preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
পাহাড়ের প্রেমে সাগরের সংগমে
ট্রাভেলগ

পাহাড়ের প্রেমে সাগরের সংগমে

কেউ বলে সাগর আবার কেউ-বা যাবে পাহাড়। অবশেষে সহজেই বেরোল সেই সমাধান সূত্র। আসলে এক যাত্রায় চাই আমাদের পৃথক ফল। তা-ই ঠিক হল আমাদের এবারের গন্তব্যস্থল বিশাখাপত্তনম বা ভাইজ্যাগ। যেখানে পূর্বঘাট পর্তমালার পা ডুবে আছে সাগরে।

গত দু-বছর ধরে কাজের অহেতুক চাপে সকলের মন হয়ে উঠেছিল যেন খাঁচার পাখি। গত শীতে সেই বন্দিদশায় কিছুটা ইতি টানা গিয়েছিল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম দল বেঁধে ব্যাগ গুছিয়ে। তবে বেগ পেতে হয়েছিল একটু স্থান নির্বাচনে। কেউ বলে সাগর আবার কেউ-বা যাবে পাহাড়। অবশেষে সহজেই বেরোল সেই সমাধান সূত্র। আসলে এক যাত্রায় চাই আমাদের পৃথক ফল। তা-ই ঠিক হল আমাদের এবারের গন্তব্যস্থল বিশাখাপত্তনম বা ভাইজ্যাগ। যেখানে পূর্বঘাট পর্তমালার পা ডুবে আছে সাগরে। হাতে বড়োদিনের ছুটিতে সময় মাত্র এক সপ্তাহ। সেই ফুরসতেই আমরা বড়োদিনের আগের সন্ধ্যায় চেপে বসলাম যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসে। পরদিন দুপুরে গিয়ে নামব ভাইজ্যাগে।

ট্রেন যাত্রাটি বড়োই নয়নাভিরাম। তবে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় দৃশ্য উড়িষ্যার চিল্কার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। মনে হয় ট্রেন যেন নিজের পথ ছেড়ে সাগরে নেমে যাচ্ছে ধীরে। আর ঠিক তখন থেকেই যাত্রাপথের দু-ধারে আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হল ছোটো-বড়ো পাহাড়। ভাইজ্যাগ নেমেই আমরা স্টেশন থেকে একটা অটো ধরে সোজা সমুদ্রের ধারে। হোটেল ডলফিন। সামনেই প্রশস্ত রামকৃষ্ণ বিচ। এই নাম হওয়ার কারণ ঠিক বিচের ওপরেই অবিকল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে একটি কালী মন্দির। হোটেলে ঘরের প্রশস্ত জানলার পর্দা সরাতেই সামনে বঙ্গোপসাগর। তবে পুরী বা দীঘার থেকে তার রূপ আলাদা। কেউ যেন কালির দোয়াত উলটে দিয়েছে। আমাদের চোখ আটকে গেল সেই নীলাম্বরী বিপুল জলরাশিতে।

ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই বিকেলের দিকে আমরা পায়ে হেঁটে বেরোলাম সমুদ্রের ধারে। বিচ ধরে একটু এগোতেই চোখে পড়ল বালির চড়ায় রাখা রয়েছে এক বিশাল সাবমেরিন। ভেতরে ঢোকার প্রবেশমূল্য আছে। এই প্রথম জীবনে আমরা সাবমেরিন দেখলাম। তবে ভেতরের গঠনগত নৈপুণ্য অবর্ণনীয়। এত অল্প স্থান সংকুলানে যে কত কম জায়গায় কীভাবে বেশি জিনিস ধরানো যায়, তা নিজের চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য! জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। সাবমেরিন দেখে পাশেই গেলাম এক সেনাবাহিনীর মিউজিয়ামে। ঢুকতেই সামনে একটি প্যাটন ট্যাঙ্ক রাখা আছে। তার ভেতরে ঢুকে ছবি তোলা যায়। এ ছাড়াও অনেক কিছু দেখার আছে। ভালোই লাগল বেশ। এবার গেলাম বিচের ওপরেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে কালী মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখতে। আরতি দেখার পর আমরা বিচের ধারেই তৈরি এক সুন্দর ইকো পার্কে গিয়ে বসলাম। এখানে চীনে বাদাম সিদ্ধ করে বিক্রি হয়। তাই নিয়েই বসে গল্পের মাঝে প্ল্যান করে নেওয়া হল পরদিন সাইটসিনের।

পরের দিন খুব ভোরে উঠে আমরা সকলে স্নান সেরে নিলাম। অসুবিধে হল না। এখানে শীতকালেও আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। স্নানের উদ্দেশ্যে আমরা ভোরবেলাতেই যাব পাহাড়ের মাথায় সীমাচলম মন্দিরে। মন্দির খোলে ভোর ছ-টায়। এখানে নারিকেল দিয়েই পুজো দেওয়ার রেওয়াজ। চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ভোরবেলাতেই বেশ ফাঁকায় দর্শন হয়ে গেল বালাজী মূর্তির। এবার হোটেলে ফিরে প্রাতরাশ করার পালা। সকালেই একটি গাড়ি ঠিক করে নিয়েছিলাম। গাড়িটা সারাদিন থাকবে আমাদের সাথে। জলখাবার খেয়ে বেরোলাম ঋষিকোন্ডা বিচের উদ্দেশ্যে। এই সমুদ্র সৈকতটি ভারতবর্ষের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানে ঠিক যেন সমুদ্রে পা ভিজিয়ে পূর্বঘাট পর্বতমালা দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের গায়ের সবুজ অরণ্যের ছায়া পড়েছে সাগরের নীল জলে। সে এক নৈসর্গিক শোভা। কেউ এখানে থাকতে চাইলে পাহাড়ের মাথায় অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের রিসোর্ট আছে। কোলকাতায় অন্ধ্র ট্যুরিজম থেকে বুকিং হয়। তবে স্নান করার পক্ষে রামকৃষ্ণ বা এই ঋষিকোন্ডা সৈকত কোনোটিই উপযুক্ত বা নিরাপদ নয়। এবার আমরা যাব কৈলাসগিরি পাহাড়ের চূড়ায়। কয়েকটা ঘূর্ণিপাক দিয়ে কৈলাসগিরির মাথায় চড়তেই আমাদের চোখ বিস্ফারিত। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখি সদূর অনন্ত বিস্তৃত বঙ্গপোসাগর পায়ের নীচে, আর সম্পূর্ণ ভাইজ্যাগ শহর স্পষ্ট দৃশ্যমান। এ ছাড়াও এই কৈলাসগিরিতে আরও কিছু আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল টয় ট্রেন আর‌ হর-পার্বতীর এক বিশাল মূর্তি। যথারীতি টয় ট্রেনে চড়ে কৈলাসগিরির উপরিভাগ জুড়ে সুন্দর সাজানো এক উদ্যান ঘুরে দেখলাম। এবার আমাদের হোটেলে ফেরার পালা। দুপুরে আমরা দক্ষিণ ভারতীয় খাবার পাশ কাটিয়ে বাঙালি খাবারের স্বাদ নিতে গেলাম ভাইজ্যাগের একমাত্র বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ ‘নিমন্ত্রণে’। তারপর ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার ক্লান্তিতে একটু ভাতঘুমের বিশ্রাম। আজকের সন্ধেটা রামকৃষ্ণ বিচেই কাটাব। পরদিন আমাদের গন্তব্য আরাকু উপত্যকা আর বোরো গুহা। ভোর ছ-টায় ট্রেন, কিরনডুল প্যাসেঞ্জার।

এই আরাকু আর বোরো গুহা আমরা গিয়েছিলাম অন্ধ্রপ্রদেশ ট্যুরিজিমের তত্বাবধানে। প্যাকেজ ট্যুর বুকিং করেছিলাম কোলকাতা থেকেই ওদের অফিসে। ট্রেনে যাওয়ার উদ্দেশ্য হল, যাওয়ার পথে প্রচুর টানেল দেখা। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ঘন্টাপাঁচেক লাগল আরাকু পৌঁছতে। এই উপত্যকার কফি বাগানে ঘেরা স্বর্গীয় পরিবেশ সত্যিই মনোমুগ্ধকর। বাগানের ভেতর একটি গাছবাড়িও আছে দেখলাম। ইচ্ছে করলে না কি থাকা যায়। কফি গাছের মাথা যেন আকাশের সাথে কথা বলছে। আর তার নীচে এক অদ্ভুত রোদহীন আর্দ্রতা। এখানকার কফি জগৎবিখ্যাত। তাই অল্প নিলাম। স্থানীয় আদিবাসীদের ধিমসা নাচ অনেকদিন মনে থাকবে। সঙ্গে আনা শীতবস্ত্রগুলো এখানেই প্রথম কাজে লাগল। বেশ ঠাণ্ডা। অসুবিধে বলতে একটারই সম্মুখীন হয়েছিলাম, সকাল থেকে শুধু দক্ষিণ ভারতীয় খাবার। তবে ব্যবস্থা অঢেল। খেয়েদেয়ে উঠে এবার আমরা ভলভো বাসে করে গেলাম বোরো গুহা দেখতে। যেটা আসলে শুনেছি নাকি বিশ্বের বিস্ময়।

সত্যিই বোরো গুহায় পৌঁছে বুঝলাম কিছু ভুল শুনিনি। বিশাল গুহামুখ। দূরে কোনো এক অজানা ঝরনার জলের কুলুকুলু অবিরাম শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে অনেক নীচে নামা যায় গুহার ভেতরে। গুহার ভেতর চুনাপাথরের দেওয়াল। সেখান দিয়ে ক্রমাগত গড়িয়ে পড়ছে জল। আর তাতে এই গুহার অন্তবর্তী গঠন সদা পরিবর্তনশীল। জলের মৃদু ঘর্ষণে ঈশ্বর যেন সর্বদা চুনাপাথের দেওয়ালে এঁকে যাচ্ছেন তাঁর অনবদ্য চিত্রকলা। সৃষ্টিকর্তার এ এক অপরুপ সৃষ্টি! বোরো গুহা থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম অনন্তগিরি বলে একটা জায়গায়। এখানে দেখলাম মেঘ আটকে আছে নানা জায়গায় পাহাড়ের বুকে। যেভাবে ঠিক ছোটো ছোটো দুঃখ আটকে থাকে সুখের ভেতর। ভাবতে ভাবতেই মেঘ গায়ের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আমাদের ভিজিয়ে দিল। এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম নীচে শ্যুটিং স্পট। এখানে না কি বহু বিখ্যাত হিন্দি ছবির শ্যুটিং হয়েছে। আমার চোখে চিরদিনের মতো লেগে রইল অনন্তগিরি। এবার আমাদের ভাইজ্যাগ ফেরার পালা। ফিরতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল।

পরদিন আমাদের রাতে কোলকাতা ফেরার ট্রেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশের টেবিলে হোটেলের সেবাবন্ধু ছেলেটি ভাঙা হিন্দি আর তেলেগু মিশিয়ে বলল, ফিস হারবারটা একবার দেখে আসতে। সারা ভারতবর্ষে মাছের মূল জোগানটা নাকি এখান থেকেই আসে। মনে হল ঠিকই তো, আমরা তো কোলকাতায় ঘরে বসে অন্ধ্রের মাছই খাই। তাহলে যাই একবার। দেখতে গেলে মন্দ হয় না। একটা পাহাড় এখানে অনেকটা ঢুকে আছে সমুদ্রের ভেতর। তার কোলেই এই ফিস হারবার। গিয়ে বুঝলাম, সত্যিই এখানে একবার না এলে ভাইজ্যাগ ভ্রমণ অনেকটাই অধরা থেকে যেত। অবাক হয়ে জীবনে এই প্রথম দেখলাম মাছের পাহাড়। ট্রলার সামুদ্রিক মাছ এনে উপুড় করে দিচ্ছে সমুদ্র সৈকতে। এ ছাড়াও আছে চাষের চালানি রুইমাছ। জেসিবিতে করে সেইসব মাছ তোলা হচ্ছে ট্রাকে। এই দৃশ্য দেখে এক বিরল অভিজ্ঞতা হল জীবনে। এবার একটু ছোট্ট কেনাকাটার পালা। বাজার ঘুরে দেখলাম, স্টিলের বাসনই এখানে অন্যান্য জায়গার তুলনায় বেশ সস্তা। বাধ্য হয়ে তা-ই কিছু কেনা হল। এবার ঘরে ফেরার পালা। রাতের ডাউন যশোবন্তপুর এক্সপ্রেসে।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

জীবনে বহু জায়গায় ঘুরেছি। কখনো সমুদ্র মাতাল করেছে আবার পাহাড় করেছে উদাসীন। কিন্তু এইবারের ভ্রমণে এত অল্প সময়ে স্বল্প খরচে যে সাগর আর পাহাড়ের মেলবন্ধন উপভোগ করলাম তা অবর্ণনীয়। তবে একটা কথা সব শেষে মাথায় রাখতে হবে যে শীতকাল ছাড়া এখানে যাওয়া একদমই উচিত হবে না। বাকি এই লেখা পড়ে যদি যান, কথা দিচ্ছি, বিন্দুমাত্র হতাশ হবেন না।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, আনন্দমেলা, নবকল্লোল, ও বর্তমান প্রকাশনীর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং অসংখ্য গল্প সংকলন ও পত্রিকার নিয়মিত লেখক। ২০২৩ সালের এবিপি আনন্দ-র সেরা গল্পকার (অণুগল্প)। একক বই— ‘বই-শাখে পঁচিশ’, ‘চতুরঙ্গে দৈবরহস্য’, ‘যেসব গল্প বলা বারণ’, ‘কুড়ির মধ্যে কুঁড়ি’।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন