প্রতিম ডি গুপ্তর ‘রান্না বাটি’—এক মিষ্টি, ঘরোয়া গল্প, যেখানে রান্না হয়ে ওঠে সম্পর্ক মেরামতির পথ। ঋত্বিক-সোহিনীর জুটিতে ঝাল-মিষ্টি আবেগের পারফেক্ট মিশেল!
রান্না করা কী এমন ব্যাপার? খানিকটা তেল, কিছুটা ফোড়ন, তারপর সবজি বা মাছ কিংবা মাংসে কিছুটা মশলা দিয়ে কষিয়ে ফেলতে পারলেই সুস্বাদু খাবার রেডি! আজ্ঞে না। ঠিক অতটাও সহজ নয়। কারণ শুধু বাজার থেকে দেখে-শুনে জিনিস কিনে আনলেই ভালো রান্না হয় না। ভালো রান্না, আর প্রতিদিন ভালো রান্না, দুটোর মধ্যে একটু তফাৎ আছে বই-কি! প্রতিদিন ভালো রান্না করতে যে জিনিসটা সবচেয়ে আগে দরকার সেটা হল রান্নার প্রতি ভালোবাসা। এ ছাড়াও কিছু উপকরণ লাগে বটে। সেগুলো হল যত্ন আর ধৈর্য। বিশ্বাস করুন, স্রেফ এই উপকরণগুলো জোগাড় করে ফেলতে পারলেই আপনি হয়ে উঠতে পারবেন দুর্দান্ত একজন শেফ, কিংবা রন্ধন পটিয়সী গৃহিণী। রান্না আসলে একটা আর্ট, আর অবশ্যই প্যাশনও। এই কথাগুলো নতুন কিছু নয়। আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু ঠিক কতটা আর্ট আর কতটা মনের কাছাকাছি এই দক্ষতা, তাই নিয়েই পরিচালক প্রতিম ডি গুপ্তর সাম্প্রতিক হালকা মেজাজের ছবি ‘রান্না বাটি’।
হালকা মেজাজের বললাম বটে, তবে এমনও না যে হাসতে হাসতে দেখে চলে আসা যাবে। ভালো রান্নার মতোই সমস্ত উপকরণকে হালকা আঁচে এমনভাবে কষানো হয়েছে ছবিতে, যে কিছুটা ঝাঁঝ উঠবেই। সেই স্বাদের গন্ধে চোখে কিছুটা জলও আসতে পারে। মোদ্দা কথা ঘরোয়া পদ্ধতিতেই বেশ এলাহী আহারের আয়োজন করেছেন পরিচালক। আর সেই আয়োজনে নিজের ভাঁড়ারে থাকা সমস্ত উপকরণকে বুঝেশুনে প্রয়োগ করেছেন তিনি। তাহলে রান্নাটা কেমন হল দেখে নেওয়া যাক।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
কথায় বলে পুরুষ মানুষের মনের রাস্তা নাকি পেট দিয়েই শুরু হয়। এভাবে বললে কিন্তু সবটা বলা হয় না। আসলে খাদ্যরসিক সমস্ত মানুষের মনের রাস্তাই পেটের থেকে শুরু হয়। শান্তনু দাশগুপ্তর (ঋত্বিক চক্রবর্তী) অবশ্য তেমন নয়। তিনি বেজায় ব্যস্ত এক কর্পোরেট বাঙালি। বেশ কিছুদিন হল স্ত্রী মারা গেছেন ক্যানসারে। একমাত্র কন্যা মোহরের (ইদা দাশগুপ্ত) সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা সহজ নয়, যদিও দু-জনে একই বাড়িতে থাকে। মেয়ের সঙ্গে সারাদিনে প্রায় কথাই হয় না শান্তনুর। আত্নীয় বন্ধুদের পরামর্শে নানাভাবে চেষ্টা করে সে মেয়ের মন জয় করার, কিন্তু কালে কালে ক্রমশই বুঝতে পারে আধুনিক যুগে টিনএজার বাচ্চার মন পাওয়া প্রায় ভগবানের দেখা পাওয়ার মতোই কঠিন ব্যাপার। এইখানেই সবচেয়ে বেশি প্রয়াত স্ত্রী সুপ্রিয়াকে (সোলাঙ্কি রায়) মিস করে শান্তনু। সুপ্রিয়া অসাধারণ রান্না করত। মোহরের জগৎ ছিল তার মাকে ঘিরেই। মায়ের রান্নাঘর তার কাছে যেন একটা স্বপ্নের দুনিয়া। মোহরকে বুঝতে গেলে, তার পরিসরে প্রবেশ করতে গেলে সে যা ভালোবাসে তা-ই করে দেখাতে হবে, এটা বুঝে নেয় শান্তনু। তখনই তার মনে হয় রান্নার ব্যাপারটা যদি শিখে নেওয়া যায় তাহলে মোহরকে রোজ বাইরের খাবার খেতে হবে না আর। এমন একটা কঠিন কাজ শেখাতে আসরে প্রবেশ করে রিটা রায় (সোহিনী সরকার)। রিটার সহায়তায় কীভাবে শান্তনু যুদ্ধ জয় করে সেটা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়াই ভালো।
পরিচালকের ভাঁড়ার নিয়ে যে কথা একটু আগে বলেছি, সেটাকে এবার একটু ব্যাখ্যা করা যাক। প্রতিমের অন্যতম জনপ্রিয় ছবি 'মাছের ঝোল', যার বিষয় ছিল রান্নার মাধ্যমে সম্পর্ককে জয় করা। সেই ছবিতে রান্না এবং ঋত্বিক, দু-জনে একে অপরের পরিপূরক যেন। এখানেও বহুদিন পরে ঋত্বিককে রাঁধতে দেখা গেল। যদিও এখানে তিনি দক্ষ রাঁধুনি নন, তবে ঋত্বিক আর খুন্তি কড়াইয়ের যুগলবন্দি আগের মতোই সুর তাল লয়ের স্বাদ এনে দেবে দর্শককে। তবে এই ছবির ভিত শুধুই রান্না নয়। খুব বাস্তব এক সমস্যাকে এই ছবিতে তুলে এনেছেন প্রতিম। কৈশোরের সমস্যা, এবং তাকে বুঝতে পারা। যুগে যুগে পৃথিবী যত এগিয়েছে এই সমস্যা সম্ভবত তার চেয়েও এক কদম এগিয়ে রয়েছে চিরকালই। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ সমস্যার মুখোমুখি যে হয়নি সে কল্পনাও করতে পারবে না কতখানি কঠিন একটি কিশোর বয়স্ক মানুষের মনের তল পাওয়া। ঠিক এই জায়গাতে সবরকম চমক থেকে বেরিয়ে ছবিটা বড্ড বেশি ঘরোয়া হয়ে যায়। এ যেন আমাদের সকলের ঘরের গল্প। আর রইল বাকি রান্না করার দক্ষতাকে আকর্ষণীয় আর লোভনীয় করে তোলার কাজ। সে তো প্রতিম ‘মাছের ঝোল’ রান্নার সময়েই করে দেখিয়েছেন। এমনকি সেই উল্লেখ এখানেও কিঞ্চিৎ পাওয়া যাবে। রয়েছে কাতলা কমলার ছোঁয়াও। রিটার চরিত্রকে (সোহিনী সরকার) খানিকটা ম্যাজিক রিয়ালিজ়মের ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দিয়েও পরে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই কারণে আদ্যোপান্ত স্টাইলিশ হয়েও রিটা যেন খুব চেনা কেউ।
ইদা দাশগুপ্ত বয়সে নবীন হতে পারেন, কিন্তু রক্তে যে অভিনয় রয়েছে সে-কথা প্রথম ছবিতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিদীপ্তা চক্রবর্তী এবং বিরসা দাশগুপ্তর কন্যা অভিনয়ে মায়ের মতোই স্বাভাবিক অথচ চমকে দেওয়ার মতো নিখুঁত অভিব্যক্তির অধিকারিণী। ভবিষ্যতে অভিনয়ে পাকাপাকিভাবে আসবেন কি না জানা নেই, তবে এলে বাংলা ছবির ভালোই হবে। অতীতের স্মৃতি হিসেবে থেকেও আগাগোড়া ভীষণ মিষ্টি আর মায়াময়ী রূপে সোলাঙ্কি যে-কোনো মেয়েকে রান্নাঘরমুখী করে তুলতে পারেন। সুপ্রিয়া আর তার রান্না শুধু মোহরকে নয়, দর্শককেও মুগ্ধ করে রাখবে। অনির্বাণ চক্রবর্তী এতদিনে মোটামুটি বাংলা ছবির বর্তমান মি. ডিপেন্ডেবল হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁর অভিনীত কোনো চরিত্রই কোথাও সন্দেহের অবকাশ রাখে না। অ্যালজ়াইমার্স আক্রান্ত অজিত দাশগুপ্ত চরিত্রটি যেমন মনছোঁয়া তেমনই মজার। বরুণ চন্দকে এমন স্নেহশীল চরিত্রে খুব একটা দেখা যায়নি এর আগে। নিজের চরিত্রে সুন্দর মানিয়ে গেছেন রোজা পারমিতা দে।
গত কয়েক বছরে নানারকম চরিত্রে নিজেকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন ঋত্বিক। কিছুদিন আগে তাঁকে অ্যাকশন চরিত্রে দেখা যাওয়া নিয়ে যারা উচ্ছ্বসিত ছিলেন তাদের জন্য নতুন খবর, এই ছবিতে ঋত্বিককে নাচতে দেখা যাবে! বলা বাহুল্য সেই ব্যাপারটাও নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দিব্যি ম্যানেজ করেছেন ঋত্বিক। আর বাকিটা নিয়ে কিছু বলার অপেক্ষা সত্যিই রাখেন না তিনি। সোহিনীকে এমন স্মার্ট, ঝকঝকে চরিত্রে কমই দেখা যায়। ভারি মোহময়ী দেখতে লেগেছে তাঁকে। এ ছাড়া যে-কোনো ভূমিকায় তিনি বরাবরই অপ্রতিরোধ্য থাকেন, এখানেও তা-ই থেকেছেন।
ছবির চিত্রগ্রহণ এবং সেট সজ্জা দুইই মনে রাখার মতো। রণজয় ভট্টাচার্যের সুরে গানগুলি বেশ ভালো লাগে শুনতে। সব শেষে এটুকুই বলার, ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক ছবিই তৈরি হয় সারা বছর ধরে। বরং বাঙালিয়ানা মেশানো এমন সিধেসাধা প্লটে আরও কিছু ছবি হলে বাঙালি দর্শক কিঞ্চিৎ শান্তি পায়।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।


