প্রকাশিত হল তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা ‘এসো পিতা, প্রিয় পিতৃলোক’।
কেমন স্বজন তুমি? তোমাকে ফেলে যাই ও নিঠুর বেদনায় একাকী
বলো, সে রাত্রির, বলো, সে সকালের কেমন আসা-যাওয়া নীরবে
তুমি তো ডাকোনি, আমাকে কখনো আপন স্বভাবে, আর যা
দেখেছি পড়ে আছে... স্মৃতির ভারানত এবং ছলছল সেসবের
এখন কাছে এসে কেবল সাজিয়েছি অনতিক্রমের যত উৎস
এখন দূরে গিয়ে কেবলই ভুলে থাকি নিঃস্ব দুপুরের স্বপ্ন...
***
যখন আমাদের অভিমানী অপেক্ষা শেষ হল,
যখন শেষ হল নানান পাথর সাজানো পথে ও পথে-প্রান্তরে
ফেলে রাখা স্মৃতি হাতড়ানোর অপেক্ষা,
তখন একটা পাতা খসে পড়ল না বয়স থেকে,
তখন একটা মেঘ হু-হু বেদনার মতো ভেসে এল না এত পথ পেরিয়ে
যেখানে অনন্যোপায় ঠেলে দিয়েছ আমাকে, যেখানে শব্দের পাশ কাটিয়ে,
নিঃশব্দের পাশ কাটিয়ে নিঃস্ব হতে শেখা এক জীবনভরতি
ভালোবাসার কাছে
আমার আসলে হাহাকার প্রত্যাশা ছিল,
প্রত্যাশা ছিল আরও একটু ময়লামাটি সরিয়ে বেঁচে ওঠার
কৌশল জেনে নেওয়া,
প্রত্যাশা ছিল... শুধু এক শূন্যপথে অগভীর খাঁখাঁ রৌদ্রালোকে
কে যেন বার্তার মতো বয়ে নিয়ে এল এই মুহূর্ত,
যার জন্য বহুদিন প্রতীক্ষায় অপেক্ষার প্রতিটি প্রহরের কাছে
রেখেছি আরও আরও অঙ্গীকার, চেয়েছি, না, না, আরও একটু,
এবারের মতো কেটে গেলে হয়...
***
তবু অলক্ষে, মৃদু অলক্ষে এসেছ
যেন অনন্ত, যেন অশান্ত বাসনা
আমি নিশ্চুপ অপেক্ষা লিখে কেঁদেছি
যেন সহজের কাছে সমস্ত ভাসমান...
***
অনতিক্রমের কাছে ফিরে ফিরে আসি।
স্বজনের সমাগম ঠেলে ঠেলে ফুঁপিয়ে ওঠা বিকেলের রোদে
তখনও যে শূন্যতা আমার শরীর ছুঁয়ে গেছে,
যে-চিৎকার আমাকে সতর্ক করেছে,
যেসব আসন্ন ভয়ে মরুবাক বেদনাতাড়িত আমি উঠে আসছি
এই অভাবের, তখনও না-বোঝার পাশ কাটিয়ে, আর দেখছি,
ও আমার আজীবনের অবজ্ঞামাখা প্রেম,
ও আমার ধুলোমাটির গন্ধমাখা নিশিযাপনের আলো...
সবাই কেমন যেন দায় সেরে ফিরে যেতে চায়।
সবাই কেবল নিজেকে প্রমাণ করবে বলে এগিয়ে আসে।
***
অসংলগ্ন এই গোপনের মধ্যে যেসব অসম্ভবের ছায়া
সেসব যেদিন সত্যি হল, সত্যি এবং আসলে বিস্ময়।
অসংলগ্ন প্রত্যাশাকে সাজাই, যেন সুদূর অভিমানে
কান্না আসে, কান্না আসুক, এই হারানোর কান্নামাখা ভয়...
***
প্রতিটি কান্নায় কিছু অভিমান জমা থাকে।
প্রতিটি কান্নায় কিছু লুকোনো অভিনয় দেখে বুঝি,
প্রত্যেক চোখেরই বহুবিধ দৃশ্যান্তর আছে।
কেবল সেই অদৃশ্যের পাশাপাশি হাঁটি,
কেবল দৃশ্যান্ত খুঁজে আমাদের অবসন্ন সীমানায় না-দেখার পায়ে,
ব্যর্থতার পায়ে ফুল ছড়িয়ে রাখি।
আর অনেক দৃশ্যের মতো অনেক অভিনয় পার করে এসে
যে-কুঞ্জের কাছে অবসন্ন চুপিচুপি কাঁদি, তার প্রতিটি শাখার কাছে
আমার এ জন্মান্ত অভিমান লেখা আছে। তাদের প্রতিটি ভোর জানে
কী রহস্যের অবহেলা পার হয়ে, কত হ্যা-হ্যা পার হয়ে,
বন্ধুদের ফিসফিস, পড়শির খ্যাক-খ্যাক, স্বজনের ধুত্তোর পেরিয়ে
ভোরের শহরগামী ট্রেন হা-ক্ষমাপিড়িত যত যন্ত্রণার ভেতরে,
যত অদেখা রক্তক্ষরণের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে এতদূর এনেছে আমাকে।
শিখিয়েছে এই নিশ্চুপ বেঁচে থাকা...
***
তখন অবসরে যেভাবে কেঁপে ওঠে আমার শব্দের কান্না
এবং যে পাথর সাজিয়ে অবসরে দিয়েছে জীবনের যত ক্ষোভ...
তখন এইভাবে দাঁড়ালে মনে হবে আসলে ক্ষমাই ঈশ্বর!
আমাকে শিখিয়েছে নীরব হতে হতে কীভাবে পাখিসব উড়েছে...
***
তেমন অদৃশ্যলোকে কে এসে দাঁড়ায় চুপিচুপি?
কে এসে হাত রাখে কাঁধে? কে এসে ফিসিফিস বলে যায়
ও আমার আশৈশবের পার হওয়া...
ও আমার গন্ধে গন্ধে পার হওয়া অসীম দুপুর...
আমি শুধু নতজানু হতে হতে ভাবি, এত যে মূর্তির কাছে,
এত যে বিশ্বাসের কাছে হা-আরোগ্যকামনায় কেটে গেল একটা অতল...
আর কার অপেক্ষায় কেঁদে উঠব? আর কার কাছে অবনত নীরবে বলব,
বাবা, বাবা, আমি সেই হতাশ সন্তান তোর, যাকে আমি নিজেই চিনি না...
কার কাছে ছুটে এসে বলব, বাবা, বাবা, চুপ করো...
মা আমার আসমস্ত অপেক্ষায় রাত জেগে জেগে
সাজাচ্ছে তাঁর অফুরান সিঁদুরের কৌটো,
আর হাউহাউ কেঁদে উঠছে, দ্যাখো, বাবা, দ্যাখো,
তোমার সে কাশির দমকে উড়ে যাওয়া রক্তিম ভবিষ্যৎ
কেমন আঁচলে আঁকড়ে ধরে মা আমার ভেসে যাচ্ছে
তোমার ডুকরে ওঠা রক্তস্রোতে,
তোমার হারিয়ে ফেলা স্মৃতিঘোরে, আসমস্ত যাপনের
একটুকরো মুখ ফিরিয়ে উঠে আসা যত সিন্ধুসমূহের স্রোতে,
বাবা, তুমি ফেলে গেছ দু-একটি চকিত মেদুর...
যেমন কাতরে উঠে অবিশ্বাসে দেখেছ কারা যেন
টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে
আসমস্ত জীবনের অলিখিত দিনলিপি, তারই পাতায় পাতায় আঁকা
অবনত সন্তানের অসহায় তাকিয়ে থাকা, আর তুমি বিশ্বাস করছ,
আমার এ-পথ, আমার এ-সম্ভাবনা তুমি পরিণত হতে দেখেছ
কত-না জন্মের পার থেকে...
দেখেছ তোমার ক্লান্তি, মা-র ওই আসমস্ত রাতজাগা মৃত্যুবোধ,
তোমার স্থিতিসম্ভাবনা, আমাদের লণ্ডভণ্ড সমাহার পেরিয়ে আসলে
যে-পূর্ণিমা দেখেছ তুমি, তা আমার আকাশের ঘোর থেকে
বহু বহু নিষেধের ছায়া রেখে গেছে।
এমন নিশিথ নেই যাকে আমি আপন ভাবিনি।
তোমার যে স্নেহগন্ধ, তোমার যে নীরবের মতো করে বলে ওঠা
নানান কাহিনি,
ওই যে অনেক কথা যাকে তুমি সাজাতে পারোনি বলে
নিভৃতে দেখেছ কেন শব্দগুলি ফিরে যাচ্ছে আর তাঁর হাহাকারে
কেঁদেছ, কেঁদেছ আর আধোঘুমে ফিরে গেছ
প্রস্তরীভূত কত কত অতীতের দেশে,
অথচ ফেরার পথ অচেনাই, তাই আর বলোনি সেসব...
বাবা, তোর এই হতাশ সন্তান জানে, তাঁর সব শ্রুতিদোষে
বাষ্পদীঘল চোখে ভেসে ওঠে এই।
শুধু এক মহাশূন্য, ছায়া নেই, নিরাশ্রয়ে তোকে যে রেখেছি ওই,
মাখিয়েছি সুগন্ধীর ছোঁয়া, ধুয়ে-মুছে পরিয়েছি নববস্ত্র...
এসব আজও তাঁর স্বপ্ন মনে হয়। ভাবি, যত প্রশ্নঘোর,
পীড়িত স্বপ্নের বুকে তোকে অপহতা-অসুরের-রাক্ষস ভেবে
কাদা-মাটি-তিল রেঁধে অমন বসন্তমুখে খড়কুটো গুঁজে দেব...
কেমন স্বজন আমি? কেমন সন্তান আমি তোর?
যে আমার রাত্রিজুড়ে অপেক্ষায় বসে থাকা মেঘ,
আমার অদৃশ্য সব মনখারাপের দিনে ডেকে নিত
একঝাঁক পাখিভরতি বন,
বনভরতি আলো আর তোমার মেদুরগন্ধে
না-আঁকা স্মৃতির ছবি জুড়ে, বসন্তের গন্ধ জুড়ে,
নানান অনতিক্রম পেরিয়ে আসা বিপত্তি এড়িয়ে যত ছায়া রেখে গেছ,
বাবা, আমি তাকে কী করে এমনভাবে ফেলে যাই
জঠরের মতো তীব্র হোমানলে।
ভাবো, এই রুগ্ণ কাঁধে কলসের ভার নিয়ে দেখে যে তুমি কেঁদেছ গোপন,
আজ আমি মাকে গিয়ে যদি বলি, যদি বলি এই সন্ধ্যা...
সাধ্যের অতীত যত নিষাদপ্রবণের প্রহরে তুমি উঠে এলে জল থেকে,
কেবল শরীর নেই, শরীর-শরীর সব আলো,
দেখলাম নিভে গেছে আর মা অসীম যে-প্রশ্নবোধে
আমাকে ডেকেছে কাছে,
যাকে আমি এতদিন বুঝিয়েছি, আরোগ্য আসলে এক নিহিত বিশ্বাস,
বলো, তাকে আজ কী বোঝাব এ হতাশ শ্রুতিদুষ্ট ঋক্ষদেশে?
মা যদি কখনো শোনে তোকে আমি তিল-অন্নে, কাদা-জলে,
ভস্মে-ঘৃতে রেখেছি আকাশতটে একা, যদি শোনে স্নিগ্ধচোখে
তোকে আমি দিয়েছি প্রেতাগ্নি ছোঁয়া, অপহতা, অসুরের,
রাক্ষসের নিরাশ্রয়ে ফেলে, ডেকেছি দুয়ার খুলে,
এসো অগ্নি, এসো স্নিগ্ধ জলপথ, এসো বৃষ্টি, এসো রাত্রি...
এ গহন পথজুড়ে তোকে যে একাকী আমি ছেড়ে যাব,
না কোনো বর্তিকাচিহ্ন, নেই কোনো পথ পেরোনোর কানাকড়ি...
আর ফিরে দেখি এক শেতাম্বরী সন্ধ্যার অচেনা বাঁকের কাছে
নতমুখ, মা আমার একাকী কাঁদেন।
দুই হাতে টেনে নেন অপদার্থ সন্তানের
দুই-মিথ্যে জন্মভরতি অমলিন স্নেহ...
***
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
যে জীবন অপেক্ষার মতো, কুয়াশামলিন ভোরে
বহু প্রশ্নমায়াবোধে যাকে আমি শূন্যতায় রেখেছি সাজিয়ে,
আর এই অগ্নিচিহ্ন, বহুদূর বাসনার অবিশ্রাম হাহাকার থেকে
যত-না অবজ্ঞা নিয়ে ছুটে আসছে আর্তজঠরের ছায়া...
যাকে তুমি শিখিয়েছ উপেক্ষার আনত পাথরে
ভালোবাসা ছাড়া কোনো উপশম নেই,
যার স্তব্ধ বিকিরণ বিমর্ষ নীরবের আর নৈশ বিস্ময়ের
কোন চেনা অবসরে আমাকে চেনাচ্ছে যে বিপথগামীর মলিনতা,
তাকে আমি কীকরে চেনাই বলো অবজ্ঞার দেশ?
কী করে পিছল ঘাট পার হয়ে, ফিরে যাই দূর বনপথে,
ডাকি এই আকাশের,
নিরালম্ব বায়ুভূত, নিরাশ্রয় অজানা বিস্ময়...
তবু কেন মুখ ফেরানোই যেন এই ঘোর...
তোমার সেই না-না বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া
সমস্ত আয়ুর কাছে,
জানি, সেসব আসলে ছায়া। জানি এত ব্যর্থতার,
এত এত হতাশার ভারানত সন্তানের বুকে
আর কেন ক্ষত দেবে তুমি,
কেন আর যেতে দেবে, এ দুয়ার, এ জঠর পেরিয়ে একাকী...
তবু শোনো, এই যে আকুল আমি কখন অজান্তে
শুধু গোপনের কাছে এসে,
তোমার আয়ুর কাছে আততায়ী সেজেছি কেবল—
ঘোর কষ্টযাপনের, এত মৃত্যুপ্রত্যাশায় বারংবার
চুরি করে নিয়ে গেছি
ঐশ্বর্যের মতো সব স্মৃতি, আনন্দের মতো সব মায়া—
আর বৃষ্টিবাসনার, আর বৃক্ষবাসনার কত অরণ্যের মাঝে
পাখিভরতি নানান আদরে হঠাৎ বেজে উঠছে মুহূর্তের ধ্বনি—
তাকে তো চেয়েছি ভুলে যেতে— ভেবেছি এসব স্বপ্ন,
আর এই কল্পনার মধ্যে থাকা সামান্য যে বাস্তবের
মেধাভরতি ফুলে ফলে বেঁচে থাকা বসন্তসম্ভাবনা...
তাঁর কি অপেক্ষা নেই তবে? তাঁর নেই অবজ্ঞা পেরিয়ে এক
অবিশ্রাম আদরের মেঘ?
***
ও মেঘ, দুপুর পথে ভূমিযজ্ঞে যেখানে চলেছ—
অযোধ্যা, মথুরা, মায়া, কাশী, কাঞ্চি, অবন্তিকা ঘুরে
পুরী দ্বারাবতী হয়ে মোক্ষদায়ী সমস্ত শহরে...
ও মেঘ, কুশের স্থানু, তিলভরতি, কাদাভরতি জলে,
জলে ও জলের ঋণে, এই নিয়ে তৃপ্তি পেতে হবে?
যাকে ভিক্ষা দিতে চাও, অতিথির মতো অবশেষে
ও জল, জলের ছায়া, অন্ধকার তার পরিচিত।
তাকে যে বলিনি শুধু বাবা, বাবা, আমাকে এ অবসরে
কার হাতে তুলে দিচ্ছ... হে হতাশ, ভূমিযজ্ঞে, জলে...
আমি যে কাদায়, তিলে, জলে ও জলের ঋণে দেব—
বলেছি, অতিথি তুমি, আছ দূর সপ্তদ্বীপে একা—
তাকে যে ডেকেছি মৃদু— কুশাগ্রের এক ফোঁটা জলে—
আহা, এই ঋণ তবে? তিলে-জলে মাখা পিণ্ডখানি
কেন আজ গোত্রনামে সমর্পণ করি এইভাবে?
যে আমি বিশ্বাস করি, প্রার্থনার মতো মেঘে মেঘে
আমার এ সমর্পণ তোমাকে আশ্বস্ত করে রাখে—
শুধু এক একাকার স্থানু সব ব্যথায় ব্যথায়
এই তো আমার দীপ্তি... কুশমানুষের নিরাশ্রয়ে
বলেছি— তদৈব গুরু, গুরু, আত্মা, প্রিয় পিতৃলোক—
দেবতাভ্য পিতৃভ্যস্চ, মহাযোগী প্রিয় পিতৃলোক—
বলেছি, কোথায় দিলে, কার হাতে তুলে দিলে, পিতা?
বলি স্বধা ঐ, স্বাহা ঐ, বলি, নিত্যমেব নমো নমো...
***
অবশেষে জেগে উঠি, স্নানন্তের ছায়ায়, ছায়ায়
ভাঙা ভাঙা কল্পনার মৃদু আলো পেরিয়ে পেরিয়ে
আমার যে ইতিহাস অপদগ্ধ ধানের সায়রে
আমার যে কবিতার অতিদূর পিতৃলোক তুমি—
অনেক মায়ার মতো না-বোঝা রহস্যে, দূরালোকে
আছ— কি বুঝি না ঠিক, তবু সেই আসা-যাওয়াটুকু
সমর্পণ করে যাই— অচেনা বটের ছায়াতলে...
অচেনা নদীর তীরে যত চিহ্ন ফেলে আসি আজ—
তাঁর সব শাখে শাখে ভাঙা কলসিতে বিঁধে যেন
রক্তাক্ত পায়ের কাছে খণ্ড খণ্ড এসে বসে জল...
তাকেই আত্মীয় ভাবি— তাকে ডাকি মানুষের মতো।
আর সে শব্দের দেহে মৃদু আলো ছড়াতে ছড়াতে
দুটি ডানা মেলে ধরে এ রৌদ্রের খণ্ডমেঘ ঢেকে—
তাকেই আত্মীয় ভাবি— ফেলে আসা শরীরের মতো,
যেখানে নরম মাটি ঢেকে দিচ্ছে দহনের ছবি—
ঘাসের শরীরে তাঁর যত পথ খরচের কড়ি
ছড়াতে ছড়াতে চলা নীরবের শববাহকেরা
সবাই আত্মীয় নয়, সবাই রক্তাক্ত নয়, জানি—
তবু এই জেগে ওঠা, প্রার্থনার এই পিতৃলোকে
এ জলে, জলের ঋণে নদীতীরে হাওয়ায়, বাতাসে—
অর্ধদগ্ধ তিলান্নের যেটুকু সমাজ রেখে গেছে,
আমি কী বিশ্বাস করি, তুমি কী বিশ্বাস করেছিলে—
সেসব পেরিয়ে এই হেমন্তের ভোরের আবেশে
শুধু যদি ডাকি আজ— এই ব্যর্থ সন্তান তোমার—
অপেক্ষা পেরিয়ে এসে যে অঞ্জলি তুলে দিয়ে বলি,
ফিরে এসো, ফিরে এসো, এসো পিতা, প্রিয় পিতৃলোক—
***
তবু কি এসেছ ফিরে, স্মৃতিময় কাতরের কাছে?
জীবিত এ পৃথিবীর শূন্যতায় হারানো অক্ষরে
যেটুকু হেঁটেছ একা, যেন দূর সিন্দুবাসনার
যেন দূর হেমন্তের ফেলে আসা অতীতের গ্রাম—
যেন সেই বহমান অবনীজলের ফোঁটা ফোঁটা—
যেন চেনা সপ্তদ্বীপ অপহতা অশরীর থেকে
কোন ভাঙা বাতিস্তম্ভে রেখেছ দৃষ্টির চেনা মাটি—
এই যে বারান্দাখানি, এই যে বারান্দাহীন ঘর
এই যে জলের কাছে অকাতর ভেসে যাওয়া স্মৃতি
ভেসে ভেসে যাওয়া দেহ, দেহাবশেষের আকুলতা...
সমাজ কি জানে এই? এই ঘর, বারান্দার কূলে
না-থাকা শরীর সেজে যাকে আমি তৃপ্ত করি রোজ,
সামান্য অবনীজল, সামান্য তিলান্নে মেশা ভোর...
সমাজ কি বোঝে এই, যে হতাশ ব্যর্থ সন্তানেরা
কেন তাকে মেনে চলে, কেন আজও এত সংস্কার?
কেন এই লোকাচারে কেবল পীড়িত হতে থাকি?
কেবল অন্ধের মতো ও আমার শ্রুতিদুষ্টভাষা
যাকে দূর বলে ভাবি, যাকে ভাবি প্রিয় পিতৃকূল...
অসমাপ্ত যে কুটির শহরের কাছাকাছি এসে
রয়েছে প্রতীক্ষা শেষে ডাকবাক্সের মতো পরাগত
তাকে কী বোঝাই আজ, প্রস্তুতির সামান্য বাসনা?
***
সেই যে প্রহর তিলান্নে আর সেই যে প্রহর জলে
পাথর মাটির উপত্যকায় চকিতে বিস্ময়ে
সামনে এল। এবং যাকে দিলাম যথাবিধি
গোত্রনামে পাত্রভরে স্বহাঃ শান্তি বলে...
সেই যে প্রবল আলোকছটা পুড়িয়ে দিল স্মৃতি
ফেরার পথে, বাবা, তোমায় লিখেছি এই চিঠি।
লিখেছি আর কান্না দিয়ে ভিজিয়ে দিলাম তাকে
এক জীবনের প্রহর গোনার আরেক অপেক্ষাতে—
পড়বে তুমি? পড়বে, বলো ব্যর্থ ছেলের কথা?
***
তবুও লিখেছি সাজাতে না পারার সুদূরে যে দুয়ার বন্ধ
তোমাকে লিখেছি যা তুমি পড়বে না, ভুলেও যাবে কি কখনো?
তাকে কি ছুঁয়ে যাবে, অপার বেদনাতে এবং করুণাকিরণে
তাকে কি দেবে, বলো হেমন্ত মহিমার সামান্য যে ছায়া ছড়িয়ে...
যে তুমি বিস্ময় ছড়িয়ে রেখেছিলে জীবনে জীবনে এযাবৎ
আর যে স্মৃতি নিয়ে অজানা চিহ্ন নিয়ে রয়েছি অপেক্ষা সাজিয়ে
সেখানে এসে দেখো, চেনা যে সহজের তোমার যে সায়রে রয়েছি
তাকে কি ভুলে যাব? তাকে কি মুছে দেব একটি আগুনের স্পর্শে?
***
সেই যে প্রহর জলের মতো, সেই যে জলের ঋণে
ভাসিয়ে এল চিহ্নটুকু, ভাসিয়ে এল ধুলো
আর যে স্মৃতি এ-ঘর ও-ঘর সেসব লিখে ফিরি
তেমন আমি হেমন্ত নই, তেমন কি ভিখিরি?
তবুও শুনি একটা লেখা যা লিখতে পারছি না
তবুও শুনি নানান গুজব। আত্মীয়দের ঘৃণা
গিলছি এবং এই প্রহরের সামান্য যে জলে
মিশছে বিষাদ, বিষাদ জুড়ে তিক্ত কোলাহলে
দেখছি যেন দশান্ত এক অশান্ত এক ক্ষত
টলতে টলতে ঝাঁপ দিয়েছে হৃদ্শরীরের মতো—
সেই যে প্রহর জলের ঋণে, কীসের যেন দশা,
গিলছে কিন্তু শরীর আমার কেমন যেন অসার
হয়ে আসছে... বাবা, আমি কান্না ভুলে গেলাম
শরীর আমার টলছে, তবু কান্না ভুলে গেলাম—
ভুলেই গেছি যে শববাহক তোমায় ফেলে রেখে...
যে আত্মীয় হাসছে হা-হা তোমায় ফেলে রেখে
তাদেরকে আজ ডাকব কেন, দিন প্রতিদিন আর?
তাদেরকে আর করব কেন স্বপ্নে ব্যবহার?
তারচে যদি শব্দে, লেখায় তোমায় সহজ রাখি
ব্যর্থ আমার অপেক্ষাতে তোমায় নিয়ে থাকি—
আর মেলে দিই সবিস্ময়ের অবনত জলে রোজ
যে জলের ঋণে ভরতি সরোজে রেখে গেছ, হে সহজ—
যদি লিখি ফিরে শ্মশানস্বপ্নে অশরীর ভরা ছাই
যদি লিখি, বাবা, জন্মান্তরে তোমাকেই কাছে চাই—
এই অভিমান এই অবেলার যৎসামান্য লেখা
এসব তোমার, তোমার জন্য। এসব তোমার একার...
***
অতিবিস্ময় থেকে এক প্রশ্নসঞ্জাত জন্ম যেভাবে দেখায়,
আমি সেই কোলাহল পার হতে হতে জলের নিকটে
এই দাঁড়ালাম মুঠোভরতি ছাই নিয়ে।
মুঠোভরতি রক্তপাত কুড়োতে কুড়োতে ভাবি, আর ছায়া নেই।
নেই আলো। নেই কোনো সমাহারপ্রত্যাশী মাটি।
তবে এই অনন্তপ্রস্থরীভূত জন্ম থেকে, মায়ারৌদ্রের
অচেনা জন্মান্তর,
এই পূনর্জন্ম প্রত্যাশার অপস্নাত উদাসীন জীবনের মৃদু...
এসব ছাড়িয়েছি এত এত... কী করে দাঁড়াই আজ এই সত্য,
অতলের স্থিতিবাসনায়? কীভাবে ভাসাই জলে এই পিণ্ড,
এই অস্থি, যার কাছে এসে নীরবে কেঁদেছি কতবার,
কতবার ব্যর্থ করাঘাতপ্রবণের না-দেখা দরজা পার হয়ে
চুপচাপ দেখেছি তোর একাকার প্রলয়ের শেষে
ছড়ানো-ছিটানো এক ছবি।
আর আজ, বাতাসের ম্লান শব্দে, তোমার যে মৃত্যুদোষ জুড়ে
ছলোচ্ছ্বল ভাষাভরতি অতিবিস্ময়, তার কাছে ডুবে যায়
আমার এ নীরবতা,
আমার এ আততায়ী সাজা। যত আকূলের স্থলভরতি, নদীভরতি,
ম্লানভরতি আকূলের শ্মশান-শ্মশান আলো ফিরে গেল
আমাদের সমস্ত মর্মরে, যত আমি হাঁটুজল পার হয়ে
ছাইভরতি স্মৃতিমাখা অবসর ধুয়ে দিতে চাইছি
এ কোলাহলপ্রবণের দেশে, আর সে নিমেষের,
আর যত পাথরের অরণ্যবিহিত বহুভাষ ছায়া-ছায়া যাপনের
যতদূর ছুটে যাচ্ছে, তাকে আমি স্বপ্নকালীন ভোরে
দেখা না পাওয়ার মতো ভেবেছি—
এই তো জন্মান্তপথ, তাকে তুমি আজ আর অবসরে
বিমূঢ় ভেবো না।
ভেবো, যে অবিশ্রামে, সংসারে অস্থির সমিধে, জলে,
দেহান্তের কাছে যে তোর হতাশ ছেলে হাহাকার লুকিয়েছে,
যে শুধু ভেবেছে, এসব আসলে স্বপ্ন... পরজন্মে
ঠিক ভেঙে যাবে—
তাকে কী ব্যর্থতা বলা যাবে বহুদূর এক বিবিধের
মতো যে হতাশ,
অক্লান্তে নিজেকে ভুলে পাখিদের উড়ানসীমার কাছে
ভেঙে পড়া দিনান্তের মোহভরতি তুমিই শিখিয়ে গেছ,
ভালোবেসে যাওয়া ছাড়া-মাত্র অভিশাপ নিয়েই এসেছি...
হে অতল, তোমার যে নিরাশ্রয়ে রেখেছি সামান্য জল,
ও জল, জলের ঋণে, তার কাছে কী রেখে
যাওয়ার থাকে আর?
কাকে আর রেখে যাই জন্মান্তে এমন সন্ধ্যার মতো ঘোরে?
***
রাখি বিষাদের, যত মোহময়, হতাশের যত জল
রাখি হে অপার সম্ভাবনার দিনান্তে, হে অতল...
আর জলময় কত আকূলের পার হয়ে আসা নদী
কত জন্মের অপ্রত্যাশায় রেখে গেছে সম্মতি।
বলেছি— করুণ, কথা দাও, এই জল থেকে যদি উঠি,
যেন ভুলে যাই এই হেমন্ত দিনের যা সব জটিল।
যেন ফিরে গিয়ে দেখি সব আছে। দেখি ঘর জুড়ে আলো...
স্বপ্নে রয়েছি, জেগে উঠে দেখি বসন্ত চমকালো...
যেন শ্মশানের বন্ধুরা সব আসলেই ধুলোমাটি
আসলে জন্ম-মৃত্যুর দূর যেখানে নিহিত থাকি—
সে-ই আত্মীয়, সে-ই তো স্বজন, যে শুধুই সম্মত
মেঘে মেঘে শুধু অনিকেত রাখা, আর নিহিতের পথও
যেন ভুলে যাই। আমি, হে হতাশ, বিষাদের সংসার
মেরে ফেলি সব সম্ভাবনাকে সকরুণে, প্রতিবার—
তোর সন্তান, জন্মের কাছে অস্থির ঝড়ে-জলে
লিখে যাই তোর হত্যার লিপি, গোপনে, কৌতূহলে...
তবে তাকে রেখো, শ্মশানের কোলে, হাতে একমুঠো ছাই
তবু যে বলেছি, আরেক জন্মে, এই সংসারটাই,
এই স্মৃতি, আর জল থেকে উঠে ফিরে যেতে চাই ঘরে
যেখানে তোমার ছায়া রয়ে গেছে। অবিরাম অকাতরে
তাকেই মাখব স্বপ্নের মতো, বাড়িময় হে কঠিন
ক্ষমার মতোন নানা অক্ষরে বিবিধের। উদাসীন
লিখে রেখে যাব যে গোপন— আমি জানি এক হত্যাকে
মৃত্যু দেখেছি, মুঠোর ভেতরে। আর জন্মের বাঁকে
অপেক্ষা নিয়ে, বাবা, তাকে লিখি, তুমি কি পড়বে আর?
এই ভাঙা ভাঙা, এত কাটাকুটি, শব্দের ব্যবহার?
তবু লিখে যাই আর চুপিচুপি কেঁদেছি ছায়ার কাছে
সে ছায়ার তলে অঙ্কুর যেন দিগন্তে, গাছে গাছে
স্নিগ্ধ লিখেছে, লিখেছে স্বজন, মৃত্যুকে, আঁকাবাঁকা
কেউ না বুঝুক, আমি লিখে যাই, অদেখার সে আকাশ।
আমি লিখে রাখি ছায়ায় ছায়ায় দিগন্তে কবিতাকে
কেমন উদাস স্বজনের ঘরে মিথ্যে এ কবি থাকে।
সাজানো জীবন, বানানো কথায় সেই ছেলেটির লেখা
অনতিক্রমের কোনো এক কোণে পার হওয়া পথরেখা
মুছে দিতে চায়, অপেক্ষা লিখে, আর তার কলরব—
ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে। সব ভেসে গেছে। সব।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
শান্তনু চট্টোপাধ্যায়,'আশীর্বাদ', অক্ষয় ঘোষ সরণী, পূর্বাশা, ন
2 দিন আগেঅদ্ভুত কাব্যিক বয়ন ,গভীর আকুতিভরা অতলস্পর্শ বিরহের লোধ্ররেণুময়তায় সমাচ্ছন্ন কবিতাগুলির ঊর্মিল স্রোতে আবিষ্ট করে রাখলেন কবি তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় !!! বারংবার নান্দনিক কুর্ণিশ তাঁর শব্দসাধনের অমিত বৈভবের কাছে,প্রণতি তাঁর ঐশী বোধের কাছে,সপ্রাণ আলিঙ্গন তাঁর সাবলীল অনুভববেদ্যতার প্রতি রইল...