preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
দেশ নেই, দেশ আছে
ডায়াস্পোরা

দেশ নেই, দেশ আছে

ডায়াস্পোরা বিভাগ এই ব্লগজিন-এর অন্যতম বিভাগ। নাহার তৃণা-র লেখায় উঠে এসেছে পরভূমবাসের বিচ্ছিন্নতার বেদনা ও নিজ দেশের প্রতি অবিরত আকর্ষণের কথা।

কিছু বায়না করে না পাওয়া বালকের রাগ সামাল দিতে মায়ের হাসিমুখের উপস্হিতি যেমন বালকের রাগ মুছে নেয়, সেভাবে ঠান্ডা বিকেল এসে দাঁড়ায় সময় গড়িয়ে, মুছে যায় রোদের রাগ।

এ সময়টাতে অনেকেই কাজ শেষে বাড়ি ফেরে। আমিও ফিরে আসি শেষ বিকেলের রোদ গায়ে মেখে। ঘরে ফেরার এই সময়ে আমার কেন জানি মনটা কেঁদে ওঠে। আশৈশব যে ঘরে ফিরেছি খেলা শেষে, ক্লাসশেষে, সে ঘরে আর ফেরা হয়না বলেই মনটা কাঁদে, সে আমি বিলক্ষণ জানি। এও জানি, সেঘরে আমার কোনোদিন ফিরে যাওয়া হবে না। এখন আমি অন্য দেশের চেনা-অচেনায় মিশানো এক ঘরে থাকি। আমার মধ্যে সহজেই অন্যকে আপন ভাববার বিরল গুণটি নেই বলেই কি না জানি না, আমি না পারি এ ঘরকে নিজের ভাবতে। না পারি এই দেশটাকে আপন করতে। তবুও প্রতিবার ঘরে ফিরে নিজেকে শোনাই, ‘দিস ইজ হোম।’

বহুদূরের লাল সবুজ পতাকাটি অবিকল একটা সবুজ টিয়া পাখির লাল ঠোঁট হয়ে আমাকে লক্ষ্য করেই যেন গেয়ে ওঠে, ‘এবার তোর আপন দেশে আয়।’ ঘর ছাড়া মানুষেরা ঘরে ফেরার আকুতি বয়ে বেড়ায়। তাদের এক পা যেন উঠেই থাকে আশৈশব পরিচিত গণ্ডিতে সেটি রাখবার জন্য। “বুকে হাওয়া ঘুরে ওঠে শূন্যতা আনে। কে যেন জানতে চায় দেশ কোনখানে?”

অকারণে মনে পড়ে যায় অদ্ভূত সেই সিনেমার কথা ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান!’ কিন্তু ঐ দলে তো আমি পড়িনা। আমি আসলে ঠিক কোন দলে পড়ি? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি। অফিসের এক গোঁড়া বর্ণবিদ্বেষী সহকর্মী মাঝে মাঝেই স্পষ্ট ভাবে জানান দেন, এ দেশটার অধিকার কেবল তাদের, অভিবাসীদের নয়।

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

এমন আচরণের মোক্ষম জবাব দেওয়া যায় ইতিহাসের চোখে আঙুল দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবারই ব্যাপারটা হালকা তামাশায় মোড় নেয়। আড্ডা শেষে ওর স্বদেশী বন্ধুরা স্বভাব সুলভ সুশীল ব্যবহারে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয় লোকটার হয়ে। সে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য খুঁইয়ে বসা মানুষ, সেটা আর দশজনের মতো আমারও জানা। তবুও ভেতরে ভেতরে আমাদের প্রতি কারো ঘৃণা টের পাই, ভদ্রতা বশে তাকে পাশ কাটাই ঠিকই। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে তার রেশটুকু পুরোপুরি মিটিয়ে ফেলতে পারিনা। একটা অক্ষম রাগ বুকের মধ্যে পুষেই রাখি।

কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচারী ইচ্ছার কাটাকুটিতে যদি এই পৃথিবীর মানচিত্রের বুকে এত এত আঁচড় না পড়তো, বিভেদের সীমানা টেনে, দেগে দিয়ে যদি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেওয়া না হতো। তবে কেমন হতো সেই একক পৃথিবীর মানচিত্র? অচেনা সেই মানুষটির মতো অবাক র্নিলিপ্ততায় বলে দিতে পারতাম আমিও তবে, ‘জানিনা কোন দ্রাঘিমায় আমার দেশ।’ আশ্চর্য মেঘদলের পাশাপাশি তবে হয়তো ভালোবাসাবাসিটাও আশ্চর্য সুন্দরই থাকতো এক মানুষের প্রতি অন্য মানুষের। কিন্তু সেটা হবার নয়। তাই সহকর্মীর অবান্তর কিন্তু কার্যকরী খোঁচা বুকের গভীরে অপমান হয়ে জেগে থাকে। অক্ষম রাগ অভিমানী শিশুর মতো ঠোঁট ফুলিয়ে রাখে।

আছে বৈকি, আমারও একটা দেশ আছে। যে দেশটাকে একদিন স্বেচ্ছায় ফেলে চলে এসেছি দূরের এই দেশে। এ নাকি সব পেয়েছি’র দেশ। হয়তো তাই। এদেশে সব আছে। তবুও মন খারাপের প্রহর, কিংবা ঘুঘু ডাকা নিস্তব্ধ দুপুর জানান দেয়, জানালার শিকে মাথা রেখে অজস্র রিকশার ভিড়ের দৃশ্য নেই। সোঁদা গন্ধ মেখে সন্ধ্যাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফেরা নেই। নেই মায়ের আঁচলের উষ্ণ আশ্রয়, বাবার স্নেহার্দ্র আশকারা। নেই পাড়ার ছেলেমেয়েদের হল্লা। বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে যাওয়া লোকটা। ছেলেবেলার অলিগলি সব  উধাও। তার খোঁজে হন্য হয়ে এ ব্লক ও ব্লক করাই সার, এই ছিমছাম সাজানো দেশে। এত বেশি সাজানো গোছানো দেখে নিজেকে মাঝে মধ্যে দম দেওয়া পুতুল মনে হয়। প্রিয় শহরের অনিয়ন্ত্রিত যে ভিড়ভাট্টাকে একসময় অসহ্য ঠেকতো; যোজন দূরত্বে বসে তারই জন্য বোকা মন দগ্ধ হয় সন্তর্পণে। অভ্যস্ত বিদেশি ভাষার ঘেরাটোপ পেরিয়ে আলটপকা কাউকে বাংলা বলতে শুনলে হাভাতের সামনে ভাতের থালা রাখবার মতো ভেতরটা এই এত বছর পরও খলবল করে ওঠে। বাবা বলতো যখন যেখানে থাকবে, সে জায়গাটাকে আপন ভাববে। বাবার শিক্ষা প্রায় ভুলে বসে থাকি। এদেশটা সুখ, নিরাপত্তা আর যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য দু’হাত ভরে দিয়ে যাচ্ছে- তবুও স্বার্থপরের মতো একে একান্ত আপন ভাবতে পারি কই! নিজের স্বার্থপরতায় নিজেই লজ্জা পাই। রাতঘুমে প্রায় স্বপ্ন দেখি, দেশে ফিরে গেছি। আগের মতো হইহই আনন্দে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছি। টেবিলে দেওয়া খাবার ঠান্ডা হচ্ছে বলে মা বানোয়াট রাগ দেখাতে গিয়ে হেসে ফেলছে। বইপাড়া, নাটকপাড়া ডাকছে নাম ধরে…। ঘুম ভেঙে জাগরণে টের পাই বাস্তবে ভূখণ্ড বদলে গেছে। মন কি খারাপ হয়? হয় বইকি। 

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নানান খবর সময় পেলেই খুঁটিয়ে পড়ি। দেশের ভালো খবরে মন যেমন আনন্দে নেচে ওঠে, খারাপ খবরে দমে যায়। খবরের নাড়ী টিপে বোঝার চেষ্টা করি দেশটার স্পন্দন। দেশ খুব ভালো নেই, টের পাই। স্বার্থে অন্ধ একদল নিজেদের আখের নিয়েই ব্যস্ত। সে ভালো থাকে কীভাবে? দেশের কী অনুভূতি আছে? সেও কী বুকের ভেতর কষ্টগুলো পুষে রাখে? নাকি অসহায় দেবতার মতো সে কেবলই দেখে যেতে শিখেছে? কেঁদে যেতে শিখেছে? নিজের কাজকর্মে হাসিও পায়। দেশে থাকতে পত্রপত্রিকা এতটা মনোযোগ দিয়ে পড়েছি কিনা সন্দেহ। এখন দূরে বসে মায়াকান্না মূল্যহীন। তবুও মন বেয়াড়ার মতো ভাবে, অদৃশ্য কাকে যেন প্রশ্নও ছুঁড়ে দেয়। উত্তরহীন সেসব প্রশ্ন ঝুলে থাকে ছেলেবেলায় দেখা ইলেক্ট্রিকের তারে ঝুলন্ত বাদুড়ের মতো। 

দেশ নাকি মায়ের মতো? তবে? তবে সন্তান হয়ে আমরা কীভাবে পারি তাকে অপমানে বিদ্ধ করতে! কেবলি অবয়ব পেয়েছি হয়তো, মানুষ হতে পারিনি। নইলে কী উপায়ে সম্ভব হয় সন্তান দ্বারা মায়ের অপমান? স্বার্থপর, খুবলে খাওয়াদের পাতে দেশটা তার সর্বস্ব তুলে দিতে দিতে নিঃস্ব। স্বাধীন কিন্তু একা। 

প্রশ্ন আসতেই পারে, এত যে বড় বড় কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছো, তুমি কোন কাজে লাগছো দেশের? এবেলায় মুখে কুলুপ! এবেলা ভীষণ রকম চুপ। আমি ভীষণ রকম স্বার্থপর ভাবে কেবল নিজেই সুখী থাকতে ভালোবাসি। আমার কী আসে যায় দেশের কথা ভেবে! দেশের নানা সংকট-সংগ্রামে আমি তো বুক চিতিয়ে রাজপথে গিয়ে দাঁড়াই না। যাঁরা বুক দিয়ে দেশের সংকট সংগ্রামে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়ান, দেশটা তাঁদের নামেই লিখে দিলাম। দেশ নিয়ে আমার ভাববার অধিকার নাই। ভাবতেও চাই না। কাঙ্গাল মন যেন কোনো ভাবেই মুখ ফসকে বলে না ওঠে, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ সেদিকে কড়া পাহাড়া বসিয়ে দিলাম। নাহ্ আর ভাববো না দেশ নিয়ে... দেশ আমাকে খাওয়ায় না পরায়! দেশ আমার কথা ভাবে নিশিদিন? আমি তো তার কাছেও কেউ নই আর। কেবল মুখ ফুটে ঐ সহকর্মীর মতো বলে না কেউ, এদেশ তোমার নয়। কারণ দেশে গেলে আমি ঠিক তেমন অভ্যর্থনাই পাই, যেমন পেয়ে থাকে একজন ভিনদেশী আগন্তুক। আমার উপস্থিতির উদ্দেশ্যে বহুদিন পর দেখা হওয়া প্রায় সবার মুখের প্রথম বুলিই থাকে, ‘ক’দিন থাকছো? ফিরছো কবে?’ স্বদেশীদের কাছে এখন আমি কেবলই শীতের পাখি যেন। মেয়াদ ফুরোলেই ফেরার পালা তাই। বুকের ভেতরের অসহায় মানুষটা মনে মনে বিড়বিড় করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালায়…

“আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা―
সারা দেশে।” 

বাচ্চা ছেলের অভিমান নিয়ে দূরে থাকি। সুখেই আছি। আমার কোনো দেশ নাই, এই বোধকে দানা পানি দেই যত্ন করে। তবুও তাতানো দুপুর গড়িয়ে একটা শান্ত বিকেলকে বুকে নিয়ে যখন গোধূলি বিষণ্ন রাজকীয়তায় শিশিরের শব্দে নেমে আসতে থাকে, বুকের ভেতর কাঙ্গালপনা কেন এভাবে ছলকে ওঠে! কেন ছন্নছাড়ার মতো তার জানতে ইচ্ছে করে―

“কতদিন বুকে মাখনি স্বদেশ?
বহুদিন হলো মরে বেঁচে থাকা
এই শূন্যতা হলোনা তো শেষ!” 


একটা গল্পের আদল ফুটে উঠতে না উঠতেই খেই হারিয়ে ফেলি। লেখাটা আধখামচা ভাবেই পড়ে থাকে। শূন্য ক্যানভাস, ইজেল, রং,তুলি উদাসী মুখে তাকিয়ে থাকে। আমি ততোধিক উদাস ভাব নিয়ে পাশ কাটিয়ে বুক শেলফের ধুলো ঝেড়ে তুলে আনি প্রিয় কোনো কবিতার বই…

“বালক জানে না তো কতোটা পথ গেলে
ফেরার পথ আর থাকে না কোনো কালে,
বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে”
ক্রমাগত ভুলেভরা বালকের জন্য মনটা হু হু করে ওঠে অকারণেই। বইটা নামিয়ে রেখে খোলা জানালার কাছে আশ্রয় পেতে চায় মন। ‘আমার জানলা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়’। আকাশের মেঘেরা দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছে, আমার দিকে মনোযোগ দেবার সময় কোথায়! অভিমানী আমি তাই, আকাশকে উপেক্ষা করে রাতের শহরে চোখ মেলি।
কৃত্রিম আলোতে ভেসে যাওয়া শহরটা এখন একমনে ঝিমোচ্ছে। দিনভর মানুষের হরেক ব্যস্ততা শহরটাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। এখন যেন একটু অবকাশ। একটু নিজের মুখোমুখি বসিবার পায় অধিকার। শহরের এক রাস্তা কি আরেক রাস্তার সাথে কথা বলে এই অবসরে? কী কথা বলে তারা পরস্পরে? আমি কান পাতি, রাস্তার ফিসফিসানির বদলে আমার কানে উঠে আসে দূরবর্তী কোনো ট্রেনের ঝমঝম শব্দ। আমার এই ঘর থেকে ট্রেন আসা-যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। ধারে কাছেই স্টেশন।
একবার ট্রেনে করে আমার কোথাও যাবার কথা ছিল। হাতের কাজ সেরে একটু আগেভাগেই চলে গিয়েছিলাম সেদিন স্টেশনে। ট্রেন আসতে তখনো বেশ কিছু সময় বাকি ছিল। এদিক-ওদিক খানিক ঘুরে ফিরে লোহার বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসি। চোখ বুঁজে কান পেতে রাখি ট্রেনের হুইসেল শুনবো বলে। হঠাৎই টুকরো গানের কলি ভেসে আসে কানে। কৌতূহলী হয়ে তাকাই। একটু দূরে, ছোটো খাটো জটলা, বুঝি ওখানে কোনো ভাসমান শিল্পী গান ধরেছেন। “ও মেয়ে আজ রাতে আর ফিরছি নাকো বাড়ি, তোমার সঙ্গে নিলাম আমি সাত জনমের আড়ি। ঢের হয়েছে ঘরকন্যা এবার বাঁধন ছিড়ে আমি ঐ আকাশ পানে যাবো…আমি আকাশ ছোঁবো, আকাশ পানে যাবো…,” নিতান্তই গ্রাম্য সুরে গাওয়া গান। কৃষ্ণাঙ্গ গায়কটি দক্ষিণের মানুষ হয়তোবা। উচ্চারণে সে ছাপ টের পাই। হঠাৎই কী হয়, আমি সব ভুলে ঐ ছোট্ট জটলার মাঝে গিয়ে বসি। সব ভুলে যাই…আমার কোথাও যাবার কথা ছিল। হয়তো যেখানে যাচ্ছিলাম, সেখানে আমার জন্য কেউ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিল না। তবুও আমার ফিরবার কথা ছিল। কেবল ছিল না ফিরে যাবার তুমুল আলোড়ন। নইলে সেদিন খোদ স্টেশনে থেকেও কী করে ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাইনি! এরকমটি আমার খুব হয়। বেমালুম সব ভুলে যাই হঠাৎ। পথের মাঝখানে গিয়ে ভুলে যাই আমার গন্তব্য ঠিক কোথায়! ইদানীং এটা যেন বেশিই হচ্ছে। মাঝে মাঝে এ কারণে আতংক হয়। সিনেমাতে দেখা সেই মানুষটার মতো একদিন পথের মাঝে দাঁড়িয়ে আমিও যদি ভুলে যাই, আমি কে? কোথায় আমার গন্তব্য! 
আমার সহকর্মী এলিস আমার এহেন ব্যবহারে একটু চিন্তাগ্রস্ত। হয়তো ব্যাটা ভাবছে আমি না প্রোজেক্টের ভরাডুবি করি! দল থেকে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য লোক ঢোকানোর বুদ্ধি মাথায় এলেও তাকে বাউন্স ব্যাক করতেই হবে আমার অতীত দক্ষতার জোরেই। তাই ওসব নিয়ে আমি মাথাকে ব্যস্ত হতে দেইনা। চাকুরির বাজারে মহামন্দার রেশ এখনো কাটেনি... আমাদের এখানেই এক ব্রাজেলিয়ানের চাকুরি চ্যুতি নিয়ে ঘটে গেছে মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনা। অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর মানসিক চাপে বেদিশা হয়ে অনেকেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে গতবছরের অনেকটা সময় জুড়েই। বিচ্ছিন্ন এসব ঘটনাগুলো এলিস আমাকে একরকম জোর করেই গেলায়। কারণটা স্পষ্ট, কিন্তু আমি নির্লিপ্তভাবেই শুনে যাই সেসব। নিজের প্রতিক্রিয়া জানাবার তাগিদ অনুভব করিনা। রাগী গলায় এলিস আমার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয় পুরোনো বুলি, ‘তোমার ধ্বংস হোক!’ এই কথা সে যখনই উচ্চারণ করে, কোনো এক অজানা কারণেই আমার বেদম হাসি পেয়ে যায়। আমি হাসির দমক লুকোবার জন্য যখন যা পাই তার আড়ালে মিশে যাবার চেষ্টা করি।
এলিস হতাশ হয়ে ফিরে যায় নিজের নির্দিষ্ট কিউবিকলে। আমি শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকি মনিটরের দিকে। মন উড়ে যায় অন্য কোথাও, অন্য কোনো খানে…। সেই মাটিতে যার গভীরে আমার নাড়ী পোঁতা আছে। দূরে বসে কল্পনায় সেই মাটির বুকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, যদি সে আমায় ডাক পাঠায়! যেদিন সে ডাক শুনতে পাবো, সব অভিমান মুছে জন্মভূমির মুগ্ধ মাটিতে পা রেখে বলবো, 
“আমি আবার ফিরে এলাম, আমাকে নাও
ভাঁড়ার ঘরের নন মরিচ আবার মশলাপাতা গেরুয়া ছাই
আমায় তুমি গ্রহণ করো।
আমি আবার ফিরে এলাম,
সিগ্ধ কাক, আলাপচারী তালচড়াই
আমাকে আজ গ্রহণ করো।”



কৃতজ্ঞতা স্বীকার:  কবি সৈকত কুণ্ডু’র কবিতা, ‘দেশ’।
কবি আহসান হাবীরের কবিতা, ‘আমি কোনো আগন্তুক নই’।
কবি আবুল হাসানের কবিতা, ‘প্রত্যাবর্তনের সময়’।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

নাহার তৃণা। জন্ম ঢাকায়। বর্তমানে ইলিনয়ে বসবাস। মূলত গল্প লেখায় ঝোঁক। পাশাপাশি অনুবাদ, প্রবন্ধ, সিনেমা-সাহিত্য সমালোচনা লিখে থাকেন। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস’ প্রতিভা অন্বেষণে তার “স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট”, সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। গল্পপাঠ, পড়ুয়া, এবং শিশুকাগজ ওয়েবজিনের সঙ্গে জড়িত। প্রকাশিত গ্রন্থ: স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট (পেন্সিল-২০২০), একডজন ভিনদেশি গপ্পো(অন্বয়-২০২০), দূরদেশের গল্প (চৈতন্য-২০২২)। সম্পাদিত গ্রন্থ: গল্পের পুষ্পিত কুঞ্জ (বইয়ের হাট পাবলিকেশন্স-২০২১), গল্পপাঠ নির্বাচিত জাপানি গল্প সংকলন (যৌথ সম্পাদনা-২০২২), গল্পপাঠ নির্বাচিত লাতিন আমেরিকান গল্পসংকলন (যৌথ সম্পাদনা- ২০২২)।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন