preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
হাসপাতালে
গল্প

হাসপাতালে

আলোগুলো দিনের মতো উজ্জ্বল, হাসপাতাল তো নয়, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। রোগীদেরকে অন্যের দয়ার ওপরে নির্ভর থাকতে হয়। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শাস্ত্র প্রাণহীন হয়ে গেছে, ডাক্তাররা জানতেও চায় না কার কী পছন্দ, ওষুধ কোম্পানির ফর্মুলাতেই চাপা পড়েছে স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান।

টপ, টপ, টপ...
স্যালাইনের ফোঁটা পড়ছে। শব্দটা কি সত্যিই হচ্ছে, না কি দৃশ্যের মধ্যে মূর্ছনা মিশিয়ে দিচ্ছে আমার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র। ব্যাটা ঘাড়ের ওপরে বসে মাঝেমধ্যে এমন খিটকেল পরিবেশ তৈরি করে, যেন বিদেশি সিনেমার ভূগোল। যুদ্ধ, প্রেম, হেরে যাওয়া— প্রতিটা ক্ষেত্রে একইরকম জ্যান্ত।

বিকেলে ভাইপো এসেছিল। একথা-সেকথার পর বললে, ‘কাকা! এখানে বেড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার’। কার ভাগ্য কে জানে! ওর কথা কিছুই কানে ঢুকছিল না, ঠোঁটের ওঠা-পড়া দেখে আন্দাজ করেছি কী বলতে চাইছে। আমারই তো ভাইপো, ছোটোবেলায় পিঠে চাপিয়ে বিশ্বদর্শন করিয়েছি। মাপে বেড়েছে, কিন্তু বিস্ময় কাটেনি এখনও।

চুপ করে রইলাম। ভেতরের যন্ত্রপাতিগুলো বিকল হয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে গেলে যতটা বাতাস লাগে, লাঙসের সাধ্য নেই তা যোগানোর। চোখদুটোও বন্ধ করে নিয়েছিলাম, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভাবতে পারে বাঁচতে চাইছি। ঘন ঘন আসবে, পাড়া-প্রতিবেশীরা ভাববে লোকটার চোখ-কান কাটা।
ও কিছুই খেয়াল করেনি, হাবিজাবি বকেই চলেছে নাগাড়ে, কিম্বা হয়তো ফালতু ভাবনাগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়াতেই প্রকাশ প্রায় কাঁচা বয়সের সৌন্দর্য।
শরীরের সাড় যতই চলে যাচ্ছে, ইন্দ্রিয়গুলো হয়ে উঠছে তীক্ষ্ণ। কটা বাজে বোঝার উপায় নেই, ঘরের দেওয়ালে স্বাস্থ্য-দপ্তরের পেল্লাই বিজ্ঞাপন। সময় এগোচ্ছে না, পিছোচ্ছে না, খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকিয়ে পেশেন্টরা অপেক্ষারত, সামনে দীর্ঘ রাত, কোন খাটের কে কখন বিয়োগ হয়ে যাবে ওপরওয়ালা জানে! পাশের বেডের ছেলেটার সলিড শুরু হয়েছে আজ থেকে, যদিও মুখে এখনও অক্সিজেন মাস্ক। দুপুরে বাড়ির লোক খাইয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু রাতের খাবারটা পড়ে আছে টেবিলে, কে সাধতে আসবে এখানে? সাদা ভাতের পাশে গন্ধবর্ণহীন ঝোলে ভেসে আছে ফ্যাসফেসে মাছের পেটি, পুষ্টি এবং বাড়ি ফেরার রসদ। ওইটুকু ছেলে, কীসের এত জেদ, গায়ে জোর থাকলে ওকে আচ্ছাসে বকে দিতাম।

ভাইপো প্রাইভেট ফার্মে। দম ফেলার সময় নেই, কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষি করে বউ-বাচ্চা সামলায়। একমাত্র বাচ্চাটা স্প্যাসটিক, জাস্ট মনের জোরে টিকে আছে, খরচপাতি কম! সরলার জন্যে যদি কিছু রেখে যেতে পারতাম। বউমা পরের ঘরের মেয়ে, কদ্দিন আর মানবে! কাকার প্রতি ওর আবেগটা ছেলেমানুষি, বাঁচা-মরা নিয়ে আমার কোনো আদিখ্যেতা নেই, কেউ কি আসলে কাউকে বাঁচাতে পারে? জীবিতদের টাকা খুব দরকার। হাসপাতালে যতই সরকারি ব্যবস্থা থাক, যেতে আসতেও তো খরচ হয়। পিয়ালি জানলে হয়তো কিছু দিত।
আমার মোবাইলটা এখন সরলার কাছে।

হাসপাতাল চত্বরে কোথাও হয়তো চাদর পেতে গা এলিয়ে দিয়েছে। গতবার বড়ো-মা যখন মারা গেল, এখানে ঠেক গেঁড়েছিলাম। যা মশা, ঘুমোবার জো নেই, পেশেন্ট পার্টির অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ওরাও নির্মম হয়ে ওঠে। এখানে নিয়ম হল রাতে আত্মীয়স্বজন কাউকে-না-কাউকে থাকতে হবে, হঠাৎ বাইরে থেকে কোনো মেডিসিন কিনতে হলে কে দায়িত্ব নেবে? একটা অতিথিশালা অবশ্য আছে, তবে সেটা জন্ম থেকে বন্ধ। যাদের সামর্থ্য আছে পয়সা দিয়ে লোক রাখে, ছ-শো পার নাইট।

এরপর ও যদি ফোন ঘাঁটে, কতবার ভেবেছি গ্যালারি, মেসেঞ্জার ইত্যাদি লক করে রাখব, শেষপর্যন্ত কিছু-না-কিছু আপশোস থেকেই যায়। ব্যাট তুলে মাঠ ছেড়ে বেরোনোর ভাগ্য ক-জনের কপালে জোটে! চ্যাট হিস্ট্রি জানলে নির্ঘাত মূর্ছা যাবে। আমি হলে স্বামীর মৃত্যু-কামনাই করতাম।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

আলোগুলো দিনের মতো উজ্জ্বল, হাসপাতাল তো নয়, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। রোগীদেরকে অন্যের দয়ার ওপরে নির্ভর থাকতে হয়। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শাস্ত্র প্রাণহীন হয়ে গেছে, ডাক্তাররা জানতেও চায় না কার কী পছন্দ, ওষুধ কোম্পানির ফর্মুলাতেই চাপা পড়েছে স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান। সরলা আলো জ্বালিয়ে ঘুমোতে পারত না কিছুতেই, এই নিয়ে কত খটাখটি দু-জনার। গত দশ-বারোদিন মেয়েটার কম ধকল যাচ্ছে! নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই, আমাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, যেন নিয়তিকেও রুখে দেবে... এত মনের জোর ও কোথা থেকে পেল? বরের জামার খুঁট ধরেই তো কাটিয়ে দিল শেষ তেইশটা বছর। ঠিক বুঝতে পারছি না, আমার কি অনুতাপ হওয়া উচিত? আরও একটু সাহস সঞ্চয় করে প্লিজ চেপে ধরো, সব স্বীকার করে নেব, বলব, পিয়ালিকে খবর দাও, নিজের ভালো লাগার কথা ভেবে নয়, বিশ্বাস করো, ওকে তোমার আজ বিশেষ প্রয়োজন। লড়াইটা কেন তুমি শুধু একাই চালাবে?

নীচের দিকটা ভিজে ভিজে লাগছে, মনে হয় বাহ্য হয়ে গেছে। আগে গা ঘিনঘিন করত, এখন শরীরের বাইরে থাকা প্র্যাকটিস করছি... এই চুল উঠে যাওয়া, গালভাঙা, পোকায় খাওয়া দেহটার প্রতি কোনো মায়া-মমতা নেই, ওর মাথাটা আমার পুঁজি, ভাবনা ছাড়া অন্য সব বিকল্পকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কঠিন কিছু বেরোবে না, সেটাই বাঁচোয়া, স্যালাইনে পেট ফুলে আছে। অন্যেরা আমার জন্যে দুর্ভোগ পোয়াচ্ছে দেখলে কুঁকড়ে যেতে ইচ্ছে করে। দূরে চেয়ারে বসে থাকা ঝাপসা নার্সটিকে স্কুলের ক্লার্ক দিদিমণি মনে হচ্ছে, কেউ মরে গেলে ওঁর খুব খাটনি, কাগজপত্তরে ভুল থাকলে মড়ার যে পুড়েও রেহাই নেই। উনি কোনোদিন আমাদের ক্লাস নেননি, তবু তিন-চার-শো কবিতা লিখেছিলাম ওঁকে উদ্দেশ করে। ফার্স্ট বয় কৌশিক কালপ্রিট, ও যে বাংলার দিদির প্রেমিক, সেটা সবাই জানত। তখন হিংসা ছিল, স্বপ্ন ছিল, জীবনটা বাঁধে বাঁধে শুকিয়ে যায়নি। কৌশিক মাঝে মাঝে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন করে, ওর সাহেব বউ ডিভোর্সের মামলা স্যুট করেছে, কেসটার কোনো ডেপ্‌থ নেই। দারু ধরেছে, তবে মেপে। ক্লার্ক দিদির প্রতি সমীহ রেখেই বলে ফেললাম, ‘মঞ্জুলাদি, বেডশিট পালটানোর দরকার নেই যদি কেন ফালতু ফালতু কেনালে, জানো, সরলার ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই।’

কুঁচকে যাওয়া ফ্যাকাশে চামড়ায় ঠান্ডা গরম দুই-ই সমান, এসির একটানা ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দের ক্ষমতা নেই তাকে জাগানোর। কিন্তু কানদুটো বেইমানি করছে, মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে কেউ যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছে তীব্র শলাকা।

আমাদের বাড়ির সামনে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ আছে, রাতে তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে। ওদিককার জানলা খোলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

তবু তাকে আটকে রাখা দায়, বিরাট বিরাট ডালপালা নিয়ে এমনভাবে জাহির করে, যেন সে-ই মালিক, আমি নাছোড় অতিথি হয়ে রসালাপে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি। কতবার ভেবেছি কেটে দেব, পারিনি, সরলার প্রতিরোধের সামনে আমার নিষ্ঠুরতা এভাবেই বার বার পরাজিত হয়। সন্ধেবেলায় বসে ঝিঁঝিঁদের মেহফিল, এসির শব্দের মতো বিরতিহীন, কখনো একটু জোরে, কখনো আস্তে, রাতের বেলায় পৃথিবী মোটেই শব্দ-শূন্য হয় না।

এইমাত্র এসির আওয়াজ ছাড়িয়ে প্রকট হয়ে উঠল হাঁপানির শব্দ, পাশের বেড থেকে। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ফলিডল খেয়েছে, চব্বিশ-পঁচিশ বয়স হবে। বউ নাকি তার পুরোনো প্রেমিককে ভোলেনি, তলে তলে যোগাযোগ রাখে। কাল রাতে ওর বেডেই ছিলাম শেয়ার করে, আজ সকালে এখানকার বাচ্চাটা দেহ রেখেছে, তাই নিজের একটা জায়গা পেয়েছি। বাচ্চার মা খুব কাঁদছিল। হার্টের সমস্যা, বুড়ো ডাক্তারবাবু নাকি বলেছিল বাঁচানো যেত। আজকাল হার্ট পালটানোর অনেক উপায় বেরিয়েছে। কিন্তু এখানে সেসব ব্যবস্থা নেই।
মেহতাবকে বলেছিলাম, ‘ফালতু বিষ খেতে গেলি কেন, বউ গেলে কি বউয়ের অভাব!’
ডুকরে উঠেছিল, ‘কাকু, জানো, দু-সপ্তা ধরে সালমা এখানেই পড়ে আছে, কুটোটাও গিলতে চায় না। যদি বেঁচে ফিরি ও যাকে ভালোবাসে তার সঙ্গেই ওকে বিয়ে দেব।’
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বোধ হয় মানুষের মনের জোর কমে যায়। মেহতাবের শ্বাস নেওয়ার ধ্বনিটা কি ক্ষীণ হয়ে আসছে, না না, শোনার ভুল।
সরলা আমাকে বলে গেছে, ‘দেখো, এখান থেকে তোমাকে ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে যাব।’


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখিরনিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

Tuhin Subhra

1 দিন আগে

এই গল্পটি গভীর জীবনবোধে ভরা, যেখানে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের মনোজগতের সূক্ষ্ম পরিবর্তন, স্মৃতির আলোছায়া ও সম্পর্কের জটিলতা অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। চরিত্রগুলি যেন জীবনের নিজস্ব ট্র্যাজেডি বয়ে নিয়ে এসেছে, কিন্তু তবুও তাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মানবিকতার আভাস পাঠককে আলোড়িত করে। লেখকের ভাষা খুব গভীর, বিমূর্ত কিন্তু বাস্তব—একপ্রকার আত্মোপলব্ধির ডায়েরি যেন। সবচেয়ে ছুঁয়ে যায় সরলার সেই প্রতিজ্ঞা—"দেখো, এখান থেকে তোমাকে ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে যাব।" —যেখানে ভালোবাসা আর প্রত্যাশা মৃত্যুকেও হার মানায়। এক কথায়, এটি একটি হৃদয়স্পর্শী, চিন্তন-উদ্রেককারী গল্প, যা পড়ার পর পাঠক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকেন।


Image Description

dasshekhar13@gmail.com

23 ঘন্টা আগে

Darun Chhilo sr.kichhu somoyer jonno oi caracter a chole gechhilam..tobe sr ak bar basanti highway ta porte chai .valo thakben.


মন্তব্য করুন

লেখক

পবিত্র সাঁফুই, পেশা শিক্ষকতা, বসবাস, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা। প্রকাশিত বই— কাব্যগ্রন্থ: অন্য সব বেলাভূমি (২০০০), গল্পগ্রন্থ: সাকি নাচছে, (২০১৬), কৈখালি ডটকম (২০২২), ঝিঁঝিঁ খেলা (২০২৫)। উপন্যাস: বাসন্তী হাইওয়ে (২০২৪)।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন