এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৪ সালের জারি বোবাযুদ্ধ পত্রিকার জানুয়ারি বইমেলা সংখ্যায়। এখনও কোনো সংকলনে স্থানভুক্ত হয়নি।
ঝকঝকে রোদের একটা সকাল।
মামল্লীপূরম বাসস্ট্যান্ডে নেমে যখন হোটেলের দিকে যাচ্ছি, একজন টাউট কার্ড দেখিয়ে বলল তার হোটেলের কথা। তাতে কর্ণপাত না করায়, জানতে চায়: অ্যাকচুয়ালি আমি কোথায় যেতে চাই। টিটিডিসি-র হোটেল শুনে ফ্যাক-ফ্যাক করে হেসে বলে, ওটা বন্ধ এখন! ভাবলাম, নির্ঘাত গাঁজা মারছে। পাত্তা না-দিয়ে এগোতে থাকি। সামান্যই হাঁটা-পথ। কিন্তু গিয়ে দেখি, সত্যিই বন্ধ। রিনোভেসনের কাজ চলছে।
মামল্লীপূরমের সমুদ্র, তার ঢেউয়ের বুকে ফেনার পিপাসা, শোর টেম্পল এবং আর্কিওলজিকাল আর্কিটেকচারের পাশাপাশি এখানে আগ্রহযোগ্য এবং উপরন্তু হিসেবে যা—তা ঐ টিটিডিসির হোটেল। আগের বার যখন এসেছিলাম, কী ভালোই না ছিলাম। ফ্ল্যাশব্যাকে তা ভাবতে ভাবতে ফের বাসস্ট্যান্ডে ফিরি। বাধ্য হয়েই ভেংকটেশ্বর লজ। যা এককথায় খাজা।
দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমোনর পর শরীরটা চাঙ্গা হয়। সন্ধ্যেয় বিচে একপাক মেরে একটা ছোট্ট বারে গিয়ে বসি। নামটা খুবই সুন্দর। ইউফোরিয়া। বসে বসে ভাবছিলাম এই ছোট্ট শহরটার কথা—কী আন্তরিক ভাবেই না দম্ভ আর দারিদ্র এখানে সহাবস্থান করছে। পেছন থেকে এ সময় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। ফিরে দেখি, সমর। ওর সাথে দেখা হতেই টিটিডিসি-র দুঃখ হাওয়া হয়ে গেল। আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময় একই হোস্টেলে থাকতাম। খুব বন্ধুত্ব ছিল আমাদের। হোস্টেলের বেশিরভাগ ছেলের সংগে প্রকৃত বন্ধুত্ব যে গড়ে ওঠে না তার বেসিক কারণ—ওরা নিজেদের কথা কাউকে বলবে না আর অন্যদেরটা শোনায়ও উৎসাহ নেই। আমরা দুজনেই খুব খোলামেলা ছিলাম। ওর চেহারায় প্রথম দিন থেকেই আলাদা একটা সম্ভ্রম ছিল, যা অন্য কারোর ছিল না। সব কিছু খোলাখুলি বলতে পারত সমর। ওর কাছে শিক্ষণীয় যা যা ছিল, এটা তার মধ্যে প্রধানতম ব্যাপার। একদিন সবার সামনে ও আমায় কমপ্লিমেন্ট দিয়েছিল—সব সময় সত্যি কথা না বললে আমি নাকি খ্যাতির শিখরে উঠতে পারব। ও কখনো আর পাঁচজনের মতো ওর মনের জোর দেখানোতে উৎসাহী ছিল না। সবকিছুর প্রতিই ছিল অদ্ভুত এক ধরনের টান বা আকর্ষণ—যা আমায় মুগ্ধ করত। এরকম একটা ব্যাপারও বোধহয় নেই যা টান-জনিত কারণে ও করে বসেনি। সব সময় কিছু না কিছু করতই। আদপে আসলে কিছুই করত না। যখন পড়ত (সে পদার্থবিদ্যার বইই হোক আর আউটবুকই হোক), তখন তেড়ে পড়াশোনা করত। টার্গেট একটাই—সবসময় নিজেকে আরো উন্নত করার চেষ্টা। ক্লাস করে ফিরে এসে বসে গেল ঢাউস অক্সফোর্ড ডিকসনারিটা নিয়ে। পড়ে-টড়ে শুল। সকালে আবার পড়তে শুরু করল। রিলিজিয়াসলি অমন করে ডিকশনারি পড়তে আমি আজীবনে কাউকে দেখিনি। দুনিয়ার সব খবর রাখত। যতরাজ্যের সব বেখাপ্পা খবর। সেগুলো যত বেশি উল্টোপাল্টা হত, ওর কাছে তা ছিল তত বেশি আকর্ষক। এইসব জানার ভেতর দিয়ে ও সম্ভবত প্রমাণ করতে চাইত: মানুষের জীবনটা আসলে ধুলো-ইঁট-পাথর; গোটাটাই ফালতু। মানবজীবনের যে কোনো ব্যাপারকে (ব্যাপার=তত্ত্ব নয়, আরো যা যা আছে তা-ও) যে কোনো পাল্টা ব্যাপারের মাধ্যমে ক্যানসেল করা যায়।
তো সমর বলল, আমার টেবিলটায় আয়। এটা ফাঁকা।
গিয়ে বসলাম।
বলল, কী খাচ্ছিস?
হুইস্কি। তুই?
বেশ ফিচলেমির সুর নিয়ে বলে, ধেনো মদ।
মানে?
ভদকা। বলেই হো-হো হাসি।
প্রায় পঁচিশ বছর বাদে দেখা, অথচ মনে হচ্ছে রবীন্দ্র ছাত্রাবাসের সাত আর বারো নম্বরের দুটো ছেলের দুপুরে দেখা হবার পর সন্ধ্যেয় আবার যেন দেখা হয়েছে বাসুদেবদার ক্যান্টিনে।
পারস্পরিক খবর নেবার পর দুজনেই দুজনকে অবিবাহিত দেখে উল্লসিত হয়ে উঠি। ওকে জিজ্ঞেস করি, এখনও কি মজার মজার খবরগুলো রাখিস?
সমর কিছু না বলে, হাসতে হাসতে সিগারেট জ্বালায়।
শোনা না। কাতর রিকোয়েস্ট আমার।
তাতে কাজ হয়। ও বলতে শুরু করে: ট্রেড সেন্টারে বিমান হানার পর ১১০ তলা থেকে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। অমন অসহায় অবস্থা! কী আর করবে? ও-তো এক মৃত্যুর কোল থেকে আরেক মৃত্যুর কোলে ঝাঁপ দেওয়া। সেই দৃশ্য দেখার পর এবার প্যারাশুট কেনার হিড়িক পড়ে গেছে আমেরিকায়।
বিশেষ করে মাল্টিস্টোরিডে যাঁরা থাকেন, তাঁদের। প্যারাশুট কোম্পানিগুলোর হাতে এখন প্রচুর অর্ডার। ছাঁটাই শ্রমিকদের ফের চিঠি দিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে এনে কাজে বহাল করছে কোম্পানিগুলো।
সত্যি?
বিশ্বাস হচ্ছে না?
এক একটা প্যারাসুট কত করে রে?
পিটিআই-এর নিউজটায় লেখা ছিল: প্যারাশুট পিছু দাম আটশো ডলার।
উরেব্বাস! আআআটশোওও.....
আমি আরেক পেগ হুইস্কি নিই। তুই হুইস্কি নিবি?
ও বলে, না। হোয়াইট মিসচিফ-ই দিতে বল। একটু চুপ করে থেকে বলে, লিখিস এখনো?
হ্যাঁ, তিনটে উপন্যাস লিখেছি।
দিস, পড়ব।
ঠিক আছে। পাঠিয়ে দেব তোকে।
এখনও ডায়েরি লিখিস?
হ্যাঁ, বাস্তবসম্মতভাবে সত্যি বা ব্যক্তিগত স্মৃতিতে যা আছে—আমার ডায়েরি মানে তা-ই। উপন্যাসে তার সংগে একটু খুঁটি আর আধটু নাটি যোগ করে দিই। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একটু বিশেষভাবে দেখাই।
আমি ছিলাম তোর জার্নালের একমাত্র শ্রোতা। এক চুমুক দিয়ে বলল, আছে নাকি ব্যাগে ডায়েরি?
আছে। কিন্তু এখানে—
হোস্টেলে আমার ঘরে এসে ঠিক এই কন্ঠস্বরেই বলত, নতুন কিছু লিখলি? লোডশেডিং হয়ে গেলে, মোমবাতি জ্বালিয়েও পড়ে শোনাতে হত।
আমার হিচকাচানি বুঝতে পেরে বলল, আলো কম বলে বলছিস? দাঁড়া, ওয়েটারকে বলে ক্যান্ডেল আনাচ্ছি।
সত্যিই ক্যান্ডেল এল। রুম নম্বর বারো। টেবিলে মোমবাতি। চেয়ারে আমি। বিছানায় বসে সমর। নাথিং চেঞ্জেস, একসেপ্ট দা টাইম। আমাদের বয়সটা শুধু ডবল হয়ে গেছে। স্পেস আর টাইম বদলিয়ে, সমর সেই পুরনো কণ্ঠস্বরে বলে, বড় দেখে একটা এন্ট্রি শোনা।
বারটা ফাঁকাই ছিল। লেখা পড়ে শোনানোতে অসুবিধা নেই। ডায়েরি বার করি কাঁধ-ব্যাগ থেকে। শেষতম এন্ট্রিটা ট্রেনে লেখা এবং মোটামুটি বড়। বোধগম্য হবার পক্ষে সুবিধাজনক। সুতরাং, এটাই পড়া যাক।
ত্রিচি এক্সপ্রেস/ বিকেল ছ-টা
এইমাত্র নেলোর গেল। রেলওয়ের ট্র্যাকসনের খাম্বাতে দেখলাম ১৬০ লেখা আছে। অর্থাৎ অত কিলোমিটার বাকি চেন্নাই। সাড়ে আটটায় এগমোড়ে পৌঁছনর টাইম। ঘন্টা দেড়েক লেট। তার মানে দশটা বাজবেই। রাতটা আজ ওখানেই কাটবে। সকালে কিছু একটা ধরে মামল্লীপূরম চলে যাব।
গতকাল হাওড়ায় বিকেলে চেপেছি। মাত্র দশদিন আগে টিকিট কাটলে করমন্ডলে রিজার্ভেসন পাওয়া যায় না। অগত্যা ত্রিচি এক্সপ্রেস। করমন্ডলের ২ঘন্টা বাদে ছেড়ে ৩ঘন্টা বাদে চেন্নাই পৌঁছয়। কী এমন খারাপ!
কাল গাড়িতে চেপে বুঝতে পারলাম—সহযাত্রীদের মাঝে আমি অড ম্যান আউট। এসি থ্রি-র এই কিউবিকলটাতে আটজনের জায়গায় আছে ছ-জন। আমার নম্বর ৯। ১০-১১-১২-তে মাড়োয়ারী ফ্যামিলি। পাশের কিউবিকলটায় ওদের আরও তিনজন। ওদিকে সাইড বার্থ ১৫-১৬তে পিতাপুত্র। তারা বাঙালী। এত লো-প্রোফাইলের যে বোঝাই যাচ্ছিল রেলওয়ে পাশধারী। বাইপাস হয়ে গেছে। এবার পেরাম্বুরের রেল-হাসপাতালে চলেছেন চেক আপ করাতে। সাথে ছেলে। না, সে চাকরী পায়নি। প্রকৃতই বেকার। ওদের বাড়ি চিত্তরঞ্জনে।
মেড়ো ফ্যামিলি প্রথমে ঘন্টা তিনেক তাদের খাওয়া দাওয়া দেখাল। খড়গপুর পেরোতেই পাশের কিউবিকলের আরো দু-জন এখানে এসে বসল। আরো জমে উঠল গল্প। ব্যাগের চেন টেনে বার করল একজন একটা বই। ১৮ পয়েন্ট বোল্ডে ছাপা। আসলে গানের বই। শাওন কি মাহিনা পওন করে শোর’, ‘দিদি তেরা দেওর দিওয়ানা’ ইত্যাদি গানের সুরে আধারিত ভক্তিসংগীত গাওয়া শুরু হল। কখনো একক, কখনো কোরাস।
মনের বিরক্তি নিশ্চয় মুখের রেখায় ধরা পড়ছিল। বয়স্ক যিনি এই গ্রুপের, সেই ভদ্রলোক কনসেন্ট নেবার জন্য জানতে চাইলেন—আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো?
না। ঠিক আছে। বাংলাতেই বলি। কেননা এরা তো সব কলকাতার। এও বলি, তবে তিনঘন্টা ধরে চললে কিন্তু অবজেক্ট করব।
মাঝবয়সী হালকা ট্যারা মহিলা গায়িকা: এসব হল ভগবানের গান। ভজন।
আমি: ভগবান বলে কেউ আছেন নাকি?
ট্যারা: কী বোওলছেন!
বয়স্ক ভদ্রলোক ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে বলতে শুরু করেন।
আমি ওয়াকম্যানের ইয়ারফোন কানে লাগাই।
মিনিট পনেরো বাদে আমার কমেন্টের জন্যই হোক অথবা ওদের গলা ধরে যাবার জন্যই হোক—গান বন্ধ হয়ে যায়। এই ধরনের গানের আয়োজন এখন খুব হচ্ছে। অর্কেষ্ট্রা নিয়ে মেড়োদের বাড়িতে এসব গানের জলসা হয়। বিয়ে বাড়িতেও হয়। এদেরকে ধন্যবাদ দিতে হবে অন্তত একটি কারণে। এরা ট্রেনের কিউবিকলটাকে বদলে ড্রয়িং রুম বানাতে পেরেছে। গ্রেট লেখক মাত্রেই এই বদলে দেবার ব্যাপারটা পারে। কাফকা-র ক্যাসলের ১২ নম্বর চ্যাপ্টারটা সকলেরই মনে আছে। ছিল ক্লাসরুম। K. আর ফ্রিডা ওটাকে বানিয়ে ফেলল বেডরুম। কব্জির জোর ছিল কাফকার, তাই পেরেছিলেন। আমি যে কবে পারব? এক্ষেত্রে আমি তো কিছু বদলাইনি। বদলেছে ওরা এবং তাও ওদের স্বার্থে। আমার বরং এখন ক্যাসলের রক্ষীদুটোর মত ভূমিকা। এককথায় যাকে বলে পাপারাৎজিপনা।
ক্যাসেটের একপিঠ শেষ হয়ে গেলেও, ইয়ারফোন কান থেকে খুলি না। গানের বদলে শুনতে থাকি ওদের কথা। যা বলতে থাকে তা হল—সুন্দরলালজির বাড়িতে জলসার কথা। কি একটা গান নাকি দারুণ হয়েছিল। ট্যারা মহিলা গেয়েছিলেন। অন্য মহিলার তেমন কোনো কীর্তি নেই। ট্যারাদের একটি গানের দলও আছে। যদিও তা কনট্র্যাক্ট এখন অবধি পায়নি কোথাও। অদূর ভবিষ্যতে পাবে—এরকম আশা রাখে। সে দলে জ্যোতি নামে একটি মেয়ে আছে। রামকৃষ্ণজির বাড়িতে দারুণ গেয়েছিল সে। তৎসহ নাচ। নিশ্চয় ঐ গানের গ্রুপ ঐ মেয়েটির গায়কীর জ্যোতিস্পর্শেই উজ্জ্বলতা পায় মাঝে মাঝে। আলোচনা আবার বেঁকে যায়। ভজন অনুষ্ঠান বিষয়ক কথা থেকে চলে যায় অমুক ফ্যামিলি আর তমুক বাড়ির কথায়।
ক্যাসেট বদলাই। একাদিক্রমে দুটো ক্যাসেট শুনি। শেষটা হাবির তনবীরের ‘চরণদাস চোর’। সাইড ‘বি’ চালাতে গিয়ে চালাই না। গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে কেন?
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছিলাম। স্টেশনের নাম ভদ্রক। ইউথ হোস্টেল আছে এখানে। অনেক দিন আগে একবার আসার প্ল্যান হয়েছিল। আসা হয়ে ওঠেনি। আগে মানে সেই সময়টা—যখন আমি আর হায়দার অযৌন হনিমুনে বেরোতাম। হায়দার আজ বিবাহিত। চাইলেও সেই ট্রিপ আর করা যাবে না।
ভদ্রক ছাড়ার পর আবার সিটে গিয়ে বসি।
বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে বলেন: নাইনটিন ফরটি সেভেনে এখানে ছিলাম। তিনবছর।
আমি: এখানে?
ব.ভ.: চাকরি করতে এসেছিলাম।
আমি: কিসের?
ব.ভ.: অফিসের মেঝে আর টেবিল মোছার।
আমি: ধ্যাৎ! তাই হয় নাকি?
ব.ভ.: হ্যাঁ, সত্যিই। তারপর কটকে চলে গেলাম। রাইস মিলের ম্যানেজারি। ওখানে চার বছর। তারপর চলে এলাম কলকাতা।
আমি: ট্রান্সফার?
ব.ভ.: হ্যাঁ। কিন্তু চাকরি ছেড়ে ছিলাম। নামলাম ব্যবসায়। প্রথমে লুব্রিকেটিং অয়েল। তারপর আরো হ্যানা-ত্যানা।
আমি: এখন কিসের ব্যবসা করছেন?
ব.ভ.: প্ল্যান্টেশন। কলকাতা আর চেন্নাই-এ অফিস। খুব শিগগিরই হায়দ্রাবাদে অফিস খুলছি।
আমরা একান্তেই কথা বলছিলাম। কেননা ভদ্রক ছাড়ার পর থেকেই ট্যারা মহিলা ও অন্যান্যরা পাশের কিউবিকলে।
ভদ্রলোক এও জানালেন চেন্নাই অফিস জামাই সামলায়। যে দম্পতি ছেলে-মেয়ে সহ ওঁর সঙ্গে যাচ্ছে, তারা আসলে মেয়ে-জামাই। বাকি থাকল ঐ জোভিয়াল ট্যারা। উনি বুঝি আপনার আরেক মেয়ে?
ব.ভ.: না-না। আমার ওয়াইফ।
আমি: ওয়াইফ?
ব.ভ.: হ্যাঁ, সেকেন্ড ওয়াইফ।
ভদ্রমহিলা বড় জোর ৩৫। তার বেশি নয়। ভদ্রলোক মিনিমাম ৬০। তো কী হয়েছে? হলদে হয়ে যাওয়া পাতা কি রোদ পোয়ায় না?
ব.ভ. আর ওসব ব্যাপারে কিছু বলেন না। ব্যাগ থেকে গীতা বার করলেন। বাংলা এবং হিন্দি—দুরকম। গর্বের সংগে বললেন, দুটোই পড়েন।
নীরবে গীতা পড়ে চলেছিলেন ব.ভ.। পাশের কিউবিকল থেকে জামাই এবং স্ত্রী এসে বসল ৷ গীতা পাঠ ডুববে নির্ঘাত। স্টেপ মাদার ইন ল-এর হাত দেখছিল জামাই। দেখছিল মানে দেখেই চলছিল।
এই প্রথম ট্যারাকে লক্ষ্য করলাম। গায়ের রং কালো। স্বামীর পাশে থাকাকালীন তাকে দাসীসুলভ লাগছিল। কিন্তু এখন তার মুখে এক অলৌকিক আলোকসম্পাত। ঐ আলো তার শরীরের। অন্য আভাস—তা সরে যাওয়া আঁচলের। বিনয় মজুমদার থাকলে বলতেন—না না, এতো বাতাসের খেলা।
জামাই-এর অমন করে হাত দেখে যাওয়া আটকাতে ব.ভ. উদ্যোগী হন। জামাই-এর হাতটা দেখতে চাইলেন। হাতের তালু দেখে প্রথম কমেন্ট—খইনি খাও?
জামাই একটু লজ্জিত হল শুনে। কেননা একটু আগেই সে বলছিল কোনো নেশাটেশা করে না। রোববারে শুধু তাস খেলে। যাহোক, সে স্বীকার করে খইনির ব্যাপারটা। অ্যালিবাই হিসেবে বলে—ওদের বাড়িতে সবাই খায়। এও বলে, ছোটবেলার থেকেই ও এতে আসক্ত।
স্টেপ মাদার ইন ল নিজের ফেট নিয়ে খুব চিন্তিত। ব.ভ.-এর হাত সরিয়ে, জামাইএর হাতে আবার হাত পেতে দিলেন। মন দিয়ে শুনছিলেন কমেন্ট।
রাত দশটায় ‘শোব’ বলায় বন্ধ হল ওদের আদিখ্যেতা।
খাওয়া দাওয়ার পর শোবার ব্যবস্থা করছিলাম। ব.ভ.-এর স্ত্রী ব্যাগ থেকে বার করলেন প্রিমিটিভ খল-নুড়ি। চ্যবনপ্রাস+মধু+রসুন+আরো কি সব মিশিয়ে পিষতে লাগলেন। এটা ভদ্রমহিলার রুটিন ওয়ার্ক। ব.ভ. চেটেপুটে খেলেন। রতিবর্ধক কিছু কি ছিল এসবে?
রাতে একবারই উঠেছিলাম। টয়লেট থেকে ফিরে শুতে গিয়ে দেখি লোয়ার বার্থে ব.ভ.-এর স্ত্রী নেই। মিনিট দশেক হয়ে গেল। গেলেন কোথায়? টয়লেটে গেলে তো এর মধ্যেই ফিরতেন। উঠে পাশের কিউবিকলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখি, দাঁড়িয়ে আছেন। মিডল বার্থে শুয়ে সেই জামাই। ব.ভ.-এর মেয়ে আপারে। লোয়ারে ঘুমে কাদা ব.ভ.-এর মেয়ের মেয়ে।
বিমূর্ত ধারণাটা মূর্ত হওয়ায়, ভালো লাগল আমার।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, বগিটা অনেক ফাঁকা। ব্রেকফাস্টের পর আমি ৯নম্বর থেকে ৩৫-এ চলে আসি। এই কিউবিকলটাতে মাত্র একজন আছে। মাঝবয়েসী ছেলেটার নাম বিক্রম শেনয়। নেলোর যাচ্ছে। ব্রায়ান অ্যাডামস্-এর ফ্যান। ওর ওয়াকম্যান সিডি-র।
রাজামুদ্রিতে অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল বিক্রম। ট্রেন ছাড়ার পর সে কাঁধে একটা পুঁচকে বাঁদর নিয়ে এসে বসল। বাঁদরের গলায় অবিশ্যি চেন।
আরে, এটা কোত্থেকে?
কেউ বিক্রি করেছে ওকে, দাম চারশো টাকা। একটু বাদে বিক্রম হাওয়া হয়ে গেল। অবলীলায় আমার পাশেই ফেলে রেখে গেল তার একগুচ্ছ সিডি, ওয়াকম্যান আর চেনখোলা ব্যাগ। পড়ে থাকা টাইম-টেবলটা হাতে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখি, মানিব্যাগও রেখে গেছে।
আসলে তার টিকি বাঁধা পাশের সেকেন্ড এসি-তে। ঘন্টা দুই বাদে সে ফিরে এল। সাথে একটি বিদেশী তরুণী। এবার বাঁদর ঐ মেয়েটির কোলে।
ব.ভ. বাদে গোটা মেড়ো ফ্যামিলিটাই এসে হাজির হল বাঁদর দেখতে। ওদের গ্রুপের বাচ্চাদুটো প্রথমে দেখতে এসেছিল। ওরাই খবর দেয়। প্রত্যেকেই কোলে নিচ্ছিল বাঁদরটাকে। বাচ্চাদুটো হলদিরামের ভুজিয়া খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। বাঁদরটা খেল না।
বছর কুড়ি-র ঐ মেয়েটি এম-টিভির স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ভি.জে.-দের মত। তার পিঠ ও গলা উন্মুক্ত। বুকেও ব্যাপক এক্সপোজার। মাড়োয়ারী ফ্যামিলির জামাই-এর চোখ দেখি ফ্যাল-ফ্যাল করছে সেদিকে। স্টেপ মাদার ইন ল জামাই-এর দৃষ্টি লক্ষ্য করছিলেন।
বিক্রম ব্যাগ থেকে কিছু নিয়ে আবার চলে যায়।
দুপুরের খাবার দিয়ে গেছিল। খেয়ে নিই। কিন্তু বিক্রমের পাত্তাই নেই। ট্রেতেই ঢাকা থাকল খাবার।
টয়লেটের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। ট্রেনের বাথরুমের দরজা ঠেলে বিক্রম ও সেই মেয়েটি বেরোল একসাথে।
না, ওর মুখে কোনো লজ্জার ছাপ নেই।
সারাটা দুপুর বিক্রম ঐ মেয়েটির সাথেই কাটাল। পড়ে থাকল খাবার। নেলোর আসার আগে ফিরল। প্যাক-আপ করে নামার আগে আমাকে বলে, চলি। তার কাঁধে সেই পুঁচকে চেন-বাঁধা বাঁদর।
যতক্ষণ না বিয়ে হচ্ছে, এদেশের মেয়েরা যৌনতা করে না। আধজন একজনের কথা ধরছি না। নিজের বেঁচে থাকা থেকে বলতে পারি অবিবাহিত পুরুষের এখানে দুটো অপশন—(১) সম্ভ্রান্ত বিবাহিত মহিলারা এবং (২) নিচু শ্রেণীর সস্তা মহিলারা যেমন বাড়ির কাজের মেয়ে, অত্যন্ত অল্প রোজগেরে মহিলা এবং অবশ্যই বেশ্যারা। ভারতীয় অবিবাহিত পুরুষ যদি উল্লেখিত অপশনগুলির একটিও ব্যবহার না করেন, তাহলে তার জীবন প্রকৃতই অসহায় এবং ম্যাড়মেড়ে। বিক্রমকে এই যৌন সিনারিওর বাইরের লোক মনে হল।
আমার পাঠ শেষ। সমরের দিকে তাকাই।
ও সিগারেট জ্বালায়। আমাকেও দেয়। একটা লম্বা টান মেরে বলে, সত্যিই ট্রেনে লিখেছিস এটা?
বিশ্বাস হচ্ছে না তোর?
না!
চল্ আরেক পেগ করে খেয়ে আমরা বেরিয়ে যাই।
কোথায় যাবি?
বিচে চল্। এখন তো সবে সোয়া নটা।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
তরুণ চট্টোপাধ্যায়
4 মাস আগেভীষন মেদহীন ঝরঝরে লেখা।ট্রেন যাত্রার মতো একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে এক সুন্দর গল্পের অবতারনা করলেন।প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দ ও খরচ করলেন না।অথচ সুন্দর একটি গল্প পেলাম।