preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
ব্যবচ্ছেদ: পর্ব ৬
ধারাবাহিক

ব্যবচ্ছেদ: পর্ব ৬

ঝলসানো জীবন। সবারই আছে। কেউ কেউ সেই জীবন কেটে কেটে নুন লঙ্কা মিশিয়ে ক্যাম্প ফায়ার করে। কেউ কেউ সে-জীবন নিয়ে নীলকণ্ঠের মতো মিলিয়ে যায় অনন্তে। কেউ আবার কাঁধে করে গোলকধাঁধায়। একটা পারাবার, ‘এক আগুনের নদী আছে আর ডুবে ডুবে পার হতে হবে’। নদী পার হতে হতে কোনোদিন নিজেকে একটা দরজার সামনে পাব। সে জানি। কিন্তু সে-দরজা কোনো ব্রথেলের হবে, না মন্দিরের তা জানার জন্যই বেঁচে থাকা।

ছয়

ঘরের কথা যখন এল তখন বলি। আমি কার্তিক, মিষ্টি আর আরও দু-জন ছেলে, আমরা সেই কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়িতে বাইরের ঘরে বসে আছি। তখন ফাস্ট ইয়ার। পিয়োর সাইন্স, কেমিস্ট্রি, বোরিং সাবজেক্ট। তখনও রোহিণী আসেনি। মানে জীবনে। যদিও জীবন বলতে তো তখন সবেমাত্র মিষ্টির পাশে বসা। যদিও সে জানে একঝলক যখনই রোহিণী পেরিয়ে যাবে তখনই এই ছেলেগুলো কেমন যেন আনমনা হয়ে তাকিয়ে দেখবে নিজেদের। সে তখন একবার তার স্থূল কোমরের কথা ভাববে। যার সাথে রোহিণীর কোমরের কোনো মিল নেই। বুক দু-খানি মিষ্টির মিষ্টি কিন্তু তাও ঠিকঠাক মানানসই নয়। তারা আবার দেখতে গেলে নিজেদের হীনমন্যতায় ভোগে। ভাবে কখন না জানি সবাই জেনে যায় তার খোলস ছাড়া চেহারা। তাহলে আর কী, যে-দিকে দু-চোখ সবার, সেদিকেই তাকিয়ে মনে মনে বলা, বাল।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

রোহিণী ভিতরে চলে গিয়েছে। মাস্টার ভিতর থেকে এখনও আমাদের পড়াতে আসেনি। আমরা বসে বসে নিজেদের মাঝে গুলতানি চালিয়ে যাচ্ছি।
অমিয় স্যার নিশ্চয়ই এত কিছু জানেন না। জানলে অবশ্যই উনি একটা বাঁধা রাখতেন। কিছু না হলে আরও সময় রোহিণী পেত। যখন সত্যিকারে তার মাথায় ভূত চেপে ছিল। আর আমরা ভাবছিলাম এত প্রতিষ্ঠিত প্রফেসর যখন, তখন এইসব থাকতে বাধ্য। যদিও কেমিস্ট্রি বাবুর পলিটিকাল গ্রাউন্ড বেশ পোক্ত ছিল। পলিটিক্স ওঁর রক্তে।
আমাদের সাথে আরও যে ক-জন ছেলের যোগাযোগ ছিল তাদের মধ্যে একজনের কথা এখন না বললে এ-গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অবশ্য সে-ছেলের নাম আর নাই-বা নিলাম। সে-ছেলে এখন যে কোথায়, সে আর জানা যায়নি। বা হয়তো আমি নিজেই আর তার খোঁজ রাখতে চাইনি। কেন? তা বলার জন্যই লেখা।

তাকে দেখে একটু পিছিয়ে পড়া ঘরের মনে হত। সামান্য দুটো টাকাও তার কাছে প্রায় থাকতই না। আবার গুটখা খাওয়ার নেশা ছিল খুব। আমার কাছে একটাকা, দু-টাকা ধার চেয়ে মাঝে মাঝে গুটখা কিনে খেত। ধার যখন বেড়ে বেড়ে চার কী পাঁচ টাকায় দাঁড়িয়েছে তখন কে জানে কোথা থেকে ফেরত দিত আমায়। আমি সেদিন মিষ্টি কার্তিক আর তাকে নিয়ে রিকশা করে কলেজ থেকে স্টেশন ফিরতাম। রিকশাভাড়া ছিল সাত কী আট টাকা। আমি একাই দিতাম পাঁচ টাকা। দিলদরিয়া যাকে বলে। মিষ্টি এপ্রিসিয়েট করত। তাকে মাঝে বসিয়ে দু-দিকে দু-জন বসে যখন ফিরতাম তখন সেই ছেলেটি রিকশাওয়ালার সিটের উলটোদিকে পিছন ফিরে বসত। রিকশাওয়ালার অবস্থা করুণ। কখনো সে টানছে কখনো প্যাডেল করছে। আর যখনই সে টানছে তখনই দেখি সেই ছেলেটিও পিছন থেকে ঠেলছে। আমরা তাকে ইয়ার্কি করে হেঁইয়ো হেঁইয়ো বলে যাচ্ছি। এক সময় যখন স্টেশনে এসে দাঁড়াচ্ছি, সে-ছেলে দেখি আমাদের জন্য জায়গা রাখবে করে ছুট দিচ্ছে ভিতরে।

এমনই ছিল সে, যাকে আর মনে করতে গেলে কেমন যেন মন চুপ মেরে যায়। মন চুপ মারা কাকে বলে জানেন তো? মন চুপ মারা মানে সময়টা দাঁড়িয়ে যাওয়া। একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে বুঝতে না-পারা, কোন দিকে যাব? কোন দিকে মোর পোড়া ঘর। তা যখন ঘরপোড়া তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা প্রতিজ্ঞা করা খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু কঠিন হল প্রতিজ্ঞাটা কী সেটা জানানো। প্রতিজ্ঞাটা ছিল, আমি আর কোনোদিন ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব না, ওই পথ ওই রাস্তা চিরতরে আমার জন্য বন্ধ। নিজেই বন্ধ করেছি।
কিন্তু তার প্রেক্ষাপট?
বলি

সময় এগিয়ে গিয়েছে কিছুদিন। রোহিণীও এগিয়ে গিয়েছে। এখন অমিয় স্যার সারাদিন সেই যে বললাম চুপ মেরে যাওয়া, তেমনই চুপ মেরে বসে থাকে পড়ানোর ব্যাচে। ছাত্ররা আসে। কিছুক্ষণ বসে থাকে। স্যার কিছু একটা নোট লিখতে দিয়ে চলে যায়। আমরাও কলেজ যাই আসি। মাঝে পড়ে থাকে আমাদের মাঝের হাসিঠাট্টা। আমরা কি খুব বেশি কেরিয়ার কনশাস হয়ে পড়েছি? হাসি পায়, তখনকার ছাত্র আর এখনকার ছাত্রদের মাঝে কত তফাত। তেমনই একদিন, ট্রেনে করে আসছিলাম কী যাচ্ছিলাম মনে নেই, সেই ছেলেটি আমার পাশেই ছিল। আমার হাতে আমার গল্পের ডাইরি ছিল, সে-ছেলে দেখেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার লেখা? বলেছিলাম, হ্যাঁ। সে তখন একটা গল্প পড়েছিল সেখানে থেকে। বলেছিল, প্রকাশ করতে দিস না? বলেছিলাম কোথায় দেব, সেটাই জানি না। সে জানিয়েছিল, আরে তোদের কেমিস্ট্রি স্যারকে দিয়ে আয়। উনি একটা ম্যাগাজিন দেখেন। আমি বললাম, সত্যি? তা সেই গল্পটিই দিয়ে এসেছিলাম ম্যাগাজিনের জন্য।

তারপর আবার পেরিয়ে গিয়েছে কয়েক মাস। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার টেস্ট হয়ে গেছে। কিছু ছেলেকে টেস্টে অ্যালাও করা হয়নি। তার মধ্যে সেই ছেলেটিও রয়েছে। এবং তাকে কেমিস্ট্রিতেই আটকে দিয়েছে। তার অভিযোগ যেহেতু সে আমাদের কেমিস্ট্রি স্যারের কাছে টিউশনি পড়ে না, তাই তাকে অ্যালাও করা হয়নি।

আমাদের কলেজ যাওয়া কিছুটা কমে এসেছে। সামনে পরীক্ষা, কিছুটা তৈরি না হলে কি হয়? তাও কিছু একটা কারণে অনেকদিন পরে কলেজে গিয়েছি। সেই ছেলেটিও গিয়েছে, সে কেমিস্ট্রি স্যারকে ধরবে। তাকে কেন অ্যালাও করা হয়নি। এবং এই সব ঘটনাক্রমে সেদিন মাঠে আমার সাথে দেখা।
—আরে তোরা তো এখন আর আসিসই না।
—আর আসা হয় না, পড়ার চাপ রয়েছে যে।
—সেই, আমাকে তো অ্যালাও করছে না, তোদের স্যার।
—আমাদের মানে?
—মানে একদিন দেখাব। আচ্ছা তুই কি সেই গল্পটা দিয়েছিলি?
—দিয়েছিলাম তো। কিন্তু কেন বলতো? পত্রিকাটা পেয়েছিস?
—তোর গল্পটা অন্য একটা মেয়ের নামে ছেপেছে।
—কী?
—ইয়েস, মাই ফ্রেন্ড, অন্য একটা মেয়ের নামে, কেমিস্ট্রি অনার্স থার্ড ইয়ার। তোর স্যারের ভাইঝি কী ভাগনি হবে।

ঝলসানো জীবন। সবারই আছে। কেউ কেউ সেই জীবন কেটে কেটে নুন লঙ্কা মিশিয়ে ক্যাম্প ফায়ার করে। কেউ কেউ সে-জীবন নিয়ে নীলকণ্ঠের মতো মিলিয়ে যায় অনন্তে। কেউ আবার কাঁধে করে গোলকধাঁধায়। একটা পারাবার, ‘এক আগুনের নদী আছে আর ডুবে ডুবে পার হতে হবে’। নদী পার হতে হতে কোনোদিন নিজেকে একটা দরজার সামনে পাব। সে জানি। কিন্তু সে-দরজা কোনো ব্রথেলের হবে, না মন্দিরের তা জানার জন্যই বেঁচে থাকা।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু খুলছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু। কিন্তু ভিতর থেকে কথা বলার শব্দ কানে আসছে। অথচ দরজা খুলছে না। ডেকে যাচ্ছি। ডেকে যাচ্ছি। ভিতরের কথা এবার থেমে গিয়েছে। নিস্তব্ধ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। কেউ কি মারা গিয়েছে? এই এক্ষুনি? না কেউ মারা যায়নি। বরং তুমি মারা পড়েছ। মাঠে মারা বলতে গেলে। আর তোমার ওটাও মারা গিয়েছে।

তাহলে এবার। কিছু করার নেই ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসব বলে দরজা থেকে দু-পা পিছিয়ে এসেছি। এমন সময় রোহিণী দরজা খুলল। এখন সে এ-ঘরের গৃহিণী। এলোমেলো আটপৌরে কাপড়। অযত্ন চুল। হালকা ঘামে ভেজা গাল। কোমরের কাছে সায়া দেখা যাচ্ছে। কাপড় গুঁজতে ভুলে গিয়েছে। খুব টাইট করে সে হয়তো সায়ার দড়ি বাঁধে। এখন সায়া হালকা করে বাঁধা তাই সে কিছুটা নীচের দিকে নেমে এসেছে। টাইট বাঁধনের জায়গায় তার লাল দাগ অসহ্য। রোহিণী আমি কিন্তু এসব একদম পছন্দ করি না। সে জানে। কীভাবে জেনেছে জানি না। কিন্তু সে জানে, এ-ছেলের চোখ তাকে প্রতিবার একটা ধাক্কা দেয়। টেনে ধরে না।
ভাবতে পারেনি নিশ্চয়ই তাও কিছুটা নিজেকে গুছিয়ে বলে— এখন তো স্যার নেই।
আমি বলি— জানি স্যার এখন নেই। আমি শুনতে পেয়েছি, স্যার নেই। পত্রিকা নিয়ে কথা ছিল। কিন্তু জানি স্যার এখন নেই। তাই আবার কাল আসতে হবে।
—তুমি বলে যেতে পারো কী কথা, আমি বলে দেব।
—না থাক। আমি স্যারকেই জানাব।
ফিরে আসছি, রোহিণী আর কোনো কথা উচ্চারণ করেনি। আমিও কিছু বলিনি আর। কিন্তু বুঝতে পারছি সে মনে মনে বলছে, একবার বসলে না। আমিও মনে মনে বলছি, কেন বসব?
—দেখো তোমার ঘর এসে গেল।
—আমি জানি আমার ঘর এসে গিয়েছে। কিন্তু তুমি কি ভিতরে আসতে চাও?
রোহিণী এ এক ধর্মযুদ্ধ। তুমি হ্যাঁ বললে হেরে যাবে আর না বললে আমি জিতে যাব।
—তুমি এখন কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। আমি বরং পরে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
—ভয় নেই।

রোহিণী, বলেছিলাম না তুমি হয় ভাতৃহত্যা, নয় তো প্রেমিক হত্যার দায়ে পড়বে। যা এখন দেখতে গেলে এক ভাঙা সেতুর উপর রাত্রিযাপন। চোখে ঘুম খুব কিন্তু ঘুমাতে বারণ। এদিকে পড়লে খাদ। আর ওদিকে আগুন। সে আরও যেন ভিতর থেকে জ্বলে উঠল। কিন্তু কিছু করার নেই কেননা প্রতিপক্ষ এখন অসুস্থ।

তা এই যখন অবস্থা দেখি আমার ফ্ল্যাটের ওয়াচ-ম্যান মশাই একবার যেন দেখে গেলেন কে এতক্ষণ তাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু ভিতরে আসতে চাইছে না। আমিও তাকে ইশারায় জানালাম আমি। সে যেন কিছু একটা আন্দাজ করে কাছে এল এবং জানাল। সে আর কাজে থাকতে চায় না। সে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু কেন? তাও সে বলতে নারাজ। ঘরের বিশেষ প্রয়োজন। এটুকুই বলা যেতে পারে।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

দেবনাথ সুকান্ত একজন লৌহ ইস্পাত কারখানার শ্রমিক এবং সেই শ্রমিকের চোখ দিয়েই দেখতে চান তাঁর কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী, যা উঠে আসে তাঁর যাপিত জীবনের কবিতা এবং গল্প উপন্যাসে। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেরা তাঁর গহন মনের ভিতর রেখে যায় ইস্পাতের মতো দৃঢ় চেতনার সমন্বয়। তার কিছুটা তিনি লেখেন, কিছুটা জমিয়ে রাখেন কালের প্রবাহের জন্য। এর আগে লিখেছেন, ‘ছেদবিন্দু', ‘টানেলের মুখে কিছু হায়ারোগ্লিফ’, ‘এক অপরিহার্য রক্তরেখায়’, ‘অন্ধকারে এক জলস্রোত’-এর মত কাব্যগ্রন্থ, ‘রক্তাক্ত স্পর্শের আলো’-এর মত উপন্যাস। যা আসলে তার অতীতকে খুঁজে নিজেরই মুখ বার করার এক প্রয়াস। তার বেড়ে ওঠা দুর্গাপুরে। চাকরি সূত্রে ঘুরেছেন, হাজারিবাগ, বোকারো, ধানবাদ, রাঁচি আর বার্নপুর। ভালোবাসেন বই পড়তে আর বাঁশি বাজাতে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন