বাংলা ডায়াস্পোরা বিভাগটি নানারকম লেখায় ভরা থাকবে। এরকম পরিকল্পনা নিয়েই বিভাগের উন্মোচন। ডায়াস্পোরার লেখকদের চিন্তন প্রক্রিয়াও সেসব লেখার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেই চিন্তাপ্রক্রিয়ায় লেখকদের জীবনের জার্নি অবিচ্ছেদ্য। নাহার মনিকা এই লেখায় সেই জার্নির একটা রূপরেখা দিয়েছেন।
তখন শিশুকাল, বয়স সাড়ে পাঁচ কি ছয়।
গায়ে সাবান মেখে কুয়োতলায় খেলতে খুব ভালোবাসতাম। ওই আমাদের দেশে শিশুরা যেমন কোন খেলনাপাতি ছাড়া খেলে, তেমন।
খেলতে খেলতে মা’র বকা খেতাম, আর আমার বিপত্তারিণী হয়ে কাছে কাছে থাকতো জ্যোৎস্না খালা, মায়ের পরের বোন। আমার গা হাত পায়ে বালতি বালতি পানি ঢেলে বলতো- সাবান ফ্যাক্টরির মালিকের সঙ্গে তোকে বিয়ে দেবো!’
ভেজা গায়ে সাবানে আরো ফেনা তুলে আমি নাকি খিলখিলিয়ে হাসতাম, আর সাবান কোম্পানীর মালিক সম্ভাব্য শ্বশুরকুলের গল্প বানাতাম। সেসব গল্প শুনতে মামা খালাদের ভেতর আমাকে নিয়ে নাকি বেশ কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো।
সেদিন ছিল রোববার। গরমের দিনে দুপুরে বাড়িতে সোরগোল তুলে আকাশবানী কলকাতা বাজছে। রান্নাঘর থেকে ছুটির দিনের নিয়মিত সুখাদ্য মাংস-পোলাও এর ঘ্রাণ।
বড় বোনের গা ধোয়া শেষ। আমিই ত্যাড়ামি করে দেরি করছি, মানে পাতলা কাঁচের মত হয়ে আসা কসকো সাবান থেকে আরো বুদবুদ তুলে খেলছি।
জ্যোৎস্না খালা ছোট ভাইয়ের গা মুছে কোলে করে ঘরে নিয়ে গেছে, হয়তো জামা পরিয়ে, পাউডার দিয়ে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। তার ফিরে আসতে দেরি হবে!
তপ্ত রোদে গায়ের সাবান শুকিয়ে চড়চড়ে হয়ে যাচ্ছে। খালাকে ডাকবো?
উঠে দাঁড়িয়ে পাশের বালতি থেকে পানিটুকু পায়ের ওপর ঢেলে দিলাম। শানবাঁধানো কুয়োতলা মুহূর্তে পিছল হয়ে উঠলো।
চারদিকের সোনা রোদ সাবানের সাদা বুদবুকে সোনালী আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। কুয়োতলার কোল ঘেষে পেয়ারা গাছের অঘন পাতার ভেতর অসংলগ্ন আলোর নেমে আসা দেখতে দেখতে আমি আলগোছে দড়িবাঁধা বালতি হাতে তুলে নিয়েছি। জ্যোৎস্না খালার অপেক্ষা করে লাভ নেই।
বালতি নিয়ে ঝুঁকেও ইঁদারার তল দেখা যায় না। আমি পায়ের পাতায় ভর দেই, কপিকলের দড়ি নেমে এসে আবার উঠে গিয়ে পানিবিহীন বালতিকে উঁচুতে তুলে ফ্যালে, আমি পিছলে গিয়েও দড়িটা ধরে ফেলতে পারি। বালতিটা ইঁদারার মুখে আনতে পেরেছি, পানি এবার তুলেই ফেলবো। আমার সাবান মাখা পা উঁচু হচ্ছে, আমার দুই বাহু দীর্ঘ হচ্ছে, বালতির দড়ি সজোরে ধরে উবু হতে গিয়েই একেবারে উড়ে গেলাম!
সাঁ করে নিচে পড়ে যাচ্ছি, ইঁদারার দেয়ালে দু-তিনবার ধাক্কা খেতে খেতে দেখছি ভেজা দেয়ালের গায়ে সবুজ শ্যাওলা। আবার ধাক্কা, আবার সবুজ শ্যাওলা, ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেই বালতির ভেতরে ঢুকে গেলাম। পানির রং আশ্চর্য কালচে নীল! সমুদ্র দেখিনি, সে কি এরকম? ওপর থেকে এক ঢোক নীল আকাশ গিলে ফেলেছে কুয়ো, কিছুটা আলো নিচে নামতে নামতে দড় হারাচ্ছে!
চিৎকার করছি, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। চোখ, কান এমনকি সমস্ত রোমকূপ দিয়ে আওয়াজ তুলতে চাইছি, যা ওপরে পৌঁছে যাবে, কিন্তু আমার চারপাশে শুধু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, আর ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসা ছায়া ছায়া অন্ধকার।
কতক্ষণ সময় গেল, আমি সেই সমুদ্রে ডিঙ্গির মধ্যে বসে দুলছি, চেতন অচেতনের ভেতর আমার অকুল দরিয়ার যাত্রা!
হঠাৎ ঢাকনা দেয়া আলোর মুখ খুলে গেল, কতগুলো মুখ ভেসে উঠলো কুয়োর মুখে। শোরগোল স্পষ্ট হচ্ছে আর আমি ওপরে উঠছি, আমি ওপরে উঠছি আর ঝাঁপসা মুখগুলো কাছে আসছে। ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে আমি একসময় নিজেকে একটা তোয়ালে জড়ানো অবস্থায় বাবার কোলে আবিস্কার করলাম। কুয়োর দেয়ালে ধাক্কা লেগে আমার কপাল ফেটে গেছে। শাদা তোয়ালে জুড়ে লাল রক্ত। মায়ের চিৎকার, কান্না, বাবার বিব্রত, গম্ভীর, তাৎক্ষনিক সমস্যা সমাধানের তৃপ্ত অথচ ব্যথিত মুখের চারপাশে অসংখ্য চেনা অচেনা মানুষ। প্রায় সবাই রবাহূত। কেউ একজন দৌড়ে বড় রাস্তায় গিয়ে খবর দিয়েছিল যে একটি বাচ্চা কুয়োতে পড়ে গেছে!
ঝপাৎ করে পানিতে পড়ে যাওয়ার শব্দ আর তা যদি হয় ইঁদারার গোল দেয়ালের ভেতর, সেটি যে কত মর্মভেদী হয়, তা সেদিন আমি বুঝেছি কি না জানি না, তবে সেদিন থেকে শব্দের অর্থ বদলে গেল আমার কাছে।
হড়বড় করে কথা বলে বড়দেরকে আমোদ দিতো যে বাচ্চা মেয়েটি, সে হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দিলো! যেন কুয়োর গহীন কুঠুরির জলের তালে দুলতে দুলতে শব্দ আর কথার ভার থেকে সে মুক্তি পেতে চেয়েছে।
কিন্তু সে কি আর সহজ কাজ!
মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে জীবনটাকে বোনাস হিসেবে ভাবার বোঝাবুঝিটা ওই শিশু বয়সে হওয়ার কথা না, তবে অবচেতনের গভীর মোহনায় এর ভ্রুণ তৈরী হয়েছিল নিশ্চয়ই।
সে কারণেই কি দীর্ঘকাল বাদে একদিন ঘুম ভেঙ্গে মনে হলো, তাই তো!
সেই শিশুটির আর বড় না হবার সম্ভবনা তো আমায় জাপটে ধরেছিল।
হতেই তো পারতো আমার ওই কূপমণ্ডূক পতনের শব্দ কেউ শোনেনি। মা তার মত রান্নায় ব্যস্ত, খালা ভাইকে পাউডার দিতে দিতে আমার কথা ভুলে গেছে। বাবার হাত রেডিওর নব-এ ঘুরতে ঘুরতে চোখে ছুটির দিনের আলস্যে ঘুম। পেয়ারা গাছে একটা ঘুঘু অবিরাম ডেকে যাচ্ছে, উঠোনভরা খটখটে রোদের মরীচিকা। এর মধ্যে কেউ আমার পতনের ঝপাৎ শুনলোই না। কোথায় থাকতাম আমি!
সশব্দ আমাকে সপাটে কাবু করে দিতে এই ভাবনাই তো সবল প্রতিপক্ষ।
তবে ছুটির দিনের বাড়িতে পরিবারের বুঝি আরেকটি সজাগ ইন্দ্রিয় থাকে। কুয়োতলার শব্দ, বালতির ঠোক্কর সব দ্বিগুণ তিনগুণ শোনা না গেলে মা কেন ধুম্রজালের ভেতর থেকে মশলা নাড়া খুন্তি হাতে ছুটে আসবে! কেনই বা সাড়া পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার দেবে, লাগোয়া বাজার থেকে শত শত লোক ছুটে আসবে। খোঁজ পড়বে কুয়োওয়ালার। অথচ আমার ঠান্ডা মাথার, শক্ত সমর্থ বাবা কাঁপা কাঁপা হাতে কপিকলের পুরনো অশক্ত দড়ি আস্তে আস্তে তুলে বালতির ভেতরে অজ্ঞান হয়ে গুটলি পাঁকিয়ে থাকা আমাকে তুলে ফেলবে!
আমাদের বাড়ির বারান্দায় একটা বেঞ্চ পাতা ছিল, আমাকে সেই বেঞ্চে বসিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ করছিল ডাক্তার, সদ্য জ্ঞান ফেরা আমি তখন সব উৎসুক, ব্যথিত চোখের খুশী দেখেছি, যারা ভেবেছিল আমি নেই, কিন্তু ফিরে পেয়ে খুশী। চারপাশের কথার সমুদ্র আমি শুনতে পাইনি, পেলেও সেসব শব্দকে আলাদা করতে পারিনি। এখনো চোখ বন্ধ করে সে শব্দ আমি শুনতে পাই, মনে হয় গলিত কোন ভোতা অস্ত্রের মত কোন অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে শব্দের সেই একরোখা স্রোতে বয়ে যাচ্ছে।
ওই স্রোতটা নিয়ে আমি বড় হচ্ছিলাম। একা।
তখন বেশ বড় একটা ক্যানভাসে কয়েকটি রেখায় আঁকা সরল শৈশব আমাদের।
এলাকার অর্থনীতির নাটবল্টু সামলানো চিনিকল। পাড়ার রাস্তায় ঢোকার আগে বাজার। পাড়ার শেষে কিছু আবাদী জমির ভেতর দিয়ে রাস্তা পেরোলে শুক নদী। চিনিকলের বর্জ্য ফেলার জন্য নদীর সংগে জুড়ে দেয়া ক্যানেল। চিনিকলের স্কুল। নাতিদীর্ঘ এক বন পেরিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাই। ছুটির পর স্লেট দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে কচি শালপাতা পেড়ে হাত রঙ্গিন করি। কোন কোন হাফ স্কুলের দিনে বালি মাটির কোটরে জমে থাকা বর্ষার জলে হঠাৎ জন্মানো ব্যাঙ্গাচি ধরি স্কুল ড্রেস খুলে। বাড়ি ফিরে মা’য়ের হাতে নির্ধারিত পাখার মারের সঙ্গে শুকনো ধুন্দুলের খোসায় সাবান মেখে গা ডলে গোসলও জোটে।
ততদিনে আমার সাবানপ্রীতি উধাও হয়েছে। সেখানে ঢুকে পড়েছে বই!
আমাদেরকে বই পড়ে শোনাবার কেউ ছিল না। মা, মামা, খালাদের বইপত্র, এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকা বাসি সংবাদপত্র, মুদি দোকান থেকে সদাই আসা কাগজের ঠোঙ্গা, সোভিয়েত ইউনিয়নের বদান্যতায় রঙ্গিন ছবিওয়ালা বই, ম্যাগাজিন এসবের পরও কুমীরের হা খোলা মুখের মত পড়ার ইচ্ছায় বাগানের ঝিঁঝিঁ পোকাদের, গাছের গায়ে ঝুলতে থাকা মধুফলের চুয়ে পড়া মধু, দুলফি ফুলের নিস্পাপ ফুটে থাকা, জিয়া গাছের আঠায় নানান শেইপ, সাইজ এসবের পাঠ চলতো নিত্যদিন।
বুকের ভেতর কুয়োর তলদেশ থেকে উঠে আসা সেই কথার ভোতা স্রোতটা কিন্তু তখনো চলমান।
বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করে সেখান থেকে নিজে বেরুবো, অথবা সেসব ভোঁতা শব্দকে ধার এবং আকার দেব!
এদিকে সব ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া মেধাবী বড়বোন মেহেরুন্নেসা মেরী হাই স্কুলে উঠে গল্প লিখছে। গল্পের প্রধান চরিত্র মেডিকেল কলেজে পড়ে, প্রেমের গল্প। পড়ে আমার ছটফট লাগে, ভেতরের কথার স্রোতটাকে ভাষা দিতে ইচ্ছে করে।
আমার ক্লাস এইট, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অনুবাদে পড়া শেষ। কাস্তে প্রতীকটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। মাঝে মাঝে ‘ডিয়ার ডায়েরি’ ধরনে বাঁধানো খাতায় লেখি।
ক্লাস নাইন শুরু হবার আগে ছুটির সকাল। চিনিকলের ছাই উড়ে উড়ে আরেকপ্রস্থ কালো চাদরে ঢেকে দেওয়া উঠোনটাকে ঝাঁট দিচ্ছে গৌরাঙ্গের মা। মঙ্গায় পীড়িত নিঃস্ব তাদের পরিবারটি কয়েকদিন আগে এ এলাকায় এসেছে। গৌরাঙ্গ ও তার বোনের হাড় জিরজিরে শরীর দেখে আমরা সবাই শিউরে উঠেছি। তখনো আমার দূর্ভিক্ষ নিয়ে কোন বই পড়া, বা সিনেমা দেখার সুযোগ হয়নি।
ডায়েরি লেখার ইচ্ছে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলাম।
কিন্তু লেখা হয়ে গেল কবিতা। কবিতার নাম ‘এই এখন, এক্ষুনি’।
পাঠ্যবইয়ের বাইরে শুধু রবীন্দ্র নজরুল পড়া আমার কবিতার ধরন সমাজতান্ত্রিক, বক্তব্যও পরিষ্কার যে এক্ষুনি সমাজ পালটে ফেলতে চাই, গৌরাঙ্গের পরিবারের আহার বাসস্থানের নিশ্চয়তা চাই।
এখন পেছন ফিরে দেখি যে সে কবিতা আবেগ ভরা, অথচ সে বিরাট কবিতা লিখে ফেলার পর মনে হলো আমার শব্দের, কথার ভোতা স্রোতে খানিকটা ঢেউ বয়ে গেল।
সেই থেকে কি শুরু! কবিতা দিয়ে ভেতরের শব্দগুলোকে বের করে দেয়ার প্রবণতা?
ডায়েরি, কবিতা আমার লেখালেখির ডাইভিং বোর্ড। হাঁটতে, দৌড়াতে শেখার পর এক্টু একটু করে সাঁতার শিখে একদিন নদীর ধারে পেতে রাখা লম্বা কাঠের তক্তা ধরে দৌড়ে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া।
বড় বোনের অনুসারী হয়ে আমিও আমার সেই স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা এক পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিন পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কবিতা ঢাকার এক দৈনিক কাগজের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হলো। প্রকাশিত হওয়া যে লেখালেখির প্রণোদনায় প্রথমদিকে, কে না জানে!
প্রায় দশহাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনকারী চিনিকলে দেশের নানা অঞ্চলের মানুষের সমাহার। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য তৈরী হওয়া স্কুলও তার ব্যতিক্রম নয়। পদাধিকার ইত্যাদি কারণে স্কুলেও যে শ্রেনীবিভাজন ছিল না তা না, কিন্তু তখন আমাদের শিশুমন সেসব বুঝতো না, বা বুঝে ফেললেও কিছু করবার ছিল না। স্কুলে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যেতাম।
অফিসার্স ক্লাবে কর্মকর্তারা স্ত্রী-সন্তান সহযোগে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ‘ফাংশান’ করতো। এর আগে চলতো ধারাবাহিক মহড়া। একেকদিন একেকজনের বাড়িতে বিকেলের নাস্তার সঙ্গে সেসব মহড়া এতই লোভনীয় ছিল যে বিকেলের খেলার মাঠ ভুলে থাকতে কষ্ট হতো না।
সাধারণ কর্মচারীদের একটি ক্লাবঘর ছিল, আমাদের স্কুলের মাঠ ছাড়িয়ে আরেকটি বড় মাঠের এক কোনে। দুই মাঠের মাঝখানে নিচু আল বোঝাই চোরকাটা এর সীমানা নির্ধারণ করে দিতো। বড় মাঠে প্যান্ডেল বানিয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। এই ক্লাবঘরের লাগোয়া স্থায়ী মঞ্চ ছিল। নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের দিন সামনের টিনের বেড়া সরিয়ে মঞ্চ সেজে উঠতো অবধারিত কালো পর্দ্দায়।
বড় বড় জাতীয় দিবস আর স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই মঞ্চে হতো।
গানের গলা খুব সহজে তারায় পৌছাতো আমার। ঠিকঠাক উচ্চারণে কবিতা পড়তে পারতাম, নাচের ছন্দও অন্য অনেকের চেয়ে ভালো খেলে যেতো পায়ে। সুতরাং এসব অনুষ্ঠানে আমি থাকবো এটাই স্বাভাবিক। এক পর্যায়ে এমন হলো- গীতি আলেখ্য বা এ রকম কোন বড় অনুষ্ঠানে ধারাবর্ণনার জন্য আমার বিকল্প জুটতো না। হায়ারে যেমন খেলোয়াড় খেলতে যায়, তেমন করে অনুষ্ঠানের জন্য আমার ডাক আসতে থাকলো। তবে পরিবারের ফিল্টার ছিল, সবখানে যাওয়া নিষেধ। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে যেতো এবং ফিরিয়ে আনতো।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
খেলোয়াড়েরা হয়তো পয়সাপাতি পায়, আমি পুরস্কার পেতাম বই আর জলখাবার। গরমাগরম লুচির সঙ্গে রসগোল্লা। চিনিকলের প্রাপ্তবয়স্কদের অনুষ্ঠানে ধারাবর্ণনা করে ভেতরে তাৎক্ষনিক ভারিক্কিপনাও টের পেতাম না কি!
কেমন করে যেন গীতি আলেখ্য লেখার ভার আমার ওপরে চলে এলো।
বিষয় নির্ধারণ করে দিলে রীতিমত খেটেখুটে লিখতাম। তখন তো গবেষণার সুযোগ নেই, হাতের কাছে রেফারেন্স বলতে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী আর আমার প্রিয় নজরুলগীতির দুই বই।
তো, বসন্তউৎসবের গীতি আলেখ্যতে গান বা কবিতা গুঁজে দিয়ে বর্ণনাটুকুতে যথেচ্ছ কল্পনা মিশিয়ে লিখে দিতাম। সেসব গোঁজামিল নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। বরং উদার প্রশংসা জুটেছে।
এদিকে তখন রোজ কবিতা লিখি। সপ্তাহে একদিন ছোটভাইয়ের হাত ধরে স্থানীয় পোস্টাপিসে যাই। সরকারী হলদে খামে তা পোষ্ট করে অপেক্ষা করি কখন কাগজে কবিতাটি ছাপা হবে।
আমাদের বাড়িতে আম্মার শরৎ, নিমাই, ফাল্গুনীদের সঙ্গে ইতোমধ্যে ঢুকে গেছে কিছু লিটল ম্যাগাজিন, সেবা প্রকাশনীর থ্রিলার, আনন্দবাজারের পুজোসংখ্যা আর বিচিত্রা’র ঈদসংখ্যা।
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে একটি এনজিও (আর ডি আর এস) লাইব্রেরীর সদস্য হতেই আমার সামনে আরেক যাদুর দুনিয়া খুলে গেল। হাতে পেয়ে গেলাম পুরো এক তাক বোঝাই নোবেল বিজয়ীদের উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ।
স্কুলের পাট চুকলে কলেজ,, চিনিকল থেকে কয়েক মাইল দূরে। ইক্ষু বহনকারী ট্রাকের ভেতরে দু’ধারে কাঠের বেঞ্চি বানিয়ে দেয়া, তাতে আমরা কলেজ পড়ুয়ারা সকালে কলেজে যাই, বিকেলে ক্লাস শেষ হলে যাদের হয়নি তাদের জন্য অপেক্ষা করি। তারপর বাড়ি ফিরে আসি।
চিনিকলের সাংস্কৃতিক আবহে গড়া আমার মানসিকতাও সঙ্গে সঙ্গে গেল।
কলেজের প্রতিযোগিতায় কবিতা লেখাসহ আরো দুটো ক্যাটাগরিতে ফার্স্ট হয়ে আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সবচাইতে আনন্দের ছিল পুরস্কারের এক ব্যাগ বোঝাই বই নিয়ে বাড়ি ফেরা! মানিক রচনাবলী আর বেশ কিছু ভালো বইয়ের গর্বিত মালিক আমি তখন। এর মধ্যে আর
আমার সলজ্জ লেখালেখির কথা তখন কলেজে মোটামুটি প্রকাশ হয়ে গেল। সাহিত্যে আগ্রহীদের মনযোগ পেতে থাকলাম।
কলেজের দু’বছর কিন্তু দেখতে দেখতে চলে যায়।
এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পালা।
বলা যায় পুকুর থেকে সমুদ্রে এসে পড়লাম। বড়বোন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে বাংলা সাহিত্যে, আমি সমাজবিজ্ঞানে। ওর সুবাদে আমার দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই সহজ পদচারণা।
আমার ভেতরের শব্দগুলো তখন দ্বিগুণ তিনগুণ স্রোত তুলে চলছে। আমার চারপাশের আওয়াজও তখন প্রবল, প্রকট। এর মধ্যেই আমার শব্দরাশিকে প্রকাশিত হতে দিতে চাই। ততদিনে ডাকবিভাগের হলুদ খামের সঙ্গে আমার সখ্যতাও বেশ পোক্ত। হলুদ খামে কি আর মুখ দেখা যায়? লেখা পাঠাই তখনকার গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক, সাপ্তাহিকের সাহিত্যপাতায়।
তখন দেশে সামরিক শাসন।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংকটে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন দীর্ঘায়িত হতে থাকে। ডিপার্টমেন্ট এ সময় দেয়ার বদলে আমি বাইরের বইপত্র ও লেখালেখিতে নিমগ্ন হতে থাকলাম। ডাক্সু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন)র’ সাহিত্য সম্পাদক লেখার আমন্ত্রণ জানায়, অধ্যাপক যাঁরা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত এমন দু’একজন ভারী উৎসাহ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাজনীতিবিমুখ হয়ে থাকা যায় না। সারা ক্যাম্পাস প্রতিবাদমুখর। আমিও ব্যতিক্রম নই।
সে সময় ভার্সিটির ছাত্রী হস্টেলের গেইট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যে ছ’টায়। ঢোকার পথে হাউস টিউটরদের অফিস, নিউ বিল্ডিং নামের ছাত্রীদের থাকার ভবনের নিচে স্টাডি রুম, সারি সারি ডেস্ক, বেঞ্চের একপাশে স্ট্যান্ডিং টেবলে কব্জা দিয়ে আটকে রাখা প্রায় সবকটা জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা। যেন ছিঁড়ে না যায়, যেন কেউ নিয়ে না যেতে পারে।
পাঠাগারের একধারে বিখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফী ছাত্রীদের গান শেখান। তাঁকে পাশ কাটিয়ে পত্রিকার টেবিলের দিকে যাই। বিচিত্রার পাতায় আমার কবিতা ইলাস্ট্রেশন সহ ছাপা হয়েছে। কবিতার নাম ‘ফেরদৌসী বাঈ’। আমার ফেরদৌসী বাঈ প্রতিবাদী, সঙ্গীতের মত তার দেহবল্লরী, প্রতিবাদ আর প্রকৃতির সংযোগ নিয়ে পংক্তিমালা। নারীর সহজাত প্রতিভা যেন রূপের আড়ালে না চলে যায় তেমন একটি অভিপ্রায়ও ছিল সে লেখায়।
এর মধ্যে দারুণ এক প্রণোদনা এসে যায়, তা হলো লেখক সম্মানী। পত্রিকাগুলোতে লিখে আমার হাত খরচা হয়েও পরিবারের জন্য উপহার কেনা যায়। মনে আছে, শুধু লেখার চেক জমা দেয়ার জন্য একটা জনতা ব্যাংকের শাহবাগ শাখায় একটা একাউন্ট খুলেছিলাম।
ছাপালেখা আমি পত্রিকা থেকে কেটে একটা ড্রয়ারে রেখে দিতাম। এক বন্ধু তা দেখে একটা চমৎকার বড় বাঁধাই খাতা, বাঁশকাগজে মলাট দিয়ে ওপরে ছবি এঁকে উপহার দিলো। কেটে রাখা কবিতা সেখানে আঠা দিয়ে সেঁটে নিচে প্রকাশিত হওয়ার তারিখ লিখে রাখি। পৃষ্ঠাসংখ্যা গুণে রাখিনি, তবে প্রায় সবগুলো পাতা ভরে এসেছিল ছাপা অক্ষরের কবিতা দিয়ে।
এর মধ্যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো দানা বেঁধে উঠলো। ডাক্তার মিলন নিহত হলেন। নূর হোসেন বুকে পিঠে শ্লোগান লিখে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান তৎপরতা লেগেই থাকতো, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত হতো এবং আমরা আবাসিক হল খালি করার নোটিশ পেতাম।
এমনি এক নোটিশের দিন দুই আগে এক বন্ধু আমার কবিতার খাতাটি চেয়ে বসলো, সে মন দিয়ে আমার লেখা পড়তে চায়। কেউ আগ্রহী হয়ে লেখা পড়বে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! দিলাম। ফেরত পাবো, জানি তো।
কিন্তু হল খালি করার ডামাডোলে, পুলিশ রেইডের মুখে সে আমার খাতাটি সঙ্গে নিতে ভুলে গেল।
আমার সে সময়ের লেখালেখি সব হারিয়ে গেল।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হতে না হতেই চাকুরী জীবন। একটি দিনের জন্যও বেকারজীবন হলে কি আরো কিছু কবিতার জন্ম হতো? কে জানে!
২
আন্তর্জাতিক সংস্থায় গবেষকের কাজ করি। কেইস স্টাডির উত্তরদাতাদের জীবনের গল্প তথ্যের আকারে নোট করে নেই। সেখান থেকে রিপোর্ট লেখি, সায়েন্টিফিক জার্নালে ছাপা হয়। মাথায় কবিতা এলে লিখে রাখি, ছাপাতে দেবো দিচ্ছি করে দেয়া হয় না। আমার লেখালেখি বিষয়ে গবেষক সহকর্মীরা কিছু জানতে পায় না।
এর পর ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর বৃত্তি নিয়ে বিলেতে চলে যাই উচ্চতর শিক্ষা নিতে। হা করে নিঃশ্বাস নেয়া ব্যস্ততার ভেতর বাংলা লেখালেখি থেকে দূরে চলে গেলেও লন্ডন শহরে ক্যামডেন টাউনের হরেক পশরার উইকএন্ড মার্কেট ঘুরে এসে, কিংবা রিজেন্টস পার্কের সাতশো গোলাপ দেখে অথবা গৃহহীন কাউকে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বাড়ি ফিরে বই নিয়ে পড়তে বসার আগে কিছু সময় ধরে বাংলা লিখতাম।
সে সব লেখা খাপছাড়া, মনের অস্থির প্রকাশ। না ডায়েরি, না কবিতা, না গল্প।
অনেক পরে যখন বাংলা ব্লগের জন্ম হলো তখন বুঝলাম সেসব আসলে দৈনন্দিন ব্লগই ছিল।
ততদিনে বিবাহিতের তকমা জুটে গেছে। জীবনসঙ্গী চিত্রশিল্পী রাকীব হাসান। কেনিয়ায় নায়রোবীতে তার আর্টের পড়াশোনা শেষে, কর্মজীবন। ওয়েস্টল্যান্ড নামের একটি এলাকায় তার স্টুডিও গ্যালারী।
সেদেশে একদিন ভঈ নামের এক পাহাড়ের কোলের গ্রামে বেড়াতে গিয়েছি। পাহাড়ের মাথা আকাশের গায়ে গিয়ে মিশেছে। দলে আমরা চারজন। সারাদিন পরে ফেরার সময় আমাদের গাড়ি বিকল হলো, রাত কাটাতে হলো খুব সাধারণ একটা টিনের গুমটি ঘরে। আশপাশে কোন দোকান না থাকায় খাবার জুটলো না। গুমটির মালিক দুটো মোটা ভুষড়ো কম্বল দিলেন। প্রচণ্ড মশা। মশার হাত থেকে বাঁচতে কম্বল মুড়ি দেই, আবার কম্বলে গরম লাগলে মশার কামড় খাই। এই করে করে রাত কাটলো। ভোর হতে না হতেই কী করে এই নরক থেকে বেরুবো তার তোড়জোড় করছি। গুমটির দরজা খুলতেই বিস্ময়ের মত নীল পাহাড় ঠায় দাঁড়িয়ে, পাদদেশ থেকে পাহাড়ের শান্ত সমাহিত ছবি দেখে রাতের সব যন্ত্রণা ভুলে গেলাম।
ফিরে এসে সে রাত নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম।
নাইরোবতে আমার কাছে মাত্র তিনটে বাংলা বই ছিল। দেশ ছেড়ে আসবার আগে তাড়াহুড়ো এবং ওজনের কারণে বেশী আনা সম্ভব হয়নি। জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা, হুমায়ুন আজাদ এর নারী আর সুনীল এর একা এবং কয়েকজন, উপন্যাস। ওই তিনটে বই বিশেষ করে জীবনানন্দ আমি উল্টেপাল্টে পড়েছি। কবিতা পাঠ থেকেও কবিতা লেখা হয়। আমারও হয়েছে।
রাকীব নায়রোবিস্থ ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টার এর গ্যালারিতে আমার কবিতা থেকে তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে একটি একক প্রদর্শনী করেছিল ‘The Crimson Poems and the Blue Edge’,নামে সে চিত্রপ্রদর্শনীতে ছবির সঙ্গে সঙ্গে কবিতাগুলোর ইংরেজী অনুবাদও দর্শক পাঠকের মনোযোগ পেয়েছিল। সেটি ছিল ১৯৯৯ সাল।
দেশের সঙ্গে আমার লেখালেখির সংযোগ তখন মোটামুটি বিচ্ছিন্ন। বাংলা ছাপার অক্ষরও দেখার সুযোগ হয় কম। পরের বছর কেনিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে খেলতে গেল। ফিরে এসে তাদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ক্যাপ্টেন আসিফ করিম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি খোঁজ পেয়েছেন যে আমি বাঙ্গালী। বাংলায় ছাপা হওয়া দেশের পত্রিকাগুলো তিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করতে চান, আমি যদি সাহায্য করি। চোখের সামনে দশবারোটা বাংলায় ছাপা পত্রিকার পাতা দেখে আমার বুকের মধ্যে আনন্দের কাঁপন টের পেয়েছি। খুব দ্রুত সেসব সংবাদ অনুবাদ করে দিয়েছিলাম।
এই ব্যাপারটা আমার বেলায় খুব খাটে, ভালোবাসার কিছু হলে পরিশ্রম গায়ে লাগে না।
কোনদিন বিদেশে থিতু হবো ভাবিনি।
বিয়ের আগে দেশে থাকতে একদিন সহকর্মীদের প্ররোচনায় জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম। সে ভদ্রলোক নাকি ঠিক হস্তরেখাবিশারদ ইত্যাদি নন। সংখ্যাতত্ববিদ।
তো আমার হস্তরেখার সংখ্যা গননা শেষে বললেন—আপনার তো বিদেশেই বাস।
আমার সহকর্মীকে বললেন—কতবার তো ব্যাগ গোছালেন, গেলেন কি বিদেশ?
সহকর্মী হাসলেন—কী যে বলেন, আমার তো ক্যানাডায় ইমিগ্রেশন হয়ে আছে।
সে মাসেই আমি বিয়ে করলাম।
আমার সহকর্মী তার দু’দিন বাদে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেলেন।
আমি তখন জানলাম যে দেশের মানুষ ক্যানাডাতে মাইগ্রেট করে যেতে পারে, যাচ্ছে।
ক্যানাডা, বসবাসের জন্য কখনো আমার লিষ্টিতে ছিল না। তেমন ভাবলে তো বিলেতই ভালো ছিল। দেশ থেকে কাছে, অত বরফে ঢাকা থাকে না।
কেনিয়াতে ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে সামাজিক নিরাপত্তার তেমন নিশ্চয়তা ছিল না। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিই এর জন্য দায়ী। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব নেই। ধনী গরিবের মধ্যে দৃষ্টিকটু রকমের ফারাক, অথচ এক্সপ্যাট্রিয়ট হিসেবে আমাদের কিছু করার নেই। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বংশোদ্ভূত (মুহিন্ডি) এবং পশ্চিমাবিশ্বের শ্বেতাঙ্গ (মুজুঙ্গু) মানুষজন এই বিভাজনে মূল ভূমিকা রাখে।
মুহিন্ডি এবং মুজুঙ্গুরা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট-এ চড়ে না, রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ছিনতাই-এর শিকার হয়। তাদের বাড়ির সুউচ্চ গেইটে দ্বাররক্ষী এবং সিকিউরিটি কোম্পানীর পাহারা।
দেশী দূতাবাসের অনুষ্ঠানাদিতে গিয়ে, কেনিয়ার নয়নাভিরাম প্রকৃতি নিরাপদ জায়গাগুলোতে আরো অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঘুরে বেড়িয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আমার কেন যেন এমন সোনার কারাগার ভালো লাগছিল না।
এমন সময় রাকীব এর এক একক প্রদর্শনীতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এলেন সে সময় নাইরোবীতে কর্মরত ক্যানাডিয়ান হাই কমিশনার, বার্ণার্ড দ্যুসো। ভদ্রলোক চিত্রকলার অত্যন্ত উঁচুমানের সমঝদার। তাঁর সঙ্গে আমাদের ভালো বন্ধুত্ব হলো। একদিন কথা প্রসঙ্গে রাকীব বললেন— এখনো উত্তর আমেরিকাতে প্রদর্শনী করা হয়নি।
বার্ণার্ড বললেন —আপনারা কেন ইমিগ্রেশন নিয়ে ক্যানাডা আসছেন না, তাহলে প্রদর্শনী করা খুব সহজ হয়ে যায়।
কথাটা আমার খুব মনে ধরলো। নাইরোবির সোনার কারাগার থেকে মুক্ত হবার তাড়নাও মনে মনে ডানা মেললো। ক্যানাডায় ইমিগ্রেশন-এর দরখাস্ত এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যোগাড়ের তোড়জোড় করতে লাগলাম।
মানুষের স্থানান্তরের পেছনে ভৌগোলিক, আর্থ-রাজনৈতিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় যে বিশ্বপ্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষের জীবনের যে ছক, তাতে সে ঘুরপাক খায়, একে পোশাকি ভাষায় ডেস্টিনি বলা যেতে পারে। সেই ছকে পড়ে আমিও মে’মাসের এক অতিক্রান্ত দুপুরে ক্যানাডার মন্ট্রিয়াল শহরে এসে নামলাম।
নাইরোবিতে কর্মস্থল থেকে বেশ বড়, প্রায় তিন’শ কেজির এয়ার শিপমেন্ট বিদায়ী উপহার পেয়েছি। সুতরাং এবার আমার ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে এসেছি, সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশে বসবাস করবার, সমাজ-সংস্কৃতি ও মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা, যা আবারো মাথার ভেতর অবরুদ্ধ শব্দের বহতা নদী।
ক্যুবেক ফরাসী ভাষাভাষী প্রদেশ। এরা নতুন অভিবাসীদেরকে ফরাসী ভাষা শেখার সুযোগ দেয়। আমিও মন্ট্রিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিখি। আর আর সব ঝাঁকের কই ইমিগ্রান্টদের মত ফের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। গুছিয়ে বসে সংসার বড় হয়, সন্তান আসে। ম্যাকগিল এবং মণ্ট্রিয়াল ভার্সিটিতে সামাজিক স্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে কাজ পাই। খুব ব্যস্ত জীবন।
কিন্তু ঐ যে শব্দের ভার, কথার ভার যা সারাদিন চাপা দিয়ে কাজ করে যাই, তারা রাতের বেলা জাঁকিয়ে বসে ফিস ফিস করে- ‘কি হে, কিছু লিখছো না যে!’
-আরে না, কি লিখবো! লেখা টেখা হবে না আমাকে দিয়ে। তাছাড়া সময় কই?’
শব্দকে ভোঁতা শব্দ দিয়ে ঠান্ডা মেরে বসিয়ে রাখি।
কিন্তু ভেতরের ওই আপাত নিস্তরঙ্গ স্রোতে প্রতিদিন ঢেউ বাড়তে থাকে।
বাস করি মন্ট্রিয়াল শহরে, দিনের বেলায় ফরাসী, ইংরেজী এসব ভাষায় কাজকর্ম সারি। কিন্তু বাড়ি ফিরলেই বাংলা শব্দমালা একটা শতভূজা অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আবিস্কার করি যে, মনে মনে প্রতিদিন দেশে ফিরে যাচ্ছি, নিজের শৈশব কৈশোরে ফিরে যাচ্ছি।
তখন ২০০৫, এমনি একদিনে, অফিসে নিজের ডেস্কে বসে কিছু সায়েন্টিফিক পেপার রিভিউ করছিলাম, হঠাৎ ইচ্ছেটা এত প্রবল হলো যে আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত দ্রুত বইপত্র ঠেলে প্রিন্টার থেকে কিছু সাদা কাগজ নিয়ে লিখতে বসে গেলাম, বাংলায়। একটি গল্প লেখা হলো, নাম- কমলা।
মন্ট্রিয়ালের বা ক্যানাডা, ইংল্যান্ডের গল্প নয়। পুরোই আমার ছেড়ে আসা মফস্বলের শহরের পটভুমি।
এই গল্প লেখার আগে প্রায় দশ বছর কেটে গেছে, এক বসায় এমন করে কোন লেখা লিখিনি।
বেশ একটা ঝাঁকি লেগেছিল সেদিন, মনে আছে।
চুলোয় যাক চাকুরী, গবেষণার পড়ালেখা। আমি বাংলায় লিখছি! নিজের লেখা লিখছি!
বন্ধুদের আড্ডায় ‘কমলা’ পড়ে শোনালাম। বিলেত থেকে প্রকাশিত ‘সুরমা’ পত্রিকা গল্পটি এক চমৎকার ইলাস্ট্রেশন এর সঙ্গে পুরো পাতা জুড়ে ছাপলো। মাঝখানের রাইটার্স ব্লক ভুলে উত্তেজনা আর আনন্দ দুইই ফিরে এলো আবার।
এর বছরখানেকের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। খুলে গেল অন্যরকম যোগাযোগের এক জগৎ। এখন আর চিঠির খামে লেখা পোস্ট করতে হয় না।
চেনা জানা সাহিত্যের পরিধির মানুষের সঙ্গে, সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকলাম। আমার নামের সঙ্গে পরিচিত কেউ কেউ আবারো লিখতে অনুরোধ করেন, লেখা চান। সেসব লেখা লিখে উঠতে পারলে এক অনির্বচনীয় ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে। দেখলাম, শৈশবে যে অব্যক্ত শব্দস্রোত গ্রাস করেছিল, তাদেরকে সামান্য অবয়ব দেয়ার কাজটা খুব ভালোবাসি। নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবি, শৈলী এবং আঙ্গিক নিয়ে ভাবি, লেখা এডিট করতে সময় নিই। তারপরও নিয়মিত লেখা হয়।
মানুষ আসলে নিজের অভিজ্ঞতা লেখে। সে অভিজ্ঞতা একেবারে সরাসরি, সরেজমিনে হতে হবে এমন কোন শর্ত নেই।
আমি লেখি দেশের সঙ্গে আমার সংযোগের কথা, যে সংযোগ মানচিত্র পেরিয়ে কোথাও খোয়া গেছে বলে আপাতভাবে মনে হলেও তা খুঁজে বেড়ানোর আখ্যানও আছে সেখানে।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন