preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
প্রতিকৃতি
গল্প

প্রতিকৃতি

সত্যিই কী এমন কিছু ঘটতে পারে, যেখানে, হিংসার লেলিহান শিখা শিল্পকর্মকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেবে? হিংসার এতই স্পর্ধা? মন কিছুতেই মানতে চাইছিল না এ-কথা। সৃষ্টির কাছে বিনাশ পরাস্ত হবেই। বেঁচে থাকবে অসংখ্য সরোজার সৃজন।

আমার অনুভবে বিষণ্ণতা

নীলের ছোঁয়া

আমি বারান্দায় গিয়ে নিরুত্তাপ আঙুল আঁকি—

নীরব রাতের মসৃন খোলসটিতে।

দেখি, সম্পর্কের বাতিগুলো নিভে অন্ধকার

আমাদের জুড়ে রাখার সব গলিপথ— অবরুদ্ধ।

আমাকে সূর্যের সাথে কেউ আলাপ করাবে না

নিয়ে যাবে না কেউ— যূথচারী পাখিদের আসরে

মনে গেঁথে রেখো উড়াল,

ওটা একটি নশ্বর পাখি।

[—‘পাখিটা মরেও যেতে পারে’, ফরফ ফারুকজাদ]

মে মাসের তীব্র গরম কাটিয়ে, জুনের মাঝামাঝি এক ছুটির দিনে, আকাশ কালো করে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমি একটি অনলাইন আর্ট গ্যালারির পেজের পর পেজ দেখছিলাম। আমার ঘরের ফাঁকা দেওয়ালটায় একটা যুতসই পেইন্টিং রাখতে চেয়েছিলাম। দেওয়ালটা, যেন, দিনকে-দিন আমার একাকীত্বের পরিপূরক হয়ে উঠছিল। প্রতিটি ছবি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে একটি ছবির ওপর মাউস পয়েন্টার থামিয়েছিলাম। একটি মেয়ের পোর্ট্রেট— তুলির টান আর রঙের ব্যবহার আমাকে মোহিত করে ফেলেছিল, মুহূর্তেই।

ছবির নিচে দেখলাম লেখা রয়েছে, মিডিয়াম-ডেনসিটি ফাইবার বোর্ডের উপর অয়েল পেইন্টিং। বুঝলাম, শিল্পী একজন পরিবেশ-সচেতন মানুষ। ছবির নারীর মুখটি একজন মণিপুরীর, সে কোন জাতিগোষ্ঠীর সেটা বোঝার জ্ঞান আমার নেই। জানার ইচ্ছেও ছিল না। মুখে অদ্ভুত স্নিগ্ধতার ছোঁয়া, প্রশান্তিমাখা হালকা বাদামি চোখের তারা, কালো চুল পিঠের পিছনে অদৃশ্য। অবাক করেছিল তার পরনের পোশাকটি, আমাদের বাঙালি মেয়েদেরকে এ-রকম পোশাক পরতে দেখিনি কখনও। স্থান, ভাষা, খাদ্যাভ্যাসের নানারূপতার পাশাপাশি পোশাক দিয়েও কোনও অঞ্চলের বা দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাস পাঠ করা যায় বলে মনে হয় আমার। ইন্টারনেট খুঁজে জানলাম, ছবির নারীটির পরিধানের নিচের বস্ত্রটি থাম্বানলৈখোক— গোলাপি আর কালোতে অনুভূমিক ডোরাকাটা। এটা এক বিশেষ ধরনের ফানেক। থাম্বান-এর অর্থ পদ্ম। ওদের দেশে বিয়েতে বরের বাড়ি থেকে কনেকে থাম্বানলৈখোক দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। আর যে ইনাফি (অর্থাৎ ওড়না) গায়ে জড়িয়েছে সেটি হল চারাংমাশা— সাদা রঙের জমিনে কমলা পাড় বসানো। এবং ব্লাউজের মতন পোশাকটি হল ফুরিত। মেয়েটির মুখ সামান্য ডান দিকে ঘোরানো আছে, কয়েকটি চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে— যেন বাতাসে উড়ছে। দুই ঠোঁটের মাঝে হালকা ফাঁক। চোখের দৃষ্টি সরাসরি আমার দিকে না হলেও, মনে হচ্ছে যেন সে বুঝেছে আমি তাকে খুঁটিয়ে দেখছি!

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

আমি আর অপেক্ষা না করে, ছবিটি আমার নাম-ঠিকানায় অর্ডার করে দিয়েছিলাম, এবং দেখলাম ডেলিভারি দিতে সাত থেকে দশ দিন সময় লাগবে। ভিতরে উত্তেজনা থাকলেও, আমি ওই ক’টা দিন ও রাতকে নিঃশব্দে চলে যেতে দিলাম, অপেক্ষা করতে-করতে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সুদূর ইম্ফল থেকে ছবিটি আমার কাছে আসবে। যা-ই হোক, প্রায় দু’সপ্তাহ পর একটি ছেলে এসে সুন্দর প্যাকিং করা বোর্ড-বাক্স’তে ছবিটি দিয়ে গিয়েছিল। বাক্সটার ভিতরে রূপসী সে-নারীর পেইন্টিং অপেক্ষা করছিল আমার দেওয়ালের শোভা বাড়াতে। সাবধানে আমি প্যাকিংটা খুলে দেখলাম, বিলের সঙ্গে একটি পোস্টকার্ড রয়েছে। তাতে ছোট করে ইংরেজিতে হাতে লেখা কয়েকটি বাক্য, আর নিচে শিল্পীর নাম-ঠিকানা। সরোজা লাইশরম, ইম্ফল ইস্ট। সরোজা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন— ছবিটি নিয়ে অনলাইন আর্ট গ্যালারি’তে আমি যেন দু’-চার কথা লিখে, একটা রিভিউ দিই।

অফিস থেকে ফিরে, রাতে, বিছানায় আরাম করে শুয়ে ঘরের চার দিকে চোখ বুলিয়ে, ছবিটিকে মন দিয়ে দেখছিলাম। একজন অজানা নারীর লার্জার-দ্যান-লাইফ মাপের মুখ প্রায় গোটা দেওয়াল জুড়ে। পরিকল্পনা করেছিলাম, ছবিটির উপর একটা ছোট স্পটলাইট লাগিয়ে রাখব, যাতে, ঘর অন্ধকার থাকলেও শুধুমাত্র মুখটা আলোকিত থাকে। এই নারীর সৌন্দর্যে আঁধার মানায় না! ছবিটি ভার্নিশ করার কারণে দিনের বেলা জানালা দিয়ে কুসুম-আলো এসে পড়লে, দৃষ্টিকোণের পার্থক্যে অদ্ভুত আলোছায়ার খেলা চলে। লক্ষ করেছি, আমি ঘরের যেখান থেকেই মুখের দিকে তাকাই-না-কেন, মনে হয়, সে-ও আমাকে দেখছে। 

যত দিন গেছে, ছবির মেয়েটির উপর আমি আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। সময়-সুযোগ খুঁজে, গ্যালারির ওয়েবসাইটে আর্টিস্ট প্রোফাইল-এর নিচে, যতটা পারি, সুন্দর করে একটা রিভিউ লিখে দিলাম। পরে, লেখাটা আবার পড়তে গিয়ে লজ্জা পেয়েছিলাম— প্রায় একটা প্রেমপত্র লিখে ফেলেছিলাম যে! ডিলিট করতে গিয়েও করিনি। মনে হয়েছিল থাকুক, আমি তো কোনও আর্ট এক্সপার্ট বা আর্ট হিস্টোরিয়ান নই। সেদিনের পর থেকে ফেসবুক, ইন্‌সটাগ্রাম খোলার মতোই রোজ কাজের ফাঁকে একবার করে গ্যালারির সাইট খুলে দেখতাম— শিল্পী কোনও উত্তর দিলেন কি না দেখতে। প্রায় পাঁচ-সাত দিন পর দেখতে পেলাম আমার রিভিউয়ের নিচে একটা ছোট রিপ্লাই এসেছে। মুহূর্তেই মনে মনে যে কী আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারব না! সরোজা লাইশরম লিখেছিলেন— ‘আমার চিত্রকর্ম আপনি নিজের একেবারে কাছাকাছি রেখেছেন, জেনে, আমি খুশি হয়েছি। এত দূরের একজন ব্যক্তি আমার পেইন্টিং কিনে যত্ন করে নিজের বাড়িতে রাখবে, তা মণিপুরের এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে বাস করে কোনওদিন আশা করিনি। আপনি আমাকে সম্মানিত করেছেন, এবং আমার সৃষ্টিকে সমাদর দিয়েছেন। আন্তরিক ধন্যবাদ।’ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে ইচ্ছে করলেও, নিজেকে সংযত রেখেছিলাম। দু’দিন পর সংযমের সীমা ছাড়িয়ে গেলে, আমি প্রতুত্তরে জানতে চাইলাম— ‘আপনার ছবিতে আমি অত্যন্ত মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। যদি কোনও অসুবিধা না থাকে আমাকে বলবেন, এই ছবির মডেল কে ছিলেন? না কি, এটা আপনার সেল্ফ-পোর্ট্রেট, বা মস্তিষ্কপ্রসূত কোনও নারী?’ জানতে চেয়ে ভুল করে ফেলেছি, বার বার মনে হচ্ছিল। কী জানি উনি হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন! কিন্তু না, আমি সে দিন রাতেই উত্তর পেলাম, সরোজা জানিয়েছিলেন— ‘বলতে বাধা নেই, ছবির নারী আমি নিজেই। কখনও-সখনও নিজেকেও অন্যরকম দেখতে ইচ্ছে করে। প্রতিটি নারীর একটা বিশেষ রূপ থাকে, যেটা সহজে একজন পুরুষ বুঝতে পারে না। তখন নারী হয়ে ওঠে রহস্যময়। শুধুমাত্র একজন নারীই পারে নিজের বা অন্য কোনও মেয়ের মায়াবী সে-রূপ আঁকতে।’ সত্যি করেই ছবিটির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা আমাকে প্রতিনিয়ত টানে, অথচ আপাতদৃষ্টিতে ভীষণ সাধারণ। 

রাতের পর রাত চলে যায়। বিষণ্ণ দিনের ক্লান্তিতে, আমি একাকী, তাকিয়ে থাকতাম সরোজার মুখের দিকে। একসময় ঘুম এসে যেত, ভাবতে ভাবতে। ছবির মেয়েটির একটা নাম আছে, সে অস্তিত্বহীন একজন কাল্পনিক মানবী নয়। তাই কোনও উত্তর না পেলেও আমি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতাম। প্রলাপ যাকে বলে। কখনও আশা করতাম, সে-ও বুঝি এবার আমার কথায় সাড়া দেবে। ঠোঁটের দিকে তাকাতাম— এই বুঝি নড়ে উঠবে। সময় বয়ে যেত, তবুও তিনি নির্বাক থাকতেন। তবে চোখের ওই চাউনিতে, মনে হতো, আমার কথা শুনছেন তিনি, এবং চোখের ইশারায় উত্তর দিচ্ছেন, শুধু আমাকে তা পড়ে ফেলতে হবে। আমাকে ওই ইশারা ভাবাতো, ঘূর্ণিপাকের মতো। আমি নিজের মতো করে কিছু উত্তর সাজিয়ে নিতাম। তারপর আবার কথা শুরু করতাম। বেশ সময় কেটে যেত আমার।

সরোজার সঙ্গে কয়েক বার অনলাইন গ্যালারির মন্তব্য-জানালায় কথা বলেছি আমি। সবটাই চিত্রকলা সম্পর্কিত। বলেছি, আমি তাঁর অন্য আর একটি পেইন্টিং কিনতে চাই। শিল্পী ও শিল্পকর্মকে আমি আলাদা করতে পারছিলাম না, কিছুতেই। সরোজার ছবি আমার শোবার ঘরের দেওয়ালে রয়েছে, এবং তাঁকে আমি রোজ রাতে দেখি, সে অবলোকনে অবশ্যই কিছুটা অন্তরঙ্গতা ছিল। তবু, রক্তমাংসের সরোজা আমার কাছে অচেনা। গ্যালারির ওয়েবসাইটে তাঁর ছবি খুঁজে পাইনি। কেমন দেখতে তিনি? এই ছবির সঙ্গে বাস্তবের সরোজার কতখানি মিল? অমিলই বা কতটুকু? সত্যিই কি এই মিল-অমিল খোঁজার খুব দরকার আমার? মাঝেমধ্যেই দেখি সরোজা নতুন কী এঁকেছেন। সাধারণত প্রতি মাসে দুটি কি তিনটি নতুন ছবির বিজ্ঞাপন দেন। ছবিগুলো মন্দ না, কিন্তু আমার কাছে যেটা ছিল, সে’রকম মনোমুগ্ধকর আর একটি ছবি আমি দেখতে পাইনি।

মাঝে এক বছর কেটেছে। আমি ছবির সরোজার সঙ্গে আগের মতোই কথা বলি সময় পেলে। কিন্তু বাস্তবের সরোজার সঙ্গে কমেন্ট-বিনিময় আর হয়নি। কিন্তু এ-বছরে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে মণিপুরে। মৈতৈ ও কুকি জনজাতির মধ্যেকার দ্বন্দ্বে দেশ তোলপাড়। সংবাদমাধ্যমে অল্প-অল্প খবর পাচ্ছি। উত্তরপূর্বের রাজনীতি নিয়ে আমি খুব বেশি ওয়াকিফহাল নই।

একদিন সকালে, ছবিটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেছিলাম। এ-কার মুখ দেখছি আমি? আতঙ্কিত এক নারীর দিশাহীন দৃষ্টি যেন ফ্রেমের বাইরে তাঁর নিজের গ্রামের দিকে চেয়ে রয়েছে। তবে কী তিনি বুঝতে পারছেন আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় এগিয়ে আসছে তাঁর রাজ্যের ওপর? সম্ভবত, তাঁর চোখের ভাষায় এক মন্ত্রোচ্চারণ চলছে— যেন, তিনি জাদু করে এই বিপদের হাত থেকে নিজের কাছের মানুষদের, নিজের গ্রাম, নিজের মাটিকে রক্ষা করতে চাইছেন। 

সেই প্রথম, ফ্রেম সহ ছবিটিকে আমি সম্পূর্ণ অন্যভাবে আবিষ্কার করেছিলাম। এ পর্যন্ত, ফ্রেমটিকে ক্যানভাসের অলঙ্কার ভেবেছি। ছবিরই একটা বর্ধিত অংশ। ভুল ভেবেছিলাম। ফ্রেমটি কোনওভাবেই এই পোর্ট্রেটের অংশ নয়, এমনকি, আমার ঘরের দেওয়ালেরও না। ফ্রেমটি আমার চোখে একটা কনফাইনমেন্ট আর্কিটেকচার হয়ে উঠল, বা, অন্য ভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক বঞ্চনার একটা পরিখা। অর্থাৎ, ওই মুহূর্তে, মেয়েটির মুখের (সরোজার হলেও, আমি চাইনি মুখটার একটা নামকরণ করে বিষয়বস্তুকে একরৈখিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলতে) চাইতেও বাইরে যা ঘটে চলেছিল, সে-সব হয়ে উঠেছিল ছবির মূল বক্তব্য। ব্যক্তিগত ট্র‍্যাজেডি’কে সরিয়ে মুখটাকে একটা জনজাতির সুখ-দুঃখ, লোককথা, ইতিহাস মনে হচ্ছিল। ব্যক্তিগত ও রাজনীতি— এই দুটি বিষয়ের সংযুক্তিতে, ছবিটির নিজস্ব ডিসকোর্স পরিণত হয়েছিল গোষ্ঠীর ডিসকোর্স-এ। তাই মুখটা হয়ে উঠেছিল একাধিক মানুষের প্রতিভূ— যারা ‘দ্য সাফারিং স্পেকটেটর্‌স অফ ইন্ডিয়া...’। 

তবুও, বার বার, আমার সরোজার কথা মনে পড়ছিল, ইস্ কেন যে আমি তার ইমেইল আইডি বা মোবাইল নম্বর চেয়ে রাখিনি! সময় নষ্ট না-করে, গ্যালারির ওয়েবসাইটের মন্তব্য-জানালায় একটা ছোট নোট লিখে রাখলাম— ‘সরোজা, আপনি নিরাপদে আছেন তো? আপনার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।’ সেদিন রাতেই উত্তর পেয়েছিলাম। তিনি গ্রাম ছেড়েছেন। নিজের ঘর, আঁকার সরঞ্জাম, অসমাপ্ত পেইন্টিং ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তবে কোথায় আছেন, সেটা জানাননি। তিনি এ-ও জানেন না, ফিরে আসার পর সবকিছু ফিরে পাবেন কিনা! আদৌ কী তিনি নিজে অক্ষত ফিরতে পারবেন, দৈহিক আর মানসিকভাবে? যদি মৃত্য ঘটে তাঁর, মরার ঠিক আগের মুহূর্তে অতীত-সুখস্মৃতির একটুকরো ইমেজ চোখে ধরা দেবে, নাকি কোনও মূর্তিমান বিভীষিকার মুখ?

এই সঙ্কটকালে, আমি কীভাবে পাশে দাঁড়াতে পারি সরোজার? আবারও মন্তব্য-জানালায় মেসেজ ছাড়লাম। উত্তর আসেনি। জানতে পারলাম মণিপুরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। সত্যিই কী এমন কিছু ঘটতে পারে, যেখানে, হিংসার লেলিহান শিখা শিল্পকর্মকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেবে? হিংসার এতই স্পর্ধা? মন কিছুতেই মানতে চাইছিল না এ-কথা। সৃষ্টির কাছে বিনাশ পরাস্ত হবেই। বেঁচে থাকবে অসংখ্য সরোজার সৃজন। সেদিনের পর থেকে আশি দিনের ওপর হয়ে গেল, সরোজার বার্তা পাইনি। খবর আসছে, মণিপুরে আগুন জ্বলছে। কত মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। চলছে রাজনৈতিক চাপান-ওতোর। শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, একেবারে। এর মধ্যেই ভাইরাল হল ধর্ষণজনিত ঘৃণ্য ঘটনার একটি ভিডিয়ো। হায়! এ লজ্জা কোথায় লুকোব আমরা?

দেওয়ালের রঙতুলির সরোজার দিকে তাকাই, আমার জাগ্রত চেতনা বুঝিয়ে দেয়— এই নারীকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। ওই দুটি চোখ নির্ভীক, চোয়ালে দৃঢ় প্রত্যয়। তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমি ভালোবেসেছি কাকে— এই ছবির সরোজাকে, নাকি রক্তমাংসের শিল্পী সরোজাকে? 

প্রতিদিনের খবরের কাগজ, টিভি, ফেসবুক, ইউটিউব— কিছুই বাদ রাখিনি মণিপুরের খবর জানতে। আমি নিজেকে সরোজার জায়গায় বসিয়ে ভয়টাকে অনুভব করার চেষ্টা করছি। মণিপুরের রক্তমাংসের সরোজাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে গ্রাস করছে একটু একটু করে। যদিও সরোজা আমার ঘরে আছেন, আমি চাইলেই কথা বলতে পারি ওঁর সঙ্গে। কোনটা বাস্তব, কেন এমন হয়? কী নিয়ে থাকব আমি— স্মৃতি নাকি এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্তমান? ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত, কতভাবেই না এর যাপন করতে পারি আমরা! ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয়, সরোজা আমার কাছে নিরাপদে রয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে আমি কী করতে পারছি তাঁর জন্যে?

হিংসা দীর্ঘদিন চলতে পারে না, অনেক কিছু হারালেও শান্তি ফিরবে একদিন। হয়তো ছবির সরোজার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষ সরোজার দেখা হয়ে যাবে, আবার। তখন আর ভুল করব না, অন্তত, বন্ধুত্বের খাতিরে, আমার ঘরের ঠিকানা ওঁকে দেব— যে-ঠিকানায় শান্তি ও নিরাপদে জন্ম নেবে সরোজার শিল্পসৃষ্টিরা।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

Image Description

শাশ্বতী লাহিড়ী

1 মাস আগে

লেখকের ব্যক্তি - চিন্তার গাঢ়তর আলোয় এই সৃজন, সুন্দর ও সুখপাঠ্য যা সমাজের অনেক মানুষের চিন্তা - চেতনার সঙ্গে মিলেমিশে যায়। আরও লেখা পাবার আশা রইলো। শুভেচ্ছা।

মন্তব্য করুন

লেখক

শুভ রায়চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত শহর বনগাঁ-য়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলচ্চিত্রবিদ্যায় মাস্টার্স। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘আমার সেপ্টেম্বরের দিনগুলি ও অন্যান্য গল্প’ (২০২২)।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন