প্রকাশিত হল শাশ্বতী লাহিড়ীর লেখা অণুগল্প ‘ছিটমহলের হল্লা-বোল’।
“দেশে দেশে স্বাধীন নাগরিকরা সমস্ত আয়ুষ্কাল জুড়ে কেন্নোর মতো নিজেদেরকে ঘষটে ঘষটে অদ্ভুতুড়ে নাঙ্গা প্রাণীর ঢঙে কেবলই গড়াচ্ছে ভূগোলকের শরীরময়। যেন খাদ্য ও আশ্রয়সন্ধানী শরণার্থী পিঁপড়েদের একটা অনন্ত মিছিল এঁকেবেঁকে পেঁচিয়ে ফেলছে পৃথিবীর ব্যাস। আর তাদেরকে বাজের প্রখরতায় পাহারা দিয়ে চলেছে দ্বিপদী হিংস্র শ্বাপদ আর সরীসৃপের দল।”
খবরের কাগজে সুমন্ত চ্যাটার্জির সদ্য প্রকাশিত আর্টিকেলটা আধখানা পড়েই বিরক্তির ঢঙে পাশে ভাঁজ করে রেখে মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন ফুলবাবু। কিছুটা দূরে ছাতিম গাছের ছায়ায় গঞ্জ-হাটের টোকরিওলার ঢঙে উবু হয়ে বসে কিছুক্ষণের বিরতি নিচ্ছিল পিঁপড়েদের যে-দলটা, তাদেরই একজনকে ফুলবাবু জিজ্ঞেস করে বসলেন,
—তোদের দেশ-গাঁ কোথায়?
—আইগ্যা জানা নাই বাবু। কারে কয় দ্যাশ, হেইটাই তো জ়ানি না!
—দেশ মানে... তুই যেখানে বাস করিস, মানে জন্মেছিলি আর কি!
—হাসাইলেন বাবু। বাস তো করি না কোথাও! শুধু হাঁটি। হেঁটে চলা মায়ের প্যাট থ্যিকা ধুলায় খসি পড়ি একদিন। সেই থ্যিকাই হাঁটা-জ়েবন শুরু।
—ঘরবাড়ি কিছু নেই তোদের?
—আইগ্যা ছেল... ও... কুনোদিন! পুব্বোপুরুষের জমি ছেল। ভিটা ছেল। কামকাজ ছেল। এহন কিসু নাই।
—তা সেসব গেল কোথায়?
—যা ছেল, সেসব এখন সগ্গে গেছে। পাতালে গেছে। দ্যাশে দ্যাশে রাজারা বুনো কুত্তাগুলানরে লেলায়ে দ্যায়। মুখে রক্ত তুলি ছুটতে থাকি পথে পথে, পায়ের হাড়-মাংস ক্ষয়ে যায়, তবু পথ ফুরায় না। পাণ্ডবদের সগ্গোযাত্রার মতো পথেই মরি যায় আমাদের বউ, বাচ্চা, মা, বাপ সব্বাই। পথেই চিতা জ্বাইলে মুখে আগুন দিই। কখনো ভাইস্যে দিই জ়লে। তারপর ফির হাঁটতে থাকি। কোথায় এর শ্যাষ জানি না! কাঁটাতারে শরীর খুবলে যায়। রক্ত গড়ায়। তবু হাঁটা থামে না।
—হুম! তো প্রতিবাদ করিস না তোরা?
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
—হে হে হে! হাসাইলেন বাবু! আমাদের আবার পোতিবাদ। না আছে কাগজ়পত্তর, না আছে দ্যাশ, না অন্ন-আশ্রয়ের হক। পোতিবাদ করলি যে দ্যাশের শত্তুর বলি দেইগে দ্যায়! কতজনারে ওরা ভুখা কুত্তা লেলায়ে শরীল ছেঁড়ল! গরাদের আন্ধারে বিষ গেলায়ে কব্বর দেলো। সোমত্ত মেয়ে-বউগুলানরে বনবাদাড়ে টানি নে যেয়ে শরীর খেলো। ভিটা-মাটি ভাঙচুর করি ভাগালো কতজনারে! দ্যাবতাদের তবু মন জ়াগে না। অন্ধ, বোবা-কালা। তেনাদের অস্তরগুলান একবার যদি হাতে পাইতাম, তয় লেঠেলগুলারে দেখায়ে দিতাম পোতিবাদ কারে কয়!
ফুলবাবু কিছু বলতে যাওয়ার মুখেই, দোকানি ছোটুর মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল—
“মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে উগলে হিরে মোতি...”
গানটা শোনামাত্র ঘৃণায় কুঁচকে যায় পিঁপড়ের মুখ, শরীরের আদলও। থুঃ থুঃ করে দলাপাকানো থুতু ফ্যালে সে মাটিতে। সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে—গাঁড় মারি তোর শালা আবাগির ব্যাটা! দ্যা...অ্যা...শশ্! দ্যাশ তো নয়, শকুনের ভাগার! তার আবার ‘তেরি’ আর ‘মেরি’! থুঃ থুঃ…
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন