অন্নপূর্ণা বসুর ‘স্বার্থপর’ এক অনন্য পারিবারিক গল্প, যেখানে ভাই-বোনের সম্পত্তি বিতর্কে উঠে আসে নারীর অস্তিত্ব ও অধিকারের প্রশ্ন। কোয়েল মল্লিকের অসাধারণ অভিনয় ও হৃদয়ছোঁয়া সংলাপে ছবিটি ছুঁয়ে যায় গভীর বাস্তবতা। নারী–পুরুষ উভয়ের ভাবনার দরজা খুলে দেবে এই সিনেমা।
মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে হবে। তাদের চাকরি করে স্বনির্ভর হতে হবে, বাড়ি ফিরে সংসার সামলাতে হবে, বাচ্চা মানুষ করতে হবে, সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে, আপদে বিপদে অনুষ্ঠানে বাড়িতে থেকে কুলবধূর কর্তব্যও পালন করতে হবে। এইসবই তাদের করতে হবে অনায়াসে, কারণ তারা মেয়ে। ছেলেদের জন্য এত শর্ত থাকে না কস্মিনকালেও। কিন্তু যদি, প্রথম শর্ত অর্থাৎ চাকরিটা সে না করে? হয়তো চাকরি থাকলেও সংসারের প্রতি দায়দায়িত্ব পালনের কারণে সে-চাকরি তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। হয়তো সন্তানের জন্ম, কিংবা বাড়ির সমস্যায় চাকরিটা টিকিয়ে রাখা যায়নি। কিংবা হয়তো শারীরিকভাবে দশভূজা না হতে পারার কারণে, কিংবা সঠিক সচেতনতার অভাবে চাকরি জিনিসটাই তার কখনও করা হয়ে ওঠেনি। তখন তার সামাজিক স্ট্যাটাস হয়ে দাঁড়ায় গৃহবধূ। অর্থ যা-ই হোক, সোজা কথায় যার কোনো নিজস্ব পরিচয় থাকতে নেই। এমনকি পৃথিবীর কোথাও একটা নিজের বাড়িও থাকতে নেই। যে বাড়িতে সে জন্মে থেকে বড়ো হয়েছে সেই বাড়িই এখন তার ভায়েদের সম্পত্তি। আর যে বাড়িতে সে বিয়ে হয়ে এসেছে সে-বাড়ি তার শ্বশুর শাশুড়ির পুত্রের। মেয়েটির নয়। সংসারে সমস্যা নেই বলে অনেকেই এ ব্যবস্থা মেনে নেন, কেউ কেউ অস্তিত্বহীনতায় ভোগেন, তবে তাতে সমস্যা মেটে না। মেয়েদের নিজেদের অস্তিত্ব তাহলে কোথায়? নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে সংসারের স্বার্থে গোটা জীবনটা দিয়ে দেবার পরও তাদের চিরকাল পরবাসী হয়ে থাকতে হয়। আবার যে শাশুড়ি তার পুত্রবধূকে বলেন পরের বাড়ির মেয়ে, সেই বাড়িতে তার নিজেরও বিশেষ অধিকার থাকে বলে মনে হয় না। সারাজীবন ‘আমার টাকা আমার বাড়ি’র বুলি শুনে জীবন কাটাতে হয় তাকেও। ভাই-বোনের মধ্যে সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গল্প বুনতে গিয়ে বেশ বড়ো প্রশ্ন তুললেন পরিচালক অন্নপূর্ণা বসু।
কালীপুজো উপলক্ষ্যে মুক্তি পেয়েছে কোয়েল মল্লিক, কৌশিক সেন অভিনীত ছবি ‘স্বার্থপর’। দুর্গাপুজোয় একাধিক বড়ো বাজেটের তারকাখচিত ছবি মুক্তি পাবার ফলে সাধারণত কালীপুজোয় খুব একটা ছবি মুক্তির চল দেখা যায় না। কারণ ছুটির মরশুমে পুজোর ছবিগুলো ভালোই ব্যাবসা করে। তবে এবার সেই মরশুমে বড়ো বড়ো চারটে ছবির যাত্রাপথেই রাস্তা কাটল ‘স্বার্থপর’। কারণ ভাইফোঁটাই এই ছবি মুক্তির আদর্শ সময়।
ছবির একটি পোস্টারে মাঝখানে ছিলেন কোয়েল, তাঁর পিছনে বাকি অভিনেতাদের দেখা যাচ্ছে সার দিয়ে। প্রথম দেখে একটু খটকা লেগেছিল। গল্প যেখানে ভাই-বোনের আপন স্বার্থরক্ষার সেখানে একা নায়িকা এগিয়ে কেন? কেন দু-জনেই সামনে নয়। এর উত্তর রয়েছে ছবির ভেতর। এই গল্পের প্রাণ অপর্ণা। তার আন্তরিকতা, সারল্য, প্রাণের টান ছাড়া এই গল্প হত না। তাই তাকেই তো পুরোভাগে রাখতে হবে। আর সেই ভূমিকায় অবাক করার মতো অভিনয় কোয়েলের। ‘পাগলু’, ‘মন মানে না’, ‘নাটের গুরু’-র মতো অগুনতি কমার্শিয়াল ছবির নায়িকা কোয়েল। সেই তিনিই সম্ভবত প্রথমবার এমন একটি অনাকর্ষণীয় ইমেজে নিজেকে মেলে ধরে এক সুন্দর ইমেজারি তৈরি করলেন, যা আগামীদিনে তাঁকে নিশ্চিতভাবে অন্য ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ করে দেবে। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে অপর্ণা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন কোয়েল।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
ছবির কাহিনি কলকাতার অনতিদূরে গঙ্গানগরে অপর্ণা ও তার দাদা সৌরভের (কৌশিক) বাবা মায়ের বসতবাড়ি ঘিরে। বিবাহিতা অপর্ণা এখন কলকাতায় তার স্বামীর বাড়িতে থাকে। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এত বড়ো বাড়ির দায়িত্ব সামলাতে না পেরে সৌরভ ঠিক করে দোতলার অংশ, যেখানে তার বোনের ঘর ছিল সেই অংশ হোমস্টেকে ভাড়া দিয়ে দেবে। কিন্তু তার জন্য অপর্ণাকে আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে হবে বাবা মায়ের বাড়ির ওপর তার আর কোনো অধিকার নেই। অপর্ণা রাজি হয় না। তার তো তাহলে নিজের বলতে কিছুই থাকবে না। এই দাবিতে স্বামী দেবর্ষিকে (ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী) খুব একটা পাশে পায় না সে। শুরু হয় একই মায়ের পেটের দুই সন্তানের আইনি লড়াই। সৌরভের পক্ষে দাঁড়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দুঁদে উকিল তারক সরখেল (অনির্বাণ চক্রবর্তী)। অপর্ণা নিয়ে আসে হাইকোর্টের যুধিষ্ঠির নামে পরিচিত গোবিন্দ কুমার লাহাকে (রঞ্জিত মল্লিক), যিনি আদালতে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলেন না। ভাই-বোনের সবচেয়ে কুৎসিত যুদ্ধ দেখতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সৌরভের স্ত্রী শালিনী (শাঁওলি চট্টোপাধ্যায়)। দুই পক্ষের যে-কোনো একজনের হার ছারখার করে দেবে বসু পরিবারের এতদিনের ঐতিহ্যকে। কোর্টে কেস চলাকালীন সওয়াল জবাবে একইসঙ্গে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে দুই ভাই-বোন। কী রায় দেবে জাস্টিস বেঞ্চ সেটা জানতে হলে যেতে হবে প্রেক্ষাগৃহে। তবে যুগ যুগ ধরে মেয়েদের সঙ্গে হয়ে আসা অন্যায়ের প্রতিবাদে ব্যারিস্টার লাহা কোর্টে দাঁড়িয়ে যা বললেন তা এই ২০২৫ সালেও অন্তত ভারতীয় উপমহাদেশের মহিলা এবং পুরুষদেরও শোনা এবং জানা উচিত। কারণ অধিকাংশ লোকে জানেই না মেয়েরা সংসারের জন্য ঠিক কী কী আর কতটা করে।
প্রথম ছবির বিষয় এবং কাস্টিং দুই ক্ষেত্রেই প্রশংসা প্রাপ্য পরিচালক অন্নপূর্ণার। কৌশিক সেনকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, তবু না বলে থাকা যায় না। নেগেটিভ চরিত্র তিনি আগেও করেছেন, কিন্তু এমন একটি সাদা কালো মেশানো রক্ত-মাংসের চরিত্রে দর্শকের মন কেড়ে নেবেন তিনি। রঞ্জিত মল্লিকের জিকে লাহার চরিত্রটি কিঞ্চিত আরোপিত লাগলেও অভিনয়ে আজও তিনি আগের মতোই অপ্রতিরোধ্য। চাঁচাছোলা ব্যক্তিত্বের সরখেলের চরিত্রে অনির্বাণ প্রতিবারের মতোই একেবারে আলাদা রূপে। যদিও শেষ দৃশ্যে চরিত্রটিকে অন্যভাবে দেখানোর প্রচেষ্টা না থাকলেও চলত। এ ছাড়া অবশ্যই উল্লেখ্য শালিনীর চরিত্রে শাঁওলি চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়। কোনোরকম অতি অভিনয় না করেও দর্শকের মনে আলাদাভাবে জায়গা করে নেবেন তিনি। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে ছবির দুটি গানই শ্রুতিমধুর। ছবির চিত্রগ্রহণ পুরোনো বাঙালিয়ানা মনে করিয়ে দেয়।
যদিও বাস্তবে পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যা ও আইনি বিবাদ দীর্ঘদিন ধরে হয়ে চলা এক তিক্ত অধ্যায় হয়েই থেকে যায়, এতটা আন্তরিকতা, মনের টান সেখানে থাকে না। তবু কিছু চিরাচরিত ভালো লাগার ফ্রেম, বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ দর্শককে ছবির মূল বক্তব্যের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। উত্তরাধিকার যেমন সকলের সমান তেমন বাবা মায়ের দায়িত্বের ক্ষেত্রেও সমান অধিকারের কথাটা মেয়েদের ভেবে দেখা দরকার। বিয়ে করে অন্য সংসারে চলে যাওয়া মানেই বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব কমে যায় না। বিশ্বব্যাপী স্মার্টনেস তৈরির দৌড়ে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক অত্যন্ত জোরদার বার্তা দিতে চেয়েছেন পরিচালক। ভরপুর বিনোদনের পঙ্ক্তি থেকে বেরিয়ে এসে ছিমছাম সুন্দর বাঙালিয়ানায় মোড়া ছবি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য অন্নপূর্ণা বসুর।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।


