preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
বিন্দুসময়বিন্দু
ফিরে পড়া

বিন্দুসময়বিন্দু

এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালের ‘অপর’ পত্রিকার জুলাই-ডিসেম্বর সংখ্যায়। এখনও কোনো সংকলনে স্থানভুক্ত হয়নি।

গলার ব্যথাটা রয়েছে, রয়েছে যৌনচাপ, আর কোনো গভীররাতের জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া। জঙ্গলে কত শব্দ! রাতে। এইসব, সৃষ্টির আদি থেকে প্রবহমান এইখানে। নাবালজমির ধানক্ষেতের শেষে মোলায়েম কার্পেটের গড়ান বেয়ে নেমে আসে হাতির দল, রাতে। ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, পটকা ফাটিয়ে জীবিত মানবসমাজ সম্পদ রক্ষা করে, অন্ধকারে; গলার ক্ষতটা রয়, তবু, সঙ্গী যৌনতাপ।

* * *

আলো যখন অস্পষ্টতা দূর করে টিউব-ওয়লের হ্যাণ্ডেলের, ইতস্তত রিক্সার হর্ন চমকে দেয় ভোরের ছেঁড়া স্বপ্ন, কর্মঠদের দিনগুরুর ক্ষুৎকাতরতা ঝাঁট দিয়ে ফেরে রাতের যতো শান্তি, হিসির প্রাবল্য তখন আর ফ্রয়েডীয় শৈশবানন্দে ধারণ করা অসম্ভবপ্রায়। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের পাশের নরম, পাতলা চামড়ার লালিমা আকৃষ্ট করেছে যে মশাকে তাকে মৃত্যুর ক্ষণিকের তড়িতাস্বাদ থেকে আলস্যের কারণে বঞ্চিত রেখে পা’টা তোষকে ঘসে নিয়ে ডানহাত বাড়াতে শরীরকে ঈষৎ মধ্যঃস্থিত শূন্যতায় সরিয়ে চোখ মেলে চেয়ে দেখি—পূর্ণবয়স্কা নাইটিশোভিত সংসারসঙ্গিনী, আহা! যেন বালিকা। কন্যা আমার! বালিশ থেকে মাথা নেমে গুঁজে আছে তোষকের পেলবতায়, দুই হাঁটু পেটের কাছাকাছি, চুল লেপ্টে আছে বালিশের বিভিন্ন প্রান্তে, কুঞ্চিত ভ্রু’র মাঝে ঘস্‌টে যাওয়া সিঁদুর, অল্পখোলা ঠোঁটজোড়ায় স্বপ্নসুখের অনাবিল মহিমা। নিঃশব্দে, নিষ্কম্পে পা টেনে বাঁহাতের কনুই-এর উপর শরীরের ভর রেখে সেই ছড়ানো চুলের, কুঞ্চিত ভ্রুয়ের, অল্পখোলা ঠোঁটের, গোটানো হাঁটুর মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিক মহাকালে প্রবেশ—গাছ ছিলো করবীর, পেয়ারার, কুলের, আর কাঠবেড়ালী—অনেক অনেক বাচ্চারা মিলে কাঠবেড়ালীকে নারকেলের খোলায় দুধ—কিচ্চি, একটা ছোট্টসোনা, পেয়ারার ডাল থেকে পড়ে গিয়ে তাকে তখন বারান্দার এককোণে বেঁধেই রেখে জল-দুধ-মুড়ি, সব বুড়োধাড়ীগুলোর শুধু ছোটাছুটিই সার, তোরা বাঁচাতে পারবি আমি না দেখলে? রাতে বা নির্জন দুপুরে যখন হুলোটা এসে ঘাড় মটকাবে তখন তো তোরা ভয়ে শুধু লাফালাফি করবি পেয়ারার ডাল থেকে কুলের, করবীর ডালে আর বারান্দার কার্নিশ ধরে ভয়েভয়ে দেখবি সোনাটাকে নিয়ে হুলোটার ভোজ। আজ আর স্কুলে কি করে যাই? বাবা, একটা কাঠের জালঘেরা বাক্সো এনোতো! সোনাটাকে বাক্সে ঢুকিয়ে না রাখলে কি আর আস্ত থাকবে ওটা? না, না, এখন কিছু খাবো আমি, কিকরে খাই বলো মা? কচিটা একটুও জলও খেতে পারছেনা, উঠে সোজা হয়ে বসতেও পারছেনা, বাবা—বাবা—একটু এসোনা এখানে। কমল কাকুকে যাবার সময় বলে যেও তো একটু দেখে যেতে। কিন্তু ওষুধ কি খাবে ওটা? এ্যাই দিদি, ওস্তাদি মারিস না, আঃ ওটাকে জোর করে ওঠাবার চেষ্টা করছিস কেন? আঃ—আঃ—লাগছে না সোনার। ওমনি করিসনা, দ্যাখ্‌ ওর মুখটা, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, আঃ—আঃ—

চূর্ণ চুলে, কপালে, সিঁদুরে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া—আমার বৌ।

ঢোক গিলতে গেলেই তীক্ষ্ণ তীর, মৃত্যুর বাজী খেলতে গিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ আলপিন গিলেছিলাম কি? নম্র একাগ্রতায় স্থির লক্ষ্যে বনভূমি থেকে মানুষিক শ্ৰমভূমিতে গুম্‌ গু্ম্‌ শব্দে অগ্রসরমান মৃত্যুদূতের দল। চোলি—তা সে যতই রঙঝমাঝম, শব্দমাতাল, হদ্দপাগল হোক না কেন পেছনে তো মাংসপুঞ্জই থাকে, মাংস, চর্বি, পুষ্টি, খাদ্য, সালাড, যোগাভ্যাস—জানি দিল্‌ থাকে মাথায়, তবু যৌনচাপ;

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

* * *

আকাশ ও জল—নৌকো ডোবে বা ভাসে নীল পৃথিবীতে—শক্ত কোরে ধোরো কিন্তু, ভীষণ ভয় লাগছে আমার, আর বেশীদূর যাবো না আমরা, চলো এবার ফিরি, পাড়ে। কি সুন্দর রাস্তা। য্যানো ন্যাতা দিয়ে মুছে রেখেছে, ফাঁকা ফুটপাথ, নেই কোনো হকারের উৎপাত, এরকম গরমের সূর্যাস্তে দুজনে হেঁটে যাওয়া, দুজনে, শুধুই আমরা। এ্যাই, একটু কাছাকাছি হয়ে হাঁটো না!

ভীষণ অসভ্য তুমি, ওখানে হাত দিচ্ছো কেন? দেখছোনা এখনো ঠিকমতো অন্ধকার হয়নি। এসি মার্কেটে যাবে তো? একটা যা দারুণ শাড়ি দেখে এসেছি না আগের দিন! ঐ যে, যেদিন শোভনবাবুর বৌ-এর সাথে গেলাম। দ্যাখো, দ্যাখো, গাড়ীটার রঙটা কি সুন্দর নীল, না? আচ্ছা-এরকম একটা গাড়ীর দাম কতো? হাসছো কেন? বলোই না। বাব্বাঃ, অ্যাতো? আচ্ছা? তুমি অন্য কোনো চাকরী আর পেতে পারোনা? বা ব্যবসা? ব্যবসা করতে প্রচুর পয়সা লাগে তা আমি জানি, তবে ব্যবসা না করেও তো কেনা যায়, কেন? শোভনবাবু তাহলে কি করে কিনলেন? প্রাইভেট ট্যুইশন করে? তা হোক, সেটাতো আর ঘুষ খাওয়ার মতো না! অ্যাই, একদম মুখগোমড়া করবেনা এখন। বাদ দাও। শাড়ীটা কিনছি তো তাহলে আজ? কত টাকা আছে তোমার কাছে? তিনশ? আমার কাছেও শ’দুয়েক হবে, সবমিলে হয়ে বরফ, বরফ, অ্যাতো বরফ কখনো দেখিনি আমি, শুধু সিনেমায়, সেইযে অনিল কাপুর যখন শ্রীদেবীর জামায় বরফ ঢুকিয়ে দিচ্ছিলো, গা শিরশির করছিলো আমার, অনিল কাপুরটা খুব দুষ্টু, কিন্তু হেভী স্মার্ট, কি ভালোলাগে আমার! পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রে, ঘাসে, ফুলে, গাছে, স্কার্টে, শাড়ীতে, চুড়িদারে, জ্যাকেটে, জিন্‌সে, স্নাকারে, দুএকদিনের নাকামানো গালে, ঠোঁটে, উরুতে, গলায়, এরোপ্লেনে, আকাশে, বাজনায়, শ্যাম্পেনে, মুরগীতে, নরম গদিতে, শাদা সিল্কের চাদরে, বালিশে, রঙিন ব্রা আর প্যান্টিতে, কার্পেটে, শুধু দুজনে, লঞ্চে, সমুদ্রে, জঙ্গলে কাঠের আগুনে, গীটারে, তোমার দীর্ঘদেহে, লম্বাচুলে, বুকভর্তি লোমে, পেটানো বেতাল শরীরে, গুঁড়িতে হেলানো মাথায়, ক্লাসিক মাইন্ডের নীল নীল ধোঁয়ায়, আঃ—আঃ—ফুলে, গন্ধে, কাঠিন্যে; কামড়াও—আমাকে আরো জোরে কামড়াও—আঃ—আঃ—

ডাকছো কেন আমায়? রান্না-অফিস-টিফিন-নিরামিষ-মাসের শেষ-এঃ শুকনো কেরানী আর্টিস্ট।—আমার বর।

সকাল তেমনই পাতিকাকের ঘাড়, আলো যেখানে ভাষা হারায়। হিমেল মায়া মেরুণ পর্দার ফাঁক বরাবর—‘কতো জানলায় একলা মানুষ’—দুজনে একা একা বোর হয়ে যাবে যে! তখন মাধ্যমিক, হারিকেন উসকে ভোর, ফুলচোর—পবিত্র বৃদ্ধসকল বৃদ্ধাদের নিষ্কাম প্রেমে গঙ্গাস্নান, শীৎকারের শিশির স্থলপদ্মে, তপতীর কমলা গালে নারকেল, সুপুরির সুরেলা আবছায়া। সারিসারি বেঁটে গাছ এখনই ড্রিল শুরু করবে, গলিপথ বেয়ে বেয়ে ক্ষয়িষ্ণু জলধারা—“নদী তুমি কোথা হইতে আসিতেছো?” “মহাদেবের জটা হইতে।” “কোথায় যাইতেছো?” যেতেই হবে! নির্দিষ্ট অভিমুখে! উৎস ও ধ্বংসের মাঝে কতো রাস্তা গড়া হবে আর? অকস্মাৎ এ কোন্‌ শৃঙ্খলার রঙবাহার? কৃষ্ণকথিত বৃত্তাকার পরিক্রমা শুনেছে কি, ওগো নদী? অজ্ঞতা কি তবু তোমার আদিম থেকে আধুনিক সাম্যে যাওয়ার ভবিতব্য আটকাতে পারবে? আর্‌রে ধ্বোর্‌—কিসের যাওয়া! গতিই অনিশ্চিত, তার আবার ‘প্র’! মায়াবাদী সেলাম হকিংদা—“তোর কোনো গতি কোরে যেতে পারলাম নারে রাসু!”—এইসব ব্ৰহ্মশব্দ আছড়ায় সরকারী হাসপাতালের বারান্দায়, তবু, আছাড়িপিছাড়ি, “আমার কি হবে গো?” ধূসর গন্ধমাখা সকাল অহেতুক কর্মব্যস্ততাময় দিনের শেষে রাত হয়ে যাবে, আবার “পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সকালে তুমি আর আসবে কি কখনো?” রাত কত হইলো?

উত্তরহীন প্রশ্নেরা কি পৃথিবীর চেয়েও ভারী? আরও বীভৎস বেগে তারা কি এক অনির্দিষ্ট কেন্দ্রাভিমুখী চক্রে আবর্তিত? অহরহ? এই বিন্দুসময় যায় কোথা? অতীত তুমি কোথায় লুকোলে? ঐতিহ্যে? জ্ঞানযুক্তি-ধর্মমুক্তিবিজ্ঞানসংগ্রামপ্রগতির অজ্ঞান ধারাবাহিকতার পরম্পরায়? প্রশ্নের বীজ কি মাটি থেকে ওপড়ানো যায়, খালাসীটোলায়? অথবা, “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি যাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।” সমগ্রতা, টোটালিটি, হোল—কখনো কোথাও বিচ্ছিন্নতা নেই, সমগ্রের অন্দরে এই একটু চুড়ুকবুড়ুক। অস্থানিক, রহস্যময়, কালহীন চেতনার প্রগাঢ় অন্তর্বিন্দু থেকে ম্যাক্রোশৃঙ্খলার আপাত অসাবধানে একটি আকস্মিক মশা হুল ফোটায় ঝুলন্ত বিচিতে, থাপ্পড় মারা অসম্ভব, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাবিদ্ধ মর্ষকামী আরাম। ছিঃ। আলতো হাতের নাছোঁয়া নাড়ায় উড়ে যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা নেই, আবারো বসে বাঁ বাহুতে, থাপ্পড়, রক্ত-লাল-কালো-পাখনা থেঁৎলে থাকে, কোনো শৃঙ্খলা ভাঙা হয় কি এর দ্বারা? এই মৃত্যু পারে কি কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে? হাজার হাজার কালো, গরীব, বিচ্ছিরি, বর্বর, মুখ মানুষের হত্যা—তাতে সমগ্রতার পরম মানসের শৃঙ্খলারই সিঁড়িভাঙা সরল! সময়বিন্দু, বিন্দু, বিন্দু, য্যানো ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছি চলেছে নতুন কোনো চাক তৈরীর প্রেরণায়। প্রাকৃতিক বাসা, অপ্রাকৃতিক সমাজ, সামাজিক কর্ম, মানবিক প্রকৃতি—ভোরের মায়াতলে ছায়াঢাকা বিশাল পুকুরে এক পুরুষ হাঁসের নেতৃত্বে কখনো সরলরেখায়, কখনো বৃত্তচাপে এগোচ্ছে পাঁচটা আরো প্রাণী, অশ্বত্থের বাঁধানো বেদীতে হেলানো মাথা রেখে নরম মাটিঘাসে থেবড়ে পা ছড়িয়ে বসে খালিগায়ে ভোরের নরম স্বাদ মেখে “হংসধ্বনি”—শিব-হরি’র যুগলবন্দী —কে বলে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতাই এনেছে মানবসংস্কৃতি? হা মূর্খ! ওপারে বসন ছাড়ছে আমার স্নেহের তপতী, বসন—যা সভ্যতা, যা নৈতিকতা, এই ভোরের অসহ্য প্রাকৃতিকতায় তা ছুঁড়ে ফেলার অমোঘ টানে তপতী মানুষ হয়ে ওঠে, প্রকৃতি, পৃথিবী, পৃথিবীরও ওপারে যে রসহ্যময়তা আছে তার সমগ্রতার ইঙ্গিতবাহী মানবী, দাঁড়ালো সে পুকুরপাড়ে নেমে, কমলা-গোলাপী-হলুদে মাখামাখি এই প্রাকৃতিক মানব, যাতে উপস্থিত রয় বিশ্বমানবচিত্ত, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, গাঢ় সবুজ গভীর জলে হংসধ্বনির নীরব মূর্ছনায় তাঁর পদযুগ জীবন স্পর্শ করে, জীবন জীবনে মেলে, প্রকৃতি জীবনে, এই মায়ামাখা নীড়ে, তাঁর দৃষ্টি অসীম তথা অসমগ্রতার ভ্রান্ত দিগন্ত পেরিয়ে কসমিক সৌন্দর্যে বয়ে যায়। মাত্র বাঁশী-সন্তুরের পার্থিবতা। পার্থিবতা-অপার্থিবতা, বাস্তবতা-অবাস্তবতা, সীমাহীনতা-গণ্ডীবদ্ধতা, ইন্দ্রিয়াতিগ-ইন্দ্রিয়াতিত—জোড়া জোড়া মজার শব্দবন্ধ হুরহুর কোরে মেঘলা সকালের গরাদকে ফাঁকি মেরে মশারীর জননযন্ত্রে, একটার উপর আর একটা সজোর সঙ্গমে বৃত্তাকারে পাক খায়। রাশি রাশি জোড়া জোড়া মশা, মাছি, চড়ুই, হাঁস, কুকুর, গাধা, সকালের কালচে বিবর্ণতার পথ বেয়ে, মেরুন পর্দা, গরাদ, জানলা, দরজা, দেয়াল, ঘর, বাড়ী, সভ্যতা, স্থাপত্য, সংস্কৃতির ধ্বংসের উৎসবে। খাঁ খাঁ সবুজ, নীল, লাল, হলুদ, কমলা, খয়েরী অর্থাৎ রঙীন পৃথিবীতে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে ও, ঘুমিয়ে গ্যাছে কি? রাতে যখন সম্পূর্ণ জ্যোৎস্নার আলো পেতে আমরা সরে গেছিলাম গাছেদের, পাহাড়ের অর্থাৎ সব উঁচুদের আড়াল থেকে, সেই প্রক্রিয়ার ভেতরে ও বোধহয় জেগেই ছিলো, যখন আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে মখমল গড়ান বেয়ে চলে যাচ্ছিলাম এই ফাঁকা মাঠের ভেতরে, তখন তো ও জেগেই ছিলো, যদিও ওর চোখ ছিলো বোঁজা, তবু ওর কাঁপা ঠোঁট, দৃঢ় হাতের বন্ধন, ফুলেফুলে ওঠা নাকের পাটা, শক্ত দুই বুক অবশ্যই ওর জেগে থাকার প্রমাণ, অন্তত আমার এরকমই বিশ্বাস, জোড়া জোড়া এই মজা মজা খেলায় যখনই মেতেছি, দেখেছি ওদের অনুরূপ আচরণ, কেউ কেউ চীৎকার কোরে জানান দিয়েছে জেগে থেকে সম্ভোগসুখের, অন্যরা চোখ বন্ধ রেখে, দাঁতে দাঁত চেপে চূড়ান্ত অপ্রকাশ্য রাখতে চেয়েছে জোড়াবাঁধার পায়ের তলায় পৃথিবী টলানো অনুভূতিকে, আমিও উদাসীন থাকিনি, ক্রিয়াশীলতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে আবার বাড়িয়েছি প্রতিক্রিয়ায়। সবাই বলে পুরুষ স্বার্থপর, তাই, পরম পরার্থপরতাকে অণুতে পরমাণুতে প্রশ্রয় দিয়েছি, দেখেছি এতে ওরা বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে, এই এখন যেমন ওরা আসছে জোড়ায় জোড়ায়, তারপর ক্লান্ত সৈনিকের স্বার্থপরের মতো বসে পড়ছে মশারীর গায়ে। অতৃপ্ত পুরনারীগণ ভন্‌ভন্ করে অস্থিরতায়। ভোর আসছে নেমে, সভ্যতার আলো দিগ্বিদিকে নৈতিকতার হীরকদ্যুতি ছড়িয়ে দেবে এখনই, সময় বড় কম, কোথাও কোনো জঙ্গল-ঘাস-পাথর-ঝর্ণার আড়ালও আর নেই, লেসার রশ্মি খুঁজে খুঁজে ফেরে সব ত্রিমাত্রিক অবয়ব, সবাই জানে একদমই আড়াল থাকছে না আর, দিনে, সূর্যালোকে, সবাই তাই ভুলতে চায় এসব, দিনে। তাই যতসব বিশালকর্মধর্মচর্চাজ্ঞানসংস্কৃতিসংগ্রামসাহিত্যদাঙ্গা সিনেমাক্রায়োজেনিকমতাদর্শবাস্তবতাঈশ্বর-দ্রব্যপূজোপোস্টমডার্নিজমনরবলি ক্ষমতারহুঙ্কারঅনাহারেমৃত্যুনিউওয়াল্ডঅর্ডার, দিনে,সামাজিক শাসনের সময়ে, বিন্দু, বিন্দু বিন্দুবিন্দু সময় চলে যায়, অন্ধকার নামে, পূর্ণিমা বা একাদশী অথবা অমাবস্যায় সময়বিন্দু দাঁড়ায়—রাত কত হইলো?

এই মিহি জাল ভেদ করতে অ্যাতোই অক্ষম হৃদয় নিংড়ানো নীল? শ্যাওলা ছাইদান, হলুদ প্যাকেট আর জুলুরাজা বুথেলিজি “কতদিন বলেছি, মশারীর ভেতর সিগারেট খাবে না!” চিলেকোঠা, কোথায় মশা! আর তন্তু! পাতায় পাতায় শিরার নাচন, চারদিকের জানলায় নির্মেঘ আকাশ তপতীর পৌঁছনোর অপেক্ষায় ঘামে চিক্‌চিক্‌, “আসবে, আসবে, প্রতীক্ষায় থাকো, আমরা পৌঁছে দেবো তোমার যন্ত্রণার ধারাভাষ্য।” দক্ষিণের ধানের ক্ষেতে ঠাণ্ডা বাতাসের দোলা, হাজার হাজার বছর জলাধারে, পাশে রঘুনাথজীর মন্দির, জৈষ্ঠ্যের দুপুর, স্যাঁতস্যাঁতে মন্দির চাতালে ফুল-দুধ-বেলপাতা-ধূপ, ঠাণ্ডা নেশা, নিকষ কালো অনার্য লিঙ্গ জড়িয়ে নীল শান্ত সাপ, পাতাল ফুঁড়ে ফুঁড়ে কলিবঙ্গাল থেকে এই ভগীরথের দেশে; মশারীর অন্তর্গত ধোঁয়াশা দুহাতে তাড়াই—কুয়াশাঘেরা উত্তরের উপত্যকার সবুজ বনানীর গলিপথে তপতীর ঘোড়া আসবে, প্রতীক্ষায় থাকি, থাকে সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতা, যা কোনো নতুনতর গুণগত পরিবর্তনে ধেয়ে যাবার তাত্ত্বিক বেড়াজাল নাপামে নাপামে ছারখার কোরে দেয়। সত্যিই কি এক অসীম, অপূর্ণ, অজানা শিকারে যাবার কথা ছিলো? কৈশোরে? ‘আবর্তন চক্রাকারে’—অট্টহাস্যে ভাসিয়ে দিইনি কি ক্রমোন্নতির অমোঘ ধারাভাষ্যে? হায় কালচেতনা! ব্যক্তিক বা দৈবিক। মহাকাল।

বান ডাকে, বান আসে, পাড় ভাঙে, বেড়া-উঠোন-তুলসীমঞ্চ, প্রদীপ দুহাতে, লালপেড়ে গরদ, আঁচলের চাবির গোছ বুকে, দাওয়ায় জল ছলাৎ ছল, বান সাঁঝে। “তপু—তপু—তপু—উ—উ—উ—উ—উ•••, মেয়েটা যে কোথায় ঘোরে আদাড়েবাদাড়ে! অ্যাই কালিয়া,—যা—যাতো—খুঁজে আনগে যাঃ—” “আর আটটা বাকী, উফ্‌! অ্যাতো ছোট্ট ছুঁচে কি মালা গাঁথা যায়? মা বলে কলকে ফুলের পেছন থেকে নাকি মধু খেতে নেই, কতো পোকামাকড় থাকে নাকি। এইরে! মা ডাকতে শুরু করেছে, আরো আটটা—আরে দেখেছো ছাগলটার কাণ্ড! পাড়ঘেঁষা ঘাস খুব কচি, না? টুপুং কোরে পড়ে গেলে কি হবে, অ্যাঁ? কালিয়া, টেনে আনতো ওটাকে! আঃ আমাকে টানছিস কেন? আবার জামায় দাঁত দিচ্ছিস! ছিঁড়ে গেলে কি হবে? মা-তো আমাকেই ঠ্যাঙাবে, জানিস তোর গায়ে গায়ে মিশতে বারণ করেছে আমায়!” বান আসে, ডাকতে ডাকতে, পালা—পালা—বন—বাদাড়, কাঁটাঝোপ, চড়াই-উৎরাই, ময়লা-জলা, জঙ্গল, মরুভূমি মাড়িয়ে, ছুটতে ছুটতে ছলাৎ ছল, চৌকির নীচে আমেরিকান রুই, “বড়দা, এই দ্যাখ্‌, কেঁচো রেখেছি এই কৌটোয়, বাবা—বাবা—ছিপটা কোথায়?” চৌকি ছাড়িয়ে ছলাৎ ছল, প্রাণের কাছে কবিতা পড়ে মৃতের দল।

বমি পায়? গার্গলে? তা নাইবা করলে! গলায় ব্যথা? তো বিড়ি-সিগারেট নাইবা খেলে! ও, ঢোক গিলতে গেলেও ব্যথা? তা ঢোক গেলার কি দরকার? ভয় পেয়েছো বুঝি? ছিঃ, ভয় পেতে নেই। বড়রা কখনো ভয় পায় নাকি? এক কাজ করো—জলটা গরম কোরে, মুখে নিয়ে, মাথাটা হেলিয়ে দাও পেছনে, জল চলে যাবে গলার গভীরে, ঐভাবে থাকো। তা থাকি। থাকতেই থাকি। ছাদ, স্কুল জমেছে কোণে কোণে, সুতোর মতো ঠ্যাঙওলা মাকড়শার জাল, রোদ পড়েছে জালে, বর্ণালী, বর্ণালী ঐ আলোছায়া উর্ধ্বলোকে, কত অলৌকিক স্তর সেই আনন্দলোকে, গাছে গাছে ঝুলে আছে আপেল-বেদানা, ম্যাকসিমাম রাজকুমারীর আনাগোনা, দুপাশ দিয়ে বইছে দুধনদী আর ক্ষীরনদী, কমলা-হলুদ-ফিকেসবুজ লেজখাড়া পাখিরা তিনতালে মেতে আছে দূর্বাঘাসে, নেই কোনো লেখাপড়া, ঘন রোদের দুপুরে মাঝের ঘরের রোদের মুখ না দ্যাখা মেঝেতে, মাথার তলায় দিদার হাত—

হারাধনের দশটি ছেলে

ঘোরে পাড়াময়,

একটি কোথা হারিয়ে গ্যালো

রইলো বাকী নয়।

হারাধনের নয়টি ছেলে

কাটতে গ্যালো কাঠ,

একটি সেথা বাঘে খেলো

রইলো বাকী আট।

আমার কেন একটাও ভাই নেই দিদা? মাকে বলোনা কয়েকটা ভাই আনতে! আমরা বাঘ মারতে যাবো, হ্যাঁ, কাঠ কাটতে নয়, বাঘটাকে মারতেই যাবো, কেন খাবে বাঘটা আমার ভাইকে? কেন? আয় তোরা—আমি জানি ব্যাটা কোথায় থাকে! ছড়িয়ে পড় চারদিকে। হেঁটে, দৌড়ে, ঘোড়ায় কোরে পৌঁছে যা কোণে কোণে। সাথে রাখ এই বাঁশী। শিখে নে এই সুর। বাজাতে বাজাতে যাবি, আর কান পেতে শুনবি প্রতিধ্বনি। প্রকাণ্ড গুহার কালো গহ্বর থেকে ফিরে ফিরে আসবে এই বাঁশীর সুর। উঁচু উঁচু গাছের চামর দোলাবে তোদর মাথায়। খিদে পেলে বাতাসকে বলবি, তেষ্টা পেলে আকাশকে, ঘুম পেলে দিদাকে—দিদা মাকে কিন্তু আজই বোলো আমার জন্য সাহসী কটা ভাই আনতে! দেখো—বাঘটাকে মেরেই ফিরবো, ওটার চামড়াটা খুলে এনে দেবো তোমায়, তুমি তাতে বসে পূজো করবে। শুধু আটটা ভাই এনে দাও, নইলে একাএকা যে ভীষণ ভয় করে আমার! ঢোক গিলতে গেলেই ছুঁচের খোঁচা—

প্রাগৈতিহাসিক সবুজ গড়ান বেয়ে নেমে আসছে মত্ত হাতির দল, নাবাল—জমির ধানক্ষেত দলে-মুচড়ে হিংস্র আক্রোশে গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন কোরে মহানগরের পথে ধেয়ে আসছে উত্তুরে নীল বাতাসের স্রোতে ভেসে। বাঁশীর সুরে পায়ের তলায় মাটি হালকা, নগরীর কিশোরীরা নগরদ্বারে উড়ুউড়ু, বাসন্তী শাড়ী আর রজনীগন্ধা বিনুনিতে, আজ, বাঁশী কেন গায়? কে আসে হেথায়?

গাছগাছালির জাফরীর সুড়ঙ্গ বেয়ে সেই ধ্রুবজ্যোতি প্রবহমান এই মৃত্তিকায়, হালকা অন্ধকারে রেশমী ওড়নায় ভেসে এলো তপু, হাতে ধোঁয়া-ওঠা জলের স্বচ্ছ গ্লাস।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালের ‘অপর’ পত্রিকার জুলাই-ডিসেম্বর সংখ্যায়। এখনও কোনো সংকলনে স্থানভুক্ত হয়নি।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন