“সে শুধু অভিনেতা কেন, আমাদের আশপাশের কোনো মানুষেরই কি ভিতরের আসল ছবি আমরা দেখতে চাই?”
ঘোর-লাগা গলায় অমিতা থেমে থেমে উচ্চারণ করে, “কিন্তু, অলোক... অলোকও যে এত ভালো অভিনেতা... তা আমি আগে একটুও বুঝতে পারিনি! কী অসামান্য ওর অভিনয় ক্ষমতা! কী করে ও এটা পারল! আগের রাতে... ওঃ, মা গো, ঠিক আগের রাতে একটা নষ্ট মেয়েছেলের সাথে ফূর্তি করে পরের দিনই এত স্বাভাবিকভাবে আমার সাথে রাত কাটাতে! ওঃ, আমি আর নিতে পারছি না, শ্রীময়ী”, এই প্রথম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অমিতা।
‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা...’, ইনক্রিসিং মেলোডি।
বাথরুম থেকেই রিংটোনটা শুনতে পেল শ্রীময়ী। কে আবার ফোন করল? সন্দীপ নয়তো! কিন্তু... সন্দীপ তো এখন ফিরছে! বাড়ি ফেরার পথে, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থেকে, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সন্দীপ ফোন করতে পছন্দ করে না। তবে যে-ই ফোন করুক, শ্রীময়ী এখন ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে ফোন ধরার মতো অবস্থায় নেই!
আবার সেলফোনটা বাজছে। আচ্ছা জ্বালাতন তো! মা-ই বা গেল কোথায়? পাশের ঘরেই তো ছিল। এসে ফোনটা ধরছে না কেন? কিন্তু শ্রীময়ী জানে মা শুনতে পেলেও, এসে তার ফোন ধরবে না। এ বাড়িতে যার মোবাইলে ফোন আসে, পারতপক্ষে সে ছাড়া অন্য কেউ কল রিসিভ করে না।
স্কুল থেকে ফিরে প্রত্যেকদিন বাথরুমে অনেকটা সময় যায় শ্রীময়ীর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ঋতু—যা-ই হোক, আর ফেরার সময়েরও যতই তারতম্য ঘটুক, শাওয়ারের অঝোর ধারায় প্রাত্যহিক সে নিজেকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দেয়। সারা দিনের সমস্ত ক্লান্তি, ভিড়-বাসে সুযোগ-সন্ধানীর সূক্ষ্ম বা স্থূল-হস্তাবলেপের গ্লানি মুছে ফেলতে উন্মোচিত দেহত্বকে সে আহ্বান করে শান্তিবারির ধারাস্পর্শ। আর নিয়মিত অনুভব করে তার মধ্যে ফিরে আসছে স্নিগ্ধ সজীবতা, অনাঘ্রাতা পুষ্পের মদির সৌরভ, অমলিন যৌবনের নিষ্কলুষ উদ্দীপনা।
আজ আর নিজেকে ধারাস্নানে পুরোপুরি সমর্পণ করা গেল না! এরই মধ্যে আরও দু-বার রিং হয়েছে। একটা পোলকা-ডটেড কটন হাউস-কোট গায়ে চাপিয়ে অন্য দিনের থেকে আগেই বাথরুম ছেড়ে বেরোতে একপ্রকার বাধ্য হল শ্রীময়ী। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ফোর মিসড্ কলস্। অমিতা। তাই তো! ইশ্, কী করে ভুলে গেল শ্রীময়ী! অমিতা দুপুরে ফোন করে বলেছিল বটে, আর্জেন্ট ম্যাটার, সে যেন ফিরেই ফোন করে। আশ্চর্যের কথা, রিং শুনেও তার অমিতার কথা মনে পড়েনি! আরও আশ্চর্য, তার পরিবর্তে সন্দীপের কথা মনে এসেছে!
টিফিনের পর ক্লাসে যাবে বলে শ্রীময়ী উঠছে, সে-সময় অমিতার ফোনটা আসে। সে খেয়াল করেছিল অমিতার গলায় অন্য সময় যে সহজ উচ্ছ্বাস থাকে তা একদম নেই। তাই জানতে চায়, কী হয়েছে, অমিতা? সিরিয়াস কিছু? শরীর খারাপ? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিতা শুধু বলে, ফিরে ফোন করিস। আর তারপরই ফোনটা কেটে দেয়।
শ্রীময়ী সোফায় বসে সামনের টেবিলে রাখা প্লাস্টিকের বোতল থেকে একঢোঁক জল খেয়ে কল ব্যাক করল অমিতাকে।
দু-চার সেকেন্ড রিং হওয়ার পরই অমিতা ফোন ধরে বলল—হ্যাঁ, শ্রীময়ী বল। কখন ফিরলি? ফোন ধরছিলিস না কেন?
—বাথরুমে ছিলাম।
—তুই একবার আসতে পারবি? ভীষণ দরকার।
—এখনই! এই সন্ধ্যাবেলায়...! আগামীকাল সকালে গেলে হবে না?
—এখনই যে তোকে দরকার শ্রীময়ী! আগামী...কাল! দেরি হয়ে যাবে না তো...!
—কী সব বলছিস বল তো? আগামীকাল গেলে কিসের দেরি হয়ে যাওয়ার কথা বলছিস?
—জানি, তুই সবে ফিরেছিস। তোর বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি তোর কাছে যেতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়! এদিকে দরকারটা... বুঝলি... সত্যিই ভীষণ আর্জেন্ট।
—ঠিক আছে। দেখছি মাকে ম্যানেজ করে বেরোতে পারি কি না! ধরে নে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছচ্ছি। আর যদি একান্তই না যেতে পারি... তোকে ফোন করে জানিয়ে দেব। টেনশন করিস না। রাখছি।
কিন্তু এখন মাকে কী করে রাজি করাবে ভেবে পেল না শ্রীময়ী। মা রাতে স্কুটি নিয়ে কোথাও বেরোতে দিতে চায় না। যদি বেশি আপত্তি করে টোটো বা অটো ধরে যাওয়ার কথা বলে দেখবে। কিন্তু হাতে সময় কম। রাত বাড়ছে। শুধু শুধু বসে থেকে সময় নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।
শ্রীময়ী হাঁক দিল, “মা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আমি একবার অমিতার কাছে যাব।”
“সে কী রে! এই তো ফিরলি। খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিবি না! কালকে সকালে গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত!”
“মা, আমি অমিতাকে সেটাই বলেছিলাম। কিন্তু ও আর্জেন্ট দরকার বলে এখনই যেতে বলছে।... তুমি চিন্তা কোরো না। আমি অটো বা টোটো করে চলে যাব। তুমি বাবলুকে বোলো, ন-টা নাগাদ গিয়ে আমাকে নিয়ে আসতে।”
“তার পাত্তা পেলে তবে তো বলব! সেই কোন সকালে একমুঠো নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়েছে। দুপুর পর্যন্ত থানায় ছিল। এখন মর্গে গেছে। একটু আগে ফোন করে জানাল, ফিরতে নাকি রাত হবে।”
“থানায়! কেন? আর মর্গেই-বা কেন?”
“ওহ্, তোকে বলা হয়নি, দাসপাড়ার নমিতা আজ সকালে গলায় দড়ি দিয়েছে।”
“সেকি! কেন...?”, খাওয়া থেমে যায় শ্রীময়ীর।
“রেবাকাকিমা তো বলছিল, নিজের লজ্জা ঢাকতে বেচারির নাকি এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না! পালপাড়ার রমেশ, না রাকেশ বলে কোনো একটা ছেলেকে ভাই পাতিয়েছিল। তার নাকি ওদের বাড়িতে যাতায়াতও শেষ এক বছর খুব বেড়েছিল। কিন্তু মাসদুয়েক সে আসা বন্ধ করে দেয়।”
“কেন? বন্ধ করে দেয় কেন?”
“কোথায় নাকি ছেলেটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এদিকে... ভিতরের খবর যা শুনলাম... ছেলেটার নাকি নমিতার সঙ্গে ফিজিকাল রিলেশন ছিল। সবাই তো বলছে নমিতা নাকি কনসিভও করে। সেই লজ্জাতেই...। এখন পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যদি সেটাই আসে বেচারি মরেও কলঙ্কের হাত থেকে রক্ষা পাবে না!”
কিছুদিন আগে লাইব্রেরিতে নমিতার সঙ্গে বেশ কিছু কথা হয়েছিল শ্রীময়ীর। নমিতা নিজে থেকেই জানিয়েছিল, রায়পাড়ার প্রবহমান শিক্ষাকেন্দ্রে ও এখন পড়াচ্ছে। একটা সেল্ফ হেল্প গ্রুপ খোলার ব্যাপারে পরামর্শের জন্য শ্রীময়ীর কাছে একবার আসার কথাও বলেছিল।
শ্রীময়ীর থেকে দু-এক বছরের বড়ো হবে নমিতা। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় তার বিয়ে হয়। কিন্তু মাস তিনেক পরে অজ্ঞাত কারণে বাপের বাড়ি ফিরে আসে। সেই যে ফিরে আসে, আর যায়নি। লোকে কানাঘুষো করে ওর বরের পুরুষত্বহীনতার কারণেই নাকি নমিতা বরের ঘর করতে চায়নি। নমিতার বাবা এবং তিন দাদা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে নমিতার ডিভোর্স হয়নি। কোর্টকাছারি করতে চেয়ে প্রথম প্রথম ওর মেজদা খুব উৎসাহ দেখালেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব মন্দীভূত হয়। কেউই আর কিছু করেনি। এসব বছর দশেক আগেকার কথা। দাদারা এখন ঘোরতর সংসারী। বাবাও আর বেঁচে নেই। মাকে নিয়ে নমিতার আলাদা সংসার। দু-চারটে ছেলে পড়িয়ে, সর্বশিক্ষার ওই সামান্য মাইনের কাজ করে আর এদিক-সেদিক করে সংসার ঠেলছিল নমিতা। বিধবা বা ডিভোর্সি নয় বলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে নমিতা যে বঞ্চিত হচ্ছে, শ্রীময়ীকে সেদিন সেকথাও বলেছিল। লাইব্রেরি থেকে ফিরে সে-রাতে শুয়ে শুয়ে শ্রীময়ী বেশ কিছুক্ষণ নমিতার কথা ভেবেছিল।
সেই আটাশ-উনত্রিশ বছরের একটা জলজ্যান্ত মেয়ে এইভাবে গলায় দড়ি দিয়ে মরে গেল! ভাবতে শ্রীময়ীর গা-টা কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে। একটু রাগও হচ্ছিল কি? বেঁচে থাকার জন্যই তো এত কিছু! জীবন ছেড়ে চলে গেলে আর তো কিছুই থাকে না। শ্রীময়ীর মনে হয়, সব চলে যাক, শুধু মানুষটা বাঁচুক। মরে গেলে তো সবই গেল। নিজেকে মেরে মানুষ কখনও বাঁচতে পারে বলে সে মনে করে না। তবুও কত-কত মানুষ আত্মহত্যা করে। কেন? বড়ো জটিল প্রশ্ন! শ্রীময়ীর মনে হয় এ প্রশ্নের উত্তর সে কখনও খুঁজে পাবে না।
একটু হালকা রূপটান সেরে পার্সটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শ্রীময়ী। পরনে পুজোয় সন্দীপের দেওয়া মাস্টার্ড কালারের সালোয়ার কামিজ।
“মা, আমি তাহলে স্কুটি নিয়েই বেরোচ্ছি। বাবলু ফিরলে তুমি একটা ফোন করতে বোলো।”
“রাতে আবার স্কুটি নিয়ে যাবি? দেখিস, সাবধানে যাস।” শ্রীময়ী পিছনে শুনতে পায় মায়ের গজগজানি, “না-গেলেই আর চলছিল না! আমার হয়েছে যত জ্বালা! ওনার এখনও ক্লাব থেকে ফেরার নাম নেই! ছেলে সমাজসেবা করে বেড়াচ্ছে। এদিকে রাতবিরেতে মেয়ে চলল কিনা বন্ধুর বাড়ি! এখন মরো তুমি বাড়িতে বসে রাজ্যের দুর্ভাবনা নিয়ে!”
শ্রীময়ী একটু দাঁড়িয়ে যায়। মাই আবার তাড়া লাগায়, “কী হল, দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা। পৌঁছে ফোন করিস। আর... একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস।”
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
দুই
তিন দিন আগেই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ছিল। এখন কৃষ্ণপক্ষ। পূর্ণিমার পরই কেমন একটা ম্লান অন্ধকার রাতের আকাশকে গ্রাস করেছে। চাঁদের আলো নিষ্প্রভ।
শর্টকাট হবে বলে শ্মশানধারের রাস্তাটাই নিল শ্রীময়ী। শ্মশান পেরিয়ে এই নাবতলার মাঠটা আড়াআড়ি পার হলেই প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার পিচের রাস্তা। মাঠের ঢালাই-রাস্তা বরাবর শ্মশান পর্যন্ত ইলেকট্রিক পোস্ট পোতা। কানেকশনের তার এখনও জোড়েনি। এই রাস্তা দিয়ে শ্রীময়ী স্কুটি নিয়ে প্রায়ই আনাগোনা করে। তবে সন্ধ্যার পর খুব একটা না। মাঠের মধ্যে বাঁশবাগানের ভেতরেই চোলাইয়ের ঠেক! সেখানে জড়ো হওয়া মোদো-মাতালের ঠেলায় সন্ধ্যার পরই জায়গাটা হয়ে ওঠে নরক গুলজার। জায়গাটার পাশ দিয়ে রাতবিরেতে যেতে শ্রীময়ীর বুক কাঁপে! কিন্তু আজ আর সে বেশি ভাবল না।
ঢালাই-রাস্তাটা নির্বিঘ্নে পেরিয়ে ঠিক পিচ-রাস্তায় ওঠার মুখে উলটোদিক থেকে আসা একটা মোটরবাইকের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল শ্রীময়ীর। কী যে সব গাড়ি চালায়! হেড লাইটের আলো আপারে থাকলে উলটোদিকের ড্রাইভারের যে অসুবিধা হয় তা খেয়ালও করে না। শ্রীময়ী স্কুটিটা একটু আস্তে করে রাস্তার ধারে সরে যায়, তারপর চোখটাকে একটু সইয়ে নিয়ে আবার নর্মাল স্পিডে চালাতে শুরু করে।
কী হতে পারে অমিতার? মাসখানেক আগে শেষ কথা হয়েছিল। বেশ খুশি খুশি গলায় জানিয়েছিল, “বুঝলি শ্রীময়ী, যা এক্সপেক্ট করছিলাম তা-ই! আমি কনসিভ করেছি, তিন মাস চলছে।”
বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয়নি। আগের ফাল্গুনেই তো বিয়ে হল অলোকের সঙ্গে! সাত বছর প্রেম করার পর। অলোক বিয়ে করেছিল খুব ধুমধাম করে। অলোকদের জুয়েলারি বিজনেস, প্রচুর পয়সা। সে-তুলনায় অমিতারা কিছুই নয়। ছাপোষা, নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মেসোমশাই একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। একমাত্র ভাই অমিত অমিতার থেকে আট বছরের ছোটো। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
কত দিন, কত রাত অমিতা শ্রীময়ীদের বাড়িতে এসেছে। কয়েকবার বাড়ি ফেরেনি, শ্রীময়ীর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে। শ্রীময়ীরও ছিল অমিতাদের বাড়িতে অবাধ বিচরণ। অমিতার বিয়ের আগে শ্রীময়ী ছায়ার মতো লেগেছিল অমিতার সঙ্গে। একসাথে বিয়ের প্ল্যানিং সেরেছে, মার্কেটিং করেছে, নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েছে। বিয়ের পর অমিতা যখন শ্বশুরবাড়ি চলে গেল শ্রীময়ীর তো প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। সময় যেন কাটতেই চাইছিল না।
সন্দীপ সে-সময় একদিন মজা করে বলেছিল, “যাক, আমার সতীন-ফাঁড়া কেটেছে!”
শ্রীময়ী রসিকতায় যোগ না দিয়ে বিষণ্ণকণ্ঠে বলেছিল, “জানো, আমি অমিতাকে ভাতের মতো ভালোবাসি।”
“সেটা কীরকম!”
“আমি যে ভাত খেতে খুব ভালোবাসি, সেটা তো তুমি জানোই। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা—তিন বার ভাত খাই।... অমিতাকে আমি ততটাই ভালোবাসি, ঠিক যতটা ভালোবাসি ভাতকে।”
অথচ সেই অমিতার সঙ্গে সম্পর্কেও আট মাসের মধ্যে কেমন পলি পড়তে আরম্ভ করেছে! অনতিক্রম্য না-হলেও একটা দূরত্ববোধ যেন না চাইতেও ক্রমশ জমি পাচ্ছে। শ্রীময়ী অস্বীকার করে না—এর জন্য সে-ই বেশি দায়ী। বিয়ের পর মেয়েদের জীবনে খুব স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনগুলির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে, সব সামলে উঠতে একটু সময় লাগেই। তাই অমিতার পক্ষে যে আর আগের মতো যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়ে উঠছিল না—তার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকত্ব নেই। কিন্তু শ্রীময়ীর তো আর সেই অসুবিধা নেই! সে তো চাইলেই সম্পর্কটাকে আগের জায়গায় ধরে রাখতে পারত। কই, সে তো যত্ন নিয়ে তা করেনি! শ্রীময়ী না-চাইতেও এমনই। উলটোদিকে থাকা মানুষটা যদি একটু অনিয়মিত হয়ে পড়ে, শ্রীময়ীও তার ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন হয়ে যায়! সে যে অবুঝ তা নয়, অপরের সুবিধা-অসুবিধাও সে যথেষ্ট বোঝে, কিন্তু নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে অন্যের কাছে পৌঁছোতে কোথায় যে তার বাধে কে জানে! হতে পারে এটা তার কোনো সূক্ষ্ম মর্যাদাবোধ অথবা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা। এই অনন্য ব্যক্তিত্বের কারণেই হয়তো-বা সে কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করে না। প্রত্যেক মানুষকে নিজস্ব স্পেস দেওয়াতে সে বিশ্বাসী। অমিতার সঙ্গে এত অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও সে অলোকের সঙ্গে তার প্রেমজ সম্পর্ক নিয়ে নিজে থেকে কখনও কিছু জানতে চায়নি। বিয়ের পর যে ক-বার দেখা হয়েছে অথবা ফোনে যে কথাবার্তা হয়েছে, তাতে সে অমিতার দাম্পত্য জীবন নিয়েও কোনো আগ্রহ বা লেশমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করেনি। অমিতা নিজে থেকে যা দু-চারটে কথা বলেছে, সে মনোযোগ সহকারে শুনেছে, কিন্তু নিজে কোনো মন্তব্য করে প্রসঙ্গকে দীর্ঘায়িত করেনি।
পিচ-রাস্তার বাঁ-দিকে, ঢালাই-রাস্তার গায়ে ইলেকট্রিক পোস্টে পঞ্চায়েত থেকে লাগানো প্রতিপ্রভ বাতির আলোয় অমিতাদের একতলা বাড়িটা দূর থেকেই চোখে পড়ে। শ্রীময়ীর চোখে পড়ল আশপাশের বাড়িগুলোর ছাদ থেকে ঝুলছে মিনিয়েচারের ঝলমলে চেন লাইট। কোনোটা একভাবে জ্বলছে, কোনোটা তারার মতো মিটমিট করছে, কোনোটা বিভিন্ন প্যাটার্নে নিভছে-জ্বলছে।
শ্রীময়ী অমিতাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে হর্নটা দু-বার বাজাল। তারপর ডবল স্ট্যান্ডে গাড়িটাকে রেখে লক করল। দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল শ্রীময়ীর। অমিতা যে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, তা তার দ্রুত দরজা খোলা বুঝিয়ে দিল। কিন্তু তাহলে অমিতা কেন ধীরপায়ে আনমনে তার দিকে হেঁটে আসছে! ফুট দশেক রাস্তা পার হতেই যেন কতটা সময় লাগছে অমিতার। চুপচাপ হতবাক দাঁড়িয়ে থাকে শ্রীময়ী। সে অপেক্ষা করে তার কাছ পর্যন্ত অমিতার আসার। তার সিক্সথ সেন্স বলে, শ্রীময়ী, তুমি অপেক্ষা করো, অমিতাকে আসতে দাও।... অমিতা কাছে আসতে শ্রীময়ী এক হাতে তার এক হাত ধরে এবং অন্য হাতে হেলমেট ও পার্সটা নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলে, “মাসিমা কোথায়?”
“মা নেই। বাবাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে।”, ভারী গলায় অমিতা জবাব দেয়।
“আর অমিত? ও বুঝি পাড়ার ক্লাবে?”
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে অমিতা।
ঘরে ঢুকবে বলে পা বাড়ায় শ্রীময়ী। অমিতা শ্রীময়ীর হাতটা টেনে বলে, “চল, ছাদে গিয়ে বসি। কতদিন সন্ধ্যার পর ছাদে গিয়ে বসিনি।” অমিতার গলায় সেই চেনা সুর খুঁজে পায় না শ্রীময়ী। কেমন যেন দূর থেকে ভেসে আসা, চেষ্টা করেও সহজ হতে না পারা এক অস্বাভাবিক স্বরক্ষেপণ!
ছাদের চারধারে ফুটদুয়েক গাঁথা পাঁচিল। একটা কোণে আলোর দিকে পিছন ফিরে বসে অমিতা। কোণের অন্যদিকে আড়াআড়ি বসে শ্রীময়ী। অমিতার মুখটা শ্রীময়ী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না। পিছনে ইলেকট্রিকের আলো থাকায় চাঁদের আলো যেন আরও ম্লান বলে মনে হয়। দু-জনেই চুপ। শ্রীময়ী ভাবছিল কীভাবে এই নীরবতার অস্বস্তি কাটানো যায়। ঠিক সেই সময়েই পার্সে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। মা।
—বলো।
—পৌঁছেছিস? ফোন করিসনি কেন?
—এই জাস্ট পৌঁছোলাম। এর মধ্যে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি।
—ঠিক আছে।... আর শোন, ভাবছি ন-টার মধ্যে বাবলু না-ফিরলে তোর বাবাকে পাঠিয়ে দেব। তুই একলা ফিরতে যাস না।
—ওহ্ মা, তুমি না! বাবাকে পাঠাতে হবে না। বাবলু না-এলে আমি একাই ফিরতে পারব। এসব এরিয়া এখনও যথেষ্ট সেফ। তা ছাড়া... এখন ফেস্টিভ্যাল সিজন। চারিদিকে রাত পর্যন্ত লোক ঘোরাফেরা করছে। তুমি একদম ভেবো না। আমি কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়ব। আর শোনো না, ফেরার সময় আমি ডোমজুড় দিয়ে ঘুরে যাব। সময় একটু বেশি লাগবে। তাই দেরি হলেও একদম চিন্তা করবে না। রাখছি। ফোন কেটে দেয় শ্রীময়ী।
“রাত হয়ে গেল।”, অমিতার কণ্ঠস্বরে একটু চমকে ওঠে শ্রীময়ী।
“আর্জেন্ট দরকার বলে তোকে ডেকে পাঠিয়ে কতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি দেখ!... তবে যা বলার জন্য তোকে ডেকেছি, তা যে আমাকে বলতেই হবে!”
“ঠিক আছে। তোকে অত ব্যস্ত হতে হবে না। তুই কেমন আছিস বল তো?”
“সকাল পর্যন্ত ভালোই ছিলাম জানিস। কিন্তু... কিন্তু তারপর কেমন থাকা উচিত সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না...”, অমিতার গলায় এক অপরিচিত উদাসীনতা!
অমিতার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না শ্রীময়ী। চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ায় অন্ধকারে ঢেকেছে নিশীথ প্রকৃতি। অমিতার মুখের ছায়া যেন তার সঙ্গেই সাযুজ্য রেখে আরও গাঢ়।
শ্রীময়ী বলে, “কেন, কী হয়েছে তোর?”
“না না, কিছুই হয়নি! সবকিছু স্বাভাবিক। আমার পরিচিত ঘনিষ্ঠজনের কাছে সবকিছু... খুব স্বাভাবিক! তাদের মধ্যেও কোথাও কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। ঋতুবউদি সকালে এখানে আসার আগে আমিও তো স্বাভাবিক ছিলুম, বিশ্বাস কর... আমার কাছেও সব কিছু স্বাভাবিক ছিল!”
শ্রীময়ী ঋতুবউদিকে চেনে। অমিতার খুড়তুতো বউদি। ওর বাপের বাড়ি অমিতার শ্বশুরবাড়ির কাছেই। বউদি ভীষণ মিশুকে আর সহজ-সরল। অমিতার বিয়ের আগে বউদি সময় পেলেই তাদের দুই সখীর সঙ্গে জুটে গল্পে মেতে উঠত।
তা সেই ঋতুবউদি সকালে আসায় কী এমন হল যাতে অমিতা এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে! কোনো অনুমানের ওপর না-গিয়ে শ্রীময়ী সরাসরি জানতে চাইল, “হ্যাঁ রে, ঋতুবউদি আসায় কী হয়েছে?”
“নাহ্, কী আর হবে! কীই-বা হওয়ার আছে!... না-জেনে বিষপান করলেও শুনেছি লোকে অনেক সময় মরে না। কিন্তু... সেই বিষপানের কথা জেনে গেলে সে কি আর বাঁচে!”
“কী হল কী তোর, অমিতা? কী সব আবোল-তাবোল বকছিস!”
“শ্রীময়ী, তুই সেই বলতিস না—জীবন এত বিরাট কিছু, যাকে আমরা স্পর্শই করতে পারি না... অথবা এত তুচ্ছ, যাকে আমরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি! ভালোবাসাও কি তা-ই নয়, শ্রীময়ী!”। গলাটা যেন একটু কেঁপে যায় অমিতার।
“অমিতা, তোর কী হয়েছে বল তো? যে-তুই আমার এসব কথা নিয়ে হাসাহাসি করতিস, সেই তুই এখন এসব কথা সিরিয়াসলি ভাবছিস!”
“হেসে-খেলেই তো জীবনটা কাটছিল রে! সকালে ঋতুবউদির কাছ থেকে আসল সত্যটা না-জানলে বাকি জীবনও হয়তো হেসে-খেলেই কেটে যেত!”
“ঋতুবউদি তোকে কী বলেছে বল তো?”
“শুনবি কী বলেছে? বিশ্বাস করতে পারবি? জানিস, বলছি বটে, কিন্তু... আমি নিজেই এখনও ঠিকমতো বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি! অথচ... অথচ ঋতুবউদির বলা কথার সত্যতা নিয়ে কোথাও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই...”, একটা দমবন্ধ করা কান্নার দলা অনেক কষ্ট করে গিলে নেয় অমিতা।
শ্রীময়ী ডান হাতটা অমিতার কাঁধে রাখে। কিছু না-বলে চুপচাপ অমিতার মুখের সিলুয়েটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“অভিনয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিনেতার প্রকৃত রূপটা আমরা কেউ দেখি না! দেখি না শুধু নয়, দেখার চেষ্টাও করি না।”—শ্রীময়ীর মনে হয় ইথারবাহিত হয়ে অমিতার স্বর ভেসে আসছে।
অমিতা মুখ নীচু করে গালে হাত দিয়ে নির্বাক বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর শ্রীময়ী আস্তে করে হাতটা কাঁধ থেকে পিঠের ওপর নামিয়ে আলতো চাপ দিয়ে বলে, “সে শুধু অভিনেতা কেন, আমাদের আশপাশের কোনো মানুষেরই কি ভিতরের আসল ছবি আমরা দেখতে চাই?”
ঘোর-লাগা গলায় অমিতা থেমে থেমে উচ্চারণ করে, “কিন্তু, অলোক... অলোকও যে এত ভালো অভিনেতা... তা আমি আগে একটুও বুঝতে পারিনি! কী অসামান্য ওর অভিনয় ক্ষমতা! কী করে ও এটা পারল! আগের রাতে... ওঃ, মা গো, ঠিক আগের রাতে একটা নষ্ট মেয়েছেলের সাথে ফূর্তি করে পরের দিনই এত স্বাভাবিকভাবে আমার সাথে রাত কাটাতে! ওঃ, আমি আর নিতে পারছি না, শ্রীময়ী”, এই প্রথম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অমিতা।
শ্রীময়ী অমিতার পাশে গিয়ে বসে ডান হাত দিয়ে অমিতার পিঠটাকে বেড় দিয়ে ওর মাথাটাকে নিজের কাঁধে এনে রাখে। অমিতার চোখের জলে শ্রীময়ীর কাঁধ ভিজে যেতে থাকে।
খুব ধীরে মুখ তোলে অমিতা। “অলোক কী করেছে, জানিস শ্রীময়ী! অষ্টমীর রাতে পাড়ারই এক নষ্ট মেয়েছেলেকে নিজের গাড়িতে তুলেছিল ও। গাড়িতে একা ছিল না, ওর দু-জন বন্ধুও ছিল। কোথায় কোথায় সব নাকি ঘুরেছে! তারপর রাত একটার সময় বাড়ি থেকে মাত্র দু-কিলোমিটার দূরে রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে... ভেবে দেখ... গাড়ির মধ্যেই... চূড়ান্ত অসভ্যতামি করছিল চারজন মিলে...”, বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নার দলাটাকে আবার গিলে নেয় অমিতা—“রথতলার দু-জন ছেলে সন্দেহ হওয়ায় গাড়িটার কাছে গিয়ে দেখে ওদের চরম আপত্তিকর অবস্থায়। কিন্তু তখনই কিছু না-বলে চুপচাপ আধ ঘন্টা ধরে ওদের সমস্ত কার্যকলাপ মোবাইলে রেকর্ড করে। তারপর আরও লোক জড়ো করে ওরা অলোকদের ওপর চড়াও হয় এবং তুমুল গালিগালাজ করতে করতে প্রত্যেককে বেশ কয়েক ঘা চড়-থাপ্পড় মারার পর ওদের আটকে রেখে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না-দিলে পুলিশে দেওয়ার হুমকিও দিতে থাকে। শেষমেশ অলোক নিজের পকেট থেকে কুড়ি হাজার টাকা আক্কেল সেলামি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরে।”
কেমন এক ঘোরের মধ্যে বলে যাচ্ছিল অমিতা। যেন অন্য কোনো মানুষের গল্প, যার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্কই নেই।
“তুই তো জানিস পুজোতে আমি এখানেই ছিলাম। নবমীর রাতে অলোক এখানে এসেছিল। গাড়ি করে আমাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতেও বেরোল। কাছে-পিঠের কয়েকটা ঠাকুর দেখে এগারোটার মধ্যে ফিরে পড়েছিলাম। একটা বিষয় আমার ভীষণ ভালো লাগছিল জানিস। অলোক কী সাবধানেই-না গাড়ি চালাচ্ছিল! যেটা একদমই ওর নেচার নয়। একটু রাশ ড্রাইভিং করতে ও পছন্দ করে। কিন্তু নবমীর রাতে রাশ ড্রাইভিং তো দূরের কথা, ও আমাকে যে কী যত্ন করে গাড়িতে তুলছিল, নামাচ্ছিল তোকে কী বলব! ও অবশ্য আগাগোড়াই আমার প্রতি ভীষণ কেয়ারিং। কনসিভ করার পর ওর যত্ন নেওয়াটা আরও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কখনোই ও এমন কিছু করত না, যাতে আমার কোনো অসুবিধা হতে পারে। সেই অলোক...”, শ্রীময়ীর কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে ওঠে অমিতা।
শ্রীময়ী অসহায়ের মতো চুপ করে থাকে। কী করবে বা বলবে বুঝে উঠতে পারে না। অমিতার কান্না থামানোরও কোনো চেষ্টা করে না।
অমিতা মাথাটা তুলে আবার বলতে আরম্ভ করে, “আমি ভাবতাম অলোক আমাকে খুব ভালোবাসে... এমন ভালবাসা পেলে যে-কোনো মেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করবে। ওর ভালোবাসায় এত বিশ্বাস চলে এসেছিল বলে কিনা জানি না, আমিও ওকে প্রাণের থেকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ওর উপস্থিতি, ওর স্পর্শ আমার দেহ-মনে এক অন্য মাদকতা নিয়ে আসত। ওকে গ্রহণ করার জন্য, আমার সর্বস্ব ওকে সমর্পণ করার জন্য নিজের অজান্তেই আমি ভেতর থেকে তৈরি হয়ে যেতাম। কতবার এমন হয়েছে, আমি হয়তো মানসিকভাবে প্রস্তুত নই, ভেবেছি আজ হয়তো ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে... কিন্তু ওর সান্নিধ্যে ম্যাজিকের মতো সমস্ত মানসিক প্রতিকূলতা দূর হয়ে গেছে, অবাক হয়ে গেছি নিজের পরিবর্তন দেখে! কী করে এমন হয়েছে জানি না। আমার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।”
শ্রীময়ীর সঙ্গে অমিতা কোনোদিন এ ধরনের আলোচনা করেনি। শ্রীময়ীর অস্বস্তি হবে ভেবেই হয়তো! কিন্তু কই, আজ তো এসব কথা শুনে শ্রীময়ীর কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না!
“ডাক্তারের বিধিনিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে অলোক। দু-আড়াই মাস কেটে যাওয়ার পর আমিই বরং ওকে বলেছি এবার ফ্রি হতে কোনো অসুবিধা নেই। ও তবুও তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। ফিজিক্যাল কনটাক্টের মধ্যে গেলেও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছে। নবমীর রাতেও... ইনভলভমেন্টের সময় আমার ফিজিক্যাল কন্ডিশনের দিকে সবসময় খেয়াল রাখছিল। ওঃ, আজ বুঝতে পারছি কী নিপুণ ওর অভিনয়! কতটা দক্ষ পেশাদার ও!”
শ্রীময়ী খেয়াল করে অমিতার গলায় আর কোনো কান্না নেই। বরঞ্চ এইভাবে ঠকে যাওয়ায় ওর গলায় আত্মধিক্কারের তীব্র শ্লেষ।
“কিন্তু এখন আমি কী করি বল তো? আমাকে তো একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে! অলোক এবং ওদের বাড়ি ব্যাপারটা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিব্রত নয়। এ নিয়ে ওদের পরিবারের কারও মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। অলোকেরও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।... আর ওদের সবার পুরো ব্যাপারটা এত সহজে গ্রহণ করার এই স্বাভাবিকতাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। ঘটনার আগ-পরে সব কিছু কেমন সহজ-স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে দেখেছিস! কী সহজ ব্যাপার! আমি নষ্টামি করব, তাই গাড়িতে তুলে নিলাম একটা নষ্ট মেয়েকে। গ্রুপ হলে মস্তি আরও জমিয়ে করা যাবে। তাই গাড়িতে ডেকে নিলাম দু-জন বন্ধুকে। এই নাহলে পুরুষসিংহ! তারপর মোটা টাকার বিনিময়ে যথেচ্ছ ভোগ করলাম মেয়েটার শরীরটাকে। তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই আত্মমর্যাদার। ভাবতে বয়ে গেছে ঘরে থাকা সন্তান-সম্ভবা স্ত্রীর কথা!”, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অমিতা।—“এর থেকে রিপুর তাড়নায় অলোক যদি ধর্ষণও করত... তা-ও বোধহয় মানতে পারতাম! কিন্তু... কিন্তু ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে এই নোংরামি, হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও ঘাবড়ে না-গিয়ে সব কিছু ট্যাকল করা এবং তারপর... চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আমার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ স্বাভাবিক আচরণ আমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে শ্রীময়ী! আমার মনে হচ্ছে ওর নিষ্ঠুরতা কেমন যেন সিরিয়াল কিলারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাপিয়ে গেছে। তুই-ই বল এরকম একজন পেশাদার খুনির সঙ্গে বাকি জীবন কি কাটানো সম্ভব, না কাটানো উচিত?”
অমিতা চুপ করে যায় শ্রীময়ীর উত্তরের প্রতীক্ষায়। জবাব হাতড়াতে থাকে শ্রীময়ী। আকাশে চাঁদ আবার মেঘের আড়ালে চলে গেছে। নীরবতা ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে দেখে শ্রীময়ী ধীরে ধীরে বলে, “অমিতা দেখ, তুই এখন যেরকম মানসিক অবস্থায় আছিস, তাতে তোর কোনো সিদ্ধান্তের আড়ালে আশ্রয় খুঁজতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও দেখতে হবে তাড়াহুড়ো করে যেন কোনো রং ডিসিশন নিয়ে না ফেলিস। টেক সাম টাইম অমিতা, টেক সাম টাইম!”
“সময়ই তো নিচ্ছি বল! জেনেছি সকালে অথচ এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি তো! এমনকি এই তোকে ছাড়া কাউকে কিছু জানাইওনি। মাকে পর্যন্ত না! কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না শ্রীময়ী! নোংরা মাড়ালে—স্নান না-করা পর্যন্ত—সারা শরীর যেমন ঘিনঘিন করে তেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। নিজেকে ভীষণ অশুচি লাগছে। সমস্ত শুদ্ধতা যেন নষ্ট হয়ে গেছে আমার। মনে হচ্ছে পাপের অতলে তলিয়ে গেছি। নিজেকে এর আগে কখনও এত খারাপ লাগেনি। আমার নিজের জন্যই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে শ্রীময়ী। আমি নাহলে মরমে মরে যাব!”
শ্রীময়ী বুঝতে পারে সিদ্ধান্তের ‘অমিয় সাগরে’ অবগাহন করে অমিতা শুদ্ধ করে নিতে চাইছে নিজেকে। কিন্তু কী সিদ্ধান্ত সে নিতে বলবে অমিতাকে? খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা অমিতার জন্য কী হতে পারে সঠিক পরামর্শ?
“কাল অলোক নিতে আসবে আমাকে। তাই আজকের মধ্যেই নিতে হবে সিদ্ধান্ত। সময় নেই শ্রীময়ী, সময় নেই!”, হিলহিল করে ওঠে অমিতার কণ্ঠ। খোলা ফাঁকা ছাদে এই প্রথম হিমেল ভাব অনুভূত হয় শ্রীময়ীর। আচমকা সে সামনে অমিতা নয়, যেন নমিতাকে দেখতে পায়! উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে শ্রীময়ী। বলে, “অমিতা, চল। আমরা নীচের ঘরে গিয়ে বসি।” কিন্তু ওঠবার নাম করে না অমিতা।
“ধর, আজ সকালে ঋতুবউদি আমার কাছে আসেনি! আমি কিছু শুনিনি, দেখিনি! কিন্তু... কিন্তু এমএমএস-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া ভিডিয়ো ক্লিপিংস—আমার কাছে ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে যা ঋতুবউদি নিজের মোবাইলে লোডিং করে নিয়ে এসেছিল, দেখবার রুচি বা আগ্রহ না-থাকলেও... মনের কোণে... অবচেতনে... হয়তো-বা তখনও অলোকের ওপর থেকে বিশ্বাস পুরোপুরি উঠে যায়নি বলে... একঝলক তাকিয়েও ছিলাম স্ক্রিনের দিকে... জানিস শ্রীময়ী, চমকে উঠেছিলাম, বোঁ করে মাথা ঘুরে গিয়েছিল, ঋতুবউদি না-ধরলে হয়তো মাথা ঘুরে পড়েই যেতাম! আমি কী দেখেছিলাম জানিস! অলোকের চিরপরিচিত সেই বেডরুম আইজ! এত শকড্ আমি জীবনে হইনি। একান্ত ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্তে আমার জন্য ওর যে চাউনি, একটা ভাড়া করা নষ্ট মেয়েছেলের সঙ্গে নষ্টামি করার সময়ও সেই চাউনি! তুই-ই বল, এই সত্য জানার পর, ভালো থাকা কি আর সম্ভব! এমন সত্য জানার পরও কি বাকি জীবন অলোকের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়, না দেওয়া উচিত! সত্যর মতো বড়ো সত্য যে আর কিছু হয় নারে শ্রীময়ী!”
“তুই কি তাহলে অলোকের সঙ্গে ফিরবি না ভাবছিস?”
“ভাবছি তো অনেক কিছুই, কিন্তু কোনো কংক্রিট ডিসিশনে আসতে পারছি না! তুই আমাকে বলে দে—আমি কী করব?”
বাস্তবের মাটিতে পা-রেখে চলা, হিসেবি শ্রীময়ী বলতে চাইল, যা-ই করিস, সিঙ্গল হয়ে অন্তত বাপেরবাড়িতে থাকতে আসিস না।... অমিতা, তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি তোকে অলোকের কাছে ফিরতে বলছি না, নিজের জায়গায় ফিরতে বলছি। বিয়ে হওয়া মেয়ের অধিকারের যে জায়গা, সেই অধিকারের জায়গায় নিজের হিসেব বুঝে নেওয়ার জন্য ফিরতে বলছি। তুই হয়তো বলবি, কেন, বিবাহিত মেয়ের বুঝি বাপেরবাড়িতে কোনো অধিকার নেই? কেন থাকবে না, অধিকার আছে, কিন্তু মর্যাদা নেই। শ্বশুরবাড়িতে অধিকার যেমন আছে, আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারলে সামাজিক মর্যাদাও তেমন আছে। আর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে গেলে সমাজ-সংসারে বোধহয় এটার প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি। নমিতার অভিজ্ঞতাই হয়তো শ্রীময়ীকে দিয়ে একথা বলিয়ে নিতে চায়।
নিজের এই ভাবনায় নিজেই অবাক হয় শ্রীময়ী! নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে যে-শ্রীময়ী এত গুরুত্ব দেয় সে-ই কিনা এমন মর্যাদাশূন্য আপসের পরামর্শ দিচ্ছে! কিন্তু বিবাহিত অথচ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর নয় এমন বিবাহবিচ্ছিন্ন অথবা একা থাকা নারীর জীবন তো নমিতার জীবন! আর তা যে কতবড়ো মর্যাদার তা তো নমিতা জীবন দিয়ে বুঝেছে!
“কী হল শ্রীময়ী, কিছু অন্তত বল! অমিতার ভেঙে পড়া গলার আর্তিতে নির্বাক শ্রীময়ী লজ্জিত হয়।”
ঘোর থেকে জেগে ওঠা গলায় শ্রীময়ী উচ্চারণ করে, “বুঝলি অমিতা, তুই অলোকের সাথে... আর ফিরিস না। তোর অলোকের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কালকে সকালেই দেখবি রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হয়ে অলোকের মুখ থেকে দক্ষ অভিনেতার পেলব মুখোশ কেমন খসে পড়েছে! জীবন থেমে থাকে না অমিতা। ভুলে যা অলোক বলে কেউ একদিন তোর মনের সর্বস্ব অধিকার করে ছিল। আজকের সকালের পর থেকে অলোক তোর কাছে অতীত, জীবন্মৃত, ক্লোজড্ চ্যাপ্টার। জানি তোর এই লড়াই খুব কঠিন। আর এই লড়াই তোকে একাই লড়তে হবে। কিন্তু ভেবে দেখলে দেখতে পাবি নারী চিরকাল একাই লড়েছে। নারীর লড়াই চিরকাল একক লড়াই। তবে আমি তোকে কথা দিচ্ছি—তোর এই লড়াইয়ে তুই চিরকাল আমাকে তোর সঙ্গে পাবি। তুই হয়তো সন্দীপের কথা ভাবছিস। কিন্তু জেনে রাখ সন্দীপ যদি তোর প্রয়োজনে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, খুব ভালো, তোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়, তা-ও ভাল, কিন্তু তোর পাশে এসে দাঁড়াতে ও যদি আমাকে বাধা দেয়, তাহলে আমি ওকে ছাড়তেও এতটুকু দ্বিধা করব না।”
উঠে দাঁড়ায় অমিতা, “শ্রীময়ী, নীচে চল।”
শ্রীময়ী ফিরছিল, একটু অন্যমনস্ক। কিছুটা পর রিংটোনটা খেয়াল করল। স্কুটি থামিয়ে পার্স থেকে সেলফোনটা বের করার আগেই মিসড্ কল হয়ে গেল। সন্দীপ। চমকে উঠল শ্রীময়ী!
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন