preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
ড্রিম হান্টার
গল্প

ড্রিম হান্টার

...ঘরের পশ্চিম দিকের আয়নাটাই তার রোজকার সঙ্গী। রাত যত বাড়ে রূপসার জৌলুস বেড়ে যায়। আরশিনগরে রূপসা তখন কথার পর কথা মালা গাঁথতে থাকে। একটা নদী, একটা সমুদ্র আর গঙ্গার ঘাট। এই তার সম্পত্তি।

স্বপ্নটা আমি দেখছি, না স্বপ্নটাই আমাকে দেখছিল। বুঝতে পারছিলাম না। শুধুমাত্র একদিন-দু’দিন নয়। রোজ রোজ দেখছে; আর আমি বোকার মত শুধু স্থির হয়ে আছি। শরীর, মন আমার সঙ্গে আছে কিন্তু মাথা কিছুতেই আমার আয়ত্তে নেই। কী ভাবছি, কেন ভাবছি। কী করছি, কেনই বা করছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। অনেকক্ষণ ধরে হয়ত রাস্তা মাপছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না কোনদিকে যাব বা যাওয়া যায়। সব রাস্তাই সমান। হুশ হুশ গাড়ি চলছে, সঙ্গে হর্ণ। যা শুনলে পিলে চমকে যায়। কয়েকদিনের কাঁচা পাকা দাড়ি নিয়ে ভাবছি সিসিডিতে গিয়ে এক কাপ ক্যাপুচিনো অর্ডার দিয়ে ফেলি। সম্ভবত সেটাও একটা বহুদিন আগের দেখা স্বপ্ন। মোদ্দা কথা, আমি আমার স্বপ্নের ভেতর হাঁটছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। এরকমও লাইফ হতে পারে।

আজকাল আর পার্স নিয়ে ঘুরি না। পকেটে একটা সোনার কয়েন আছে। তাতেই চলে যায়। কিছু কিনতে গেলেই ভুলে যাই, কী কেনার ছিল। রেজার কিনতে গিয়ে বিস্কিট কিনে ফেলি। আয়নায় যখন নিজেকে সুন্দর দেখি। বেশ অদ্ভুত লাগে। নিজেকে সুন্দর দেখাটাও বুঝি রোগ। কী সুন্দর চোখ, ঠোঁট, চওড়া চিবুক। থুতনিতে একটা তিল। আর শেভিং করা গাল। নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যাই মাঝে মাঝে। অথচ আজ পর্যন্ত একটা প্রেমিকাও টিকল না। রঙিন স্বপ্ন সবাই দেখল, দেখাল এক এক করে। আমার তবু টনক নড়ল না। যে কে সেই। একদিন ঘরে থাকি তো দশদিনই বাইরে। গুলিয়ে ফেলি সবকিছুই। কেমন একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাব। দুধ-ওয়ালা, পেপার-ওয়ালা জানলার ওপার থেকে হাঁক দিলেই ঘুম ভেঙে যায়। জানলার কাচ ভেঙ্গে যে দু-একটুকরো আলো এসে পড়ে মেঝেতে তার সঙ্গে একচোট ঝগড়া করে ফেলি সাত সকালেই। একটা আধ খাওয়া বিস্কিটের মতো বিছানা ছেড়ে উঠি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। তারপর আর কী— ওই জল তোলা, চা বানানো, নিউজপেপারের কড়কড়ে ভাঁজ খুলে গরম চায়ে চুমুক; নিপাট একটা দিনের শুরু। যেখানে কোনও সমস্যা নেই। শুধু উলটো-পালটা স্বপ্ন ছাড়া।

সেদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই গুজরাট চলে গিয়েছি। পকেটে খুচরোর টানাটানি। হিসেব করে চললে ওই দশ- বারোদিন। তার মধ্যেই যদি এই দুম করে এক অন্য জায়গায় চলে যায় কেউ, কেমন দেখায় একটা। তার চেয়ে বড়ো কথা ঘোরার জন্যে ল্যাভিস ড্রেস চাই তো, আর পকেটে টাকা। মোট কথা তবুও দেখতে শুনতে ভালো হোটেলেই ঘর পেয়েছি। সকাল সকাল ঘুরতে বেড়িয়ে মরুভূমির আশপাশ বেশ ভালোই লাগল। তারমধ্যেই খবর পেলাম হোটেলে হামলা হয়েছে। বেশ ভয়ের ব্যপার। কিন্তু কোথায় কী। ভয়ডরের বালাই নেই একটুও। দিব্যি হাজির ওই গুলি ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যেই। একজনের কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে শুরু করেছি গুলি চালানো। অনেকক্ষণ যুদ্ধ চলার পর। শুনতে পেলাম কে যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে, ওমা! দেখি কী কাণ্ড। দুধওয়ালা তিন-চার বারের বেশি আমাকে এসে ডেকে গেছে। হাঁক শুনতে না পেয়ে সে দরজায় দুমদাম কিল দিতে শুরু করেছে। আর তাতেই আমার স্বপ্নের ভেতর ঝড় শুরু হয়েছে। বিছানাতেই পড়ে আছি। কোথায় ভাবলাম একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে রাজস্থানের বিখ্যাত নাচ দেখতে যাব। তা না বেজার মুখ করে দরজা খুলতে চলে গেলাম।

 

দিনের বেলা চরকি পাক খেতে খেতে এ রাস্তা, ও রাস্তা ঘুরে যখন হাঁপিয়ে উঠি; চৌরাস্তার মোড়টায় এক গরম জিলিপির দোকানে পা ছড়িয়ে বসতে কী যে আরাম লাগে। এ এক রোজকার রুটিন। তারপর শ-পাঁচেক জিলিপি কিনে রাস্তার ছেলে-মেয়েদের ভাগ করে দেওয়া। সেও বেশ আনন্দের। স্বপ্নের দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছে তার মতো। গভীরভাবে দেখতে গেলে এই স্বপ্নগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে নিশ্বাসের মতো। যদি আদিম কোনও মানুষ হতাম। এই মুহূর্তে কি করতাম। বড়জোড় গাছের পাতা জড়িয়ে হাতে কুঠার নিয়ে শিকারে বেড়োতাম। শুধুমাত্র খাওয়ার যোগাড় করা ছাড়া আর কিই বা কাজ থাকত তখন। এখনও তাই করছি খাওয়ার জন্যে লড়াই।

তবে হ্যাঁ এই যে বিকেলবেলার ঠেক তার সঙ্গে চা আড্ডা। এ সব থাকত না। কেমন মুষড়ে থাকি বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে। ওরা বলে আমার মধ্যে সেন্স নেই কোনও। আমি হাসতে জানি না। তাই বলে যে চুপচাপ থাকি তার ফায়দা তাঁরা কখনও তোলে না তা নয়। কে কী বলল তাতে কিছু যায় আসেনা আমার। আমি দিন আনি, দিন খাই— স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নের ভেতর ডুবে থাকি। কারো কিছু বলার নেই।

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

সেদিন হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গেছি। রেললাইন, বাস-ট্রাম ডিপো ধরে গঙ্গার ধারে। তারও দূর। ফোনের সিগনালও পৌঁছয় না সেখানে। দেখছি একটা মস্ত কারখানা। জং-ধরা লোহার পাত। পুরনো হয়ে যাওয়া গেট। তার চেয়েও পুরনো দেওয়াল। দেওয়ালগুলো যেন কথা বলে উঠবে। সেই অলস দুপুরের ঝগড়া, অন্যের ঘরের কুটকাচালি। হঠাৎ হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। তার মধ্যে গরম। লঞ্চের আওয়াজ, লোকজনের চেঁচামেচি। বেশিরভাগই ধুতি-ফতুয়া পরা। হাতে চটের ব্যাগ। খাবার থলে বোধহয়। কেমন ভাবলেশহীন হাঁটছে। যেন বহুযুগ ধরে হেঁটেই চলছে। আমার সামনেই একটা বটগাছ তার ঝুড়ি মেলে আছে। ফেরার কোনও তাড়া নেই বলে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। কোথাও একটা যাওয়ার ছিল, কিন্তু কেন যে যেতে ইচ্ছে করছে না। জানি না। বসে বসে ভেবেই চলেছি। এমন সময় একটা লোক এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ভায়া, এখানে বসে কেন? কারখানার সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে’। ও, হ্যাঁ তাই তো। ঘড়ি দেখতে যাব। এমন সময় দেখি হাত আটকে আছে কোথাও। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। লোডশেডিং। ঘড়িতে আটটা বাজে।

রোজগারের কথা ছেড়ে দিলাম। অ্যাকাউন্টিংয়ের কাজ করি। মাসিক বেতন ছ’হাজার টাকা। আপাতত সেটাও বন্ধ। কলকাতায় এই টাকায় ভদ্রভাবে থাকা যায় না। একদিক জোটে তো আর একদিক খালি হয়ে যায়। তাই মাসে তিন হাজার ভাড়ায় এই ঘরে এসে থাকা। একদিকে পচা খালের বয়ে যাওয়া। আর এই খাটালের গন্ধ, এক দুর্বিষহ অবস্থা। সূর্যের আলো এসে পড়লেও হাওয়ায় বিষাক্ত গন্ধে টেকা দায়। তবু আছি। শতচ্ছিন্ন হয়ে আছি। বেঁচে থাকার জন্যে আছি। সকাল দশটায় বেড়িয়ে সাতটায় ঢোকা। তারপর ঘুম আর স্বপ্ন তো আছে…

এই যেমন বাসে চেপে এখন যাচ্ছি কোথাও একটা। অফিস ফাঁকি দিয়ে। বেশ লাগছে। আচ্ছা, বাসের জানলার ধারের সিটটা সবার এত প্রিয় কেন? অবশ্যই আমারও। তার জন্যে আজ ঝগড়া পর্যন্ত করেছি। সে যাক গে। নিজের ভেতর ডুবে যেতে অনেক বেশি ভালো লাগে আজকাল। আমার মতো একলা থাকা মানুষের জন্য এ তো বিলাসিতাই বলতে হয়… যে সবসময় পকেটে সোনার কয়েন নিয়ে ঘোরে। আর দীর্ঘবিরতি খোঁজে। অনেকদিন ধরেই ভাবছি বন্ধু নীলকে একটা চিঠি লিখব। তা আর হয়ে উঠছিল না। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। সেদিন দুপুরে সাদা পাতা নিয়ে বসেও গেলাম লিখতে।

 

প্রিয় নীল,

হয়তো সামনে অনেক পথ বাকি আছে। তবুও তুমি এখন সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করছ। দু-মুঠো চাল, একটা আলু সেদ্ধ তোমার অন্ন সংস্থানের জোগাড়ে উঠে পড়ে লেগেছে। কষ্টে আছ। কিন্তু ভেবে নাও, এসব তোমার নিজস্বী। কানের কাছে শতেক আওয়াজ। কুমন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে নানাবিধ লোভ। ঝাঁ চকচকে গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, দামী মোবাইল ইশারায় ডাকছে। অথচ, তুমি একটা চৌখুপী ঘরে জপ করছ— ভালো থাকার মন্ত্র। আসলেই কি ভালো থাকার মন্ত্র আছে কোনও। অস্থির হয়ে উঠছ কখনও। তবুও অসীম ধৈর্য্য আবার তোমায় শান্ত করে তুলছে। আসলে, তুমি জানো, যত বন্ধু সংখ্যা কমবে— নিজের সঙ্গে কথা বলার চাহিদা বেড়ে যাবে। তুমি দিন-রাত দেওয়ালের কান্নার আওয়াজে চমকে উঠবে। কখনও বা বুঝতে চাইবে জানলার ওপাড়ের পৃথিবীর রোমহর্ষক জীবনযাপন। সবকিছু ভুলে যখন ঘুমের স্তরে নিজেকে তুলে আনবে, দেখবে কত মানুষ কত আপনজন তোমায় আগলে রাখছে। তুমি বুঝবে ঘুমের জগৎটাই আসল। যেভাবে জীবনের চেয়ে মৃত্যু সত্য। ঠিক সেভাবে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে একটার পর একটা স্তর কাটিয়ে। এভাবে আমিও সুতোয় গিঁট বাঁধতে বাঁধতে একদিন পেরিয়ে যাব অপেক্ষার দূরত্বটা। ভালো থাকার মতো একটা অগোছালো সময়কে দূর থেকে মেপে নিয়ে তুমি বিবাগী হও। এভাবে কয়েক’শ আলোকবর্ষ পেরিয়ে কথার মত দামী হও। এখনও তোমার চোখে চাতালের আড্ডা। আমি শেকড় সমেত স্মৃতিগুলো নির্মূল করে দিতে চাইলেও, পারিনি। ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যে দিয়েই ট্রেনলাইনে ডাউন ট্রেনের পাস হয়ে যাওয়া। তোমার কাঁধে তখন ব্যাগ, ঘেমে নেয়ে একসা। পেটের ভেতর বোতলটা চালান করে একঘুম দিয়ে ওঠা পাগলটাও কেবল হারিয়ে যায়। স্টেশন খোঁজে এক বিদঘুটে নামের। বংশপরম্পরায় তো কেউ পাগল হয়ে আসেনি। এখানে ডারউইনের তথ্যও খালাস পেয়েছে। বাধ্য ছাত্রের মতো ট্রেনে চেপে যাও, মুখোমুখি বিষণ্ণতাকে নিয়ে। আমার এবার ছুটি নেবার পালা। একটার পর একটা অফিস ডিউটি কামাই করি, উৎসবে মুখ ডুবিয়ে রাখি ভিন্ন মরসুমে। তারপর গালে হাত দিয়ে জানলা মাপি। আমার মুখে ফুটে ওঠা চিন্তার কোলাজ মুছে নিই সাদা রুমালে। তোমার ট্রেন ততক্ষণে কু-ঝিক-ঝিক।

যাই হোক, অনেকক্ষণ জ্ঞান দেওয়া হল তোমাকে। বয়সে অনেকখানি ছোটো হলেও বিশেষ কারণেই বন্ধু হয়ে উঠেছিলে। চলে যাওয়ার পর অনেকদিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ। সে যাক গে। এবার যদি দেখা হয়। অনেক কথা বলব।

ইতি তোমার বিশেষ বন্ধু

 

কোথাও যেন একটা পড়েছিলাম...

“দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে,

দেওয়ালও ঘুরে দাঁড়ায়”। 

কিন্তু মনে পড়ছে না কেন জানি না। আজকাল এমন হয়েছে। অনেক কিছুই ভুলে যাই। সেদিন কে যেন বেশ বলল— মাথা থেকে বাড়তি কিছু জিনিস ছাঁটাই করো, নাহলে মনে রাখার সমস্যা দেখা দেবে। আমিও তাই বিশেষ কিছু আর মনে রাখার চেষ্টা করি না। একটু আগেকার জিনিষ কয়েক মুহুর্তেই ভুলে যাই। আসলেই যে তা ভুলে যাই তাও নয়। মনে পড়ে না। অনেক চেষ্টার পর নাম মনে পড়লে, নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়ি।

সবসময় মনে হয়েছে, এক বিশাল শূন্যতার ভেতর একটা লম্বা রেখা ধরে হাঁটছি। আমার ছায়া ক্রমশ আমাকে পেরিয়ে যেতে যেতে অনেক দূর। ধূ ধূ প্রান্তরে একটা মাত্র ক্যাকটাসের গাছ। আর বহুদূরে এক দিগন্ত বিস্তৃত আয়না। যার মধ্যে নিজের ঝকঝকে শরীর। নিজেকে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তবুও চোখ মেলে দেখছি। এক অনুচ্চারিত শব্দের খোঁজে সামনে তাকালেও, সেই শব্দের উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। আমি কেবল দৌড়চ্ছি। দৌড়তে দৌড়তে একসময় হা-ভাতের মতো হাত তুলে অনির্দিষ্টের দিকে চেয়ে বলছি— জল—একটু জল।

মুহুর্তেই চোখ খুলে গেছে। জানলা দিয়ে  চড়া রোদ তখন আমার গালে, মুখে হাত বোলাচ্ছে। দীর্ঘ একটা রাতের জার্নি শেষে পরিশ্রান্তের মতো পাশের টেবিল থেকে জলের বোতল তুলে, এক নিমেষেই শেষ করে দিয়ে ভাবছি। আজ একটু বেশি গভীর হয়ে গেছে। স্বপ্নের রেশ তখনও চোখে লেগে। যেন এই মাত্র সুরা পান করে এলাম। চুল এলোমেলো, গালে হাত বুলিয়ে দেখি খোঁচা খোঁচা দাড়ি বেশ চুলকোচ্ছে। চোখ আধবোজা করে আয়নার দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম। হাতড়ে হাতড়ে বেশ খানিকটা এগোতেই চেয়ারে পা জড়িয়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো কাল রাতে মজলিশ বসেছিল গানের। রৌনক, রিয়া, সোহম, আরও বেশ কয়েকজন এসে হই-হুল্লোড় করে গেছে। যে যেখানে যা পেরেছে ছড়িয়ে গেছে। চেয়ার সরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই দেখলাম আস্ত একটা সুড়ঙ্গ আয়নার ভেতর। বলেছিলাম যে আমি স্বপ্নকে দেখিনা, স্বপ্নই আমাকে দ্যাখে। আমি খানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করলাম, না পেরে সটান ঘুরে আবার পা চালিয়ে দিলাম বিছানার দিকে। ঘড়িতে সবে আট-টা। অফিসের অনেক দেরী আছে।

 

 ‘আমার বিস্ময় পৃথিবীকে ঋতুমতি করেছে

মন্ত্রমুগ্ধ জামা খুলে নিয়েছে ঐশ্বরিক মিথ’।

এক ভোরবেলা স্বপ্ন দেখে আতঙ্কে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ, হাতে-পায়ে জোর নেই। মাথা ঝিমঝিম করছে। সেদিনের সেই স্বপ্নটা ভুলতে পারিনি কখনও। ট্রেন একটা টানেলের ভেতর যেতে যেতে অন্ধকার ভেদ করে পৌঁছে গেছে গোলাপী শহরের স্টেশনে। লোকগুলোর মুখে এক অদ্ভুত ছায়া। আমি নেমে পড়লাম কাউকে কিছু না জানিয়ে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে শহরের এক প্রান্তে এক জনসভায় দেখতে পেলাম, সাদা পাঞ্জাবী বক্তৃতা দিচ্ছে। যারা শুনছে, তাঁদের প্রত্যেকের হাতে অ্যান্ড্রয়েড। সেদিকেই তাঁদের মনোযোগ। কেউ আর কথা শুনছে না কিছু। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। এই বুঝি তেড়ে উঠবে। হঠাৎ সেখানে ধুলোর ঝড় উঠল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুম্‌। আমার এক হাত দূরে একটা মানুষ কাতরাতে কাতরাতে পড়ে গেলো। তারপর আরও একজন। আমি উলটো দিকে ঘুরে পালাতে যাব, দেখি কেউ আমার পা টেনে ধরেছে। আমার পালিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি নেই। মনে হচ্ছিল, ধুলোর ঝড়টা এবার আমায় গ্রাস করবে। একসময় দেখলাম, একটা জমাট অন্ধকার আমার বুকের ওপর নেমে আসছে। ছোঁ মেরে তুলে নেবার আগে পর্যন্ত আমি হাত দিয়ে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

তখনই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। আসলে কী, সেদিনই প্রথম ভয় পেলাম। ভয়ের কথা একমাত্র নীলকেই জানালাম। তাও আবার চিঠিতে। সে চিঠি কবে তার কাছে পৌঁছবে আমারও জানা নেই। তবু তার হুকুমে প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি আমাকে পাঠাতেই হবে। উত্তর আসুক বা না আসুক।

অফিস থেকে ফিরে দেখি নীলের চিঠি এসেছে। আর দেরী না করে ওভাবেই পড়তে বসলাম। লিখেছে যথারীতি কোনও সম্বোধন না করেই—

‘জীবনটা আসলেই পদ্মপাতায় জলের মতো টলমল করছে। তোমার ওখান থেকে আসবার পর অনেক ভেবেছি। আসলে জীবনটা কি। শুধুই ব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখা নাকি শান্তির খোঁজে বেড়িয়ে পড়া। একদিক দিয়ে ভালোই করেছি। এখানকার জৌলুসহীন জীবন। ইলেকট্রিক বিহীন ঘর। ফোন, ল্যাপটপ, টিভি সব ফেলে নিস্তরঙ্গ শান্ত জীবন। এক এক করে সব ধাপ পেরিয়ে এসেছি। এখন যেখানে আছি নিশ্বাসের বেশ কষ্ট হয়। তবু ভালো থাকা। তবে হ্যাঁ যা খুঁজছি তার সন্ধান না পেলেও। আশা করছি পেয়ে যাব। তোমাকে বারবার অনুরোধ করার পরও যখন এলে না আর কী বলি বলো। তুমি আর তোমার স্বপ্ন, এর বাইরে আর কী চিনলে। তবুও বলব বেড়িয়ে এসো ওই গর্ত থেকে। যেখানে সারাক্ষণ ঝগড়া, মারামারি লেগেই আছে। বাইরের কোলাহল ছেড়ে, নিজের ভেতর ডুব দিয়ে দেখ। কতটা গভীর তুমি। চামড়ার মলাট খুলে দেখে নাও রক্তের রং। তারপর না হয় বাছ-বিচার করো তুমি কে! বা কী হতে চাও। এক চিলতে নুন কিংবা চিনির মতো গলে যেতে যেতে কতদূর ভাবনায় মগ্ন হয়ে তুলে নিতে পার জীবন। তুমি চুম্বক হতে পার। কিম্বা একটা কাক। গরুর হাম্বা ডাকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হতে পার গরুও। না হলেও বা ক্ষতি নেই। তোমার চলা ফেরা, ঝগড়ার তালে তাল রেখে একটা আস্ত মরকট মানুষও তোমার নাম হতে পারে। সংবিধানিক যে কোনও নিয়মে তুমি খাপে খাপ মিলিয়ে হেঁটে যাও রেড রোড ধরে। তোমার প্রাসাদোপম বাড়ি নেই, নেই ঝাঁ চকচকে গাড়ি। পাশে সুন্দরী নারী বা পুরুষও তোমার স্বপ্ন থেকে বাদ গেছে। রাত্তির নামলে তুমি স্বপ্নের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে তুলে আনতে পার এক-একটা গুগলি।

তোমার জানা নেই আজ পর্যন্ত কটা বাজি জিতে বাড়ি ফিরেছ। লোকাল ট্রেনের কামরায় ঝাল-মুড়িওয়ালার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবে নাও এই তো জীবন। খেটে খাও। এর বেশি কী চাইতে পারি।

ওই বাজার করা-রান্না করা-অফিস যাওয়ার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে আর কতদিন। তোমার বাউন্ডুলে জীবনে আর কিইবা আছে।

ইতি নীল

 

গঙ্গার ধার খুব প্রিয় বলেই, মাঝে মাঝে অফিস কামাই করে চলে যাই প্রিন্সেপ ঘাট। আর গিয়ে বসি একেবারে সিঁড়ির শেষ ধাপে। ঘন্টার পর ঘন্টা। তারপর শুরু হয় পার্থিব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কৌশল। আমি সিঁড়ির ধাপ থেকেই গাছের ডাল তুলে নদীর বুকে ঘাই কাটি। নদীকে খোঁচা দিই। যাতে সে অতিষ্ঠ হয়ে দু-এক কথা বলে ওঠে। মাঝে মাঝে পথচলতি মানুষ এড়িয়ে স্বর্ণঝুড়িকে জিজ্ঞেস করে ফেলি আদেখলা প্রশ্ন। আমার কাছে এখন এরাই জীবিত। বন্ধুরাও টোকা দেয়, কী এত ভাবি। সবার মাঝখানে থেকেও আমার ডুবে থাকা তাঁদের চিন্তিত করে। আর আমি ততই দূরে-দূরে সরে যাই। সমাজ, সংসার থেকে সরে আসার শুরুটা অনেক আগে থেকেই। নীলের চিঠি আমাকে আবারও প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি ভাবতে পারিনা কি করব, কোথায় গিয়ে দাঁড়াব শেষ পর্যন্ত। রাত-দিন এক করেও উত্তর খুঁজে পাই না। নিজেকে অসহায় লাগে।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের চু-কিত-কিত খেলা দেখছিলাম। মাথার ওপর ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর নিয়েও বাচ্চাগুলো খেলে যাচ্ছে। গলির মোড়টায় আজও পাগলটা দাঁড়িয়েছে। হাতে একটা লাঠি আর কালো আলখাল্লা। সাক্ষাৎ যক্ষ। মনে হচ্ছে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে। যেন যুগ যুগ ধরে সে পাহাড়া দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর গলিপথ। আজ চুল দাড়ি কেটে নিজেকে ফ্রেশ লাগছে। অনেক দিন কফি হাউসে যাওয়া হয়নি। হিসেব লেখা আর ব্যাংকে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো কাজ নেই বলেই, তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। কফি হাউসে আজকে রৌনক আর সোহম আসবে। কিন্তু ঘরে ফিরেই নিজের ঘরটা এমন অচেনা লাগল। মুহুর্তেই ঘর থেকে বেড়িয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভেতর যেমন যা আছে তেমনি রইল। শার্ট অগোছালো, চুল এলোমেলো। হাঁটতে থাকলাম গলি থেকে বেড়িয়ে। কী যেন একটা নেই। কী যেন হারিয়েছি। শুধু বারবার এই প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়লাম দু-বার। এক ট্রাক ড্রাইভার গালাগালি করতে করতে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কখন যে ব্যস্ত রাস্তার মধ্যে এসে পড়েছি জানি না। বিরক্তি রাগ-আক্রোশ সব গিয়ে পড়ল নীলের ওপর। সে এভাবে কেন চলে গেলো। রোজকার এই নাটক আর কিছুতেই ভালো লাগছেনা। কত কথা জমে আছে। সে-সব তো তাকে ছাড়া বলা যায় না আর কাউকেই। রৌনক বলো আর সোহম এদের সঙ্গে যুক্তিতে কিছুতেই পারা যায় না। একমাত্র নীল ছাড়া আর কেই বা বুঝত তাকে। সবাই লবডঙ্কা বলে ডাকত আড়ালে। আরও নানা কথা কানে আসত মাঝে মাঝেই।

রামদার চায়ের দোকান পেড়িয়ে যাওয়ার পর হুঁশ ফিরল। ওই তো নীল, সোহম, অর্জুন দাঁড়িয়ে। দু-এক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তা ভেজা। আমিও কাকভেজা আর কী। বৃষ্টির ছাঁট ওপরের ত্রিপল ভেদ করে আমাদের সবাইকে ভিজিয়ে যাচ্ছে। ওদের হুঁশ নেই। ওরা এক ভাবে গল্প করে যাচ্ছে। আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সিগারেট নিভে যাওয়ার পর আর একবার ধরাতে গিয়ে নীলের চোখ পড়ল আমার দিকে। আধো অন্ধকারে রাস্তার আলোয় তার চোখ চকচকে আরও উজ্জ্বল লাগছে। ও কবে এলো। আর এলো যখন, আমাকে একবার জানাল না। আমি কী এতটাই পর হয়ে গেলাম। এসব ভাবতে ভাবতেই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর সে অদ্ভুত হেসে আমাকে পাত্তা না দিয়ে চুমুক দিল চায়ে। আমিও অবাক। খানিকটা বিভ্রান্ত। হাতে ধরা বইটা ভিজে চপচপ করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীল সামনে এসে আমাকে এক ধাক্কা। আর আমি ধড়ফড় করে উঠে বসেছি বিছানায়। ঘড়িতে সাতটা বাজে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। কফিহাউস যাব বলে আর রেডী না হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে কাদা হয়েছি— বুঝতেই পারিনি। অর্জুনকে ফোন করে দেখে নিলাম, কোথায় তারা। এখন কী আর যেতে পারব। রেডী হতেই তো অনেক সময় লেগে যাবে। সে যাক গে। আর যাওয়া হল না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

অনেকদিন নীলের কোনও খবর নেই। আমিও নিস্তেজ হয়ে পড়েছি গরমে। কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নেই। পারতপক্ষে ছেড়ে দিয়েছি কফি হাউস যাওয়া। রৌণক ফোন করতে করতে ক্লান্ত, তাই এখন আর করে না। আমার চোখে সারাক্ষণ ঘোর। কারও ফোন ধরি না। অফিস নাম মাত্র করি। চিঠি লেখা ছেড়ে দিয়েছি। কি হবে লিখে। উত্তরই যদি না আসে। তবু মাঝে মাঝে ভাবি, একটা গেম খেলব। বিভিন্ন ঠিকানায় চিঠি লিখব। অন্য অন্য নাম নিয়ে। যেই না ভাবা। অমনি লিখতে শুরু করলাম। ইয়ারবুক ঘেঁটে পছন্দসই নাম দেখে বসে গেলাম লিখতে। প্রথম নামটা স্বর্ণকমল। হ্যাঁ এই নামটা দেখেই কেমন ফুলের গন্ধ ভেসে এলো।

 

অচেনা স্বর্ণকমল,

পাতা ঝরে পড়ার মরসুম এখনও আসেনি। ঘাড়ের চুলে দীর্ঘনিশ্বাস। তুমি জানো আজ নীল শার্ট কথা রাখেনি। অজান্তে কতগুলো লিফলেট ফেলে গিয়েছিল তার নীরা। সে কলঙ্কিনী চাঁদের। তোমার আসলে করার কিছু ছিল না। ধোঁয়াটে চোখের আড়াল হলেই তুমি জানো দীর্ঘ শূন্যতা ঘাপটি মেরে বসে রাত জুড়ে। নীল শার্টের বোতামে আতকে থাকা সুগন্ধী সময় এক ফাঁকে কফি কাপের উষ্ণতায় মাখামাখি। জলের কোলাজে সাজানো ক্যাফিন চাঁদের দিকে চেয়েছিল চাতকের মতো। একটা ঠোঁটে হাসির ঝলক অনেকদিনের অপেক্ষায় হয়ে উঠেছিল অভিমানী।

নাম জানতে চেওনা। অচেনা আমি চিরদিন এরকম অচেনাই থাকব।

ইতি তোমার গতজন্মের প্রেমিক

 

বেশ কয়েক মাস হতে চলল নীলের কোনও খোঁজ নেই। কেমন যেন খটকা লাগছে, সব বিষয়েই। রোজই তো রৌনকদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কই, তারা তো কিছুই বলছে না। অবশ্য বলবারই বা কি আছে। আমাকে নিয়ে মজা করা ছাড়া, কী আর করতে পারে। আমিও তাই বেশিক্ষন তাঁদের সঙ্গ পছন্দ করিনা। বের হয়ে আসি চাতালের আড্ডা থেকে। কেমন একটা কান্না গুমড়ে মরে। ওরা আমার চুল কাটার স্টাইল, আমার হাঁটাচলা নিয়ে খোঁচা দেয়। আমি নীরবে সহ্য করি। নীল থাকলে দু-এক কথা তাঁদের শুনিয়ে দিত। সেও নেই তাই পার পেয়ে যাচ্ছে।

নীল... নীল... খুব মিস করছি তোমাকে।

চাতালের পাশ দিয়েই একটা রাস্তা ট্রেন লাইন ধরে বেড়িয়ে গেছে। সেদিকে পা চালিয়ে একটু নির্জনতা খুঁজি। বাতাসে বৃষ্টির গুড়ি। অগোছালো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা দূর এক বস্তির ভেতর এসে পড়ি। লোকগুলো কেমন উগ্র মেজাজের। বেশ কয়েকটা জায়গায় উঠতি ছেলে-পিলেরা সাট্টা-জুয়ার আসর বসিয়েছে। এদের আর কাজ কি, ওই চুরি চামারি পকেটমার। মারপিট লেগেই আছে সারাক্ষণ এদের মধ্যে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। আমি তাঁদের পাত্তা না দিয়ে আর একটু নির্জনতার আশায় রেল ব্রীজের ওপর হাঁটতে শুরু করি। তারপর বেশ খানিকটা এগিয়ে একটা সিমেন্ট বাঁধাই করা বসার জায়গা দেখতে পেয়ে বসে পড়ি। আকাশে মেঘগুলো বেশ রঙিন হয়ে আছে— শহরের আলোয়। এই বুঝি খাওয়া সেরে চরতে বেড়িয়েছে। বৃষ্টি নামবে বোধহয়। মাঝে মাঝে মেঘের ডাক আর ট্রেনের হুইসল আমাকে পার্থিব জগতে ফিরিয়ে আনছিল। ভাবলাম এখানেই রাতটা কাটিয়ে দেবো।

ট্রেনলাইনের ধাঁর ঘেঁষে আরও খানিকটা চলে গেলে হয়। কিম্বা আরও দূরে। একটা ট্রেন কেমন ঘুম ঘুম চোখে আসছে। যেন কত যুগ ধরে কত অসম্পূর্ন মানুষকে নিয়ে চলছে। হ্যাঁ অসম্পূর্নই তো। আমরা প্রত্যেকটা মানুষই অর্ধেক।

একটা গভীর ঘুম দরকার ভীষণভাবে। রাতভর ওই বৃষ্টি আর হাওয়ার দাপটে শরীর আর নিতে পারছে না। বরং এক কাপ চা আর বাপুজি কেক নিয়ে বারান্দায় বসি খানিকক্ষণ। আজ আর অফিস যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। মনে হল এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা খোলা ছাদে বসে রোদ্দুর মাপছি। মেঘেদের চলে যাওয়া দেখছি। পাখিদের ফিরে যাওয়াও। চারদিক তো অন্ধকার হয়ে আসছে। আবার বৃষ্টি নামবে। চারপাশ কেমন অচেনা। অন্ধকার কেটে গিয়ে আলো ফুটে উঠবে কখন ভাবছি। আমিও অনাবিল এক অচেনা জগতে সব কষ্ট ভুলে। কেউ নেই, রৌনক, অর্জুন সব সব বাদ। পাশে পড়ে শুধু কিছু টুকরো স্মৃতি।

অনেক অনেকদিন কোনও চিঠি আসেনি। অভিমানে লিখিনি আর। চা খেয়ে তাই লিখতে বসলাম। বৃষ্টিটা আবার ধরে এলো। কলকাতায় এত বৃষ্টি বোধহয় আগে হয়নি কখনও।

 

প্রিয় নীল,

তুমি জানো, তোমার আসলে কোনও বাস্তবতা নেই। যেহেতু তুমি বিশ্বাস করো একটি মানুষের সারা জীবনের নির্মাণ ও ধ্বংসের ফল তার বাস্তবতা। যা নিজের থাকেনা। পায় তার সন্তান-সন্ততিরা। সেই সন্তানের বাস্তবতা পায় সন্তান জন্মগুলি। আর এভাবেই বাস্তবতার অর্থাৎ একটি মানুষের মৃত্যু নির্মানের ইতিহাস লেখা হয়, কিন্তু জীবনের ইতিহাস লেখা হয়না। তুমি সেরকমভাবেই বাস্তবহীন হয়ে বেঁচে আছ। তুমি ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় মুছে ফেলতে ফেলতে আজ এক এমন জায়গায় পৌঁছে গেছ, যেখানে অস্তিত্বের সংকট বর্তমান। আমি তোমায় কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইনা। তুমি শুধু একটা জীবন হয়ে ওঠো।

আজকাল বড়ো বেশি চুপচাপ থাকি। কারও সঙ্গে ভাব জমে না। আমার সব কথা তো তোমার সঙ্গেই। এতদিনকার বন্ধুত্ব- কি নাম দেবো এই সম্পর্কের বুঝতেই পারি না। এভাবে ছেড়ে যাওয়াকে নিশ্চয়ই স্বার্থপরতা বলে। তবু বলব, তোমার এই সহজ হয়ে যাওয়াটা নদীর প্রবাহের মতো, ভেসে যাওয়া মেঘের মতই হালকা। উদ্দেশ্য আছে কিন্তু তবুও উদ্দেশ্যহীন। তোমার মতো গুছিয়ে কিছু বলতে পারিনা। শুধু বলব— তুমি যাকে ছুঁয়ে আছ, সেই জীবনকে ছুঁয়ে দেখ, ঘুরে ঘুরে দেখ তার শোভা। আর তো কিছু চাই না।

ইতি

তোমার বিশেষ বন্ধু

চিঠি লেখার পর অনেকক্ষণ বসে থাকলাম পড়ার টেবিল-এ। সত্যি কি কিছু চাইনা আর। নীলের কাছ থেকে কিইবা চাওয়ার আছে, ভালোবাসা ছাড়া। আদ্যন্ত এক পুরুষ হলেও আমার ভেতর যে এক নারী সব সময় লুকিয়ে থাকে। যে মুখ বুজে কাঁদে সারাক্ষণ বাইরে আসার জন্যে। সূর্যের আলো দেখবে বলে সে কবে থেকে অপেক্ষায়। কেউ তো বোঝে না এই দ্বৈত সত্তার কষ্ট। তার পোশাকী নামটা যে তার কাছে বোঝা হয়ে যায় বার বার। ভীষণ ইচ্ছে করে নীলের হাত ধরে বসে থাকি কোনও এক নদীর ধারে। প্রিন্সেপ ঘাটে অনেকবার গেলেও সেই একাকীত্ব আর বহিরঙ্গ কখনও তা ঘটতে দেয়নি। কাকে বোঝাবে। সবাই তো শুধু হাসে। তাকে নিয়ে টোন কাটে। কখনও তো বলে না— তোর কি ইচ্ছে, অনিচ্ছে। রাত বাড়লেই রূপম রূপসা হয়ে ওঠে।

ঘরের পশ্চিম দিকের আয়নাটাই তার রোজকার সঙ্গী। রাত যত বাড়ে রূপসার জৌলুস বেড়ে যায়। আরশিনগরে রূপসা তখন কথার পর কথা মালা গাঁথতে থাকে। একটা নদী, একটা সমুদ্র আর গঙ্গার ঘাট। এই তার সম্পত্তি।

 

—এই তুমি আবার কবে কবিতা লিখবে?

—যেদিন একটা শহর তোমার ভেতর জন্ম নেবে।

—কবে সেই সময়টা আসবে।

—যখন বন্দুকবাজরা বন্দুক নামিয়ে রাখবে। বন্দুকের আওয়াজ কমে আসবে। চারপাশের চিৎকারে আমার নীরব শব্দগুলো ফেটে পড়বে। যখন সত্যিকারের ভাষা আমায় ছুড়ির আঘাতে ফালাফালা করবে। আর আমি হয়ে পড়ব রক্তাক্ত।

 

ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখলাম আমি আর নীল একটা সর্ষে ক্ষেতের ভেতর আলপথ ধরে হাঁটছি। আমার আর নীলের ভেতর কথা হচ্ছে অগোছালোভাবে। কিছু কাঁচপোকা ঘাসের উপর পড়ে। সূর্যের প্রথম আলোয় তাঁদের শরীরে বিন্দু বিন্দু আশা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। যেন বহুযুগ ধরে এভাবেই আমরা হেঁটে চলেছি। নীল কথা বলছিল অদ্ভুত স্বরে। যেন একটা জলতরঙ্গ বাজছে কোথাও। এক অন্য স্তর থেকে ভেসে আসছে তার কথাগুলো। আর সে একের পর এক দস্তানা খোলার মতো স্বপ্নের কথা বলে চলেছে। যে স্বপ্নগুলো স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। যার কোনও ফাঁক-ফোঁকর নেই। আলস্য নেই। আছে শুধু প্রখর বাস্তবতা।

আমি তার কথার মধ্যে ডুব দিতে দিতে ভাবছি— নীলটা কত কিছুই না জানে, আমি তার একটুও জানি না। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। স্বপ্নের মধ্যেই নীল হাত ছেড়ে দিয়ে সর্ষে ক্ষেতের ভেতর ভোরের সূর্যের দিকে হাঁটতে থাকে। ক্রমশ একটা হলুদ আলোর ভেতর মিলিয়ে যায়।

মাঝে মাঝে নীলকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হয় আমার। কারণ পরিচয় হবার পর, যতবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা আড্ডা দিয়েছি। ঘুরেছি। একটা স্বার্থপর চোখ সব সময় তাকিয়ে থেকেছে। নিজের কথা ছাড়া সে কখনও জিজ্ঞেস করেনি আমার কথা। নিজের কথাই সে সারাক্ষণ বলে গিয়েছে। কখনও জানতে চায়নি খেয়েছে কি না, কিংবা কেমন আছে। সবাই বলে নীল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু একদিকে তার মন অনেক উদার। কোনও বন্ধুর বিপদে সে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছে অভিভাবকের মতো। তবুও মাঝে মাঝে তার কিছু ব্যবহার ভীষণ কষ্ট দিয়ে গেছে। এই যেমন দূরে চলে যাওয়া হঠাৎ করে। সেদিন চাতালের আড্ডায় দুম করে বলল- চলে যাওয়ার কথা। চাকরী ছেড়ে দেবে। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক সবকিছু। তার সঙ্গে যোগাযোগ শুধুমাত্র চিঠি। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই সে বলে নি। আমাকে শুধু বলল, চললাম। ব্যস ওইটুকুই। আমার কথা বলার ফুরসত টুকুও দিল না। আড্ডা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল— আসি রে। কোনও একসময় আবার দেখা হবে।

আমরা সবাই হতভম্ব। পেছন থেকে অনেকবার ডাকলাম। শুনল না। এক গম্ভীর, গর্বিত পুরুষের মতো হেঁটে চলে গেল স্টেশনের দিকে। তারপরই তো একটা চিঠি এলো। খুব অল্প শব্দের।

 যেখানে আছি। ভালো আছি। নীচের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে দিও। ভালো থেকো।

একটা পাহাড়ী গ্রামের স্কুলের ঠিকানা ছিল সেটা। অনেকবার চিঠি পাঠালেও, ফেরত এসেছে সেই চিঠি। নীলের দূরে যাওয়াই বোধহয় সবথেকে বড়ো কারণ রূপসার বাইরে বেরিয়ে আসার। চিঠির প্রতিটা শব্দে নারী শরীরের কণা কণা বেরিয়ে আসত।

নাহ, এর শেষ দরকার। অনেক হয়েছে। অপেক্ষার শেষ হোক। রূপসা নাম নিয়েই শুরু হল এবারের চিঠি লেখা।

 

প্রিয় নীল,

আজ তোমাকে কিছু জানানোর জন্যেই কলম তুলে নিয়েছি। অনেকদিন ধরেই যা জানাতে চেয়েও পারিনি। একটা আহত পায়রার মতো ছটফট করেছি শুধু। এখন ঘুমোতে গেলেও নিজের রক্তের শব্দ শুনতে পাই। আর হার্টবিট। তার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম তুমি আমি হেঁটে যাচ্ছি একটা সর্ষে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। তুমি কথা বলছ আধো অস্পষ্টভাবে। স্বাভাবিকের থেকে আরও গভীরে। আমিও চুপচাপ শুনছি। আর এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে কখন তুমি এগিয়ে গিয়েছ হাত ছেড়ে। তারপর একটা হলুদ আলোর ভেতর প্রবেশ করলে তুমি। এখানে একটা বাগান আছে। তোমারও পরিচিত সে জায়গাটি। অফিস ফেরত এখন ওখানেই বসে থাকি। ফুলগুলোর ফুটে ওঠা দেখি। আমার আরশি জীবন পড়ে থাকে ঘরে। এখানেই তখন জেগে ওঠে যত স্বপ্নের কথাগুলো। বস্তুত এই ফুলগুলিই শিখিয়ে দিয়েছে কিভাবে স্তরের পর স্তর পার হয়ে যেতে হয়। আমি দেখি তোমার মতো এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ হেঁটে যাচ্ছে বাগানের ভেতর দিয়ে। তার হাঁটাচলা দেখতে দেখতে তোমার কথা ভাবি। কেন ভাবি জানা নেই। আসলে যে আমার মধ্যে এক নদী-নারীর উৎপত্তি হয়েছে। তা টের পেতাম তুমি পাশে এসে দাঁড়ালে। কখনও কবিতা হয়ে, কখনও গল্প হয়ে তুমি সামনে চলে আসতে। আর আমি অবাক কিশোরীর মতো তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে তুমিও এই চেয়ে থাকার জন্যে প্রশ্ন করেছ। আসলে তখন উত্তর খুঁজে পেতাম না। মানব-মানবীর অদ্ভুত আকর্ষণের মতো তোমার চোখ-ঠোঁট সুদৃঢ় বাহু আমায় টানতো। সেজন্যেই চাতালের আড্ডায় তোমার উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলত অস্থিরতা। কখনও কখনও গভীর নীরবতাও যে শূন্যতা প্রসব করে। সেভাবেই তোমার চুপ থাকা আমার কষ্ট দ্বিগুণ করে দিত। এক দমবন্ধ অবস্থা। রূপসা বারবার বেড়িয়ে আসতে চাইলেও, আটকে রাখতাম আমি। হঠাৎ এরকম আকর্ষণের কারণ খুঁজতে যাওয়াটাও এক পরিশ্রমের কাজ। আমার স্বপ্ন, আমার মন বলত তুমি সেই প্রেমিক যার কাঁধে মাথা রেখে দুঃখ কষ্ট ভুলে যাব। একবার প্রিন্সেপ ঘাটে বসে থাকার সময় তোমার কাঁধে মাথা রাখতে গিয়েছিলাম। তুমি ছিটকে দূরে সরে গিয়েছিলে। ভীষণ ভীষণ আহত হয়েছিলাম সেদিন তোমার ব্যবহারে। যদিও সেটা স্বাভাবিক ছিল। আমি তারপর এগিয়ে গিয়ে নদীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা বুক চাপা অভিমান গুমড়ে গুমড়ে থেমে গেলো। তুমি তখন সিগারেট হাতে অর্জুন, সৌনকদের সঙ্গে মস্করায় ব্যস্ত। নজরে পড়ল না আমার কান্না। বুঝতে পারছিলাম, তুমি ক্রমশ সরে সরে যাচ্ছ, অনেকদূর। হয়ত, আমিই স্বার্থপরের মতো ভালোবেসেছি তোমাকে। তোমার চলে যাওয়ার ভেতরই হয়ত, সব থেকে বড় প্রতিশোধ আমার প্রতি। আসলে তুমি বুঝতে পারছিলে— আমার আকর্ষণ, আমার কথা। যাওয়ার সময় শুধু যাচ্ছি বলেই, হাঁটতে শুরু করলে। বাকি সবাই দেখেছিল আমার ভেঙে পড়া। অবাক হয়েছিল খানিকটা। আসলে তুমি যে কতটা ক্লোজ ছিলে আমার, সেটাই তাঁদের মাথায় এসেছিল। সারারাত শুধু ওই এক দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছিল। তোমার চলে যাওয়া। আমারই বা কি করার ছিল। সবই তো অদৃষ্ট। কি পরিমাণ কষ্ট যে বুকের ভেতর থম মেরে আছে, শুধু আমিই জানি।

আর কিছু বলার নেই, হয়ত অনেক কিছুই বাকী থেকে গেলো। সমাপ্তিটা আমাকেই টানতে হবে। নদী ডাকছে আমায়। একটা গভীর ঘুম। আর স্বপ্নকে কাছে টানার সময় হয়ে এসেছে। অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু এই জন্মে আর সে আশা পূর্ণ হবে না। রূপসা কখনও সূর্যের আলো দেখবে না। অনুঢ়া নারীর মতোই আমার ভেতর মৃত্যু অবধি থাকবে। অফিসের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টা। সব ঠিক ছিল। কিন্তু তোমার ছেড়ে যাওয়ার পর একবার মরে গিয়েছি। এরপর শরীরের মৃত্যু ঘটবে।

আমার কাছে জীবন একটাই। তাই পরজন্ম যে নেই তার প্রতি আস্থা রেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভুলে যেও বন্ধুত্ব। যা ছিল ভালোবাসা নিজের কাছেই রাখলাম। এর ভাগীদার আর কেউ হবে না। স্ফটিক শহরের সেই স্বপ্নটা পড়ে থাক চাতালে। চললাম। আমি চললাম।

স্বপ্নগুলো সত্যি হতে পারে।

যদি সত্যিগুলো স্বপ্ন হতে চায়।

ইতি

রূপসা

 

চিঠিটা লিখেই থেমে গেলাম। হ্যাঁ, এবার সব শেষ করার পালা এসেছে। আর চাইনা এভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে। দ্বৈত জীবন, দ্বৈত সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকব না। কিন্তু মরে যাওয়ার আগে একবার যদি নীলের দেখা পেতাম। সেটা আর সম্ভব নয়। সেই আশা চিরকালের মতো শেষ করে দিয়েছি আজকের চিঠিতে। চিঠিটা পাওয়ার পর নীলের চোখ মুখের অবস্থাটা কি হবে, এখন থেকেই বুঝতে পারছি।

পাহাড়ি বস্তিটার শেষেই একটা ঝর্ণা আছে। তার পাশ দিয়ে সরু রাস্তাটায় চোখ রাখলে অনেকদূরই দেখা যায়। এদিকটায় সচরাচর কেউ আসে না। কুয়াশার স্তর ধাপে ধাপে নেমে এসেছে বস্তির মাথা পর্যন্ত। তাই বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমার মাথায় একটা কান ঢাকা টুপি। নাক জমে গেছে ঠান্ডায়। কোনও সাড় নেই যেন। চারপাশ নিঝুম করছে। এমন অবস্থা, যে এই কিছুক্ষণ আগেই বুঝি ভূতের সিনেমা চলছিল। তাই সবকিছু শান্ত, স্যাঁতসেঁতে।

হাঁটতে হাঁটতে চড়াই এ উঠছি। সামনে এক পাহাড়ী বালক পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘোর লাগা। আজ নীলকে দেখব অনেকদিন পর। কেমন হবে তার অবস্থা। পুরনো বন্ধুকে সামনে দেখতে পেয়ে সে কি হকচকিয়ে যাবে। না চিনতে পেরে যদি বেরিয়ে যেতে বলে। দোটানার মধ্যেও হাঁটতে থাকে সে। এভাবে চলতে চলতে কখন যে ঝরনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি। সেই ঝর্নার ধাঁর থেকে নীচের বস্তিটা দেখা যাচ্ছে। পুতুল খেলার ঘর যেন সব। কুয়াশার জন্যে সকাল না দুপুর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অদ্ভুত একটা শিরশিরে ভাব বয়ে যাচ্ছে শরীরের ভেতর দিয়ে। রক্তের বয়ে যাওয়া অনুভব করতে পারছি। আর কিছুক্ষণ, কয়েকটা মাত্র মুহুর্ত, তারপর রূপমের বন্ধু, রূপসার প্রেমিকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। ঝরনা পেরিয়ে যাওয়ার পর পথটা বেশ সংকীর্ণ, পিচ্ছিলও। এখানে পা হড়কে গেলে খাদের অতলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিছুদূর হাঁটবার পর দেখতে পেলাম সেই বাচ্চা ছেলেটি অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমি আর এগোতে পারছি না। হাত-পা নেড়ে ডাকছি। সে কিছুতেই শুনতে পারছে না। গলা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠছি। কুয়াশা আমায় জড়িয়ে দিচ্ছে আরও আরও। মনে হল আমার সময় শেষ। আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চোখ কচলে প্রথমে অন্ধকার দেখলাম। তারপর ধাতস্থ হবার পর বুঝতে পারলাম বিছানায় শুয়ে। ঘামে জবজব করছে শরীর। মাথার ওপর ব্রিটিশ আমলের ফ্যানটা ঘুরছে যথারীতি।

দ্বিতীয় অধ্যায়

ঘরটা কেমন অগোছালো হয়ে আছে। আসবাবপত্র বলতে একটা চেয়ার, একটা টেবিল। বিছানা আর তার পাশে বেশ সুন্দর দেখতে ড্রেসিং টেবিল। সেখানে ছড়ানো ছিটানো সব মেয়েদের সাজগোজের জিনিস। স্বাভাবিক ভাবেই চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। কারণ এখন যার ঘরে আছি, সে একজন ব্যাচেলর। আর আনডাউটেডলি আমি তাকে বছরখানেক চিনি। তার সঙ্গে কোনও অ্যাফেয়ার তো দূরে থাক, নামও নিত না কখনও। অবশ্য একটু মেয়েলি বলে আমরা তার পেছন লাগতাম। কিন্তু তাই বলে যে সে...। না না এ হতে পারে না। এগুলো তার বোন কিম্বা মায়েরও তো হতে পারে। কিংবা সিক্রেট গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু এখানে তো ওর ফ্যামিলির কাউকে আসতে দেখিনি কখনও। চিন্তার বিষয় বটে। সে যাক গে, আসল ব্যপার হল গত পনেরদিন ধরে রূপমের কোনও ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন দূরে থাক, অফিসে পর্যন্ত জানায়নি। এদিকে সবাই ফোন করে করে হয়রান। অবশ্যই চিন্তার ব্যাপার। শেষে আমাকেই ধরল। যাতো সৌম্য, রূপম যেখানে থাকে একবার খোঁজ নিয়ে আয়। আমার বাড়িটা যেহেতু রূপমের ঘর থেকে কাছেই। তাই আমিই আগ বাড়িয়ে বললাম। ঠিক আছে আজ অফিসের পর যাব। তারপর তো এই।

বাড়ির মালিক যশোধর বাবু তো খুলতে চাইছিলেন না। অনেক বলে কয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খোলা হল। বলছিলেন কী হ্যাপা বাবু। এই তো পনেরদিন আগে সকালে দেখা হয়েছিল। দেখলাম বেশ একটা ফুরফুরে ভাব রূপমের মধ্যে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল— কাকু ভালো আছেন তো। আপনার বাতের ব্যথা কমেছে। আমিও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দোতলায় চলে গিয়েছিলাম। তারপর কখন যে বেড়িয়েছে মনে নেই। তবে রোজ অফিসে বেড়নোর সময় আমার স্ত্রীকে একবার জানিয়ে যায়। কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল— জানি না। একটু দাঁড়াও আমার স্ত্রীকে ডেকে দিই। সেই বলতে পারবে।

আমি ততক্ষণে চাবি নিয়ে একতলার ঘরটায় ঢুকে পড়েছি। ওর এখানে কখনও সখনও আমরা এসেছি হুল্লোড় করতে। কিন্তু তখন তো এইসব চোখে পড়েনি। আমরা বেশিক্ষণ থাকলেই ওর ভেতর কেমন একটা ছটফটানি দেখতে পেতাম। আসলে যে কী চাইত। কখনও খুলে বলত না কিছুই। নীল থাকলে অবশ্য তার মুখে কথার খই ফুটত। ঘরের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে আছে। বিছানায় উঠে মাথার পাশের জানলাটা খুলে দিলাম। ভ্যাপসা গন্ধ সারা ঘরময়। একটা ছুঁচো কোথা থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেলো। দেওয়ালের র‍্যাকে বইগুলোতে ধুলো জমতে শুরু করেছে। টেবিলে একটা বই খোলা অবস্থায়। একটা নোটপ্যাড-এর পৃষ্ঠা ছেঁড়া। নীচে ডাস্টবিনে অসংখ্য দলা পাকানো সাদা পাতা। রূপম তো এরকম নোংরা নয়। বেশ পরিষ্কার আর পরিপাটি থাকত সবসময়। অর্জুনের সঙ্গে একবার এই নিয়ে বেশ ঝামেলাই হয়ে গিয়েছিল একদিন।

সেদিন একটা ধবধবে সাদা শার্ট পড়ে এসেছিল রূপম। চাতালে সবে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। পেছন থেকে অর্জুন এসে ঘাড়ের ওপর। আর যায় কোথায়, পুরো চা রূপমের সাদা শার্টে। যাচ্ছেতাই ভাবে রেগে গিয়ে রূপম আড্ডা ছেড়ে প্রায় সপ্তাখানেক ঘরেই ছিল। আর সেই রূপমের ঘর কিনা এরকম অগোছালোভাবে পড়ে। টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বইয়ের পাতা বন্ধ করলাম। দেখে মনে হচ্ছে কোনও কিছু লিখতে লিখতে উঠে বেড়িয়ে গেছে। এই এখুনি এসে আবার লিখতে বসবে। নোটপ্যাড উলটে দেখি কিছু লেখা। কিন্তু পাতা ছেঁড়া তার। একটুখানিই পড়া যাচ্ছে না।

নাহ্‌ আপাতত কিছুই বোঝা গেলো না। রূপমের ফোন অফ। ব্যাগপত্তর কিছু আছে কিনা দেখতে যেতেই একটা ডায়েরি চোখে পড়ল বইগুলোর ভেতর। হাতে নিতেই সালটা ২০১৭। তার মানে এ বছরেই। কিন্তু অন্যের ডায়েরী পড়া ঠিক নয় ভেবেও, পকেটে ভরে নিলাম। তারপর আবার জানলা বন্ধ করে, লাইট অফ করবার মুহুর্তে আয়নার দিকে নজর পড়ল। ক্লিপ, কাঁটা, নকল চুল, লিপস্টিক, কাজল। কী নেই ওতে। আয়নাটা বেলজিয়াম কাঁচের। বেশ সুন্দর। কিন্তু খটকাটা থেকে গেলো। এতসব মেয়েলি সামগ্রী রূপমের ঘরে কেন। আর বলা নেই কওয়া নেই এভাবে উধাও হয়ে গেলো ছেলেটা।

এসব ভাবতে ভাবতেই বাইরে এসে তালা বন্ধ করতে যাব, দেখি কাকু দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কাকিমাও। কাকিমার হাতে চায়ের কাপ। আমাকে দেখে বলল— চা’ নাও বাবা। রূপম সেদিন আমাকেও কিছু জানায়নি। রোজ তো সকাল সকাল উঠে চান করে, দুধওয়ালার কাছে দুধ নেয়। পেপার পড়তে পড়তে ওনার সঙ্গে গল্পগুজব করে। আমিও ভাবলুম হয়ত তাড়াহুড়োতে জানাতে ভুলে গেছে। অতসব কি আর আমি বুঝি বাবা, তোমরা ছেলেপুলে মানুষ। মেজাজ মর্জির মালিক। আমি আর বিশেষ কিছু ভাবিনি। ভাবলুম কোথাও বেড়াতে গিয়েছে বুঝি। এরকম তো আগেও দু-একবার গিয়েছিল। কিন্তু ৩-৪ দিনের জন্যে।

—হ্যাঁ কাকিমা, সেতো আমরাও জানি। কিন্তু এবার যে কি হল সেটা আমাদেরও জানিয়ে যায়নি। তাই চিন্তায় আছি।

—ঠিক আছে। আসছি তাহলে। যদি ফিরে আসে জানাবেন। আমরাও খোঁজ নিচ্ছি।

চাতালের বসার জায়গায় সৌম্য বসে আছে একা। মাথা নীচু করে। হাতে রূপমের ডায়েরি। রৌনক আসছে। ও এলে তারপর ডায়েরিটা খুলব। একটা পাতা পড়েই সে বন্ধ করে দিয়েছে।

এত সুন্দর ডায়েরিটা। বেশ ভালো কভার। সৌম্য দেখেনি কখনও। যদিও অন্যের ডায়েরি পড়তে নেই। কিন্তু এখন ওসব ম্যানারস ভাবলে চলবে না। দু-রাউন্ড চায়ের পর রৌনক এলো হেলতে দুলতে। ওকে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায় এই কারণে। একটুও টাইম ম্যানেজমেন্ট নেই।

কাকার দোকানে চায়ের অর্ডার করে সে সৌম্যর পাশে এসে দাঁড়াল। কীরে, কিছু খোঁজ পেলি।

—না পাইনি, তবে ওর রুমে গিয়ে যা দেখেছি, শুনলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

—বলিস কী, তোর হাতে ওটা কী?

—ডায়েরি। রূপমের।

—কেন? কী দরকার?

—দ্যখ, না ওকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে, না। ওর খবর কেউ জানে! এই মুহুর্তে আমার যেটা মনে হয়েছে, সেটাই করেছি। এবার তোর যদি কিছু বলার থাকে, বল। শুনছি। তবে আমার যেটা মনে হয় এই ডায়েরী থেকেই আমরা জানতে পারব।

—ঠিক আছে, তাহলে তুই নিয়ে যা। পড়। কাল জানাস।

 

১ জানুয়ারী ২০১৭

নাহ সেভাবে কিছু ভেবে ওঠার আগে একবার অন্ততপক্ষে নদী হওয়া যাক। তারপর বাউল বাতাস যখন নীরবে মনের ভেতর ঘুরে ফিরবে, আর আমি জানালায় বৃষ্টির দিন গুনে রাখব। আমার সহস্র তারা ভরা আকাশ মৃদুমন্দ হাসির চোটে কেঁপে কেঁপে উঠবে বেহিসেবি। আসলে, জানো তো এই শীতলতা তোমাকে মানায় না। যেভাবে কলেজ স্ট্রীট চত্বর পুরোনো হয় না। তুমিও হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যাও টানেল। এক বিঘত সোঁদা মাটির গন্ধে আমিও বুঁদ। পায়ে ঠেকে সমুদ্রের ঢেউ। ক্রমশ আমি স্বপ্নে হারিয়ে যেতে যেতে আবারো গুমনামি হতে থাকি। বরাবরের মতো নিটোল… সুখ ফিরে পেতে ডুব দিই রাত পেরিয়ে একটা ভোরের দিকে। আমার আঙ্গুলে ফুটে ওঠে তোমার সুপ্ত ভালো লাগা। তারপর ভাসতে থাকি ইথারে। বহ্নিলতা জ্বালিয়ে শহর তখন আরো আরো দূরে জেরুজালেম থেকে মিসিসিপি। আমার সেই না লেখা চিঠির লাইনে লাইফ জ্যাকেট পড়ে হাজির হয় ডক্টর জেকিল। তারপর হাইড-এন্ড-সিক খেলায় জিতে যাও তুমি। এভাবে তন্বী সময় কেটে যায়। সমুদ্র তখন কবিতা লেখে আনমনে। কি-প্যাড জুড়ে পরে থাকে গতকাল ও আজ। আমিও রাত ভোর হতে হতে বীজ পুতে দিই। এভাবেই জন্ম নেবে আগামী একটা গল্পের। নাদান মন বলছে বালিঘড়ি উল্টে দিলে, শুধু পড়ে থাকে মুহুর্ত।

এটুকু লিখেই রূপম আর কিছু লেখেনি। এভাবে তো কখনও ওকে জানতে পারিনি। ও এত সুন্দর লিখেছে।

পরের পাতায়...

সন্ধে লিখি না আর

বৃষ্টি লিখি, লিখি মেঘ

একটা কাচের জানলা জানে গল্পটা, জানে সুখ

বিষাদ গাছের স্নেহ, বেপাড়ার লাগামছাড়া ঘুড়ি

এরপর চিঠির ভেতর সমুদ্রের ইচ্ছেপূরণ

সে তুমি জানো, তোমার মতন অন্য কেউ নয়

 

১৬ জানুয়ারি ২০১৭

শুধু নীল, তোমাকে বলি। আর পারছি না। এভাবে নিজেকে শাস্তি দিতে। কেন? কেন?

 

মানেটা কী? রূপম মানে। সৌম্য খানিকক্ষন থম মেরে বসে থাকে। রৌনককে ফোন করে। ওর ফোন এনগেজ। বার দুই ফোন করে সে চুপ করে থাকে। আবার ডায়েরি হাতে নেয়।

স্বপ্নের পর স্বপ্নের বিবরণ লেখা তাতে।

 

তার আগের কোনও পাতায় আর কিছুই লেখা নেই।

 

২৪ মার্চ ২০১৭  

এটা করতে পারলে তুমি।

 

২৫ মার্চ ২০১৭

আমি চলে যাচ্ছি। বরাবরের মতো।

 ও, হ্যাঁ মনে পড়েছে এই দিনই তো নীল চলে গিয়েছিল এখান থেকে। 

আত্মহত্যার গোলাপী নোটে লিখে যাব আজকের সন্ধে। ততক্ষণে ঝিরিঝিরি রাত নেমে আসুক গাছের গায়ে। কবরের নীরবতা ঘিরে ফেলুক শহর। পালিয়ে যাওয়ার আগে ফলকে লিখে রাখি নাম। এভাবে আরও একদিন না হয়... গাছ হব। আলো হব। যেভাবে জেনেছি ছায়াদের কোনও পৃথিবী নেই। হারিয়ে যাওয়ার যে গুজব ছড়িয়ে দেবে কান, আমি নক্ষত্রের নীচে জন্মাতে পারি আবার। ভূগোলের হাত ছাড়িয়ে ইতিহাস... তারপর ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা, কয়েক চুমুক প্রেম আর লম্বা বায়োডাটা। সে ফিরিস্তি থাক। মিউজিয়ামে বসন্তের আনাগোনা লেগেই থাকবে। সেও থাক। কবরের ভিজে মাটি ছুঁয়ে তাজমহল হয়ে যাক প্রেম। এ গলি, ও গলি, চারমাথা মোড়, তারপর ভিজে যাওয়া চোখ গান লিখে নিতে পারে অবকাশে। একটা এপিটাফ গলে গলে পড়ুক। গ্রহণের পর নাহয় কাছে টেনে নিও... আর একবার শুধু... বান নেমে আসুক বুকের ওমে।

 

২৭ মার্চ ২০১৭

এই চলে যাওয়াই যেন শেষ বারের মতো হয়। তোমাকে আর কখনো কিছু বলব না। কখনও বলব না ভালোবাসি। আমি জানি আমার এই বাইরের রূপ তোমাকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আমি আর পারছি না বিশ্বাস করো।

এখানে কবরের নিস্তব্ধতা, সন্ধের কাফিলা নেমে আসার আগে রেড লাইট ধরে হেঁটে যেতে যেতে কোনও একদিন দেখা হয়ে যাবে। যেখানে পথ হেলায় পরে থাকে। যে পথ বেঁধে দেয় বন্ধনহীন গ্রন্থি... আমার মুনতাজির দূরে দাঁড়িয়ে হেসে ওঠে। আর চিৎকার করে বলে, পুরে কায়েনাত না সহি, পাশে হাঁটলে আমিও গান বাঁধতে পারি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি মতো। বেবাক শহর আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেতে গিয়ে আপাতত হেডলাইন হোক আমার ভালোবাসা। আরও একবার নাহয় জন্ম নেব। আরও একবার ফিরে আসব তোমার জন্যে।

কিন্তু এই দ্বৈত জীবনে আর না।

 

৩১ মার্চ ২০১৭

পর পর সব চিঠি ফেরত চলে এসেছে তোমার। আর লিখব না কথা দিলাম।

 

৬ জুন ২০১৭

আজ ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে। জানিনা কোথায় আছ তুমি। জানো আজ কী করেছি। একটা লাল রঙের ওড়না কিনে এনেছি। তোমার ভীষণ প্রিয় রং তাই। আর কথা বলি না কারো সঙ্গে। ভালো লাগে না কিছুই। অফিস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। জানি তুমি আর ফিরবে না।

 

১০ জুলাই ২০১৭

আজ আবার সেই স্বপ্নটা দেখলাম জানো তো। সেই সেই হলুদ সর্ষে ক্ষেতের স্বপ্নটা। তুমি আমি হেঁটে যাচ্ছি একসঙ্গে। জানো নীল। তোমার কাছে শুধু ভালোবাসাই চেয়েছি। আর কিছুই না। বিশ্বাস করো। এভাবে আহত পায়রার মতো ছটফট করতে করতে মরতে চাইনি।

 

সন্ধেবেলা চাতালের আড্ডায় সবার জরুরী তলব। সৌম্য রৌনক, অর্জুনকে ডেকে পাঠিয়েছে। জানিয়েছে যেভাবেই হোক যেন আসে। ওরা সবাই থম মেরে বসে।

সৌম্য বলে ওঠে, এই অর্জুন টিকিট কাট সবার। আমরা সবাই যাব রূপমকে খুঁজতে।

অর্জুন বলে— কিন্তু কোথায় খুঁজব।

সৌম্য— আমি জানি সে কোথায় যেতে পারে।

সবাই বলে ওঠে কোথায়?

সৌম্য— তুই আগামীকাল এনজেপির টিকিট কাট। বাকিটা আমি বলে দেবো।

 ট্রেন চলছে। একটা অনির্দিষ্টকালের মতো যেন চলছে। সৌম্য আর কিছুই বলেনি ওদের। শুধু চায় রূপমকে খুঁজে পেতে। তার নদী হওয়ার ইচ্ছেকে পূরণ করতে। ভোর হয়ে আসছে। দার্জিলিং মেল আর এক ঘন্টার মধ্যে ঢুকে যাবে এনজেপিতে। ট্রেনের জানলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়গুলো আস্তে আস্তে ঘুম থেকে জেগে উঠছে।

সৌম্যর হাতে ডায়েরিটা।

শেষ পাতার কয়েকটা শব্দ যেন তাকে নিয়ে যাচ্ছে রূপসার জগতে—

‘স্বপ্নগুলো সত্যি হতে পারে

যদি সত্যিগুলো স্বপ্ন হয়ে যায়’।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জলপাইগুড়ি শহরে। বর্তমানে কর্মসূত্রে কলকাতা নিবাসী। পেশা লেখালিখি। প্রকাশিত বই যথাক্রমে— বাঁশিওয়ালা, নির্জনতার স্টেটাস আপডেট, ফরাসি প্রেমিক ও ঘাসফড়িং, অ্যাফ্রোদিতি ও তার অভিশাপ।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন