এখন প্রতীক্ষা, মিষ্টি তার কালি শেষ হয়ে যাওয়া পেন দিয়ে একটা চিঠি লিখবে। তারপর ঠিকানা না লিখে পোস্ট করে দেবে লেটার বক্সে। যার চিঠি তার চিন্তা। প্রতীক্ষা, কবে না জানি সে-চিঠি এসে পৌঁছায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি সে-চিঠি কোনোদিন আসবে না। ‘ফিরভি তু ইন্তেজ়ার কর সায়দ’, একটা গজ়লের কলি মনে এল তাই লিখে রাখলাম। ভুলে না যাই। মিষ্টি তেমনই বসে আছে তার শেষ হয়ে যাওয়া পেন নিয়ে। কেউ বসে আছে একটা অবাস্তব চিঠির জন্য। কেননা এখন আর তেমন কলেজ যেতে মন চায় না। মন কেমন যেন মরে গেছে। জানে মরেনি। মরেছে আত্মায়। একটা পুরোনো মৌসুম এসেছে। ইয়াদ এসেছে ভোরের বাতাসে। কী যেন একটা গজ়লের কলি। কার মনে পড়ে না। অথচ...
বাবা কি কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন নাকি? যখন জানতে চাই, বলেছিলেন, না না, বললি যে দাঁড়িয়েছিলেন তাই জিজ্ঞাসা করছি। আচ্ছা কার্তিক কেন যায়?
—জানি না, তবে তার যাওয়া-আসা আছে সেটা বোঝা যায়।
—আমার বিজ়নেসের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে?
—বাবা, তুমি এদের কাছে যাবে?
—তুই কেন গেছিলি?
—আমার আর কী, চাকরি-বাকরির যদি কিছু সুরাহা করা যায়। তাই আর কি।
—তাহলে আমি যদি ব্যাবসাটাকে দাঁড় কড়াতে পারি তো মন্দ কি।
—ও আচ্ছা। তাহলে যেও।
ঘরের একটা কেন্দ্রবিন্দুতে মনে হয় দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমাকে মধ্যে রেখে সব যেন ঘুরে যাচ্ছে। সবকটা দেয়াল আরও আরও দূরে চলে যাচ্ছে। আমি আর সেই পাথরখানি রয়েছি মাঝে। আচমকা মনে হল এই হয়তো সাড়ে-সাতি। আমার শুরু হয়েছে, যেখানে সব উলটে যাবে। কিন্তু এখন তো কাজ-বাজ নয় দেখছি মানুষগুলোই উলটে যাচ্ছে। তাহলে?
বেল বাজল। ছুটে গেলাম। কিন্তু আমি ছুটে গেলাম কীকরে জানি না। দরজায় কার্তিক আর বিপ্লবদা। আমাকে জিজ্ঞাসা করল। এতক্ষণ বেল বাজাচ্ছি কোথায় ছিলি?
—কিন্তু আমি তো একবার মাত্র শুনলাম।
—একবার?
—হ্যাঁ, আমি তো ছুটে এলাম।
—ছুটে এলি?
—তাই তো।
—কাকু আছেন?
—বাবা ছিল কিন্তু এই কোথায় যে বেরিয়ে গেল। আর দেখছি না।
—বিপ্লবদা একটা কথা বলব।
—কী কথা?
—আমাকে কিছুদিন ছুটি দাও। আমি খুব একটা ভালো নেই?
—ছুটি, এটা কোনো চাকরি নাকি, যে ছুটি চাইবি। এটা তো তোর কাজ। আমার কাজ। তোর বাবার কাজ। এখানে কে কাকে ছুটি দেবে?
—বাবাকে নিয়ে যাও। আমি কিছুদিন পরে যাব।
—কাকুকেই তো খুঁজতে এসেছি। আমাকে ডাকলেন। আর তোকে বললাম একজনকে দে।
—একজন আছে তো। নিখিলদাকে মনে পড়ে?
—নিখিল? মানে?
—বুকুদাকে ভুলে গেলে?
—না ভুলে কেন যাব। আসলে অনেকদিন কোনো খোঁজখবর নেই তো তাই। বকুলদি আছেন?
—আছেন, যাবে?
—না থাক। তুই যা। কিন্তু এখন তোর বাবা কেন ডাকল?
কার্তিক বলল, আমাকেও ডেকেছে। বলল আমার সেই কাকার কাছে যাবে। হরিপুর।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
আমরা তিনজন বসে বসে বাবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাবা এলে আমি জিজ্ঞাসা করব, আমাকে ফেলে কোথায় গেছিলে? বিপ্লবদা জিজ্ঞাসা করবে, কেন ডেকেছেন? আর কার্তিক জিজ্ঞাসা করবে কেন আবার হরিপুর।
বসে আছি তিনজন। একভাবে বসে আছি। হঠাৎ মনে হল আরে এরা তো আমার সামনে সোজাভাবেই বসে আছে। উলটে যাচ্ছে না। তাহলে কি এরা সেই এফেক্ট থেকে বাইরে। না কি এদের সাথে আমার কোনো আত্মিক যোগ রয়েছে। তাই হয়তো হবে। কিন্তু বাকিরাও তো আপন, তাই না।
মিষ্টি যেভাবে আপন ছিল। আপন ছিল আমার স্কুলবেলার খেলার মাঠ। মাঠের মাঝ দিয়ে বকুল পিসির হেঁটে চলে যাওয়া। আমাদের কিছুক্ষণ বলত থামতে, আমরা থেমে থাকতাম। নাহলে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। বকুল পিসির সাথে আরও জনা পাঁচ কী ছয় জন মহিলা হেঁটে যেত। তারাও কি আপন ছিল না বকুল পিসির। বা অমিয় স্যার। সে কি আপন ছিল না রোহিণীর।
আপন শব্দটার পাশে আরও এক সন্দেহের বোন বসে থাকে। কোনো তুতো বোন হবে। না বলে চলে এসেছে। তারপর ভাগ বসিয়েছে বিশ্বাসে। একটু একটু করে কেড়ে নিয়েছে ঘর সংসার। ভাগ হয়ে গেছে স্বামী সন্তান। সবারই মাঝে কোনো-না-কোনোভাবে এই বোন বসে আছে। নিজেকে উচ্ছন্নে যেতে দিতে চেয়ে, সব সুখ যেন উচ্ছেদ করে বসে আছে গহন রাতের বিছানায়। বসে আছে বকুল পিসি। শুয়ে আছে তার বর। অনেক অনেক দিন পরে সে হয়তো কথা বলেছে স্ত্রীর সাথে। শুনেছে ছেলে। কিন্তু তার এখানে অনধিকার তাই, শুধু তাই সে দূরে রেখেছে নিজেকে। দূর থেকে দেখেছে, বাবা বহুদিন পরে বাবা হয়ে সংসারের মন্দ-ভালোর মাঝে একটা পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপর বহুদিন পর, কোম্পানির ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে বকুল পিসি দাঁড়িয়েছে এক তিনমহলা বাড়ির সামনে। সেখানে এক বিশাল লোহার গেট রয়েছে। সে-গেটে দারোয়ান থাকে। যার কাছে ফোন রয়েছে। এখন বলে ইন্টারকম, তখন অত-শত জানতাম না। জানতাম গেট থেকে ফোন করতে হয়। তাহলে দরজা খোলে। বকুল পিসির পরবর্তী যারা ছিল তাদেরই একজনের ঘর। অবশ্য তারা এখানে স্থানীয়। জায়গাজমি ছিল আগে থেকে। বকুল পিসি কোনো একটা কারণে দারোয়ানকে বলেছে, সে এসেছে। দারোয়ান ফোন করে দিয়েছে ভিতরে। এখন প্রতীক্ষা...
এখন প্রতীক্ষা, মিষ্টি তার কালি শেষ হয়ে যাওয়া পেন দিয়ে একটা চিঠি লিখবে। তারপর ঠিকানা না লিখে পোস্ট করে দেবে লেটার বক্সে। যার চিঠি তার চিন্তা। প্রতীক্ষা, কবে না জানি সে-চিঠি এসে পৌঁছায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি সে-চিঠি কোনোদিন আসবে না। ‘ফিরভি তু ইন্তেজ়ার কর সায়দ’, একটা গজ়লের কলি মনে এল তাই লিখে রাখলাম। ভুলে না যাই। মিষ্টি তেমনই বসে আছে তার শেষ হয়ে যাওয়া পেন নিয়ে। কেউ বসে আছে একটা অবাস্তব চিঠির জন্য। কেননা এখন আর তেমন কলেজ যেতে মন চায় না। মন কেমন যেন মরে গেছে। জানে মরেনি। মরেছে আত্মায়। একটা পুরোনো মৌসুম এসেছে। ইয়াদ এসেছে ভোরের বাতাসে। কী যেন একটা গজ়লের কলি। কার মনে পড়ে না। অথচ...
ভোরের বাতাস দেখিয়েছে ছোট্ট রোহিণী যখন সে রানি ছিল বাবার কোলে। বাবা তাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে চলে যেত পুরোনো ঠাকুর বাড়ির পিছন দিয়ে সেই আমাদের গ্রাম। অমিয় স্যার কোনোদিন তার গ্রামের নাম বলেনি, এভাবেই বলত আমাদের গ্রাম। আমাদের তাই শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছিল। আমাদের গ্রামে একটা প্রাচীন শিবতলা রয়েছে। সেখানে রয়েছে প্রচুর সাপ। তারা বাস্তু। ক্ষতি করে না। বরং তারা আশীর্বাদ করে। তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। সন্তান দুধে ভাতে আছে। আছে স্বামী সোহাগে। স্বামী এখন তার দুধ খায়, বুড়ো মানুষের শেষ সাহারা। আহা কত না কষ্ট...
ফিক করে মুখ দিয়ে একটু হাসি বেরিয়ে এল। ওঃ রোহিণী, তুমি না দিলে মুক্তি না দিলে মৃত্যু।
বিপ্লবদা কার্তিকের দিকে তাকাল, কার্তিক আমার দিকে। আমি সেই জানালা দিয়ে দেখতে থাকলাম। বাবা আসছে কি না।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন