ধর্মেন্দ্র আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যু কেবল এক নায়কের বিদায় নয়—ভারতীয় পুরুষত্বের এক যুগের পতন। মাটির গন্ধ, কৃষি-শিকড়ে গাঁথা শক্ত দেহ, নৈতিক নায়কত্ব—সব মিলিয়ে ধর্মেন্দ্র ছিলেন বলিউডের ‘শেষ পুরুষালি নায়ক’। এই প্রবন্ধ তুলে ধরে তাঁর পুরুষত্বের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের গভীর বিশ্লেষণ।
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুর পরে অনেকেই বলবেন একটি যুগের অবসান হল অথবা চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বুঝবেন—৮৯ বছর বয়সে এসে ধর্মেন্দ্রর আর কী দেওয়ার ছিল? কিছুই না। আরও বেশি দিন বাঁচলে হয়তো তার পরিবারের ভালো লাগত, কিন্তু আমরা কি পেতাম? কিছুই না। এই চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বরং আমি ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুটাকে একটু অন্যরকমভাবে দেখার চেষ্টা করছি। এ প্রবন্ধ বা নিবন্ধ তারই প্রস্তাবনা ।
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুর পরে অনেকেই বলবেন একটি যুগের অবসান হল অথবা চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বুঝবেন—৮৯ বছর বয়সে এসে ধর্মেন্দ্রর আর কী দেওয়ার ছিল? কিছুই না। আরও বেশি দিন বাঁচলে হয়তো তার পরিবারের ভালো লাগত, কিন্তু আমরা কি পেতাম? কিছুই না। এই চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বরং আমি ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুটাকে একটু অন্যরকমভাবে দেখার চেষ্টা করছি। এ প্রবন্ধ বা নিবন্ধ তারই প্রস্তাবনা ।
প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু আমাদের সেই সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড়ায়, যেখানে ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু কেবল একজন অভিনেতার মৃত্যু নয়, বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক শরীরের বিলুপ্তি; যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল বিশেষ ধরনের পুরুষালি নন্দনতত্ত্ব—হতে পারে সেই পুরুষালি নন্দনতত্ত্ব হলিউড স্টাইল-মার্কা, কিন্তু কৃত্রিম নয়। তাঁর শরীর বিভঙ্গ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ধর্মেন্দ্রর পুরুষালি নন্দনতত্ত্ব, সুঠাম দেহের গন্ধ—এটি তাঁর সমকালে একমাত্র কবীর বেদি ছাড়া আর কারোর মধ্যে ছিল না। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ যখন আন্তর্জাতিক মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছিল, সেই সময় তরুণ যুবক-যুবতির কাছে ধর্মেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন এক নতুন পুরুষালি আইকন। ভারতের প্রথম ম্যাসক্যুলিন হিরো, উলটোদিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে “রাজনৈতিক কৃষক পুরুষের যে ইমেজ আমাদের মনস-পটে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, সেখানে ধর্মেন্দ্র আনলেন এক নতুন রিপ্লেসমেন্ট। নায়ক ধর্মেন্দ্র পুরুষত্বের এক নতুন ভাষা প্রতিষ্ঠা করলেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে—মুম্বাইয়ের আকাশে অনেক তারকা এসেছেন, এবং অনেক তারকা আসবেন। কিন্তু ধর্মেন্দ্র ছিলেন এমন এক স্টার, যাঁর স্টার-ইমেজ সরাসরি দেশের গ্রাম, ভাষা ও পুরুষের আত্মপরিচয়ের ভিতর ঢুকে পড়েছিল। আজ তাঁর মৃত্যু আমাদের সেই ব্যক্তিগত স্মৃতির ভেতরে নিয়ে যায়, যা এতদিনে আর্কাইভ হয়ে গেছে আমাদের রক্তের ভেতরে আলো আর ছায়ার রিলে।
ভারতীয় Masculinity–র দীর্ঘ ডায়াসপোরা এবং ধর্মেন্দ্রর অবস্থান
ভারতীয় পুরুষত্বের যে-সমস্ত ধারণা ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ সেন্সাস থেকে শুরু হয়ে পোস্ট ইনডিপেনডেন্স সিনেমা পর্যন্ত বিস্তৃত, ধর্মেন্দ্র ঠিক সেই ধারার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক ধরনের agrarian masculinity কৃষি ভিত্তিক, অলংকারহীন, শরীরকেন্দ্রিক ও আত্মবিশ্বাসী পুরুষত্ব-র প্রতিনিধি। ধর্মেন্দ্রর স্টাইল অফ ট্রিটমেন্টে “ঢং দেখানো” ছিল না, বরং দেহ-দেখানো পুরুষ। এই masculinity এমন এক যুগে তৈরি হয়েছিল যখন ভারতবর্ষের কৃষি–উৎপাদনশীলতা জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে উঠে আসছে। ফলে ধর্মেন্দ্রর শক্তিশালী শরীর, পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত ইমেজ এবং uncomplicated courage—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এক ধরনের post-Green Revolution hero। তার মধ্যে আমরা কখনোই রাজেশ খন্নার রোম্যান্টিকতা কিংবা অমিতাভ বচ্চনের angry urban angst পাইনি। কিন্তু এই দুয়ের মাঝখানে ধর্মেন্দ্র ছিলেন rooted masculinity-র জনক; যেখানে গ্রামের ছেলেটি শহরে এসে তার দেহ, নৈতিকতা এবং সংবেদনশীলতা দিয়েই পৃথিবীকে জয় করে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে আমাদের বাঙালিয়ানায় ঘেরা শ্রী অপূর্ব কুমার রায়ের “নিশ্চিন্দিপুর থেকে শহর কলকাতায়” আসার যে ইন্টেলেকচুয়াল রূপান্তর বাঙালির মননে আলোড়িত করেছিল, ধর্মেন্দ্র সেই দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ। সেই কারণে ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে ধর্মেন্দ্র কোনো বিশেষ গুরুত্ব পাননি। অবশ্য একই বিপ্রতীপে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন নিকটবর্তী উত্তম কুমারের সাথে, যখন শাপমোচন সিনেমার নায়ক উত্তম কুমার গ্রাম থেকে শহরে এসে যে জয়পতাকা তুলে দেন আর রাতারাতি বক্স অফিস বাজিমাত করেন। ঠিক তেমনি নায়ক ধর্মেন্দ্র মুম্বাইয়ের ঘরানার সিনেমায় গ্রাম থেকে শহরে উঠে এসে তাঁর rooted masculinity দেখিয়ে জয় করেন আপামর ভারতবাসীকে। এখানেই তাঁর সার্থকতা।
Star Personality — Romantic থেকে Action: দুই মেরুর একটি বিরল synthesis
ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারকে মোটামুটি আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি, এবং তিনি একমাত্র হিন্দি তারকা, যিনি full-spectrum masculinity ধারণ করে ছিলেন।
(ক) Romantic Masculinity (1960s)
Anupama, Satyakam, Chupke Chupke—এই ধরনের সিনেমাগুলোতে আমরা এমন এক নায়ককে দেখতে পাই, যিনি চোখ দিয়ে প্রেম করেন। তাঁর মুখের কোমলতা এবং শরীরের কঠোরতা একসঙ্গে দর্শককে টেনে আনে প্রতিটি বক্স অফিসের সাফল্যের দিকে।
Film scholars মনে করেন, ধর্মেন্দ্রর অভিনয়ের মধ্যে ছিল এক ধরনের soft-tough duality।এখানে ধর্মেন্দ্র দেব আনন্দ বা রাজেশ খন্নার মতো “urban romantic” নন; তাঁর রোম্যান্টিসিজম ছিল খেত-খামারের ধুলো-মাখা অথচ ধীর, সংযত ও নির্ভরযোগ্য ভালোবাসার।
(খ) Action Masculinity (1970s)
৭০-এর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জরুরি অবস্থার পরে ভারতের সিনেমায় যে hyper masculine system-defying male body উঠে আসে, তার অন্যতম মুখ ধর্মেন্দ্র। Sholay-র ভিরু—শারীরিক, হাস্যরসাত্মক, সাহসী এবং রাগহীন বীরত্বের প্রতীক।Yaadon Ki Baarat, Dharam Veer—এইসব ছবিতে তিনি হয়ে ওঠেন athletic heroism-এর মুখ। অমিতাভ বচ্চনের রাগ-নির্ভর masculinity-র বিপরীতে ধর্মেন্দ্রর masculinity ছিল calm strength—যা ভারতীয় মধ্যবিত্ত পুরুষের কাছে আরেক ধরনের স্বস্তিজনক ন্যারেটিভ।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
Masculine Body as Cultural Text: ধর্মেন্দ্রর শরীরের রাজনৈতিকতা
হিন্দি সিনেমায় পুরুষদেহ কখনও নিছক দেহ নয়; এটি জাতীয় কল্পনার পাঠ্যবই। ধর্মেন্দ্রর muscular frame ও পরবর্তী কালের “natural body”—এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের দ্রুত পরিবর্তনশীল দেহ রাজনীতিতে নতুন ভাষা তৈরি হয়। তিনি আজকের সালমান খান বা ঋত্বিক রোশনদের মতন gym-made hero নন; বরং ছিলেন field-made hero। তাঁর masculinity ছিল non-toxic—আক্রমণাত্মক নয়, বরং প্রোটেকটিভ—মানবিক শক্তির এক নিরাভরণ রূপ। Cultural studies-এর পরিভাষায়, ধর্মেন্দ্র ছিলেন subaltern masculinity-র aspirational projection, যেখানে গ্রামের ছেলেরা তাঁদের বাস্তব দেহকে স্ক্রিনে অল্প ফরমায়েশে দেখে স্বপ্নবান হত।
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু: Iconic Vacancy এবং Masculinity Shift
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু এমন এক সময়ে আসে, যখন বলিউডের masculinity পুরোপুরি রূপান্তরিত। আজকের masculinity—metropolitan, stylised, gym-sculpted। তার তুলনায় ধর্মেন্দ্রর masculinity ছিল lived-body, unmanicured, আকরিক। ফলে তাঁর মৃত্যু কেবল এক পুরোনো নায়কের সমাপ্তি নয়—বরং বলিউড পুরুষত্বের agrarian to-urban রূপান্তরের চূড়ান্ত পর্ব।
The Masculine Gap: একটি শূন্যতা কেন তৈরি হল?
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুতে যে nostalgia তৈরি হয়—বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গে—তা কেবল সিনেমার জন্য নয়; এটি এক সামাজিক শ্রেণির স্থানচ্যুতি ও cultural belonging হারানোর শোক। গ্রামীণ পটভূমি থেকে উঠে এসে সফল হওয়া, সৎ থাকা, শরীর ও নৈতিকতার সমতা—এই পুরুষ-ইমেজ আজ বলিউডে নেই। ফলে ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু মানে সেই পুরুষত্বের ইতিহাসও museum exhibit হয়ে ওঠা।
সিনেমাটিক মিথোলজি: Veeru-Jai ও male bonding-এর নতুন ছক
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুর পর যে ছবি সবচেয়ে বেশি ফিরে আসে, তা হল Sholay। কারণ, ভারতের male friendship trope—যা পরে Dil Chahta Hai বা Zindagi Na Milegi Dobara-র মতো চলচ্চিত্রে পুনরায় দেখা যায়—তার মূল ডিএনএ ভিরু-জয়ের মধ্যেই নিহিত। ভিরুর হাসি, দুঃসাহস, প্রেমে কঠোরতার অভাব—এই সংমিশ্রণ masculine tenderness-এর আদর্শ রূপ। ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু যেন এই মিথোলজির ওপর একটি কালো দাগ টেনে দেয়—যেন বন্ধুত্বের পুরোনো রূপটিও শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
ভারতীয় সিনেমার rural hero
আজকের হিন্দি সিনেমা সম্পূর্ণ শহুরে; আধুনিক মধ্যবিত্তের উদ্বেগ—কর্পোরেট চাকরি, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, মানসিক স্বাস্থ্য—এসব নিয়েই কাহিনি নির্মিত হয়। ধর্মেন্দ্র ছিলেন এমন যুগের শেষ প্রতিনিধি, যেখানে তিনি—গ্রামের রাস্তা, খাদ-খণ্ডিত খামার, মাটির গন্ধ, এবং সোজাসাপটা পুরুষত্বকে স্ক্রিনে এনেছিলেন। আধুনিকতার দৌড়ে হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় পুরুষের শিকড়-সংলগ্নতা ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুতে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু জেগে থাক Anupama সিনেমায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ধর্মেন্দ্রর লিপে—
“ইয়া দিল কি শুনো দুনিয়া ওয়ালো,
ইয়া মুঝকো অভি চুপ রহনে দো…”
এই ব্যারিটোনিয় নীরবতায় আমরা খুঁজে পাই আদি বলিউড ঘরানার শেষ ম্যাসক্যুলিন নায়কের সমাপ্তি চিহ্ন। সেখানেই তাঁর জয়, তাঁর স্থানাঙ্ক নির্ণয় হয়ে যায়।
শেষ কথা
এই নিবন্ধের শেষ লগ্নে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক—ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু কি আসলে এক সংস্কৃতির পরিসমাপ্তি? অবশ্যই বলব—হ্যাঁ। কারণ তিনি শুধুমাত্র একজন অভিনেতা ছিলেন না—তিনি ছিলেন ভারতীয় সমাজের পুরুষালি আত্মপরিচয়ের অন্যতম ভিত্তি। তাঁর মৃত্যু সেই ভিত্তিকে স্মৃতিতে পরিণত করেছে। হিন্দি সিনেমা আর কখনোই ধর্মেন্দ্রর মতন সেই ধরনের পুরুষ দেহ, সেই নৈতিক শরীর, সেই রোম্যান্টিক শিষ্টতা ফিরে পাবে না।
ধর্মেন্দ্র চলে গেলেন; কিন্তু নিয়ে গেলেন অনেক কিছু—দিয়ে গেলেন তার চেয়েও বেশি। তাঁর শরীরী পুরুষত্ব যা একসময় ভারতীয় মধ্যবিত্তের রক্তসঞ্চালনে মিশে গিয়েছিল—যা এখন থাকবে history, archive এবং myth-এর ভেতর এক অমোঘ শূন্যতায়।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।


