preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
শ্রাবস্তীপুরের কৃষ্ণকলি: পর্ব ২
ধারাবাহিক

শ্রাবস্তীপুরের কৃষ্ণকলি: পর্ব ২

কিছু কিছু মানুষের হাসির মধ্যে তার অন্তরের অনেক জ্বালা-যন্ত্রণার একটা আভাস চলকে ওঠে। মণিমালার হাসিতে যেন একটা গল্প দেখতে পেল প্রতিম। নিজেই নিজের ক্ষততে আঙুল বুলিয়ে টাটিয়ে ওঠা আনন্দ, শরীর গুঁড়িয়ে দেওয়া পরিশ্রমের ছাপ দামী সাজসজ্জা দিয়ে ঢেকে দিতে চাওয়ার অসীম উদ্যম আর একা রাতে শুধু প্রিয় গান বুকে করে ঘুমিয়ে পড়া।

প্রতিমের ঠিক সাতসকালে আদাজল খেয়ে দৌড়নোর অভ্যেস নেই। জিমে যাওয়ার অভ্যেস আছে কিন্তু ইচ্ছেমতো। একটু হাঁপিয়ে যাচ্ছিল, বার বার পিছিয়ে পড়ছিল। এই পিছোতে পিছোতেই আলাপ মণিমালার সাথে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কিন্তু মেদহীন, ঝরঝরে চেহারা। সুন্দরী হলেও অদ্ভুত একটা কাঠিন্য রয়েছে মুখে। জগিং শুরু করার আগে গ্রুপের সকলের সমবেত হাই-হেলোর সময় আলাদা করে চোখে পড়েনি। প্রতিম তখন দাঁড়িয়ে ভাবছে সামনের বেঞ্চিটায় বসবে কি বসবে না। বেশ ভালোই হাঁফ ধরেছে। বিগত মাসখানেক শরীরচর্চার সময়ই পায়নি। বাসাবদলের হাজারটা ঝামেলা ছিল। তার ওপর এইবারটা প্রায় শিকড় উপড়ে নিজেকে নিয়ে আসার ব্যাপার ছিল। সব মিলিয়ে মনে ও শরীরে বেশ কিলোখানেক ব্যাগেজ জমেছে।

প্রতিম খেয়াল করেনি কখন মণিমালা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

‘ক্লান্ত’?

একটু চমকে ওঠে প্রতিম, তার পর ধরা পড়ে যাওয়ার হাসিটা এতটুকু না লুকিয়ে বলে ওঠে—

‘বসব কি না তাই ভাবছিলাম।’

‘বোসো। আমিও বসব’।

কিছু কিছু মানুষের হাসির মধ্যে তার অন্তরের অনেক জ্বালা-যন্ত্রণার একটা আভাস চলকে ওঠে। মণিমালার হাসিতে যেন একটা গল্প দেখতে পেল প্রতিম। নিজেই নিজের ক্ষততে আঙুল বুলিয়ে টাটিয়ে ওঠা আনন্দ, শরীর গুঁড়িয়ে দেওয়া পরিশ্রমের ছাপ দামী সাজসজ্জা দিয়ে ঢেকে দিতে চাওয়ার অসীম উদ্যম আর একা রাতে শুধু প্রিয় গান বুকে করে ঘুমিয়ে পড়া।

মণিমালা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল, প্রতিম তখনও মণিমালার সেই প্রথম হাসিটা নিয়েই দাঁড়িয়ে। মণিমালা ফিরে ডাকে। প্রতিম এগোয়। পাশাপাশি বসে দুজনে।

দু-তিনজন কমপ্লেক্সবাসী তখনই ওদের দিকে হাত নেড়ে জগিং ট্র্যাক ধরে এগিয়ে যায়।

‘কেমন লাগছে?’

‘ভালো।’

‘আমি মণিমালা। ওই যারা এখনই পেরিয়ে গেলো, সিমরান আর ক্যাথি। ব্লক ডি-তে থাকে, ফ্ল্যাটমেটস। খুব মিষ্টি মেয়ে দুটো।’

‘আপনি এখানে অনেকদিন?’

‘এক্কেবারে ভিত গড়ার সময় থেকে।’

প্রতিম একটু অবাক হতেই মণিমালা হেসে বলে, ‘আমি ডেভেলপার কোম্পানিতেই চাকরি করতাম। প্রথম ফেজে ডিসকাউন্টে কিছু ফ্ল্যাট অফার করা হয় এমপ্লয়িদের। তখনই কেনা। এখন অবশ্য অন্য কোম্পানিতে।’

‘কমপ্লেক্সটা অসাধারণ বানিয়েছে কিন্তু আপনার পুরনো কোম্পানি।’

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

মণিমালা আবার হাসে। এবারের হাসিটা একটু অন্য রকম, যেন কিছু রহস্য আছে যা চলকে পড়তে চায় কিন্তু তা জোর করে ঠোঁটের প্রান্তে আটকে রাখা। প্রতিম একটু মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে মণিমালার ঠোঁটের দিকে— খুব পাতলা নয় আবার পুরুও নয়, তবে বিস্তৃত, যতটা বিস্তৃত হলে, মৃদু হাসিতেও সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলে অভিব্যক্তিটা ছড়িয়ে পড়ে। মণিমালা ঐ হাসিটুকু নিয়ে অল্প ঘাড় হেলিয়ে মাথা নীচু করে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে মৃদু ওঠানামা করছে বুকের পোশাক। ঠিক আকর্ষণ নয়, এই দৃশ্যকল্পটায় যেন আটকে গিয়েছে প্রতিমের মনোসংযোগ।

তখনই অনমিত্র হাফাতে হাফাতে এসে পৌঁছয়—

‘ওঃ আসল লোকের সঙ্গেই আলাপটা সেরে ফেলেছো দেখছি।’

প্রতিম দেখে মণিমালার মুখের হাসিটা উধাও। চকিতে সেই কাঠিন্যটা ফিরিয়ে এনে মণিমালা একটু বকেই ওঠে যেন—

‘আসল-নকলের প্যারামিটারটা কী অনমিত্র?’

অনমিত্র একটুও ঘাবড়ায় না। বেশ সপ্রতিভভাবে বলে—

‘মণিমালাদি এই কমপ্লেক্সের কোর আর্কিটেক্ট টিমের একজন।’

প্রতিম একটু অবাক হয়ে দেখে। মণিমালা একটু অস্বস্তি নিয়ে বলে—

‘আজও আমার আর অন্য কোনো পরিচয় খুঁজে পাওয়া গেল না, তাই না?’

‘মানুষের আসল পরিচয় কিন্তু কাজে, পেশায়, কীর্তিতে।’

‘থাক’, বলতে বলতে উঠে পড়ে মণিমালা, ‘আমি এগোই, বন্ধুকে সঙ্গ দাও। কথা হবে প্রতিম’, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় মণিমালা।

একটা ফর্মাল করমর্দনের কথাই ভেবেছিল সে। মণিমালার বয়স ও পেশার পক্ষে যা উপযুক্ত ছিল। অথচ যা পেলো, তা এমন পেলব ও আবেগময় যে বহুদিন মনে থেকে যাবে। রেশটা নিয়ে খানিকক্ষণ থাকতে পারলে ভালো লাগত প্রতিমের। এমনিতে সে প্রেম বা আকর্ষণের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা মানেনি কখনও। কিন্তু এর আগে কখনও ঠিক ঐ বয়সী কারো প্রতি টান অনুভব করেনি।

ভাবনায় বাধা পড়ে প্রতিমের। জগার্স গ্রুপের একঝাঁক সদস্য এসে পড়ে। নানা বয়সের মানুষ। কচিকাঁচাও আছে বেশ কয়েকজন। অনমিত্র সবাইকে নিয়ে হই হই করে চলে ক্যাফেটেরিয়ায়।

‘আজ ব্রেকফাস্ট অন দ্য হাউস, তোমার অনারে… মানে অ্যাসোসিয়েশন খাওয়াবে’, যেতে যেতে অনমিত্র ফিসফিসিয়ে জানায়।

শুনে মজা লেগেছিল বটে প্রতিমের, তবে পৌঁছনোর পর বিস্মিত হল বেশি। বেশ প্রশস্ত সুসজ্জিত ক্যাফেটেরিয়া। প্রায় ১৫০-২০০ জন একসাথে বসে খেতে পারে। তারই একপাশে থরে থরে রাখা বিলাসবহুল ব্রেকফাস্ট বুফে। অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মিস্টার গুপ্ত। বছর চল্লিশের এক হাসিখুশি মানুষ। দুহাত ছড়িয়ে আলিঙ্গন করে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘শ্রাবস্তীপুরে স্বাগত প্রতিম।’

প্রতিম এই ওয়েলকাম ব্রেকফাস্টের ব্যাপারে বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানাতেই মিস্টার গুপ্ত বলে ওঠেন, ‘আহা হা সামান্য ব্যাপার। এসব তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মানুষ এখানে ফ্ল্যাট কেনে মাথা গোঁজার আশায় কিন্তু শুধু মাথা গুঁজলেই কি আর মানুষের মতো বাঁচা হয়? পাশে যদি আরও অনেক মানুষ না থাকে তবে একাকিত্বে ডুবে যেতে যেতে অন্য মানুষ ফুরিয়ে যায়। আমরা এখানে কাউকে একা থাকতে দিই না— ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে!’

প্রতিম একটু চমকে ওঠে আর তক্ষুনি গোটা ক্যাফেটেরিয়া যেন স্লোগানের মতো একই কথা আউড়ে ওঠে— শুধু একজন ছাড়া — মণিমালা। বাকিরা যখন যে যেখানে ছিল, সেখানে দাঁড়িয়েই বা বসেই নিমগ্ন হয়ে বাণী আওড়াতে ব্যস্ত, তখন মণিমালা চুপচাপ, নিজের খাবারটা প্লেটে তুলে চলে যায় একেবারে দূরতম একটা টেবিলে। প্রতিম পুরোটা দেখে। আর কেউ ব্যাপারটা কি খেয়াল করেছে? হঠাত এমন আচরণ কেন?

তবে সে সব নিয়ে বেশি কিছু ভাবার আগেই মিস্টার গুপ্ত এবার কানে কানে বলে সেই সাবধানবাণী, যার গৌরচন্দ্রিকা হয়েছিল গতকাল রাতেই।

‘অনমিত্র তোমাকে ব্লক সি-এর পেন্টহাউসের কথাটা জানিয়েছে তো?’

প্রতিমের এবার কেমন জানি গা ছমছম করে। এখানে পা দিয়েছে ২৪ ঘণ্টাও হয়নি। তার মধ্যেই দু’বার এই কথাটা শুনল সে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে, যতটা সংক্ষেপে সম্ভব ভদ্রভাবে জানায় যে সাবধান তাকে করা হয়েছে কিন্তু কেন এই সাবধানবাণী, তা বিশদে এখনও জানা হয়নি তার। মিস্টার গুপ্ত হাসে। এই হাসিটার অর্থ হলো, বিশদে বলার জন্য প্রাণটা হাঁসফাঁস করছে।

‘চলো আগে প্লেটটা সাজিয়ে নেওয়া যাক।’

মিস্টার গুপ্ত যে টেবিলটায় বসলেন, সেখান থেকে কোনাকুনি দেখা যায় মণিমালাকে। একা নয়, সেই টেবিলে বসেছে সতেরো-আঠেরোর এক তরুণী। ক্রমাগত কিছু বলে চলেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। মণিমালাও বেশ আগ্রহভরে শুনছে।

‘হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, আসলে দেখো আমরা এখানে সবাই একটা ফিলজফিতে বিশ্বাস করি। যেটা প্রথমেই বললাম। আর পাঁচটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের থেকে আমরা আলাদা এখানেই। এই যে এক ধরনের সমালোচনা শুনতে শুনতে তুমি-আমি বড় হয়েছি যে এই ধরনের আর্বান ভিলেজ মানেই সবাই নিজের নিজের কোকুনে ব্যস্ত। সেই কালচারটাই আমরা এখানে ভেঙেছি। সেই জন্যেই বলছি যে কৃষ্ণকলির সাথে আলাপ করতে যেও না। ওর জন্য অনেক মানুষকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। একটা সময় পর্যন্ত চুপ করে ছিলাম। এখন নতুন কেউ এলে, আগ বাড়িয়ে তাকে সাবধান করে দিই এবং…’,

এই পর্যন্ত বলে একটা দীর্ঘ পজ নেয় মিস্টার গুপ্ত, খুব স্ট্র্যাটেজিক পজ। প্রতিম অপেক্ষা করে, চোখ সরায় না।

মিস্টার গুপ্ত এবার চোখ তুলে সরাসরি বলে, ‘এই সাবধান করে দেওয়াটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।’

প্রতিম এক সেকেন্ড থমকে যায়। পেট গুলিয়ে একটা হাসি ঠেলে উঠতে যাচ্ছিল। কোনোমতে তাকে সামলে স্মার্টলি জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি হোমোফোবিক, মানে আপনারা… মানে এই কমপ্লেক্সের কমিউনিটির কথা বলছি!’

ক্যাফেটেরিয়া কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে মিস্টার গুপ্ত।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

শাঁওলি দেবনাথ ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর, আংশিক সময়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। গবেষণা ও উচ্চ-শিক্ষাক্ষেত্রে কেরিয়ার তৈরি করবেন এমনই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সৃজনশীল লেখার আকর্ষণে সরে আসেন। ২০০৯ সালে, সুমন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘একদিন’ সংবাদপত্র ও ‘একদিন লাইভ’ ম্যাগাজিনে কর্মরত অবস্থায় রিপোর্টিং ও সম্পাদনার কাজে হাতেখড়ি। এবিপি ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংস্থায় ডিজিটাল সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত অবস্থায়, বিশেষ পরিচিতি পান বাংলা টেলিভিশনের দৈনন্দিন এবং ইন-ডেপথ কভারেজের জন্য। ২০১৫-পরবর্তী সময়ে, বাংলা সংবাদমাধ্যমে সামগ্রিকভাবেই টেলিজগতের খবরের ট্রেন্ডকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এছাড়া মধ্যে কয়েক বছর ওয়েব কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপনের জগতেও কাজ করেছেন। ২০২১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিনোদন জগতে চিত্রনাট্য-সংলাপ রচয়িতা হিসেবে কাজ করছেন।

অন্যান্য লেখা