চূড়ান্ত হতাশা ও বিভ্রান্তির মধ্যেও অনুপ বুঝতে পারল, এক ভয়ঙ্কর সময়ের ফাঁদে আটকে পড়েছে সে। কোনোমতেই এই কামরা থেকে বেরোনো যাবে না, তার আগেই ঘটবে দুর্ঘটনা। সঠিক সময়ে হাতে-ধরা যন্ত্রের কাঁটা ঘোরাতে পারলে মিলবে কুড়ি সেকেন্ডের স্বস্তি। আর না পারলে? নিশ্চিত মৃত্যু!
“দা ম্যামথ বুক অব টাইম ট্র্যাভেল স্টোরিজ? সায়েন্স ফিকশনের গল্প পড়তে ভালোবাসেন বুঝি?”
পাশ থেকে প্রশ্নটা এল খুব মৃদুস্বরে। অনুপ কাহিনির মধ্যে ডুবে ছিল। সে একটু চমকে উঠে বই থেকে চোখ তুলল।
প্রশ্নকর্তা তার বাম-দিকে বসা মাঝবয়সী ভদ্রলোক। পরণে প্যান্ট-শার্ট, তার ওপর একটা যেমন-তেমন কোঁচকানো ব্লেজার। মাঝারি উচ্চতা, অতি সাধারণ চেহারা। চোখদু’টো কিন্তু উজ্জ্বল। আপাতত সেই চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ অনুপের হাতে ধরা বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে।
নিচুগ্রামে কথা বলার কারণ আর কিছুই নয়, এসি টু টিয়ার কামরায় অনুপদের সামনের আপার-লোয়ার দু’টো বার্থে দুই অতিকায় অবাঙালি ভদ্রলোক এর মধ্যেই গলা অবধি কম্বল টেনে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই তাঁরা নিজেদের মধ্যে অনর্গল কথা বলে গেছেন। তাঁদের কথোপকথন থেকে অনুপ অনুমান করেছে, তাঁরা দুই ভাই। ব্যবসার কাজে যাচ্ছেন, গন্তব্য মালদহ। ন’টা বাজতে না বাজতেই বৃহদাকৃতি টিফিন ক্যারিয়ার খুলে তাঁরা প্রচুর পরিমাণে ঘিয়ের পরোটা, সবজি এবং আচার উদরসাৎ করেছেন। তারপরেই সটান হয়েছেন যাঁর-যাঁর বার্থে।
অনুপের টিকিট উল্টোদিকের লোয়ার বার্থের। বিএ ফাইনাল পরীক্ষার পর তার গন্তব্য মামাবাড়ি, উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ শহর। উদ্দেশ্য ছুটি কাটানো। এত তাড়াতাড়ি শোয়ার প্রশ্নই ওঠে না, তাই সে ব্যাগ থেকে সঙ্গে আনা একটা গল্পের বই খুলে বসেছে। পাশের ভদ্রলোকের আপার বার্থ। অনুপকে বসে থাকতে দেখে তিনিও লোয়ার বার্থে তার পাশে বসে আছেন। এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, হঠাৎ এখন মুখ খুলেছেন প্রচ্ছদে লেখা বইয়ের নামটা দেখে।
অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ জানে, সায়েন্স ফিকশন জিনিসটা অধিকাংশ প্রাজ্ঞ মানুষের না-পসন্দ্। সে একটু সতর্কভাবে বলল, “সায়েন্স ফিকশন আমার খুব প্রিয়। আপনি পছন্দ করেন না বুঝি?”
“করতাম না, যদি নিজে সায়েন্টিস্ট না হতাম!” —ভদ্রলোক একইরকম মৃদুস্বরে জানালেন, “আজকের বিশ্বসাহিত্যে এসব গল্প যাঁরা লেখেন, তাঁদের অনেকেই বিজ্ঞানী। প্রত্যেকেই নিজের-নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কেউ নাসার অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট, কেউ বিখ্যাত বায়োলজিস্ট, কেউ বা কেমিস্ট্রিতে ধুরন্ধর। পেশার পাশাপাশি লেখাটা ওঁদের নেশা। ফলে ওঁরা যে গল্প লেখেন, তাতে প্রচুর যুক্তিগ্রাহ্য তত্ত্ব থাকে!”
“অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, কল্পনা হলেও সেগুলো একেবারে অসম্ভব নয়?” —অনুপ এতক্ষণে ভদ্রলোকের সম্পর্কে উৎসাহ বোধ করছে।
“ঠিক তাই! আমি নিজে প্রমাণ পেয়েছি!”
“আপনি নিজে...ওহো, আপনি নিজেই তো সায়েন্টিস্ট! তাই বললেন না?”
ভদ্রলোক নীচু গলাতেই বললেন, “হুম! আমার নাম চন্দন সিনহা। কলকাতার কলেজে ফিজিক্স পড়াই, তবে আসল নেশা গবেষণা। বিয়ে-থা করিনি, অনেক খরচ করে নিজের বাড়ির ভেতরেই একটা চলনসই ল্যাব বানিয়ে নিয়েছি। তা আপনার নাম?”
“আমাকে তুমি বলবেন। আমি অনুপ... অনুপ রায়।” —অনুপ সমীহের সাথে বলল, “কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের কোন বিষয়টা আপনি সত্যি বলে প্রমাণ পেলেন?”
“ওই, তুমি এখন যে বিষয়ের গল্প পড়ছ। টাইম ট্র্যাভেল! সময় সফর!”
“বলেন কী? কীভাবে?” —অনুপ হতবাক।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
এবারে ভদ্রলোক একটু ইতস্ততঃ করছিলেন। কিন্তু এই বয়োকনিষ্ঠ উৎসাহী শ্রোতাকে সম্ভবতঃ তাঁর পছন্দ হয়েছিল। তাই মৃদুকণ্ঠে শেষমেশ তিনি শোনালেন এক আশ্চর্য আখ্যান।
এরকমই এক আধুনিক কল্পবিজ্ঞান গল্পের সঙ্কলনে তিনি একটা সময় সফর-সংক্রান্ত গল্প পড়েছিলেন। লেখক নিজে পদার্থবিদ; তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন— ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটারের পরিমিত ও পরিকল্পিত সংঘর্ষ ঘটিয়ে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টাইম-ওয়ার্প বা সময়-বিকৃতি ঘটানো সম্ভব।
সেই ইঙ্গিতে উৎসাহিত চন্দন নিজের গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। নিজের তৈরি মিনি পার্টিকল অ্যাকসিলারেটরের সাহায্যে কীভাবে তিনি সামান্য পরিমাণ অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে সক্ষম হন, কীভাবে নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রের মধ্যে তার সাথে ম্যাটারের নিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ ঘটিয়ে সময় বিকৃতিকে বাস্তব করে তোলেন —সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি। মোট কথা, তাঁর এই উদ্ভাবনের ফলে সময় সফর সম্ভবপর হয়।
“আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার তৈরি সেই টাইম মেশিনের আয়তন একটা দেশলাই বাক্সের থেকে বড় নয়।” —পরিশেষে বিজ্ঞানী বললেন, “যে কেউ তা নিজের পকেটেই বয়ে নিয়ে যেতে পারে এক জায়গা থেকে অন্যত্র।”
একটু থেমে তিনি যোগ করলেন, “তবে এখানে দু’টো জিনিস বলে রাখা দরকার। এক নম্বর, হাজার চেষ্টা করেও আমি ভবিষ্যতে যেতে পারিনি। অবশ্য তার কারণ হয়তো ভবিষ্যৎ বলে নির্দিষ্ট কিছু নেই। ভবিষ্যৎ আসলে বর্তমানের বিভিন্ন ঘটনার ওপর নির্ভরশীল একটা অনির্দিষ্ট অবস্থা।
দ্বিতীয়তঃ, এ পর্যন্ত মাত্র কুড়ি সেকেন্ড অতীতে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও আর এর থেকে বেশী পিছোতে পারিনি!”
এই অদ্ভুত গল্প শুনে অনুপ টানটান হয়ে বসল। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই-ছুঁই। বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ার উদ্যোগ করছেন কামরার আরো বেশ কয়েকজন। তাঁরা বড় আলো নিভিয়ে শিয়রের নাইটল্যাম্প জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। রেল-পরিবেশিত নৈশাহারের অপেক্ষায় রয়েছেন অন্যরা।
সময় সফর! কল্পগল্পের বাইরের জগতে তার কী অস্তিত্ব থাকতে পারে? চন্দন সিনহা কী মিথ্যা বলছেন অথবা ঠাট্টা করছেন? কিন্তু ম্লান আলোয় তাঁর মুখ দেখে অন্তত তা মনে হচ্ছে না।
উত্তেজনায় অধীর অনুপ শেষ অবধি তাঁকে প্রশ্ন করে বসল, “আপনি...আপনি কি সেই যন্ত্র সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন? কারণ একটু আগেই বলেছেন, সেটা আকৃতিতে ছোট!”
“ঠিক ধরেছ!” —চন্দন স্মিত হাসলেন, “আসলে যন্ত্র উদ্ভাবনের ব্যাপারটা শেষ, ও নিয়ে আর কিছু ভাবার নেই। এখন অতীতে যাতায়াতের ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণার দরকার। আর সে কাজটা নির্বিঘ্নে করার জন্য যন্ত্র নিয়ে যাচ্ছি রাধিকাপুরে, আমার পৈতৃক বাড়িতে। সেখানকার নিরিবিলি পরিবেশে...”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান!” —বাধা দিয়ে বলে বসল অনুপ, “সে যন্ত্র আমাকে দেখাতে পারেন?”
মুখে কিছু না বলে চন্দন নীচু হয়ে সিটের নীচ থেকে তাঁর সুটকেস বার করলেন। তারপর সেটা খুলে একটা খুব ছোট ধাতব বাক্স বার করে অনুপের হাতে দিলেন।
“এ... এটাই?”
“হ্যাঁ। সাবধানে ধোরো কিন্তু!”
একটা অতি সাধারণ ধাতব বাক্স। হয়তো আসল রং ধূসর, তবে আধো-অন্ধকারে কালচে দেখাচ্ছে। আয়তনে দেশলাই-বাক্সের মত, চন্দন যেমনটা বলেছিলেন। তবে দেশলাই-বাক্সের সাথে তফাত হল, বাক্সটা বেশ ভারী। আর বাক্সের একটা তলে একটাই কাঁটাওয়ালা অদ্ভুতদর্শন একটা ডায়াল। তাতে শূন্য থেকে কুড়ি অবধি সংখ্যা লেখা রয়েছে।
“কাঁটাটা শূন্য থেকে কুড়ির ঘর অবধি ঘুরিয়ে দিলেই তুমি কুড়ি সেকেন্ড অতীতে পৌঁছে যাবে!” —চন্দন ব্যাখ্যা করলেন, “তারপর সময়ের স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসবে বর্তমানে। তবে মুশকিলটা হল, বর্তমানে না ফেরা অবধি যন্ত্রটা আবার কাজ করবে না!”
“আমি... আমি একবার কাঁটা ঘুরিয়ে দেখতে পারি?” —উত্তেজনায় অনুপের কথা আটকে যাচ্ছিল।
“তুমি? তা বেশ তো, দ্যাখো!” —একটু দোনামোনা করেও সম্মতি দিলেন বিজ্ঞানী, “এ অবধি শুধু আমার নিজের ওপর পরীক্ষা করেছি। অন্য কারুর কীরকম অনুভূতি হয়, সেটাও তো জানা দরকার!”
যন্ত্রটা হাতে নিয়েও অনুপ ইতস্তত করছিল, সত্যিই কাঁটা ঘোরাবে কিনা! হঠাৎ...
চটাস্! নিজের গালে প্রকাণ্ড এক চপেটাঘাত করে পাশ ফিরে শুলেন সামনের লোয়ার বার্থের অবাঙালি ভদ্রলোক।
“মচ্ছর হ্যায় ডিব্বামে!” —তাঁর অস্ফূট, নিদ্রাজড়িত স্বর শোনা গেল।
যন্ত্রের দিকে মন থাকায় অনুপ একটু চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে কাঁটা ঘোরাতে যাবে, এমন সময়....
“খানা চাহিয়ে, খানা! গরম-গরম খানা! আণ্ডা-রাইস, চিকেন-রাইস, ভেজ রাইস...”
উৎসুক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাতে-তাকাতে প্লাস্টিকের ট্রে-তে সিল করা নৈশাহার নিয়ে করিডর ধরে এগিয়ে গেল রেলের এক কর্মচারী। আর সে চলে যেতেই পত্রপাঠ যন্ত্রের কাঁটা ঘুরিয়ে দিল অনুপ।
কিছুই কিন্তু ঘটল না!
অনুপ চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, সে বসে আছে একই জায়গায়। তার পাশে বসে তার মুখের দিকে চেয়ে আছেন চন্দন সিনহা।
ক্ষুব্ধ অনুপ সবে তাঁর কাছে অনুযোগ জানাতে যাবে যে যন্ত্রটা অকেজো, ঠিক তখনই কয়েকটা ব্যাপার ঘটে গেল।
চটাস্!
“মচ্ছর হ্যায় ডিব্বামে!”
“খানা চাহিয়ে, খানা! গরম-গরম খানা! আণ্ডা-রাইস, চিকেন-রাইস, ভেজ-রাইস...”
অনুপ হতবুদ্ধির মত নির্বাক হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চন্দন মৃদু হাসলেন।
“মনে হচ্ছে তোমারও আমার মতই অভিজ্ঞতা হয়েছে! এবারে বিশ্বাস হল তো?”
অনুপ ঘাড় হেলাল। বিশ্বাস হয়েছে কিছুটা, তাও...
সে আরেকবার যন্ত্রের কাঁটা ঘোরাল।
কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপর আবার...
চটাস্!
“মচ্ছর হ্যায় ডিব্বামে!”
“খানা চাহিয়ে, খানা!...”
তবুও, নিঃসন্দেহ হবার জন্য দরকার শেষবার পরীক্ষা। যন্ত্র হাতে ঝটিতি উঠে দাঁড়াল অনুপ। সে কামরার করিডর বরাবর এগিয়ে যাবে। ঘড়ি ধরে ঠিক কুড়ি সেকেন্ড। তারপর কাঁটা ঘোরালেই যদি দেখা যায়, সে আবার সিটে বসে আছে, তাহলে নিঃসংশয়ে প্রমাণ হয়ে যাবে— সত্যিই যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছেন চন্দন সিনহা!
বিজ্ঞানীকে নিজের পরিকল্পনার কথা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলে অনুপ করিডরে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে কোথাও কিছুটা আলো, কোথাও অন্ধকার। তাদের বার্থ কামরার একেবারে মাঝামাঝি, কামরার দুই প্রান্তের দরজা এখান থেকে সমান দূরত্বে। অনুপ সামনের দিকে এগোল।
দুই বার্থ পরের এক প্রৌঢ়া মহিলা সম্ভবতঃ টয়লেটে যাচ্ছিলেন। অত্যন্ত জড় এবং মন্থর গতি। তিনি স্থূলকায়া, তাই তাঁকে পেরিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই অনুপ মহিলার পেছন-পেছন চলল। চোখ অবশ্য ঘড়ির দিকে।
এক, দুই, তিন... পাঁচ, ছয়... বারো, তেরো... সতেরো, আঠারো, উনিশ...
অনুপ হাতে ধরা যন্ত্রের কাঁটা ঘোরাতে যেতেই হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল! একটা বিকট শব্দের সাথে প্রকাণ্ড ঝাঁকুনি। কামরার মেঝেতে একেবারে ছিটকে পড়ল সে। সব আলো নিভে গিয়ে কামরা তখন নিকষ অন্ধকার। ধাতুতে ধাতুতে সঙ্ঘর্ষের অশুভ আওয়াজ অব্যাহত।
দুর্ঘটনায় পড়েছে ট্রেন— সহযাত্রীদের আর্তনাদের মধ্যেই এক লহমার জন্য চিন্তাটা মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে গেল। পরক্ষণেই বুকের ওপর একটা প্রচণ্ড আঘাতে বন্ধ হয়ে এল শ্বাস। ওপর থেকে যাত্রীসহ বার্থ ভেঙে পড়েছে তার দেহের ওপর!
আশ্চর্যের বিষয়, এত কাণ্ডের মধ্যেও টাইম মেশিন রয়ে গেছে তার ডান হাতের তালুতে। কিছু না ভেবে, হয়তো অবচেতন মনের তাড়নাতেই, একেবারে শেষ মুহূর্তে আঙুল দিয়ে আন্দাজে তার কাঁটা ঘোরাল অনুপ।
তৎক্ষণাৎ দেখতে পেল— সে দাঁড়িয়ে আছে স্বল্পালোকিত করিডরে, সেই প্রৌঢ়া মহিলার পেছনেই! তীব্রগতিতে ধাবমান ট্রেনের দুলুনি আর একঘেয়ে শব্দের মধ্যেই শোওয়ার আয়োজন করছে তার সহযাত্রীরা। কেউ বার্থের ওপর চাদর পাতছে, কেউ ফুঁ দিয়ে ফোলাচ্ছে হাওয়া-বালিশ। মাত্র কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যেই যে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়তে চলেছে ট্রেন— সে কথা সবার অজানা!
এক মুহূর্তের জন্য তীব্র আতঙ্কে স্থাণু হয়ে থাকার পর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল অনুপ। কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যেই তাকে কামরার শেষপ্রান্তে পৌঁছে দরজা খুলে লাফিয়ে পড়তে হবে বাইরে। চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলে হয়তো হাত-পা ভাঙবে, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যাবে সে!
যেমন ভাবা তেমন কাজ।
“সরুন, মাসীমা!”
প্রৌঢ়া না সরায় তাঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে কোনোক্রমে তাঁর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল অনুপ। টাল সামলাতে না পেরে তিনি মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়লেন।
“এ কী অসভ্যতা!” —চেঁচিয়ে উঠল আশেপাশের কয়েকজন।
উত্তর দেওয়ার সময় নেই। প্রাণপণে কামরার শেষের দিকে দৌড় লাগাল অনুপ। কিন্তু প্রৌঢ়াকে সরিয়ে আসতে যেটুকু সময় বাড়তি লেগেছে, পূরণ হল না সেইটুকু ক্ষতি!
কামরার শেষ প্রান্তে পৌঁছতে না পৌঁছতেই আবার সেই বিকট শব্দ আর ঝাঁকুনি! একটা হতাশার আর্তনাদ করে ছিটকে পড়তে-পড়তেই কোনোমতে হাতের যন্ত্রের কাঁটা ঘোরাল অনুপ।
আবার সেই করিডর। আবার সে প্রৌঢ়ার পেছনে।
এবারে আর কোনো কথা নয়! সরাসরি ভদ্রমহিলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তাঁর শরীরের ওপর পা দিয়েই “অ্যাক্সিডেন্ট! অ্যাক্সিডেন্ট!” —চেঁচাতে-চেঁচাতে কামরার শেষপ্রান্তের দিকে দৌড়ল সে। তার কথা শুনে অন্য কেউ যদি সতর্ক হতে পারে, হোক!
এবারে পৌঁছে গেছিল দরজার একেবারে কাছে। ছিটকিনি খুলতে যাবে, এমন সময় আবার সেই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি!
একটা আক্ষেপের চিৎকার বেরিয়ে এল গলা চিরে। গুরুতর আঘাত লাগার আগেই কোনোক্রমে ঘোরাল কাঁটা।
এবারে কামরার অন্য দিক দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করবে, ঠিক করে নিল অনুপ। সেইমত প্রৌঢ়া মহিলার দিকে না এগিয়ে পেছন ফিরে সরাসরি উল্টোদিকে দৌড়ল অনুপ। সিটে বসে বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন চন্দন সিনহা।
এবারেও বিপত্তি! ট্রেনের কর্মচারীটি এদিকের প্যাসেজ জুড়ে দাঁড়িয়ে। তার কাছ থেকে গাড়ির খাবার কিনছে কয়েকজন যাত্রী।
“হঠ যাইয়ে! অ্যাক্সিডেন্ট হোনেওয়ালা হ্যায়!”
চেঁচিয়ে বলে অনুপ কর্মচারীটিকে ঠেলে এগোতে যেতেই তার হাত থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল খাবারের ট্রে-গুলো। একটা রাগত চিৎকার করে কর্মচারীটি পেছন থেকে তার জামা টেনে ধরল, আর তাতেই হয়ে গেল দেরি।
আবার বিকট শব্দ। ঝাঁকুনি। অনুপের হতাশার আর্তনাদ। প্রত্যাবর্তন।
পরের বার সরাসরি রেলকর্মীটিকে ঠেলে এগোনোর চেষ্টা। লাভ হল না তাতেও। ওইটুকু দেরির জন্যই পার হয়ে গেল মূল্যবান সেই কুড়ি সেকেন্ড। একেবারে দরজার সামনে পৌঁছেও শেষ মুহূর্তে টাইম মেশিনের কাঁটা ঘোরাতে বাধ্য হল অনুপ।
চূড়ান্ত হতাশা ও বিভ্রান্তির মধ্যেও অনুপ বুঝতে পারল, এক ভয়ঙ্কর সময়ের ফাঁদে আটকে পড়েছে সে। কোনোমতেই এই কামরা থেকে বেরোনো যাবে না, তার আগেই ঘটবে দুর্ঘটনা। সঠিক সময়ে হাতে-ধরা যন্ত্রের কাঁটা ঘোরাতে পারলে মিলবে কুড়ি সেকেন্ডের স্বস্তি।
আর না পারলে? নিশ্চিত মৃত্যু!
আরেকবার চেষ্টা করল মরিয়া অনুপ। তারপর আবার, আবার...
* * *
“এই পুরোনো ভাঙাচোরা কামরাটা ভূতুড়ে বলে তোমাদের ধারণা?”
“ধারণা নয় মণীশ! প্রায় বছরখানেক আগে এক্সপ্রেস ট্রেনটা এখানে বে-লাইন হয়েছিল। দু’তিনটে কামরা একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গেছিল। সবচেয়ে খারাপ হাল এই এসি টু টিয়ার কোচের। এটার এক-দু’জন যাত্রীই কেবল বেঁচেছিল। তাও তাদের বার করতে হয়েছিল গ্যাস কাটার দিয়ে কোচের বডি কেটে।”
আজিজুলের কথায় ভুল নেই। টিনের কৌটোর মত তোবড়ানো নিষ্প্রাণ কামরাটাকে খুঁটিয়ে দেখল মণীশ। অধিকাংশ জানালা ভাঙা। কোথাও-কোথাও কামরার গায়ে গর্ত করে যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে ভেতরের দৃশ্য যেটুকু চোখে পড়ে, তা ভয়াবহ। করিডর তো নেই-ই, নেই কোনো ফাঁকা জায়গা। সমস্ত বার্থগুলো তালগোল পাকিয়ে আছে একসাথে। সেই পিণ্ডের জায়গায়-জায়গায় কালচে ছাপ। রক্তের?
সে একজন তরুণ লেখক, অলৌকিক সাহিত্যের জগতে ইতিমধ্যেই কিছুটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নবদ্বীপ স্টেশনের তিন কিলোমিটার উত্তরে লাইনের ধারে পড়ে থাকা এই দুর্ঘটনাগ্রস্ত রেলের কামরা ভূতুড়ে— এই জনশ্রুতিই তাকে এখানে টেনে এনেছে। উঠেছে এখান থেকে কিছুটা দূরে, সাহেবগঞ্জ গ্রামে তার কলেজের সহপাঠী আজিজুলের বাড়িতে। সাতসকালেই আজিজুলকে সাথে নিয়ে অকুস্থলে এসেছে সরজমিন তদন্তের জন্য।
“কিন্তু অনেক লোক মারা গেছিল বলেই কামরাটা ভূতুড়ে, এমন মনে করার কোনো কারণ আছে কি?” - চারিদিক দিয়ে ঘুরে দেখার পর মণীশ প্রশ্ন করল।
“আছে। এই কামরার ভেতর থেকে নানারকম শব্দ পাওয়া যায়। রাতে তো বটেই, দিনের বেলাতেও!” —একটু ইতস্ততঃ করে আজিজুল জবাব দিল, “সেজন্যই আর সব কামরা সরিয়ে নিলেও রেলের লোক ভয়ের চোটে এটাকে এখানেই ফেলে রেখে গেছে। গ্রামের মানুষও সন্ধ্যার পর এদিকে আসে না। দিনের আলোয় অবশ্য অতটা ভয় নেই!”
আর কথা না বাড়িয়ে সন্তর্পণে কামরার গায়ে কান পাতল মণীশ। শিহরিত হয়ে উঠল তারপরেই।
তার কানে ভেসে এসেছে একটা মৃদু ধ্বনি! যেন বহু দূরাগত!
দুপদাপ-দুপদাপ! কারুর দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজ কি? যদিও খুব অস্পষ্ট। তারপরে...না, কোনো ভুল নেই! একটা অস্ফূট আর্তনাদ! হতাশার, যন্ত্রণার।
একটু বিরতি। তারপর পুনরাবৃত্তি হল সেই দৌড়ের, সেই আর্তনাদের!
“শুনতে পেয়েছ?” —পেছন থেকে আজিজুলের ভয়ার্ত ফিসফিস।
“হুঁ! কেউ একজন ভেতরে দৌড়ে গেল!” —বলে হতভম্ব মণীশ কাছের একটা ভাঙা জানালা দিয়ে আবার উঁকি মারল কামরার ভেতরে।
বৃথা চেষ্টা। ভেতরে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই।
যদিও, ঠিক তখনই পুনরাভিনয় ঘটল সেই অলৌকিক শ্রুতিনাটকের!
মণীশের সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই দুর্ঘটনাগ্রস্ত জীর্ণ কামরায় তাহলে কী সত্যিই বন্দী হয়ে আছে কোনো বিদেহী আত্মা? ফাঁদে-পড়া জন্তুর মত বাঁচার আশায় বারবার ছুটে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে? বারবার ব্যর্থ হয়ে চিৎকার করে উঠছে হতাশায়?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
শাশ্বতী লাহিড়ী
2 মাস আগেখুব ভালো, অভিনব, সংহত এবং গল্পের গতিময় চলন --- সবটা নিয়ে ছোট্ট সুন্দর কল্প বিজ্ঞান মূলক সহজ একটি লেখা। লেখককে অভিনন্দন। বিশেষভাবে ধন্যবাদ কেতাবি এর ব্লগজিন বিভাগ এ এমনসব সুন্দর লেখার আয়োজনের অবতারণা জন্য।
শাশ্বতী লাহিড়ী
2 মাস আগেখুব ভালো, অভিনব, সংহত এবং গল্পের গতিময় চলন --- সবটা নিয়ে ছোট্ট সুন্দর কল্প বিজ্ঞান মূলক সহজ একটি লেখা। লেখককে অভিনন্দন। বিশেষভাবে ধন্যবাদ কেতাবি এর ব্লগজিন বিভাগ এ এমনসব সুন্দর লেখার আয়োজনের অবতারণা জন্য।