগ মানুষের পেটে ভাত নেই… জানেন সেটা? শালা পেটে আগুন জ্বললে কে হিঁদু আর কে মুসলমান, সেই নিয়ে ভাবে কোন খানকির ছাওয়াল! নিজের পেটের আগুন সামলাতেই যে হিমশিম খাচ্ছে সে অন্যের ঘরে আগুন দেবে কখন!”
কথাটা বলে একটু সময় নেয় রতন। তারপর আরও খানিক মিহি করে বলে, “ঠাকুর বারে বারে ঐ এক নকশা আর চলবে না গো। ...আগের বার ক্যাচালটা বাঁধাবার পিছনে যে আপনি ছিলেন সেটা আমি জানি... আর দাঙ্গার জন্যই তো প্ল্যান্টের কাজটা গেল আমাদের... আজ নয় কাল, এটা সবাই বুঝতে পারবে। আর তখন...”
মোহান্তি এবার একটু অন্য খেলা খেলার চেষ্টা করে, “তোর বাপরে যে মারল তার সাথেই তোর বোন ফষ্টিনষ্টি করছে আর তুই চুপ করে বসে আছিস! আর, উল্টে এইসব আজেবাজে কথা বলছিস!”
“আমার বাপরে আবদুল মারেনি।”
এইবার সত্যি সত্যি একটু অবাক হয় শকুন। কথাটা দেখা যাচ্ছে রতন বুঝে গেছে অ্যাদ্দিনে! কিন্তু ভাঙবে তবু মচকাবে না মোহান্তি, “অঃ তাই বুঝি... তাহলে পরমেশ্বরকে কে মারল শুনি!”
আর মুখের আগল থাকে না রতনের। এইবার ‘তুই তোকারি’ শুরু হয়।
“তুই তারে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলি হনুমান জয়ন্তীর দিন। আসলে, আমার বাপরে মেরেছিস তুই... শালা খানকির ছাওয়াল...”
কাজ নেই, পেটে ভাত নেই, একঘরে হয়েছে, সাথে মোহান্তি এখন দেখাচ্ছে ঘরে আগুন দেওয়ার ভয়। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে এখন আর প্রতিআক্রমণ ছাড়া গতি কী রতনের?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন