preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ১
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ১

টেবিলে রাখা ল্যান্ড ফোনটা যখন বিকট শব্দে নীরবতা ভাঙে, দারোগা সুজয় মাহাতো তখন নিজের চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। আলস্য মাখা হাতে রিসিভারটা তুলে কানের কাছে আনেন। ঐ দিকে শশব্যস্ত এবং ভয়ার্ত এক কণ্ঠস্বর, “স্যার আমি বলবন্ত বলছি...”
“কে!”
“বলবন্ত সিং। রাধামাধবপুর মন্দির থেকে...”
ছোটো এলাকা। সবাই সবাইকে চেনেন। আর পুলিশের তো কথাই নেই, সবার ঠিকুজি কুষ্ঠি মুখস্থ, “হ্যাঁ কী হয়েছে! এই ভোর রাতে...”
“স্যার খুন...”

প্রথম দিন

পাহাড় জঙ্গল ঘেরা রাধামাধবপুর মন্দিরে গুপ্তঘাতকের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হলেন গবেষক শ্রীযুক্ত বিশ্বামিত্র সেন।

এক

চন্দ্রপুরা। ঝাড়খণ্ড।

সাদা মার্বেলের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। হাঁ করা মুখ আকাশের দিকে। দু’চোখ বিস্ফারিত। মন্দিরের মেঝের উপর চিত হয়ে পড়ে আছেন বিশ্বামিত্র সেন। পরম চৈতন্যভক্ত বিশ্বামিত্র সেন। উষাকালে, একটি বারের জন্য দেবালয় গমন ছিল যাঁর অভ্যাস। ঈশ্বরভক্ত এক অজাতশত্রুকে, এই রকম নৃশংস ভাবে খুন করল কে?

রোজকার মত আজও মিস্টার সেন অন্ধকার থাকতে পরিত্যাগ করেছিলেন শয্যা। স্নান সেরে চলে এসেছিলেন পরম পবিত্র এই স্থানে। এই মানুষটির জন্যই রাতে মন্দিরের প্রধান ফটকে তালা দেওয়া হত না আজকাল। দ্বার-রক্ষক বলবন্ত সিং-এর সাথে একটা বন্দোবস্ত করেছিলেন তিনি।

মন্দির সীমানায়, পাঁচিল খুব উঁচু নয়। বড় জোর ফুট পাঁচেক। উপরে কাচ অথবা কাঁটাতারের বেড়া কিছুই নেই। খুনি গেট দিয়েও ঢুকে আসতে পারে, অথবা সীমানা টপকেও আসতে পারে।

পূর্বদিকে, পাহাড় ছাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া ধূ-ধূ মাঠ। দূরে, মাঠের প্রান্তে আরও অনেকগুলো ছোটো ছোটো পাহাড়। অবশ্য ওগুলোকে পাহাড় না বলে বড় টিলা বললেই ঠিক হয়। টিলার পায়ের কাছে রেললাইন। মন্দিরের বারান্দা থেকে নজর করলে নীচে রেলগাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। যা এতদূর থেকে মনে হয় খেলনা গাড়ি।

পাহাড়ের নাম ‘দুগ্ধা’। পাহাড়ের মাথায় অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই মন্দির। দেবালয়ের পাঁচিল ঘেঁষে হরেক কিসিমের ফুল গাছ। গোলাপ, টগর থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন মরসুমি ফুল। মালি আবদুল নিজের ছেলে-মেয়ের মত ভালবাসে গাছগুলোকে। খাওয়ায়, পড়ায়। তাই শীত শেষ হয়ে এলেও জিনিয়া, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকায় এখনও অনেক কুঁড়ি। ফোটা আর না-ফোটা ফুলে ভরে আছে অঙ্গন। পিছন দিকে গোটা দশেক দেবদারু, দু’খানা কাঁঠালচাঁপা, একটা শিরিষ আর গোটা দুয়েক মেহগনি। মেহগনি গাছের ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের ঢাল নেমে গিয়েছে নীচের দিকে।

দুগ্ধায় শরীর জুড়ে এমনিতেই নানা রঙয়ের সমারোহ, সারা বছর। তার মধ্যেও যেন আলাদা এক মাত্রা যোগ করেছে এই মন্দির। দেবালয়-চত্বরে বসে সুদূর সীমানায় চোখ রাখলে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে। বিরাট প্রান্তর আর মস্ত আকাশের মধ্যে ঢুকে ডানা মেলে দেওয়া যায় অনায়াসে। তাই তো এখানে ছুটে আসতেন বিশ্বামিত্র সেন। পাকদণ্ডী পথ বেয়ে, নিজের টু-হুইলারটি নিয়ে, একাকী।

দেবালয়ের প্রধান ফটক সিং জি ওঁর জন্য খোলা রেখে দিতেন ঠিকই, কিন্তু রাধামাধব ওই সময় থাকতেন গৃহবন্দী। মন্দির কমিটির নিয়ম অনুযায়ী সকাল আটটার আগে দেবগৃহের দরজা কোনো মতেই খোলা যাবে না। চাবি থাকে প্রধান পুরোহিত অনাদি গোস্বামীর কাছে। বিগ্রহকে অবগুণ্ঠন মুক্ত করার অধিকার একমাত্র তাঁরই।

বিশ্বামিত্রবাবুর অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি কোনোদিন। মন্দিরের বাইরে দু’চাকা রেখে ফটক দিয়ে ঢুকে আসতেন মাপা পদক্ষেপে। তারপর চারধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতেন মার্বেল বাঁধানো শানে। পাথরের বেদী বিগ্রহ গৃহের চারিদিকে বেষ্টিত। পদ্মাসনে বসে মগ্ন হতেন ধ্যানে। জাগতিক চিন্তা পরিত্যাগ করে ক্রমশ নিবিড় এক ছায়াপথ আঁকতেন নিজের ভিতর। পৌঁছে যেতেন চৈতন্য মহাপ্রভুর মহানন্দময় জগতে। বেশ কিছুদিন হল রাধামাধব এবং নিজের গবেষণা, এই নিয়েই মেতেছিলেন তিনি। তাঁকে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ করতে চন্দ্রপুরার মানুষ কখনো দেখেনি। সুতরাং প্রশ্ন, এমন ঈশ্বরভক্ত এক অজাতশত্রুকে, এই রকম নৃশংস ভাবে খুন করল কে? কে!

হাঁ করে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বলবন্ত সিং। সকাল ছ’টায় উনিই প্রথম আবিষ্কার করেছেন নিথর দেহখানা। শ্বেত-শুভ্রতার উপর রক্ত লাল, বীভৎস… দেখে প্রথমে চিৎকার করে উঠেছিলেন, তারপর ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েছিলেন মাথাটা। তখনও হিম শীতল নয়। সেটা হওয়ার কথাও নয়। কারণ, বড়জোর আধঘণ্টা কী মিনিট চল্লিশ আগে ঘটেছে ঘটনাটা।

বলবন্ত জানেন সোয়া পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে এইখানে আসেন মিস্টার সেন। ততক্ষণ বসে থাকেন ধ্যানে নিশ্চল, যতক্ষণ না পুব-পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্য কিরণ তাঁর ললাট স্পর্শ করে।

দু-এক মুহূর্ত বিশ্বামিত্রকে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে থাকার পর, মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে, চিৎকার করতে করতে নিজের ঘরে ছুটে যান বলবন্ত। উদ্‌ভ্রান্তের মত। মোবাইলটা পড়ে ছিল বিছানায়। তুলে নিয়ে ফোন করেন চন্দ্রপুরা থানায়।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

দুই

চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।

টেবিলে রাখা ল্যান্ডফোনটা যখন বিকট শব্দে নীরবতা ভাঙে, দারোগা সুজয় মাহাতো তখন নিজের চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিলেন। আলস্য-মাখা হাতে রিসিভারটা তুলে কানের কাছে আনেন। ওই দিকে শশব্যস্ত এবং ভয়ার্ত এক কণ্ঠস্বর, “স্যার আমি বলবন্ত বলছি...”

“কে!”

“বলবন্ত সিং। রাধামাধবপুর মন্দির থেকে...”

ছোটো এলাকা। সবাই সবাইকে চেনে। আর পুলিশের তো কথাই নেই, সবার ঠিকুজি-কুষ্ঠি মুখস্থ, “হ্যাঁ, কী হয়েছে? এই ভোর রাতে...”

“স্যার খুন...”

চন্দ্রপুরাকে উপর থেকে দেখলে, পাহাড়-জঙ্গল-নদীর মাঝে জেগে থাকা এক মায়াবী জনপদ বলে মনে হয়। যেন জল আর হাওয়ার রেণু মেখে ঘুমিয়ে থাকা এক শহরতলি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরের অনুমান, গভীরে গেলে মেলে না। এক্ষেত্রেও তাই। চোরাগোপ্তা খুন-খারাপি লেগেই আছে। খুনের কথা শুনে এখানকার পুলিশ আর চমকায় না। দারোগার গলার আওয়াজে আলস্য মিশে থাকে আগের মতই। বিকট একখানা হাই তুলতে তুলতে বলেন, “কোথায়?”

“মন্দিরে। স্যার বিশ্বামিত্র সেনকে কারা যেন খুন করেছে...”

বিশ্বামিত্র সেন! নামটা শুনেই কিন্তু মুহূর্তে ঘুম ছুটে যায় মাহাতোর। তড়াক করে একটা লাফ দিয়ে উঠে পড়েন। কানের কাছে রিসিভারটা ধরা থাকে আগের মতই। কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা ধরা পড়ে এবার, “কে… কে খুন হয়েছে বললেন?”

“আজ্ঞে বিশ্বামিত্র সেন।”

চন্দ্রপুরাতে দু-চারটে কয়লা মাফিয়া খুন হয়ে যাওয়া, আর এই খুনটা এক নয়। বিশ্বামিত্র সেনকে হঠাৎ কে খুন করল!

দারোগা সাহেব বরঞ্চ ভেবেছিলেন অনাদি গোস্বামীর কথা। চন্দ্রপুরায় হঠাৎ করে যে দাঙ্গা আরম্ভ হয়েছে চারদিকে, সেই আবহের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভেবেছিলেন, মন্দিরের পুরোহিত অনাদি গোস্বামী খুন হয়ে যেতে পারেন, যে কোনো দিন। সেই আশঙ্কার কথা তিনি জানিয়েছিলেন স্বয়ং অনাদি গোস্বামী ওরফে ‘চন্দ্রপুরার চৈতন্য’-কে। যদিও সেই মানুষটি ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, উলটে স্মিত এক হাসিতে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন দারোগার সমস্ত দুঃশ্চিন্তা।

সে যাই হোক, এখন আর বেশি কথা না বাড়িয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখেন সুজয়। এস. আই মহাদেব মুর্মুকে ডেকে পাঠান।

দারোগার তলব। হাজিরা কনস্টেবল সুরিন্দর তড়িঘড়ি নক করে মহাদেবের বন্ধ দরজায়। এস. আই নিজের টেবিলে ফাইল মাথায় দিয়ে একটা পাওয়ার ন্যাপ নিচ্ছিলেন। সবে চোখটা লেগে এসেছিল, আওয়াজে উঠে বসেন। ফাইলগুলো জায়গামত রেখে দরজা খোলেন, “কী ব্যাপার!”

“স্যার আপনাকে ডাকছেন। আর্জেন্ট।”

ভোরবেলা ‘আর্জেন্ট’ শব্দটা শুনে চুল খাড়া না হয়ে উপায় নেই। চোখে মুখে জল দেওয়ার সময় থাকে না। টুপিটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে আসেন। বড়বাবুর ঘরের দিকে যেতে গেলে পিছন থেকে সুরিন্দর বলে, “সাহেব গাড়িতে গিয়ে বসে পড়েছেন।”

পরিমরি গাড়ির দিকে দৌড় লাগান মহাদেব। সব সময়ের মত সামনের সিটে বড়বাবু। ড্রাইভারের পাশে। আর পিছনে মহাদেব। কাঁচাঘুম ভেঙে গেছে। গলা এখনও জড়ানো। প্রথমে কী একটা বলেন মহাদেব, যা ঠিক বোঝা যায় না। তবে সেই আওয়াজেও উৎকণ্ঠা স্পষ্ট। গলা ঝেড়ে আবার আগের বাক্যটা বলেন। এইবার বোঝা যায়, “কী হয়েছে স্যার!”

“খুন।”

মহাদেব মুর্মুরও পুলিশে বেশ কিছুকাল হল। তিনি স্যারের মুখ দেখেই বুঝতে পারেন, এইখানে আকছার ঘটে যাওয়া ‘মার্ডার’ আর এই ‘খুন’ এক নয়।

“স্যার কে?”

সামনে থেকে দু’খানা শব্দ ভেসে আসে শুধু, “বিশ্বামিত্র সেন।”

সবে আচ্ছন্ন ভাব কেটে গিয়ে মাথাটা একটু-একটু করে পরিষ্কার হচ্ছিল। কিন্তু আবার সব ভোঁ-ভাঁ হয়ে যায় মহাদেবের। খুব বেশি আগে আলো ফোটেনি। পাখির কাকলি বাতাসে, এলোমেলো। কিন্তু ‘বিশ্বামিত্র সেন’ এই শব্দদুটো এইসব ‘শান্তি-কল্যাণ’ ছাপিয়ে যায়।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রাধামাধব মন্দিরে ঢুকে পড়ে গাড়ি। গেট খোলাই ছিল। জিপ দাঁড় করানোর সাথে-সাথে দরজা খুলে নেমে আসেন বড়বাবু। পাহাড়ের মাথায় মন্দির। নীচের মানুষজন চট করে উপরের খবর পায় না। তাই এখনও বাইরের লোকজন নেই।

ওসি সুজয় মাহাতো বেশ ঠাকুরভক্ত বলেই মনে হয়। জুতো জোড়া খুলে রেখে উঠে আসেন মন্দির বেদীতে। মহাদেবকেও স্যারের দেখাদেখি তাই করতে হয়।

ঊর্ধ্বপানে মুখ করে পড়ে আছেন বিশ্বামিত্র। সামনের দিকে কোনও ক্ষত নেই। কিন্তু দেহ পড়ে আছে চিৎ হয়ে। এখানেই প্রথম খটকাটা লাগে মাহাতোর। সামনে আঘাতের চিহ্ন নেই মানেই আঘাত করা হয়েছে পিছন থেকে। কিন্তু আততায়ী যদি পিছন থেকেই আঘাত করে থাকে, তবে দেহ উপুড় হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু এটা কী ভাবে হল! যাই হোক, ক্ষতস্থান পরীক্ষা করতে হলে মৃতদেহ উলটে দেখতে হবে।

প্রায় এক-দেড় মিনিট ওই দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওসি সাহেব পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ফোন করেন। কথোপকথনে বোঝা যায় ডি. ভি. সি হাসপাতালে ফোন করেছেন। একজন ডাক্তারকে আসতে বলেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। বিশ্বামিত্রের দেহ যে স্পন্দনহীন সেটা বলার জন্য আদৌ কোনও ‘মেডিকেল পারসনের’ দরকার নেই। কিন্তু, সেটা অফিসিয়ালি ঘোষণা করতে হবে। এরপর আছে পোস্টমর্টেম। পকেটে মোবাইলটা রাখার পর ঘুরে তাকান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বাররক্ষক বলবন্ত সিংয়ের দিকে। প্রথম প্রশ্নটা করেন মাহাতো, “কখন?”

বলবন্ত কয়েক পুরুষ ধরে আশ্রিত রাধামাধবের চরণে। চন্দ্রপুরা জায়গাটি বাঙালি অধ্যুষিত বলা যেতে পারে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষজনের কথা শুনে মনেই হয় না যে তারা বাংলাভাষী নন। বলবন্তও তাই। ওসি সাহেবের কথার উত্তরে বলেন, “আজ্ঞে সেটা ঠিক বলতে পারব না।”

“কে ওঁকে প্রথম দেখেছিল?”

“আমি। ভোর ছ’টা নাগাদ আমি বিশ্ববাবুকে ঐ ভাবে...”

“কী ভাবে দেখেছিলেন? চিত না উপুড় হওয়া অবস্থায়?”

“আজ্ঞে চিত। আমি ওঁর মাথাটা কোলেও তুলে নিয়েছিলাম...”

কথা শেষ করতে পারেন না বলবন্ত সিং। ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ওঁর মন বিষণ্ণ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সুজয়ের এখন ওসব দিকে নজর দেবার সময় নেই। পরের প্রশ্ন, “আচ্ছা... রাতের বেলা মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে না? থাকার তো কথা।”

মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত মূর্তি। বছর দু’য়েক আগে ‘সিকিউরিটির’ জন্য মন্দির কমিটি থানায় আবেদন করেছিল। কিন্তু, ফোর্স কম। কিছু করা যায়নি। সুজয়বাবু, কমিটিকে প্রাইভেট কোনো সিকিউরিটি এজেন্সির দ্বারস্থ হতে বলেছিলেন। সেটা নিশ্চয়ই এখনও করা হয়নি। যাই হোক, প্রধান ফটক যে খোলা থাকার কথা নয়, সেটা দারোগাবাবু জানেন। একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন, “বন্ধ তো থাকার কথা। কখন খোলা হয় গেট?”

এস. আই মহাদেব ভাবেন, এইবার কিছু একটা না বললেই নয়। তিনি তড়িঘড়ি বলে ওঠেন, “স্যার বন্ধ থাকলেও চারদিকে পাঁচিলের যা হাইট... সেটা টপকেও খুনি অনায়াসে ভিতরে চলে আসতে পারে। আর পাহাড়ও আশে-পাশে অত খাড়াই নয়।”

সুজয় মাহাতো ঘুরে তাকান এস. আইয়ের দিকে। বলেন, “হ্যাঁ জানি, আততায়ী পাঁচিল টপকে আসতে পারে কিন্তু বিশ্বামিত্রবাবু পারেন কি? যদি বন্ধ থাকত, তাহলে তো এখানে ইন্সিডেন্টটা ঘটারই সুযোগ ছিল না। তাই নয় কি?”

মহাদেব বোঝেন যে একটু বেফাঁস হয়ে গেছে। চুপ করে যান। সুজয়, বলবন্তকে এবার সরাসরি বলেন, “গেট নিশ্চয়ই খোলা ছিল। অত সকালে কে গেট খুলে দিয়েছিল?”

“আজ্ঞে উনিই আমাকে বলেছিলেন...”

“কে? মি. সেন!”

“হ্যাঁ। উনি আমাকে বলেছিলেন— আমি তো রোজই অন্ধকার থাকতে আসি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তোমার ফটক খোলার দরকার নেই। রাতের বেলা বন্ধ না করে শুধু ভেজিয়ে রাখলেই হবে। তা ছাড়া, বিগ্রহের ঘরে বেশ শক্তপোক্ত দরজা তো একটা আছেই...”

“মানে! রাতের বেলা গেট খোলাই থাকত? এটা মন্দির কমিটির লোকজন জানেন?”

“মন্দির কমিটির লোক জানে না। কিন্তু অনাদি গোসাঁই জানেন।”

অনাদি গোস্বামী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। পিছন দিকে তাঁর থাকার ঘর। মন্দিরে দু’জনের সব সময় থাকার কথা। একজন হলেন অনাদি আর একজন বলবন্ত। দারোগা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন, “তিনি কোথায়? এখনও খুনের খবর পাননি!”

অনাদিকে ভগবানের মত ভক্তি করেন বলবন্ত। তাঁর কথা উঠতেই একবার নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করেন বলবন্ত সিং। তারপর বলেন, “ডি-টাইপ ব্রিজে দাঙ্গা হবার পর থেকে মানুষটির আর নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। ওই গাঁয়ে দল নিয়ে নামগান করতে করতেই সময় কেটে যাচ্ছে। পুজোর সময়টা ছাড়া সারাদিন আজকাল বাইরে বাইরেই কাটে ঠাকুর মশাইয়ের। কালও সন্ধ্যা আরতির পর বেরিয়ে গিয়েছিলেন দলবল নিয়ে। বৈগাপাড়ার রতন বৈগার বাড়িতে রাত্তিরটা কাটিয়ে আজ আবার ফিরে আসার কথা, নগর কীর্তন করতে করতে।”

এস. আই মহাদেব এখনও অব্দি সেরকম কোনও জুতসই কথা বলার সুযোগ পাননি। এইবার বলেন, “ও, তার মানে ভোরবেলা যখন ঘটনাটা ঘটে তখন উনি ছিলেন না?”

“আজ্ঞে না সাহেব।”

তিন

চন্দ্রপুরা। ঝাড়খণ্ড।

ওসি সাহেবের কথা শেষ হতে না হতে একটা মটর সাইকেলের আওয়াজ পাওয়া যায়। বলরাম কিস্কু, মন্দির কমিটির প্রেসিডেন্ট। বাইক দাঁড় করিয়ে এগিয়ে আসেন, হন্তদন্ত হয়ে। সুজয় সরাসরি জানতে চান, “আপনারা জানতেন যে রাতের বেলা মন্দিরের গেট খোলা থাকে?”

বলরাম আকাশ থেকে পড়ে, “কী বলছেন স্যার? গেট খোলা থাকে মানে!”

বলরাম কিস্কু, বলবন্তের দিকে তাকায়। চাপা গলায় বলে, “সিং জি... সাহেব কী বলছেন!”

মাথা নামিয়ে নেন বলবন্ত। দাঁড়িয়ে থাকেন চুপ করে।

এইদিকে, এস. আই মহাদেব এগিয়ে গিয়ে কী যেন একটা বলেন ড্রাইভার দ্বিগু সরেনকে। চলে যায় দ্বিগু। গাড়ি থেকে একটা চকের বাক্স নিয়ে এসে এস. আইয়ের হাতে দেয়। একটা চক নিয়ে মহাদেব মৃতদেহের চারপাশে লক্ষণরেখার মত মার্কিং করেন। তারপর মোবাইল বের করে নানা অ্যাঙ্গেলে গোটা দশেক ছবি তোলেন। এই অবসরে সুজয় মাহাতো আবার তাঁর প্রশ্নমালা খুলে বসেন, “আচ্ছা সিং জি... উনি কি রোজই আসতেন?”

“জি সাব।”

“একই সময়ে আসতেন?”

“জি... আমি রোজ সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে উঠে ওঁকে দেখতাম। চোখ বুজিয়ে ভগবানকে ডেকেই চলেছেন...।”

“সাথে কেউ থাকত?”

“না। সাথে কাউকে দেখিনি কোনোদিন...”

“কতক্ষণ থাকতেন?”

“আজ্ঞে সাড়ে ছটা অব্দি।”

বড়বাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওই সময় অ্যাম্বুলেন্স ঢুকে পড়ে। একজন ডাক্তার আর দু’জন স্টাফ নেমে আসেন। ডাক্তার বাবু এক ঝলক দেখেই যা বোঝার বুঝে নেন। তাও হাঁটু গেড়ে বসেন। বিশ্বামিত্রের ডান হাতটা নিজের হাতে নেন, নাড়ি দেখার ভঙ্গিমায়। দু’এক মুহূর্তের মধ্যেই ছেড়ে দেন। হাতটা আলতো করে নেতিয়ে পড়ে। স্প্রিং করে না। বোঝা যায় এখনও রিগর-মর্টিস হয়নি।

ডাক্তারবাবু এরপর, আ‍্যাটাচি থেকে একটা মেডিকেটেড তুলোর বান্ডিল বের করেন, সামান্য একটু ছিঁড়ে প্রদীপের সলতে পাকানোর মত পাকান। বিশ্বামিত্রের দুই চোখের নীচে ঐ সলতে দিয়ে ঘষতে থাকেন। তারপর, নিথর দেহটাকে একবার আস্তে করে কাত করেন। পিঠের দিকে চাপ বাঁধা রক্ত। ডাক্তারবাবু দু-এক মুহূর্ত কী যেন দেখে নিয়ে আবার শুইয়ে দেন, আগের মত করে। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে তাকান বড়বাবুর দিকে। দু’দিকে ঘাড় নাড়েন। মৃত্যুর সরকারি ঘোষণা।

ডাক্তার আসার পর আরও একটা জিনিস নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায় যে, খুনটা করা হয়েছে পিছন থেকেই, এবং গুলি করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেহ চিত হয়ে পড়েছিল! কেন? এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন সুজয় মাহাতো ফের কাজের কথায়, “পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা কিন্তু অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল আমার চাই...”

ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন, “ইয়া মি. মাহাতো..., আই নো দি আর্জেন্সি অফ দিজ কেস। আমি এখন বডি নিয়ে যেতে পারি কি?”

“অবভিয়াসলি...”

ডাক্তার মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তোলার অর্ডার দেন। একজন মাথা এবং একজন পায়ের দিক ধরে বিশ্বামিত্রের দেহটা স্ট্রেচারে তুলে ফেলে। কিন্তু যেই ওরা ‘বডি’ নিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে যাবে, থামান বড়বাবু। এগিয়ে আসেন। বিশ্বামিত্রর পকেটে হাত গলিয়ে কী যেন একটা খোঁজেন। কিন্তু, দু-এক মুহূর্ত বাদেই বোঝা যায়, যা সার্চ করছিলেন সেটা পাননি। যেতে বলেন ওদের। কী খুঁজছিলেন তিনি…


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

nZkkAbWB

19 ঘন্টা আগে

1


Image Description

nZkkAbWB

19 ঘন্টা আগে

1


মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন