পাখির ডানার ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটা শুনলেই কোনো না কোনো বিচ্ছেদের কথা মনে আসে। জীবনের আনাচ কানাচে কত যে বিচ্ছেদ দাহ স্তূপ হয়ে আছে, তাকে বইতে বইতে যাপন করে চলা এই জীবন। ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অতীত এবং বর্তমান দুটোই। ফুড়ুৎ মনে এই তো ছিলাম কিন্তু এখন আর নেই।
পাখির ডানার ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটা শুনলেই কোনো না কোনো বিচ্ছেদের কথা মনে আসে। জীবনের আনাচ কানাচে কত যে বিচ্ছেদ দাহ স্তূপ হয়ে আছে, তাকে বইতে বইতে যাপন করে চলা এই জীবন। কিম্বা মনে আসে দ্রুত চলে যাওয়া কোনো ট্রেনের হুইসেল; ঢাকুরিয়া লেকের ধারে প্রাচীন কামানটার ওপর নাবিকের সঙ্গে নিবিড় নির্বাক বসে থাকত যখন, ঠিক তখন ঝোপের ওপারে ঝম-ঝম ধ্বনি তুলে তীক্ষ্ণ হুইসেল দিয়ে চলে যেত যেভাবে এক একটা ট্রেন।
আজ এই যে সারাদিন ধরে কেবলই ফুড়ুৎ ধ্বনি শুনছে সে, অথচ বাড়িময় এ-জানলা ও-জানলায় ছোটাছুটি করেও একটাও পাখির উড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য উধাও।
একা বাড়িতে পূব জানালার পাশে সোফায় বসে রইল থম মেরে। ফুড়ুৎ শব্দটার বহুধা মহিমা নিয়ে মনের ভেতর ঢেউয়ের উথাল পাথাল।
দেয়ালে ঘড়িটার টিক-টিক শব্দটা চারপাশের নিস্তব্ধতার মধ্যে একটু জোরেই হচ্ছে যেন! সময়ও তো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ফুরোয়, আর ফুরোয় সম্পর্ক। পরে থাকে দুটো মনের বেদনাবহ বিচ্ছেদের অঙ্গার।
বর্ষার সুর্মা রঙের ছেড়া মেঘগুলো কেবলই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে লুকোচুরি খেলে, তেমন করেই জীবনভর চলে কত না ফুড়ুৎ-এর পালা। ব্যকরণের শুদ্ধিকরণে এর অর্থ দাঁড়ায়— ‘সমাপন’, চিরতরে একটা সমাপ্তি।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
‘ফুড়ুৎ’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অতীত এবং বর্তমান দুটোই। ফুড়ুৎ মনে এই তো ছিলাম কিন্তু এখন আর নেই। বহু যোজন দূর থেকে ভেসে আসছিল কচি গলার মিহি স্বর, ‘আমায় ধরতে পারে না... আ... আ, কানামাছি ভোঁ ভোঁ... ও...’ স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে, চোখ দুটো কাপড়ে বাঁধা। আকারহীন অচেনা অন্ধকারে অসহায়ের মতো আঁকুপাঁকু। একজন সঙ্গীকে জাপটে ধরে ফেলবার মরিয়া চেষ্টায় সারাটা উঠোন জুড়ে বেভুল ঘুরে ঘুরে মরা। প্রত্যেক মানুষই কৈশোরে অন্তত একবার এই খেলাটা যে খেলেছে, এটা নিশ্চিত। এই ফুড়ুৎ- খেলাটা প্রত্যেক মানুষের জীবনে অমোঘ।
‘ফুড়ুৎ’ মহাশয় আবার বেশ রসিক মানুষ। সাধুর মতো মুখে হাসি জাগিয়ে বলেন, ‘আমি বহুরূপে সম্মুখে তোমার হে।’
প্রধানত মহাশয়ের দুটো রূপ। একটি তার ঔপনিবেশিক দখলদারির পোট্রেট, অন্যটি প্রলেতারিয়, সর্বহারা রূপ-মহিমা।
ঔপনিবেশিক দখলদারিতে ফুড়ুৎ নিশ্চিতভাবেই অলিভ পাতার মুকুট জয়ী। কিন্তু তার সর্বহারা রূপটি এর চেয়েও ভয়ঙ্কর বেদনাবাহী।
যতদিন তুমি আয়ুষ্মান ততদিন ওই ফুড়ুৎওলাও গুবরে পোকার মতো কুট কুট করে পাতার বদলে জীবনের কানা কাটতে থাকবে অবিরাম। বুকের ভেতর এক গামলা ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা অগ্নিময় তুষ, পুড়িয়ে ধুরিয়ে খোকলা করে দেবে। শ্যাম চলে গেছে রাধিকাকে ছেড়ে অতএব রাধিকার বয়ানে— ‘শূন্য মন্দির মোর।।’
‘ফুড়ুৎ’ মহাশয় অবশ্য দখলদারির আগে একবার আবেদন রাখবেন, ‘প্রাণটি আমার হাতে সমর্পণ করো নতুবা বল প্রয়োগে কেড়ে নেবো।’ তখন মানুষ সম্মোহিতের মতো প্রাণ পাখিকে ওর হাতে তুলে দেবে, কেননা ততদিনে জ্বলন্ত তুষের আনবিক কণা সমূহ তার মন, স্বপ্ন ও বাঁচবার মরিয়া বাসনাকে অস্থিচর্মসার করে পারঘাটের অন্তর্জলি শয্যায় শুইয়ে দিয়েছে। বেঁচে থাকবার বিন্দুমাত্র বাসনা আর অবশিষ্ট নেই।
—এবারে প্রশ্ন ওঠে, কেন নেই?
উত্তরটি লিপিবদ্ধ করতে বৈশম্পায়ন হাতে তুলে নিলেন তাঁর ভূর্যপত্র ও খাগের লেখনী। প্রথম শব্দটিই তিনি লিখলেন— ‘পরমাদ।’ শব্দটি পুনর্ভবা। খড়কুটোর মতো ভরহীন ভেসে চলে মাত্র, ডোবেও না, মরেও না। যদি বা মরে, অন্য জন্মান্তরে ভেসে ওঠে পুনর্বার। জীবনভর এক একটা ফুড়ুৎ-এর পরেই উত্তর না মেলা অংকের মতো মনে মনে আওড়ে চলে মানুষ, ‘কোথায় ঘটিল পরমাদ?’
আশ্চর্য এই যে, কয়েকবার মাথা ফাটলেও মানুষ আবারও বেলতলায় যায়, অন্তত যতবার সে যেতে পারে এক জীবনে, অর্থাৎ একটা, দুটো, পাঁচটা ফুড়ুৎ-এ তার বাসনা মরছে না মোটেই। সে আবার নব অনুরাগে প্রাণপণে চাইছে আবারও একটা ফুড়ুৎ-এর আদিপর্বে ঢুকে পড়তে। এই এতদিন আমি তোমার হৃদয়লগ্ন ছিলাম, এখন আর নেই। কিছুদিনের উত্তাপ নিতে এসেছিলাম তোমার দোরে।
একটা ফুড়ুৎ থেকে আরেকটা ফুড়ুৎ-এর মধ্যবর্তী সময় মানুষ যে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে, তার জো নেই। ধরা যাক কেউ লিখে ফেলবে একটা আস্ত ‘যমুনা বিষাদ কাব্য’। ‘হে ক্ষণিকের অতিথি, এসেছিল তবু আসো নাই।’ এভাবেই সারাজীবন ধরে চলল ফুড়ুৎওলার খেলখুদ।
অবশেষে এসে গেল, তার নিজেরই একদিন ফুড়ুৎওলা হয়ে উঠবার পালা। বহু’র জীবন থেকে ফুড়ুৎ হয়ে সে শ্মশানের ধুসর প্রান্তরে, নির্দিষ্ট নম্বর-প্লেট তার অসাড় শরীরে নিয়ে শবের লাইনে গিয়ে শুয়ে পড়বে। ওই লাইন আবার চলমান নিত্য জীবনের আইনভাঙা লেংচে মরা লাইন নয়। ওটা ভদ্র লাইন। ওখানে লেঙ্গি খাওয়ার সম্ভাবনা জিরো। এতটুকু বেলাইন হলেই শোকসন্তপ্ত শবযাত্রীরা শোকতাপ ভুলে একেবারে বিধ্বংসী বিপ্লব ঘটাতে পারে।
কারণ, মৃতের জন্য তাদের নাগাড়ে কুম্ভিরাশ্রু অথবা উচ্চস্বরে বিলাপ-প্রলাপের গোপন মহলে, গায়ে গতরে এক করে দীর্ঘসময় ধরে চর্ব-চোষ্য-এর লোভ সংবরণ করে মৃতকে দাহ করবার জন্য সুদীর্ঘ অপেক্ষা কি প্রাণে বা পেটে সয়?
অতএব ঘড়ির কাঁটা মিলিয়েই দাউ দাউ পুড়েধুরে ছাইভস্ম হয়ে সে মিশে যাবে পঞ্চভূতে, বায়োডিগ্রেবল পদার্থ হয়ে। কৈশোরের বহু পুরাতন ছড়াটা— ‘আমায় ধরতে পারে না’ এবার তার নিজেরই সেই ছড়া কাটা শুরু। চোখ বন্ধ অবস্থায় হঠাৎ ঠাওর করে কেউ তাকে জাপটে ধরে ফেলবার ন্যূনতম সম্ভাবনা উধাও। কেননা সে তখন নিজেই এক ‘দিগম্বর ফুড়ুৎওলা’।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন