এ লেখাটি শিল্পী অরিন্দম চ্যাটার্জির চিত্রকলা প্রদর্শনীর আলোচনা। আলোচক একে রিভিউ বলতে নারাজ, তা লেখার মধ্যে থেকেই স্পষ্ট।
বেশ কিছুদিন আগে এই সময়ের অন্যতম বিশিষ্ট শিল্পী অতীন বসাকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করছিলাম, দেশের চিত্রকলার প্রেক্ষিতে আমাদের বঙ্গদেশের যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল, সেটি কি হারিয়ে যেতে বসেছে? গণেশ হালুই, যোগেন চৌধুরী, লালুপ্রসাদ সাউ - এই তিনজন, বাংলা চিত্রকলার ‘হোলি ট্রিনিটি’-ই বলা যায়, যাঁদের প্রত্যেকেই আশি পার করেছেন (কথোপকথন বেশ কয়েকবছর আগেকার, এঁদের তিনজনের বয়সই এখন পঁচাশির বেশি) - এঁদের পর কলকাতায় বসে ছবি আঁকছেন, কিন্তু দেশের শিল্পজগতে নামডাক আছে, এমন শিল্পী কোথায়? বিশেষ করে বছর-পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর আশেপাশে বয়স, এমন খ্যাতিমান শিল্পী এখানে কোথায়? যে দু-চারজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রকর রয়েছেন, তাঁরা থাকেন রাজ্যের বাইরে। তবে কি, আরও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই, চিত্রকলার জগতে বাংলার উচ্চ মর্যাদার স্থানটি হারিয়ে যাওয়ার মুখে?
অভিযোগের যথার্থতা মেনে নিয়েও অতীনদা দুটো নাম করেছিলেন, যাঁরা কলকাতায় বসেই ছবি আঁকেন এবং সারা দেশের প্রেক্ষিতে যাঁরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতিমান, ও যাঁদের খ্যাতি উত্তরোত্তর বাড়বে বলেই তাঁর ধারণা। নামদুটি - চন্দ্র ভট্টাচার্য আর অরিন্দম চ্যাটার্জি।
চমৎকৃত হলাম, কেননা চন্দ্র ভট্টাচার্যের ছবি অনেক দেখেছি, তিনি আমার খুব প্রিয় শিল্পীও বটেন - কিন্তু দ্বিতীয় নামটি আমার কাছে একেবারে নতুন । কেননা, ইতিউতি অল্পবিস্তর ছবি দেখার অভ্যেস গড়ে তোলার চেষ্টা করি বটে, কিন্তু অরিন্দমবাবুর ছবি দেখা তো দূর, নামও শুনিনি! অতীনদা হেসে বললেন, শুনবেন কী করে! অরিন্দম তো এদিক-ওদিক জনসংযোগ করে বেড়ায় না, নিজের ঢাক নিজে পেটায় না - ঘরে বসে মন দিয়ে নিজের মনের মতো ছবি আঁকে। গ্যালারিতে ওর ছবি কমই থাকে। ওর ছবি আপনাকে খুঁজে খুঁজে দেখতে হবে।
তো তা-ই করলাম। একক প্রদর্শনী না পেলেও কয়েকটি গ্রুপ শো-তে অরিন্দম চ্যাটার্জির একটি দুটি করে ছবি দেখতে লাগলাম। ছবি দেখে ভালো লাগল বলাটা ভুল হবে - কেননা, দেখে যেটুকু বুঝলাম, ছবির মাধ্যমে ভালো লাগাতে চাওয়াটা অরিন্দমবাবুর উদ্দেশ্য নয় - তবে এটুকু অনুভব করতে অসুবিধে হলো না, যে, অরিন্দম চ্যাটার্জির মতো শক্তিশালী শিল্পী আশেপাশে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। বিশেষত এমন শিল্পী, যিনি বাজার-চালিত শিল্পব্যবস্থার মধ্যে এঁকে চলেও দর্শককে দৃষ্টিসুখ বা দৃষ্টি-শান্তি দিতে আগ্রহী নন।
তালেগোলে একসময় অরিন্দমবাবুর সঙ্গে আলাপও হয়ে গেল। মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায়। কথাবার্তা - চ্যাট - হতে থাকল। শক্তিশালী তুলির পেছনে অসম্ভব ঋজু ও আদর্শনিষ্ঠ মনটির পরিচয় পাওয়া গেল। একদিন যেমন, এই সময়ের এক শিল্পীর আঁকা শান্ত-স্নিগ্ধ শান্তিকল্যাণ টাইপের গ্রামবাংলার কিছু ছবি শেয়ার করে বিখ্যাত এক শিল্পতাত্ত্বিকের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছিলাম। উদ্ধৃতাংশের মোদ্দা কথা ছিল, অস্থির সময়ের আমাদের শাশ্বত চিরায়ত সুন্দরের কথা মনে রাখতে হবে - তার ডকুমেন্টেশন করে চলতে হবে - হারিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না। চ্যাটবক্সে অরিন্দমবাবু রীতিমতো বকুনি দিলেন। বললেন, আপনি তো বক্তব্যটাকে মিসইন্টারপ্রেট করছেন! মনে রাখুন, ওই শান্ত-স্নিগ্ধ গাছপালা কুঁড়েঘরের পাশেই চলছে পঞ্চায়েতের মাত্রাছাড়া দুর্নীতি, বাড়ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ - ওই বাড়ির ছেলেটি চাকরি পেতে ঘুষ দিচ্ছে, পাশের বাড়ির আবাস যোজনার টাকা কেউ মেরে দিয়েছে - ছবির মধ্যে তার ডকুমেন্টেশন না হয়ে শুধুই ফুল-পাখি-গাছপালার স্নিগ্ধতা থাকবে!! আর আপনার মতো সচেতন মানুষজন সেই ছবিকে জাস্টিফাই করবেন!! তো বলাই বাহুল্য, অরিন্দমবাবুর কথাটা অস্বীকার করতে পারিনি। বরং তাঁর শিল্পদর্শনের কথা বুঝে আরও বেশি করে তাঁর ছবি দেখার আগ্রহ জেগেছিল। স্বভাব-আলস্য ও সঙ্কোচের কারণে তাঁর বাড়ি গিয়ে ছবি দেখা হয়ে উঠছিল না - অথচ দেখার আগ্রহ - কৌতূহলও বলতে পারেন - তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। দীর্ঘ আলস্য ও সঙ্কোচের বিহ্বলতা ইত্যাদি প্রভৃতি কাটিয়ে একদিন না একদিন হয়ত শিল্পীর বাড়ি গিয়েই হাজির হয়ে বসতাম - কিন্তু আচমকা খবর পেলাম, শিল্পী অরিন্দম চ্যাটার্জির বড়সড় একক প্রদর্শনী আয়োজিত হতে চলেছে শিগগিরই, এই শহরেই।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন ইমামি আর্ট গ্যালারি আয়োজিত সেই প্রদর্শনী প্রায় শেষের মুখে। আর লেখাটা যখন আপনি পড়বেন, ততদিনে প্রদর্শনীটি হয়ত শেষই হয়ে গিয়েছে। পাঠিকা ও পাঠকদের মধ্যে যাঁরা এ প্রদর্শনী দেখে এসেছেন - প্রায় দু’মাস ধরে চলা এই প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছেন বহু মানুষ, প্রতিদিনই - তাঁরাই জানবেন এ প্রদর্শনীর অভিঘাত। আর যাঁরা যেতে পারেননি, লিখে তাঁদের কিছুই বোঝাতে পারব না। অতএব, প্রদর্শনীর রিভিউ লেখার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকছি।
শুনলাম, অরিন্দম চ্যাটার্জি নাকি শুরুতে বিমূর্ত ছবিই আঁকতেন (যদিও তাঁর সেসব ছবি আমার দেখার সুযোগ ঘটেনি, অন্তত এখনও) - ২০০৭-এর পর থেকে আস্তে আস্তে তাঁর ছবিতে ফিগার-এর প্রবেশ ঘটে। কেননা, তাঁর মনে হচ্ছিল, মানবসভ্যতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে - যে সভ্যতার থেকে বর্বরতাকে পৃথক করা মুশকিল - তার স্বরূপ বিমূর্ততা দিয়ে ধরতে পারা মুশকিল। মানতেই হয়, সে স্বরূপ অরিন্দমবাবু ধরতে পেরেছেন। তাঁর ছবিতে ফিগার - মানুষ - একইসঙ্গে অবমানবও - দাঁড়িয়ে থাকে, চলাফেরা করতে থাকে - তাদের সেই জীবনযাপন, যদি একে জীবন বলেন (নাকি, এই-ই জীবন?) - তার মঞ্চ সাজানো হয় কোনও পেলব নীল আকাশের নিচে নয়, রুক্ষ, চরম রুক্ষ মাটিতে। এই শিল্পী তাঁর ছবির চরিত্রদের উড়ান দেওয়ার জন্য আকাশের পরিসর তো দেনইনি, পায়ের তলার মাটিটুকুও শান্তিহীন, কর্কশ। ছবির বেশ খানিক অংশ জুড়ে কালো ও ধূসর, লালচে খয়েরি, কদাচিৎ লাল - ছেড়ে রাখা সাদা অংশে কাঠকয়লার গুঁড়ো - সচেতনভাবে ব্যবহৃত অতি-সীমিত প্যালেটে তিনি ধরে রেখেছেন বাজার সভ্যতায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া চরিত্রগুলোকে। যারা আমাদের চোখে পড়ে না আজকাল, যারা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে বৃদ্ধি আর উন্নয়নের অঙ্কে। কোভিডকাল এসে তাদের আচমকা ভাসিয়ে তুলে আমাদের সাময়িক অস্বস্তিতে ফেলেছিল বটে - কিন্তু সে তো আমাদের নিজেদেরও উৎকণ্ঠার দিন, ভেসে ওঠা মুখগুলো সহমর্মিতার চাইতেও বেশি করে জাগিয়েছিল আতঙ্ক - আতঙ্ক এই, আমাদের হালও ওদের মতো হয়ে যাবে না তো!! জানলাম, এসব ছবির অনেকগুলোই কোভিডের সময়ে আঁকা - কিছু তার আগেও, আগে থেকেই। অর্থাৎ, কোভিডকাল নগ্ন করে দেখানোর আগেই শিল্পী এ জীবন দেখেছিলেন, দেখতে পেয়েছিলেন।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গ্যালারির সাদা দেওয়াল - আলোর চতুরতা - সব-অর্থেই স্যানিটাইজড পরিবেশ, - তার মধ্যে দেওয়াল জুড়ে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের এসব ছবি - বৈপরীত্য তো বটেই! কিন্তু, আর্ট গ্যালারিতে যারা যায়, সেই দর্শককুলের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে ছবির চরিত্র/বিষয়বস্তুর দূরত্বজনিত যতখানি স্বপ্নবিলাস, বাস্তব তার চাইতে খানিক দূর। কোভিডকালের অভিজ্ঞতা সে শিক্ষা দিতে পারত - সচেতন করতেই পারত - পাছে তেমনটি ঘটে বিপদ হয়, বাজার তড়িঘড়ি কাজ করতে শুরু করেছে, আমরাও ভুলতে শুরু করেছি। অরিন্দমবাবু মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, সম্ভবত। মনে যদি নেহাতই না রাখি, তবু ডকুমেন্টেশন করে রাখতে চেয়েছেন।
জানলাম, অরিন্দমদা প্রায় আমারই বয়সী। সামান্যই বড়। হিংসে হলো। নিজের ভাবনা এমন করে প্রকাশ করতে পারার দক্ষতা আমার নেই বলে নয় - কেননা, সবাই তো শিল্পী হতে পারে না, সে নিয়ে দুঃখ বা আক্ষেপ থাকতেই পারে, কিন্তু হিংসে নয় - কিন্তু সভ্যতার প্রসাধনের খোলস ছাড়িয়ে সত্যিটা এমন করে দেখতে পারি না কেন, হিংসেটা এখানেই।
তিনি এই প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন - Not a Dream Not Peace Not Love. স্বপ্ন নয় শান্তি নয় ভালোবাসা নয়
মানতে পারলাম না। মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা না থাকলে এ ছবি আঁকা যায় না।
ওই যে, "হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়", তা কি, কোনও এক সুদূর অর্থেও, প্রেম নয়!
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
prativa sarker
10 মাস আগেঅসম্ভব শক্তিশালী ছবি! প্রদর্শনী দেখতে পেলাম না এই দু:খ কিছুটা ঘুচল বিষাণ বসুর এই লেখায়।
সৌমেন বসু
10 মাস আগেশিল্পীর ব্যাপারে কিছুই জানা ছিলো না। আপনার লেখা পড়ে আগ্রহ হচ্ছে ওর ছবি দেখার। আপনি কয়েকদিন আগে জানালে, চলেই যেতাম। গত বুধবারই ফিরলাম কলকাতা থেকে।
Sourab Chakraborty
10 মাস আগেচমৎকার লেখা।
PRAJNA PARAMITA BHATTACHARJEE
10 মাস আগেসত্যি তো ফুল ফল লতা পাখির মসৃণ পর্দা সরিয়ে যদি উঁকি দেওয়া যায়,তবে বিনা রঙে সেখানে বসে থাকে অপদৃশ্য, আমাদের ভালোবাসা কেড়ে নেওয়া হন্তারক....কোভিডকালের চিত্রটি নিদারুণ সময়ের করুণ অসহনীয় বাস্তবতা,তৃতীয় ছবিটি ভয়াবহ জটিলতার সামনে দাঁড় করায়....ব্যবস্থার পচন হয়তো বা.... এই শিল্পীর ছবি সম্পর্কে জানতে পারা আর চাক্ষুষ করার সুযোগ যে তৈরি করলো তাকে শুভেচ্ছা।
তাপস ঘোষ
10 মাস আগেআমি বিষাণ মুগ্ধ এক পাঠক। প্রদর্শনীটার সম্পর্কে একটু আগে থেকে জানতে পারলে যেতুম।
শাশ্বতী লাহিড়ী
10 মাস আগেশিল্পী অরিন্দম চ্যাটার্জীর ছবি নিয়ে বিষাণ বসুর একটি সংহত ও সহজ সুন্দর ব্যাখ্যার লেখাটি পড়ে তৃপ্তি পেলাম। লেখক নিজেকে নগন্য বোধে ছবি কেন্দ্রিক নিজস্ব ভাবনাকেও উন্মুক্ত ভাবে প্রকাশ করেছেন জন্য ওনার লেখার অভিপ্রকাশ আরও সমর্থনযোগ্যতা পেয়েছে। একটা অমোঘ যে, সাহিত্য , শিল্প সবই সমকালীনতার মুখচ্ছবি। সমকাল, লেখক কিম্বা শিল্পীর ব্যক্তি মনন যে অভিঘাত তৈরি করে সেটাই তার তার সৃজনে মৌলিকরূপ নিযে আত্মপ্রকাশ করে। শুধুই কি কোভিড এর দূর্বহতা বা ক্ষয়ক্ষতি ? বর্তমানের সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় অস্থিতিস্থাপকতা কি আমরা সমকালীন মানুষকে অসহায়তা কিম্বা পরিত্রানকামিতায় ত্রস্ত ও নিরুপায় করে দিচ্ছে না ? এমতাবস্থায় শুধুই ললিত সাহিত্য কিম্বা শান্তি সমাহিত কোনো চিত্র দৃশ্য এর সামনে আমরা কি আদৌ নিত্য বাস্তবের সঙ্গে ওই কল্পজগতের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানে সক্ষম হতে পারব ! লেখাটির জন্য লেখক বিষাণবসু কে অভিনন্দন ।